#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১৮তম পর্ব ও ১৯ তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
এরপরের কয়েকটা দিন মারজুক আর নাবিলার জীবনের বেশ ভালো একটা সময় কেটেছে। গত সপ্তাহে ওরা ঘুরে এসেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলা ও টি এস সি চত্ত্বর।
আর গত পরশু নাবিলাকে নিয়ে মারজুক হুমায়ুন আহমেদের নুহাশ পল্লী ঘুরে এসেছে।
এই যানজটের ব্যস্ত ঢাকা শহরের বাহিরে হুমায়ুন আহমেদের নুহাশ পল্লী মনটাকে কিছু সময়ের জন্য হলেও ভালো করে দেয়৷ জনকোলাহলমুক্ত পরিবেশ, তার সাথে বিশুদ্ধ বাতাস। যদিও ওদিকের রাস্তাটা তেমন ভালো না। তারপরও মনের জোর থাকলে যা হয় আর কি! নাহলে নাবিলাকে এই অবস্থায় নিয়ে বেরুনো সম্ভব হতো না। তার উপর এইরকম নির্মল পরিবেশে আসলে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। গাছের উপরের সেই টংয়ের মতো ঘরটা তো বর্ণনার বাহিরের থেকেও সুন্দর।
মারজুক যখন বললো, এখানে একটা ভূতের বাড়ি আছে।
তা শুনে অবাক বিস্ময়ে কিছুটা ভয়মিশ্রিত কন্ঠে নাবিলা বললো, সত্যি কি তাই? ভূত বলে কিছু আছে নাকি?
মারজুক হাসতে হাসতে বললো, ভূতের বাড়ি আছে ঠিক তবে ভূত নেই। এটা হুমায়ুন আহমেদের নিজের তৈরি করা।
কিছুক্ষন লীলাবতী দিঘীর পাড় বেঁয়ে নরম ঘাসের উপর দিয়ে দুজন খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করলো। হাঁটতে হাঁটতে মারজুক বললো, আমি কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ স্যারের উপন্যাসের ও অনেক ভক্ত। উনার বেশ কয়েকটা বই আমার পড়া হয়ে গেছে। কর্মজীবনে ঢুকার পরে ব্যস্ততা এতো বেড়ে গেছে যে বই পড়ার আর সময় হয়ে উঠেনা।
-আমি তার দুইটা বই পড়েছি জীবনে। তবে হুমায়ুন আহমেদ তো শুনেছি নাস্তিক ছিলো। তিনি নাকি ধর্মে বিশ্বাস করতেন না? আবার তার লেখাগুলো অনেকটা নাকি ওই লেভেলের?
-হুম তিনি নাস্তিক ছিলেন এটা ঠিক কিন্তু তিনি যে মুসলিম এটা ও উনি কখনো অস্বীকার করতোনা। আর উনার সব লেখা কিন্তু খারাপ ছিলোনা। এমন অনেক লেখা আছে যেগুলো সত্যের উপরও সত্য। ভালো খারাপ তো সবার মাঝে আছে। কিন্তু সে ভিতর থেকে কেমন তা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। তার উপরের অংশটা দেখে তাকে বিবেচনা করার কোন ক্ষমতা কিন্তু উপরওয়ালা আমাদের দেয়নি।
যত প্রিয় লেখক আর কবি হোক না কেন আমরা তাদের পছন্দ করি বলে তাদের সব কাজ ভালো হয় না। ভালো জিনিসগুলো আমরা ফলো করি সবসময়। ভালো লেখাটা গ্রহণ করে খারাপটার সমালোচনা করার রাইট ও আমাদের আছে। তারা প্রিয় বলে সমসময় কি তাদের সবকিছু ভালো হতে হবে এমন কোন কথা আছে কি?
হুমায়ুন আহমেদের লেখার ভক্ত মানে তার সব লেখা আমি গ্রহন করে নিইনি। আর মানুষ হিসাবে তিনি কেমন ছিলেন জানিনা, তবে তার লেখনী শক্তি ছিলো চমৎকার।
কিছুক্ষন পরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঝড়ো হাওয়ার সাথে শুরু হলো বৃষ্টি। কিছুটা দ্রুত হেঁটে গিয়ে বৃষ্টি বিলাসে আশ্রয় নিলো সবাই।
নুহাশ পল্লী এসেছে অথচ বৃষ্টি বিলাসে বসে বৃষ্টির সৌন্দর্য্য উপভোগ করবেনা তা কি করে হয়? তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা ওদের প্রতি দয়া করেছে। ওদের মতো আরো অসংখ্য মানুষ এখানে এসে জড়ো হয়েছে। বৃষ্টি বিলাসে বসে বৃষ্টির রিমঝিম সেতারের সূর উপভোগ করেছে দুজন মিলে । এ যেন অন্যরকম এক অনুভূতি। তবে এখন এককাপ চা হলে বেশ ভালো হতে৷
নাবিলা ভাবছে, ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু সুবিশাল দালানে থেকে মানুষ এই চরম আনন্দের মুহূর্তগুলো মিস করছে দিনরাত। টিনের চালে ঝমঝম করে পড়ার শব্দ, বৃষ্টির পানিগুলো যখন টিনের চালা বেঁয়ে বেঁয়ে মাটিতে পড়ছিলো তখন সেগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়ার অনুভূতি কিন্তু আলাদা। অবশ্য এসব কিছু তখনই অসম্ভব সুন্দর লাগে যখন পাশে প্রিয় মানুষটা থাকে। মন খারাপের বৃষ্টিটা একা একা ছু্য়ে দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু আনন্দের সময়ের পড়া বৃষ্টিগুলো প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে ছু্ঁয়ে দেয়ার অনুভূতিই আলাদা। নাবিলার খুব ইচ্ছে করছিলো বৃষ্টিতে ভিজে তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। নিজের শরীর, মারজুকের চোখ রাঙানি আর চারপাশের অসংখ্য মানুষের দিকে চেয়ে অবশ্য ইচ্ছাটাকে মাটিচাঁপা দিতে হলো।
বৃষ্টি শেষে ওরা ফিরে এলো নিজেদের গন্তব্যে। ওরা যখন নুহাশ পল্লী ছেড়ে বের হচ্ছিলো তখন বিকালের রক্তলাল সূর্যটা দিনশেষে তার ঘরে ফিরছিলো। সূর্যটাকে এখন অনেকটা বড় থালার মতো লাগছিলো। জীবনের সুন্দরতম একটা সময় কাটানো হলো সেদিন নুহাশ পল্লীতে।
মারজুক হসপিটালে চলে গেলেই নাবিলা বাসায় পুরো একা হয়ে থাকে। তবে মারজুকের মনে হচ্ছে এসময় নাবিলার পাশে কারো থাকাটা খুব দরকার। একা একা বাসায় থাকা খুবই রিস্কি। কখন কি হয়ে যায় কে জানে? কিন্তু কোন উপায় ও খুঁজে পাচ্ছেনা।
ইদানিংকালে মেয়েটার নাকি এমন কোন রাত নেই যে রাতে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেনি। তাছাড়া এভাবে বাসায় একা একা পড়ে থাকলে তো দুঃস্বপ্ন আরো ভয়ংকর আকারে ওকে আড়ষ্ট করে ফেলবে। রাতে তো ঘুম একেবারে হয়না। একটু চোখ লাগলেই সেই দুঃস্বপ্নগুলো চোখে ধরা দেয়। আর ও হুড়মুড় করে উঠে বসে।
মারজুক অবশ্য একবার নাবিলার বাবার বাসায় গিয়ে থাকতে বলেছে। কিন্তু নাবিলা নিজেই না করে দিয়েছে। আর তাছাড়া মারজুককে একা রেখে যেতে ওর মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না।
এদিকে ওর মা হলো শ্বাসের রোগী। ঠান্ডা বেশি ধরলে উনার সমস্যা বেড়ে যায়। এখানে এসে থাকতে পারবে কিন্তু মেয়ের তেমন কোন উপকার হবেনা বরং ওর ঝামেলা বেড়ে যাবে বলে ওর বাবা নিষেধ করে দিয়েছে। বাবার শরীর ও খুব একটা ভালো নেই তাই নাবিলা নিষেধ করেছে এখন আসার কোন দরকার নেই। নাবিলাকে যেতে বললে ও যাবেনা বলে দিয়েছে৷ বাবা মাকে কোন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে চায় না সে।
মারজুক ও পড়েছে বেশ বিপাকে। না কোন কাজের লোকের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। এদিকে এই মাসে মার্জিয়ার আসার কথা থাকলেও ও আসতে পারেনি। ইন্ডিয়ায় একজন বড় শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এসেছে সিংগাপুর থেকে। আয়ানের অপারেশনটা সাকসেসফুল হয়েছে কিনা তা জানার জন্য হুট করে ওদের ইন্ডিয়া যেতে হয়েছে। ওরা ফিরবে এক সপ্তাহ পরে।
বাবা মায়ের সাথে আজকাল খুব একটা মারজুকের যোগাযোগ নেই। মা এখন মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ খবর নিলেও বাবা ভুল করে ফোন করা তো দূরের কথা মারজুক নিজে থেকে ফোন দিলেও ধরে না। ছোট মামা মাঝে মাঝে ওদের এসে দেখে যায়।
নাবিলা অবশ্য মারজুককে সবসময় বলে, বাবা মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। সন্তান ভুল করে ক্ষমা চাইলে বাবা মা তার উপর রাগ করে থাকতে পারেনা। একসময় না একসময় তাদের মন গলবেই। কেননা তারাই তো আমাদের এই পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছে। তারাই তো আমাদের জন্মদাতা জন্মদাত্রী। আর বাবা মা মানেই মমতা আর ভালোবাসার এক বিশাল বাগান।
কিন্তু মারজুক জানে ওখানে গেলে সমস্যাটা কতটা প্রকট আকার ধারণ করবে। মারজুক অপেক্ষা করে আছে ওর অনাগত সন্তানের পৃথিবীতে আসার জন্য। যত যাই হোক নাতি নাতনির মুখ দেখলে তারা কখনো মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবেনা।
প্রতিদিন মারজুক হসপিটালে যাওয়ার আগেই নাবিলাকে রান্না করে দিয়ে যায়। আবার শত ব্যস্ততার মাঝে ও দুপুরে চলে আসে। সন্ধ্যার পরে চোখ ভরা সারাদিনের ক্লান্তি থাকলেও দুজনে বেলকনিতে বসে নানারকম গল্প করে সময় কাটায়। যাতে নাবিলা নিজেকে নিঃসঙ্গ না ভাবতে পারে।
আজ ডাক্তারদের একটা সেমিনার হওয়াতে মারজুককে বারিধারায় যেতে হলো। মারজুক সেই সকালেই বেরিয়ে গেছে।
নাবিলা ফোনে মায়ের সাথে কিছুক্ষন কথা বললো। ফোন রাখতে নিলেই দেখে মার্জিয়ার ফোন। নাবিলা ওদের ভালোমন্দ খোঁজ খবর নিয়ে ফোন রেখে রুমটা গুছিয়ে গোসলে গেলো। শরীর বেশ জ্বালা করছে। ঘুম না হওয়ার জন্য নাকি অন্য কোন কারণে বুঝতে পারছেনা। মনে হলো এখন গোসল করে ফ্রেশ ঘুম দিলে কিছুটা ভালো লাগবে।
গোসল সেরে নাবিলা ফোন হাতে নিতেই দেখলো মারজুকের অনেকগুলো ফোন। নাবিলা নিজে থেকে ফোন দিতেই দুইবারের সময় মারজুক রিসিভ করে ব্যস্ততার কারণে দুই মিনিট কথা বলে নাবিলাকে সাবধানে থাকতে বলে ফোন রেখে দিলো।
নাবিলা শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। আজ খুব খারাপ লাগছে কেন এমন লাগছে বুঝতে পারছেনা। ঘুম ও আসছেনা। আধাঘন্টা বিছানায় গড়িয়ে উঠে পড়লো। মনে হচ্ছে ওর সাথে আজ খারাপ কিছু ঘটবে। একরকম অজানা ভয় মনে ভর করেছে। বার বার ‘দোয়া ইউনূস’ পড়ছে ‘আয়াতুল কুরসী’। কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করলো কিছুক্ষণ। সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়লো। কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেনা। এ রুম থেকে সে রুম কয়েকবার পায়চারী করলো। তাও নাবিলার অস্থিরতা কমছেনা। এমনিতে নাবিলার সাথে যখনি কোন খারাপ কিছু ঘটে তখন আগে একটু হলেও ওর মন ওকে জানান দিয়ে দেয়।
আজ ও কি কিছু খারাপ হতে যাচ্ছে?
মার্জিয়া অস্থির হয়ে মারজুকের নাম্বারে বারবার ফোন দিচ্ছে। কিন্তু ওর রিসিভ করার কোন খবর নেই। নাবিলার নাম্বারেও কয়েকবার দিয়েছে কিন্তু ওপাশ থেকে কোন রেসপন্স পায় নি। এক পেরেশানিতে মার্জিয়া অস্থির হয়ে উঠেছে। আল্লাহ জানে আজ নাবিলাকে বাবা কি বলে?
আল্লাহ হেফাজত কর বলে মার্জিয়া সেলিনা বেগমের ফোনে ডায়াল করলো।
সেলিনা বেগম ফোন ধরতে মার্জিয়া বলল, আম্মু আব্বু কখন গেছে ভাইয়ার বাসায়?
-এইতো ঘন্টাখানিক হলো। আমার তো খুব ভয় করছে রে মা! তুই একটা কিছু কর।
-আম্মু তুমি কি জানো আব্বু সত্যি ভাইয়ার বাসায় গেছে?
-হুম সত্যি। এই মানুষটাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতাম বলে সবসময় তার সাপোর্ট করে গেছি। কখনো তার বিরুদ্ধে কথা বলিনি। তার কথায় ছেলেকে বের করে দিতেও দেরি করিনি। এই লোকটার হাই সোসাইটির সন্মান রাখতে গিয়ে আজ এতো কাছাকাছি থেকেও আমার ছেলের থেকে আমি কত দূরে। আমার ও তো কষ্ট হয় আমার ছেলের থেকে দূরে থাকতে। ছেলের পছন্দে আমার কখনো আপত্তি ছিলোনা কিন্তু এই মানুষটার জন্য জোর গলায় কিছু বলতেও পারিনি। কিন্তু আজ যদি আমার চুপ করে থাকার জন্য আমার ছেলের সংসার জীবনের কোন ক্ষতি হয়ে যায় তখন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
-আম্মু তুমি সত্যি বলছো এসব? মার্জিয়া অবাক হওয়ার চরম পর্যায়ে। যেখানে ওরা সবাই জানতো ওর মা মারজুকের এই সিদ্ধান্তে বাবার থেকেও কঠোর ছিলো সেখানে আজ কি শুনছে এসব।
-হ্যা রে মা। আমি সবসময় আমার ছেলের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে জেনেছি। হয়তো মাঝে মাঝে অভিমানে কিছু কথা বলেছি তবে ওর উপর রাগ আমার কখনোই ছিলো না। আজ আমার ছেলের জীবনটা… বলে উনি ঠুকরে কেঁদে উঠলো।
-কিন্তু আম্মু আমি এখানে থেকেই বা কি করতে পারি। ওদের দুজনকে সমানে আমি আর তোমাদের জামাই ফোন দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু ওরা কোন রেসপন্স করছেনা।
তুমিই বা বাবার সাথে যাওনি কেন?
-আমাকে কি তোর বাবা বলে গেছে? তোর বাবা ফোন না ধরায় ড্রাইভারকে ফোন দিতেই ও জানালো আমাকে। নাহলে তো এটাও জানতে পারতাম না।
আর তাছাড়া আমি গেলে ওখানে ঝামেলা আরো বেড়ে যেতো।
-দেখি কি হয়। তুমি চিন্তা করোনা।
নাবিলা তার সামনে বসে থাকা মারজুকের বাবা মানে তার শশুরমশাইয়ের করা স্পষ্ট অপমানগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গিলছে। মুনতাসির আহমেদ অনেক রেগেই একপ্রকার চেঁচিয়ে কথা বলছে। নাবিলাকে কোন কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না। নিজের ইচ্ছামতো যা কথা মুখে আসছে তাই শুনিয়ে যাচ্ছে। আর নাবিলা কান্না চেপে ধরে তা নিঃশব্দে হজম করছে……….
চলবে………..
#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১৯তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
মুনতাসির আহমেদ রাগীস্বরে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে, তোমার জন্য, শুধু তোমার মত একটা নীচু বংশের মেয়ের জন্য আজ আমার ছেলেটা আমাদের ছেড়ে এসেছে। তোমাদের মতো মেয়ের মা বাবা ও কি করে এমন পারে বলতো?
চেনা নাই জানা নাই একটা ছেলে হুট করে বিয়ের প্রস্তাব দিলো আর তারা কোনকিছু না ভেবে, তার বংশ পরিচয় না জেনে, ছেলের সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে ধুম করে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলো? অবশ্য ছেলে এতবড় একজন ডাক্তার, সবদিক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এমন সুযোগ পেলে কে না এমন সুযোগ হাতছাড়া করে।
একবারও ভাবতে পারোনি এই ছেলেকে এখান পর্যন্ত কে নিয়ে এসেছে?
কে তাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ডাক্তারি পড়িয়েছে, বিসিএস ক্যাডার করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে?
ত্রিশটা বছর যে ছেলেকে আমরা লালন পালন করেছি সে হঠাৎ করে তোমার মতো একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের দেখা পেয়ে আমাদের সাথে এতো বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। আমাদের এতো বছরের আদর স্নেহ মমতা সব সে শেষ করে দিয়েছে। একবার ভেবে দেখেছো এটা আমাদের জন্য কতটা কষ্টের?
আজ যদি তোমরা কেউ এমন করতে, অন্য কারো জন্য তোমাদের বাবা মাকে ছেড়ে দিতে, তোমাদের বাবা মায়ের কত কষ্ট হতো একবার চিন্তা করে দেখেছো?
-নাবিলা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, বাবা আমরা উনাকে জোর করিনি। আর আমিতো আগেও বলেছি এখনো বলছি, উনাকে আপনাদের কাছে ফিরে যেতে বলছি উনি না শুনলে আমার দোষটা কোথায়? আর আমরা তো উনাকে জোর করিনি তাহলে…
-এই মেয়ে খবরদার! আমার মুখের উপর একটা কথা ও বলবেনা। আর আমাকে বাবা বলার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে? হ্যা! আমাকে বাবা ডাকার জন্য আমার ছেলেমেয়ে আছে।
জানিনা কি দিয়ে আমার ছেলেকে বশ করেছো, না হলে যে ছেলে আজ অবদি আমার মুখের উপর কোন কথা বলেনি সে কি করে আমাদের অবাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করে? আমি বুঝিনা মনে করেছো তোমাদের চাল। আমি ও দেখবো তোমাদের দৌড় কতদূর!
দেখবো কি করে ও আমাদের কাছে ফিরে না যায়!
-নাবিলা মনে মনে বললো, (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহ না করুক আমার দ্বারা জাদু টোনা করার মতো এসব জগণ্য কাজ যেনো কখনোই না ঘটে। এগুলো তো প্রকাশ্য হারাম।
উনি কি বলছে এসব? যা না হয় তাই মুখ দিয়ে বলে যাচ্ছে। নাবিলার হাত পা সব অবশ হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে ও পারছেনা। কিন্তু এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থেকে এসব অপমান হজম করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।
তারপর বললো, আমি তো আপনাদের ছেলেকে আটকে রাখিনি বা কোন জোর করিনি। উনি নিজে থেকে না গেলে আমি কি করতে পারি?
-ও যাবে কি করে? যতদিন তুমি নিজে থেকে ওকে ছেড়ে না যাও ততদিন ও আমাদের কাছে ফিরে যাবেনা।
তুমি তো তাকে তোমার মিথ্যা মায়ায় আটক করে রেখেছো।
বিড়বিড় করে বললো, জানিনা কার পাপের ফসল এনে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে। বাইরে বের হতে পারিনা, সবার মুখে এক কথা আপনার ছেলে নাকি একটা ধর্ষিতা ধরে এনেছে! আবার নাকি অবৈধ বাচ্চা… লজ্জায় আমার তখন চোখ কান কাটা যায়। শেষ বয়সে এসে আমায় এতো ছোট হতে হচ্ছে মানুষের কাছে।
এতো ভালো মেয়ে হলে তোমার দিকে কেন বাহিরের ছেলেদের চোখ যায়। সব জানা আছে আমার! বয়স তো আর কম হয়নি, কম মানুষ চোখে দেখেনি জীবনে!
-নাবিলার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। যে অপমান গুলো থেকে বাঁচাতে মানুষটা আমায় পূর্ণ অধিকার দিয়েছে, আজ তার ঘরের লোকের থেকে আমায় তা শুনতে হচ্ছে। আমি কি এতটাই অপমানের যোগ্য? দোষ না করেও আজ আমায় এতো কথা শুনতে হচ্ছে! আর আমার গর্ভের এ সন্তানটি তো তার ছেলেরই রক্ত। এটা জানার পরেও উনি এসব কথা কি করে বলতে পারলেন?
সেদিন ওই বাজে লোকগুলো বিনাদোষে জোর করে আমার উপর নির্যাতন করেছে। তারা বেঁচে গেলো মাঝখান থেকে আমায় নাম নিতে হয়েছে ধর্ষিতা।
তারপর মারজুক আমায় নিজে থেকে বিয়ে করেছে আমি তো কখনো উনার সম্পর্কে এরকম ভাবিইনি, বিয়ের আগে উনার সাথে আমার সেরকম কোন পরিচিতি ছিলোইনা। মার্জিয়া আপু, মামা আর উনার জোরাজুরি আমার মা বাবা একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েটা দিয়েছে। অথচ আজ উনার বাবা বলছে আমার জন্য তার ছেলে পর হয়েছে। কেন তার ছেলে কি এতোটাই ছেলে মানুষ যে নিজের ভালো নিজে বুঝেনা?
আমার বাবা মাকে নিয়ে কথা শুনাতেও উনি ছাড়েনি।
আল্লাহ! তুমি কি আমাকে এসবের জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছো? এ কোন কঠিন পরীক্ষা আমার নিচ্ছো?
আমার ইজ্জত, আমার সতীত্ব, আমার মানসন্মান কিছুই তো আর বাদ নেই! আর কত ধৈর্য্য আমাকে ধরতে হবে? আর কত কঠিন পরীক্ষায় আমায় ফেলবে?
এরচেয়ে তো বাহিরের লোকের কথা শুনা ভালো ছিলো। এতটা গায়ে লাগতোনা। তারা বাহিরের লোক বলে গেছে, চলে গেছে। কিন্তু আজকে মারজুকের বাবার কথাগুলো যেন শরীর ফুঁড়ে গিয়ে হৃদয়ে কাঁটার মত বিঁধছে। পুরো হৃদপিণ্ড কেউ যেনো আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। বাইরের কেউ তার খবর পাচ্ছেনা। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে! এমনটা কি কখনো হওয়ার ছিলো?
-শুনো, যা ভাবার ভেবে নাও! তবে এতটুকু অনুরোধ করছি আমার ছেলেটাকে তুমি মুক্তি দাও! যদি না দাও তাহলে আমার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে বলে ভদ্রলোক গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো।
নাবিলা কোনরকমে সোফার হাতল ধরে বসে পড়লো। এতক্ষনের চেপে রাখা কান্নাগুলো ভিতর থেকে নদীর জোয়ারের মত ফুলে ফেঁপে বেরিয়ে আসলো।
এখন কি করা উচিত? চলে যাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে?
নাকি মারজুককে জানিয়ে যাবে?
কিছুক্ষন ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো না এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হবেনা উনার অনুমতি না নিয়ে। কারণ উনার সাথে তো আমার কোন কিছু হয়নি। স্বামির অবর্তমানে স্বামির অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীর ঘর ছেড়ে বাহিরে বের হতে রাসূল (সাঃ) নিষেধ করেছেন।
নাবিলার এতো কষ্টের আর কান্নার ভিতরেও সেদিন মারজুকের বলা কাহিনীটি মনে পড়ে গেলো।
রাসূল (সাঃ) এর সময় তখন। কাফেরদের সাথে মুসলমানদের প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকতো। এটাকে ইসলাম ধর্মে জিহাদ বলা হয়।
তো সেসময় জিহাদের ডাক এসে যাওয়ার কাটণে, এক সাহাবী জিহাদে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে গেলেন যে, তার ফিরে না আসা পর্যন্ত স্ত্রী যেনো কোথাও বাহির না হয়। এ যুদ্ধ বেশ কয়েকদিন ধরে চলছিলো।
এমন সময় খবর এলো যে ওই মহিলার পিতা মরনাপন্ন মৃত্যু শয্যায় শায়িত। কন্যাকে যাওয়ার জন্য খবর দেয়া হলো। সাহাবীর স্ত্রী তখন মহাসমস্যায় পড়লো। কি করবে স্থির করতে না পেরে রাসূল (সাঃ) এর কাছে লোক পাঠিয়ে জানতে চাইলেন কি করবে?
রাসূল (সাঃ) তাকে স্বামীর আদেশই মানতে হবে বলে দিলেন। এভাবে কয়েকবার খবর আসার পরেও রাসূল (সাঃ) স্বামীর আদেশের উপরই গুরুত্ব দিয়েছেন।
পরবর্তী সময়ে সাহাবীর স্ত্রী জানতে পারলেন, তার পিতা আর ইহজগতে নেই। কিন্তু সাহাবীর স্ত্রী সেসময়ও স্বামীর হুকুম মেনে সে সময়েও সেখানে গেলেন না।
সাহাবী জিহাদ থেকে এসে যখন এ ঘটনা জানতে পারলেন এবং বড়ই অনুতপ্ত হলেন এবং রাসূল (সাঃ) কে সব জানালেন।
রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমার স্ত্রী বড়ই ভাগ্যবতী। যেহেতু আল্লাহ পাক আমাকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে তোমার স্ত্রী শুধুমাত্র স্বামীর আদেশ মানার জন্য বেহেশতবাসী হবে।
(শুধুমাত্র স্বামীর আদেশ মানার জন্য যদি বেহেশতবাসী হওয়া যায়, ভাবতে পারেন তা কতটা বড় নিয়ামত আমাদের উপর সৃষ্টিকর্তার। সেখানে আমাদের কি হবে? যেখানে আমরা দিনরাত স্বামীর অবাধ্য হয়ে চলছি। বিনা প্রয়োজনেও বাহিরে বের হচ্ছি আড্ডা দিচ্ছি।
অবশ্য যেসব স্বামীরা শুধুমাত্র দুনিয়ার কথা ভেবে স্ত্রীকে এরকম কোনকিছুতে বাধ্য করে নয়তো নির্যাতন করে তাদের কথা ভিন্ন।)
নাবিলা মনে মনে বলল, তিনি তো আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার বা অন্য কোন আচরণ করেনি সেখানে আমি উনাকে না বলে চলে যাবো।
আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবো?
উনি তো আমায় বলেছেন, সাবধানে থাকতে! সেখানে এভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই ঠিক হবেনা। যা করার যা ভাবার উনি আসলেই হবে। যদি আমাকে উনার ভালোর জন্য এই সম্পর্ক ছাড়তে হয় তবে আমি তাই করবো। এভাবে উনার বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে আমি কখনোই ভালো থাকতে পারবোনা।
হে আল্লাহ আমায় শক্তি দাও!
নাবিলা কেনভাবে চোখের পানির ধারাকে আজ আটকাতে পারছে না। এতোদিনের জমানো চোখের পানি আজ সব উপচে পড়তেছে। নাবিলা সেদিন ও এমন করে কাঁদেনি যেদিন ওর জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম দূর্ঘটনা টা ঘটেছে।
নাবিলা নিজে নিজে বলছে, কিন্তু এ মুহুর্তেও বা আমি কি করবো?
আমার তো এখানে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে? এতগুলো অপমান হজম করার পরে এ বাড়ীতে থাকাটাও বিরাট লজ্জার! উনি কি বলে গেলো এসব? আমরা নাকি উনার ছেলেকে…
আল্লাহ তুমি তো সব জানো, সব দেখেছো! আমরা উনার সাথে জোর করেছি নাকি উনি নিজে থেকে আমার দায়বার নিয়েছে! আমার মনের সব খবর তো তোমার জানা আছে!
কখনো আমার জীবন এমন হবে এটা তো আমি স্নপ্নেও ভাবিনি। মা বাবার কাছ থেকে সন্তানকে কেড়ে নেয়ার কথা তো আমি ভাবতেই পারিনা। আমার তো স্বপ্ন ছিলো.. কিছু মানুষের জন্য আমার স্বাভাবিক চলাফেরাটা এভাবে কেন নষ্ট করতে হলো? কেনো আমায় এতগুলো অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে? এভাবে বেঁচে থাকার কি আসলেই কোন মানে আছে? নাবিলা এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো
সেমিনার শেষ করে মারজুক বেরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো মার্জিয়ার তেত্রিশটা মিসডকল, আর মায়ের নাম্বার থেকে উনিশটা। কি ব্যাপার মার্জিয়া এতবার ফোন কেন দিলো? আর আম্মুই বা কেন দিবে? মারজুকের মনে অজানা ভয় এসে ভিড় জমালো! নাবিলার কিছু হয়নি তো?
মারজুক তড়িঘড়ি করে আগে নাবিলার নাম্বারে ডায়াল করলো। না মেয়েটার ফোনইতো বন্ধ। কয়েকবার ট্রাই করার পরে মারজুক মার্জিয়াকে ফোন করলো।
মার্জিয়া বললো, এই তোর ফোন করার সময় হলো? সারাদিন পেরিয়ে এখন সন্ধ্যা হতে চললো!
-কি হয়েছে বলতো? তুই এতোবার ফোন কেন দিলি?
-মার্জিয়া বললো, নাবিলার সাথে তোর কথা হয়েছে?
-না তো। আমি তো মাত্র সেমিনার শেষে বের হলাম। বের হয়ে তোদের এতগুলো ফোন দেখে আমি ওকে ফোন দিলাম। ওর ফোন বন্ধ বলছে। কি হয়েছে বলতো? আম্মু ও আমায় অনেকবার ফোন দিয়েছে!
আমি তো কিছুই বুঝতেছিনা!
-মার্জিয়া কাঁপা কন্ঠে বললো, আব্বু আজ নাকি তোর বাসায় গেছে!
-মানে? আব্বু আমার বাসায় গেছে? কখন গেছে? কেন গেছে?
একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন আর মারজুকের উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনে মার্জিয়া নিজেই ভড়কে উঠলো।
-তারপর বলল, আমি জানিনা কেন গেছে। তবে দুপুরের দিকে আম্মু আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে এটা। আম্মু নিজেও জানতো না বাবা যে যাবে সেই কথাটা।
আমি তো সেই কখন থেকে তোকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি তুই তো ফোনই ধরছিস না।আম্মু ও বেশ কান্নাকাটি করছে। তুই তাড়াতাড়ি বাসায় যা। নাবিলার ফোনটাও বন্ধ। আমার তো অনেক চিন্তা হচ্ছে!
আর আমি কালই ফিরে আসছি।
মারজুক আর কিছু না বলে ফোন কেটে বাসার দিকে রওনা দিলো। জানিনা বাবা কি বলতে কি বলেছে। নাবিলাই বা কেমন আছে? মেয়েটা স্বাভাবিক আছে তো? সুস্থ আছেতো ? হাজারো চিন্তার চাপ মারজুকের চোখে মুখে………..
চলবে….