হঠাৎ পাওয়া সুখ পর্ব-২০ ২১

0
976

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
২০/২১ তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু

মারজুক দরজার সামনে এসে কলিংবেলে কয়েকবার চাপ দিতেই নাবিলা ধীর পায়ে এসে সালাম দিয়ে দরজা খুলে দিলো।

নাবিলাকে এক পলক দেখেই মারজুকের বুকের ভিতর কেমন যেনো চিনচিনে একটু ব্যথা করে উঠলো। একদিনেই মেয়েটার বয়স মনে হয় অনেকটা বেড়ে গেছে। চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। মনে হয় সারাদিনই কেঁদে কেঁদে পার করেছে।

নাবিলা দরজা খুলেই একমূহুর্ত না দাঁড়িয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। মারজুক নিঃশব্দে দরজা আটকে রুমের দিকে গেলো।
নাবিলা ওয়ারড্রোব খুলে মারজুকের জামাকাপড় আর তোয়ালে এগিয়ে দিলো। মারজুক ওগুলো নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলো।
নাবিলা তড়িৎ গতিতে গিয়ে মারজুকের জন্য চা বানিয়ে নিলো। সারাদিনের ক্লান্তির পর ফিরে এসে এক কাপ চা পেলে বেচারার মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।

মারজুকের হাতে চা ধরিয়ে দিয়ে নাবিলা বেরুতে নিলেই মারজুক বললো, দাঁড়াও!

-থমকে গিয়ে নাবিলার বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। উনি কিছু জেনে যায়নি তো?

-এখানে এসে বসো মারজুকের গম্ভীর কন্ঠ।

-নাবিলা এগিয়ে এসে বললো, কি বলবেন বলুন। আমাকে আবার রান্না বসাতে হবে।

-মারজুক অবাক হয়ে গেলো এই মেয়ের সহন ক্ষমতার শক্তি দেখে। মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় আজ সারাদিন উপোস করে ছিলো।

-কি হলো বলুন?

-আমার কাছে এসে বসতে বলেছি।

-নাবিলা এসে মারজুকের কাছ থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে বসেছে।

-আজ আব্বু এসেছিলো বাসায়?

-নাবিলার বুকের ধুকপুকানি অনেক দ্রুতগতিতে বেড়ে গেলো। যে ভয়টা পাচ্ছিলো তাই হতে যাচ্ছে। নাবিলা ভেবেছে আস্তে ধীরে সব বুঝিয়ে বলবে কিন্তু উনি তো বোধহয় সব জেনে গেছে না বলার আগে।

-নাবিলা কথা বলো! কিছু জিজ্ঞেস করেছি।

-এসেছিলো।

-কখন এসেছে?

-দুপুরের একটু আগে।
-কেন এসেছে?

-ছেলের বাসায় বাবা কেনো আসে তাও বলে দিতে হবে?

-নাবিলা সোজা কথা বলো। আব্বু যে কেন এসেছে তা আমি ভালো করে জানি! আব্বু যে শখ করে আসেনি তাও আমি জানি।
তুমি নিজে থেকে বলবে নাকি আমি…

-কি বলবো? উনি মনের কষ্টে কয়েকটা কথা বলেছে। তা নিয়ে আপনি আবার বাড়াবাড়ি করবেন না।

-কি বলেছে সোজাসাপ্টা বলতে বলেছি। আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি নাবিলা।

-নাবিলা এতক্ষনে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে।
যে কথা গুলো বললে বাবা ছেলের মাঝে সংঘাত বাড়বে মনে করে পণ করেছে এখন সেগুলো বলতেই হবে ভেবে নাবিলা নিজে নিজে ভয়ে ভিতরে ভিতরে ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

-নাবিলা!! কথা কানে যাচ্ছে না তোমার?

-নাবিলা আস্তে আস্তে দুপুরে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনাটা মারজুককে বললো। বলতে বলতে এতক্ষণে হেঁচকি উঠে গেছে ওর। কান্নার ছোঁটে কথাগুলো থেমে থেমে আসছিলো।

মারজুক মাথায় হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আব্বু এটা কি করলো? দাম্ভিকতার চাপে উনি যে এতটা খারাপ ব্যবহার করতে পারে এটা ওর কল্পনার বাহিরে ছিলো। এতদিন বাবা মাকে সন্মান দিয়ে কখনোই জোর গলায় কিছু বলেনি। তাদের সন্মান কখনোই কনাতে চায়নি। কিন্তু আজ ও যদি চুপ করে থাকা হয় তাহলে নাবিলার প্রতি কঠিন অবিচার করা হবে। মেয়েটা তো কোন দোষ করে নি!
আমার নেয়া সিদ্ধান্তের জন্য মেয়েটাকে কেন বারবার অপমানের বোঝা মাথায় চাপাতে হবে। মেয়েটা যে এখনো স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে আছে তাও তো আমার কপাল।

মারজুক উঠে গিয়ে শার্ট হাতে নিলো। আজ বাবার মুখোমুখি হতেই হবে। মারজুক বেরুতে নিলেই নাবিলা উঠে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরলো।

নাবিলা আজ বাঁধা দিওনা। বাবার সাথে আজ আমার কথা বলাটা খুব দরকার!

-আপনার হাত ধরে অনুরোধ করছি আপনি এখন ওখানে যাবেন না। আমার কারণে আপনাদের বাবা ছেলের সম্পর্কে কোন তিক্ততা আমি চাইনা।

-নাবিলা তিক্ততা কখনোই ছিলো না। কিন্তু আজকের পরে বেড়ে যাবে।

-আপনার পায়ে পড়ি আপনি এতো রাতে ওখানে যাবেন না। আমি এজন্যই আপনাকে কিছু জানাতে চাইনি।

-নাবিলা হাত ছাড়ো! মারজুকের কন্ঠে ক্ষোভ।

-প্লিজ! অনুনয়ের দৃষ্টিতে নাবিলা তাকালো।
আর আপনার সাথে আমার কথা এখনো শেষ হয় নি বলে মারজুককে টেনে এনে খাটে বসালো।

অনেক্ষণ দুজনে চুপ। কারো মুখে বলার মতো কোন কথা যেনো আজ নেই। মারজুক লজ্জায় নাবিলার দিকে তাকাতে পারছে না। বাবার কি নাবিলাকে এতো কঠিন কথাগুলো না শুনালেই হতো না?

কিছুক্ষণ পরে নাবিলাই নিরবতা ভাঙলো। মারজুককে উদ্দেশ্য করে বললো,
আমি আজ সারাদিন ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

-ভুল কোন সিদ্ধান্ত আমাকে শুনাবে না।

-আপনি তো কথাটাই শুনছেন না?
-বলো!

-নাবিলার গলার স্বর আটকে আসছে তারপরও অনেক কষ্টে বললো, দেখুন আপনার বাবা যা বলেছে তা অনেকটা ঠিক বলেছে। আপনার কথানুযায়ী আপনাদের বাবা ছেলের মাঝে কখনোই মন কষাকষি হয় নি।
আজ যে আপনাদের মাঝে এতোটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে, স্বীকার করুন আর নাই করুনয় এটা আমাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে।

-শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করবে না।আমি চেয়েছি বলে বিয়েটা হয়েছে। আর আব্বুকে আমি পর করিনি। তিনি আমাকে তার বাড়ীতে যেতে নিষেধ করেছে।

-যাই হোক না কেন আমাকে ঘিরেই তো সব! আপনি যদি সেদিন জিদ না করতেন তাহলে কখনো আপনাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হতোনা।
আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য কোনভাবে রাজি ছিলাম না। কিন্তু যখন আপনি আমাকে বিয়ে করার জন্য কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন তখন আমি রাজি হয়ে যায়। আমার মনে হয়েছে কেউ যদি আমার সন্তানকে তার পরিচয় দেয় আমায় এতোটা ভালোবাসে সন্মানের সাথে সমাজে দাঁড় করাতে চায় তাকে বিয়ে করতে দোষ কি?
এটা ও একধরনের লোভ বলতে পারেন। অবশ্য সে সন্তান আর আমার কাছে আসে নি। দুনিয়ার মুখ দেখার আগে আল্লাহ তাকে নিয়ে গেছে৷
কিন্তু একটু সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকার লোভটা সেদিন আমি সামলাতে পারিনি। এদিক থেকে আপনার বাবা কিন্তু ভুল কিছু বলেন নি।

নাবিলার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠছে, জানি আপনার কষ্ট হবে হয়তো আমারও হবে! কিন্তু, সবকিছু ভেবে চিন্তে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি…

-এখান পর্যন্ত থাকো আর সামনে আগিয়ো না।

-দেখুন সার্বিক দিক বিবেচনা করলে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটা আমি মনে করি সবচেয়ে ভালো হবে।

-মারজুক চোখগুলোকে রক্তলাল করে বললো,, নাবিলা কি বলছো? মাথা ঠিক আছে তোমার?
নাবিলা তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছো!

-দেখুন বাবা মায়ের মনে আঘাত করে কোন সন্তানই সুখি হতে পারে না। তারা যদি আমাকে ছেড়ে দিতে বলে তাহলে আমার কাছে মনে হয় এটা করাই আপনার দায়িত্ব।

আপনি হয়তো ভুলে গেছেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন হযরত ইসমাইল (আঃ) কে ঘরের চৌকাঠ পাল্টাতে বললেন, তখন ইসমাঈল (আঃ) তার মর্মার্থ বুঝতে পেরে একমুহূর্ত বিলম্ব না করে তার স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়েছে।
সেখানে আপনি কেন এত জিদ করছেন?
আপনার বাবার নির্দেশ মানতে আপনার বাঁধা কিসের?

-নাবিলা কিসের মধ্যে কি যু্ক্তি দেখাচ্ছো। হাদীসের একাংশ বলেছো আরেকাংশ বলছো না কেনো?
ইবরাহীম (আঃ) একজন নবী ছিলেন। আর নবীরা অনেক কিছু ওহীর মাধ্যমে জানতে পারতেন। ইবরাহীম (আঃ) বুঝতে পেরেছিলেন ওই মহিলা ইসমাঈল (আঃ) এর জন্য কল্যানকর না তাই উনি এ আদেশ দিয়েছেন। কেননা ইসমাঈল (আঃ) ও একজন নবী ছিলেন একথা ভুলে যেওনা। তাদের ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ আলাদা।

আর আমার বাবা দুনিয়ায় নিজের সন্মানের জন্য আমাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যেটা মানা আমার জন্য কখনোই অপরিহার্য নয়।

আর তুমি কি জানো, শরয়ী কারণ ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর কাছে আলাদা হয়ে যাওয়ার দাবি করা ও এক প্রকার হারামের পর্যায়ভুক্ত।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
কোনো মহিলা বিনা কারণে স্বামীর নিকট তালাক প্রার্থনা করে, তাহলে জান্নাতের সুগন্ধি তার জন্য হারাম হয়ে যাবে।

-আপনাকে কে বলেছে আমি বিনা কারণে এটা বলেছি? আমি ও জানি যে এটা হালাল কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম একটা কাজ।
কিন্তু আজ আমি বাধ্য হয়ে এটা বলেছি। দেখুন একজন বাবা মা সন্তানকে কত কষ্ট করে মানুষ করে তোলে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা সন্তানের সুখের জন্য সারাজীবন পরিশ্রম করে যায়। হুট করে একটা অজানা অচেনা মেয়ের জন্য তাদের সেই সম্পর্কে ঘুনে ধরলে তার থেকে কষ্ট আর কিছু নেই।
দুনিয়াবি কারণ হোক আর যে কারণেই হোক তারা তো আপনার ভালো চায়। এটা আমার বাবা মা ও মানতে পারতো না। এই যে আমরা এত বড় বড় কথা বলছি আমরা ও কিন্তু ওতো সহজে মেনে নিতাম না।

আর আপনি যদি আমার কথা ভেবে সম্পর্কটাকে আটকে রাখতে চান, তাহলে শুনুন আমার কিচ্ছু হবে না। সেদিন এতো বড় ঘটনার পরও যখন আমি বেঁচে ছিলাম তখন আজো আমি এই একটা কারণে মরে যাবো না। আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন স্ত্রীর যোগ্য সন্মান দিয়েছেন এর চেয়ে বেশি আমার আর কি চাই?
অল্প সময়ের হঠাৎ পাওয়া সুখানুভূতি টা নিয়ে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু দুজন বাবা মায়ের দেয়া অভিশাপ নিয়ে কখনোই আমরা ভালো থাকতে পারবো না।

-মারজুক এবার অনেকটা চিৎকার করে উঠলো, চুপ বেয়াদব মেয়ে! আর একটা কথা বলেছো তো থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিবো।
তখন থেকে যা না হয় তাই বলে যাচ্ছে। আমি সহজে রাগ করি না কিন্তু রাগ উঠলে তার ফলাফল কত খারাপ হতে পারে ভাবতে ও পারবে না!
নিজের মতো এতক্ষন বলে গেছো। তোমার জীবন তুমি গুছিয়ে নিবে, আমার বাবা মা তাদের সন্তান ফিরে পাবে। একবারো ভেবেছো আমার কি হবে? আমার সন্তানের কি হবে? তোমরা সবাই নিজেদের ভালো বুঝো আর আমারটা? এতো ভালোবাসি তারপরেও একথা গুলো বলতে একবারো তোমার হৃদয় কাঁপলো না? এতোটা স্বার্থপর মানুষ কি করে হতে পারে?
একবারো ভাবো নি এতে আমার কতোটা কষ্ট হবে? মারজুকের চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে।

অন্যপাশে সমানে কেঁদে যাচ্ছে নাবিলা। মনে মনে, আপনি ভাবছেন আপনাকে আমি কষ্ট দিয়েছি। একবারো ভাবেন নি এই কঠিন কথাগুলো আপনাকে বলতে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে।

কিছু সময় পর, নাবিলা আবারো বলে উঠলো, দেখুন সময়ের সাথে সব বদলে যাবে। একসময় আপনিও আমার কথা ভুলে যাবেন এটা অসম্ভব কিছু না। আপনি প্লিজ বাবা মায়ের কাছে ফিরে যান! এভাবে রেষারেষি আমি আর নিতে পারছি না।

-মারজুকের রাগ চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে। নাবিলাকে থাপ্পড় দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো।
অকৃতজ্ঞ মেয়ে কোথাকার! ডিভোর্স চাও তো? ওটা হলে খুব খুশি হবে তো? অপেক্ষা করো তোমার কথাই পালন করা হবে। মারজুকের কন্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।

নাবিলা এই প্রথম মারজুককে এই কঠিন রূপে দেখেছে। শান্তশিষ্ট মানুষগুলো যে রেগে গেলে এতটা ভয়ংকর হয়ে যায় নাবিলার জানা ছিলোনা।

-এ পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর সবাই! সারাজীবন আমাকে সবাই ঠকিয়ে গেছে। নিজের ভালো সবাই বুঝে শুধু আমি আজ অবদি বুঝতে পারলাম না বলে মারজুক লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো।

খাটের দুইপ্রান্তে দুইজন মানুষ রাতের নিস্তব্ধতায় নিঃশব্দে সমানে চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। গতকাল ও যেখানে হাসি আনন্দে আর খুনঁশুটিতে ভরপুর ছিলো, আজ সেখানে বিরাজ করছে চাপা অভিমান। দুজন ভালোবাসার মানুষের একে অন্যের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ার অজানা ভয়। এতো কাছে থেকেও তারা আজ যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে।

কি হবে নাবিলা আর মারজুকের সম্পর্কের? বাবা মায়ের ইচ্ছের মূল্য দিতে গিয়ে সম্পর্কচ্ছেদ? নাকি সম্পর্কের বন্ধণটা আরো বেশি মজবুত হবে? …….

চলবে………..

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ (২১তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু

স্বপ্ন ভিলার ড্রয়িংরুমে বসে আছে মারজুক। বিয়ের দিন সেই যে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে আর কখনো সে এ বাড়িতে আসে নি। হয়তো আজও আসতো না, যদি না পরিস্থিতি অনুকূলে থাকতো।
কাল সারারাত নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে গেছে মারজুক। চিন্তায় সারারাত এক ফোটা ঘুম ও যেতে পারে নি। বাবার সাথে একবার মুখোমুখি হওয়া দরকার। তাই ফজরের নামাজ পড়েই বাসায় না গিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছে।

এতো সকালে সেলিনা মারজুককে বাসায় দেখে অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে গেলেন।মারজুকের চোখেমুখে রাগের স্পষ্ট রেখা ফুটে উঠেছে। চোখগুলো কেমন লাল হয়ে আছে। মনে হয় সারারাত ঘুমায় নি। অবশ্য ঘুম আসবেই বা কি করে? কাল ওর বাবা নামের মানুষটা যা করেছে এরপরও। মায়ের মন ছেলের কষ্টে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো।
বড্ড চাপা স্বভাবের শান্তশিষ্ঠ ছেলেটা সারাজীবন চুপ করে এই মানুষটার সব বাধ্য বাধকতা মেনে গেছে কোন টুঁ শব্দটি না করে। কিন্তু আজ সেই শান্তশিষ্ঠ ছেলেটির চেহারায় বাবার জন্য ক্ষোভ আর ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে সেলিনা।
আজ সেলিনা ছেলেকে থামাবে না। যা হয় হবে। তারপরও ছেলেটা তো নিজের মনের কথা প্রকাশ করে নিজেকে একটু হালকা করতে পারবে। ছেলেটার এই কষ্ট সয্য করার মতো নয়।

মুনতাসির আহমেদ ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে মারজুককে সোফায় বসে থাকতে দেখে বলে উঠলেন , কি ব্যাপার তুমি এখানে? কি মনে করে?

-আপনার বাড়িতে আসার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু আজ আসতে বাধ্য হলাম মারজুকের কন্ঠে রাগ ঝরে পড়ছে।

-কথা তো বেশ চওড়া গলায় বলছো! তা এতো জোর গলায় আসে কই থেকে?

-আব্বু আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছি নরম হয়ে এলো মারজুকের কন্ঠ। যে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আজ অবদি কোন কথা বলার সাহস হয়নি আজ তা বলতে গিয়ে মারজুকের ব্যথায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু আজ যদি বাবার মুখোমুখি হয়ে কথাগুলো না শুনাতে পারে মারজুক সারাজীবন অপরাধ বোধে ভুগবে। তার সাথে বাবা ও সারাজীবন এই ভুলের মধ্যে থেকে যাবে। ছোটবেলায় মারজুক যে বাবাকে জানতো উনি তো এখন পুরোপুরি অর্থ আর দাম্ভিকতার মোহে ডুবে গেছেন। সেইখান থেকে তাকে টেনে তোলা ছেলে হিসাবে তার সন্তানের দায়িত্ব।

সেলিনা অদূরে দাঁড়িয়ে বাবা ছেলের কথা শুনছেন, আর চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। তাদের পরিবারটা কি আজ এমন হওয়ার কথা ছিলো? এভাবে বাবা মা আর সন্তানের মাঝে দেয়াল উঠে যাওয়ার কোন কারণ ছিলো কি?
কত করে এই মানুষটাকে বুঝিয়েছে সেলিনা যে হয়েছে ভুলে যান। ছেলে তো আমাদেরই৷ আর মেয়েটা তো এমনিতে সবদিক থেকে ভালো। তার সাথে যা হয়েছে তা একটা দূর্ঘটনা। আমরা না বললে মানুষ তা জানবে কেমনে? আর জানলে জানবে তাতে আমাদের কি? এভাবে সমাজ আর লৌকিকতার দোহাই দিয়ে ছেলেটা কে আলাদা করে দেয়া কি ঠিক হলো? আমার ছেলেটা যেখানে ভালো থাকবে সেটাই কি আমাদের মেনে নেয়া ঠিক নয়?
কিন্তু মানুষটা তা কখনো শুনতেই চায়নি। নিজের কথাই কথা! কারো কথার দাম তার কাছে নেই!
আজ বলুক ছেলেটা তাতে যদি মানুষটার ভুলটা একটু ভাঙ্গে!

-কি বলতে এসেছো? বাবার মেজাজী কন্ঠ পেয়ে মারজুকের হুঁশ ফিরলো

-আপনি কাল নাবিলাকে কেন কথাগুলো বলেছেন?

-বাব্বাহ্ এর মাঝে সব কথা বলেও দিয়েছে?

-আমি জানতে চাইছি বলেছেন কেন?

-আমি তোমার কাছে জবাবদিহী দিতে বাধ্য নয়? আর ভুলে যেওনা আমি তোমার জন্মদাতা।

-এই কথাটি ভুলে যায়নি বলে আজ অবদি আপনার মুখের উপরে কখনোই কথা বলিনি। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধটা অনেক বেশি তো। অন্য আর দশটা ছেলের মতো হলে তো এতদিনে অনেক কিছু হয়ে যেতো।

-মারজুক কথা সাবধানে বলো। আর আমি যা বলেছি তার মধ্যে ভুল তো কিছু বলিনি!

-আপনি যা বলেছেন তার মধ্যে ভুল ছাড়া সত্যি তো একটা কথাও নেই।

-মানে কি বলতে চাও? ওই মেয়েকে বিয়ে করে তুমি আমাদের পর করে দাও নি? আমরা তোমায় বাবা মা তোমার জন্মদাতা। তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে এ পর্যন্ত আমি কি না করেছি! দুদিনের একটা মেয়ের জন্য তুমি সেসব ভুলে যাওনি?

-মারজুকের চেখ বেঁয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। পরক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলে বললো,, আব্বু, সত্যি আমি আজ গর্বিত তোমার মতো বাবা পেয়ে। পৃথিবীতে এই একজন বাবা আমি দেখেছি যে তার সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করে কথায় কথায় তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আচ্ছা আব্বু, তোমাদের আমি পর করে দিয়েছি নাকি তোমরা আমাকে পর করে দিয়েছো?
আমি তো এটা কখনোই ভাবিনি যে আমার জীবনে এমনও সময় আসবে যখন তোমাদের থেকে আলাদা হযে থাকতে হবে।
তুমি আমায় সুস্পষ্ট ভাবে সবার সামনে বলেছো তোমার বাড়ীতে যেনো আমি আর না আসি।

-আমি বলেছি ওই মেয়েকে নিয়ে না আসতে তোমাকে আসতে নিষেধ করিনি।

-সে যাই হোক বলেছো তো! তবে তোমরা আমার জন্য যা করেছো আমি তা কখনোই অস্বীকার করিনি আব্বু না কখনো করবো। তোমরা না থাকলে আমার তো কোনো অস্তিত্বই থাকতো না এই পৃথিবীতে। তোমাদের আগে যেমন ভালোবাসতাম শ্রদ্ধা করতাম এখনো তেমনটাই করি। তার বিন্দুমাত্র কমে নি।
তবে আমি যখন নাবিলার দায়িত্ব নিয়েছি তখন সেটাকে অগ্রাহ্য করার অধিকার আর আমার নাই।
হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তোমাদের ছেড়ে দূরে থাকতে আমার যে কত কষ্ট হচ্ছে তা একমাত্র আমি আর আমার আল্লাহ জানে।

আমি প্রত্যেকদিন তোমার আর মায়ের নাম্বারে ফোন দিতাম এই একটা আশা নিয়ে যে তুমি ফোন ধরে বলবে, মারজুক যা হয়েছে, হয়েছে! এখন তুই ফিরে আয়! কিন্তু আমার উপর তোমার এতটা বেশি রাগ আর ক্ষোভ যে তুমি কখনো আমার ফোনটাই ধরোনি। আম্মু মাঝে মাঝে ধরলে তোমার ভয়ে কখনো আমাকে বাসায় আসতে বলতো না।

যে মেয়েটাকে তুমি কাল এতোগুলো কথা শুনিয়ে এসেছো সেতো আমাকে তোমরা রাজি না বলে বিয়ে করতেই চায় নি। প্রত্যেকটা দিন সে আমাকে তোমাদের কাছে ফিরে আসতে বলতো। এমনকি কাল যখন তুমি তাকে কথাগুলো শুনিয়েছো তার উচিত ছিলো আমার উপর রাগ করা। কেননা আমি তাকেও বলতে গেলে জোর খাটিয়ে বিয়ে করেছি।
কিন্তু সে কি করলো? আমার বা তোমার উপর কোন প্রকার রাগ বা অভিযোগ না করে আমাকে নিঃসংকোচে বলে দিলো, আমি যেনো তাকে ছেড়ে তোমাদের কাছে ফিরে আসি। কারণ আমার উপর ওর চেয়ে তোমাদের হক বেশি।
এটা আমি ও জানি আব্বু! কিন্তু কি জানো তো যে মেয়েটাকে আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় আমার বউ করে এনেছি এখন যদি বিনাদোষে ওকে আমি আমার বাড়ি থেকে বের করে দিই তাহলে ওর উপর অনেক বড় অন্যায় করা হবে। আর এর জন্য আল্লাহ্ আমাকে কোনদিনই ক্ষমা করবে না।
আর আজ যদি দুনিয়াবি কারণ ছাড়া তোমরা ওকে ছাড়তে বলতে আমি এক মুহূর্ত না ভেবে ওকে বের করে দিতাম। কিন্তু যে সামাজিক স্ট্যাটাসের দাবি নিয়ে ওকে ছাড়তে বলছো তা আমি কখনোই পালন করতে পারবো না।
আর তার গর্ভে আামী সন্তান বাবা, কারো পাপের ফসল নয়এটা তুমি জানার পরেও কিভাবে ওই কথাগুলো বলতে পারলে? একবারও তোমার মনে দ্বিধা বোধ হয়নি তুমি নিজের সন্তানের রক্তকে অন্যের পাপ বলতে?
একটা কথা ভাবো আব্বু,, আজ আমাদের মার্জিয়ার সাথেও কিন্তু এমন দূঘটনা হতে পারতো!
আর তখন যদি কেউ তোমার কাছে ওর প্রতি সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে আসতো তখন কিন্তু তুমিও সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে না। কারণ দুনিয়ার সব বাবা মা তার সন্তানের ভালোর জন্য কমবেশি স্বার্থপর হয়ে থাকে।
আমরা সবাই নিজের স্বার্থ বুঝি, সুযোগ পেলে সময়ের সদ্বব্যবহার করতে আমরা কখনোই ছাড়ি না।
কিন্তু অন্যের বেলায় সেগুলোকে আমরা লোভী খেতাব দিয়ে দিই।

-মারজুক!!

-চিৎকার করো না আব্বু। আস্তে কথা বলো। তোমার সোসাইটির লোক শুনলে এটা নিয়ে কথা রটাতে কিন্তু ভুলবে না! তারা তো আবার কোন একটা কথা ফেলেই হয়! তিল থেলে তা তাল বানিয়ে দিবে।

-আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?

-থিউরিটা তুমি হয়তো ভুলে গেছো, তাই স্মরণ করিয়ে দিলাম।
আর একটা কথা আব্বু, ছোটবেলায় আমি আমার যে বাবাকে চিনতাম, তুমি তা নও!
আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলো কিভাবে সৎভাবে বেঁচে থাকা যায়, কিভাবে অন্যের দুঃখে ব্যথিত হতে হয়, কারো বিপদে কিভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করতে হয়, অহংকার না করে কিভাবে নিজের মাঝে নিরহংকার একটা মন তৈরি করা যায়।

বড় বেলায় এসে তোমার মাঝে সেই বাবাটাকে আমি অনেক খুঁজছি কিন্তু পাইনি। পাবো কি করে? আমার সেই বাবাটা তো অর্থ-বিত্ত, আত্ম অহংকার, দাম্ভিকতা আর তার হাই সোসাইটি জীবনের মধ্যে এতোটাই ডুবে গেছে যে তাকে খু্ঁজে পাওয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে গেছে।

-মুনতাসির আহমেদ নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। কি বলবে? কি বলার আছে এ কথাগুলোর জবাবে?

মারজুক কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো, আমি যাচ্ছি আব্বু,,
এরপর আমি আর তোমাদের সাথে যোগাযোগ করবো না। তোমার মধ্যে আত্মমর্যাদা যদি এতো বেশি থাকে তবে আমার মাঝেও তার রেশ একটু হলেও আছে। কেননা আমি তো তোমারই ঔরসজাত সন্তান।
তবে তোমার রাগ যদি কখনো কমে ভুল করেও যদি একবার আমাকে ফিরে আসতে বলো তবে আমি সব দ্বিধাদ্বন্ধ ভুলে চলে আসবো। তোমাদের উপর রাগ করে থাকার শক্তি উপরওয়ালা আমাকে দেয়নি।
তবে ওই মেয়েটাকে সাথে করে না হলে নয়!

তোমার মুখের উপর কথা বলার জন্য যদি এতোটা কষ্ট পাও তবে ক্ষমা করে দিও বলে মায়ের দিকে একবার তাকালো৷
সেলিনার করুন পানি ভর্তি চোখের দিকে তাকিয়ে মারজুক হনহন করে বেরিয়ে গেলো।
মায়ের চোখের পানিগুলো ও সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। মারজুক জানে মা কখনো ওর বিপক্ষে ছিলো না। শুধু বাবার জন্য কখনো পক্ষপাতিত্ব করতে পারেনি। তাইতো কঠিন হয়ে সেদিন ছেলেকে কিছু কথা শুনাতে হয়েছে। মায়েরা কখনো কঠোর হয় না। মায়েরা হয় মমতাময়ী! মারজুক দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ আপন মনে কেঁদেছে। মনে মনে বললো, আল্লাহ তুমি আমার বাবাটাকে সঠিক বুঝ দাও। তার উপর তোমার রহমতের ছায়া দান করো!
ভালো করে চোখগুলো মুছে রাস্তায় নেমে পড়লো…….
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here