উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ২৩

0
649

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৩
_________________

ইরতিজার হাতে একটা গোলাপি বক্স। বক্সটার ভিতর কী রয়েছে সেটা এখনও জানে না জুহি। বললো,
“এটার ভিতর কী? কিছু কিনেছো না কি?”

ইরতিজা কিছুটা ভীত। ক্যানিয়লের ওখান থেকে কত ভয় পেয়ে যে ফিরেছে সেটা কেবল সে জানে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল ক্যানিয়ল ছুরি দিয়ে ক্ষ/ত বিক্ষত করে ফেলবে তার শরীর। কিন্তু সেরকম কিছুই করেনি ক্যানিয়ল। বরং গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছে। ইরতিজা ইতস্তত গলায় বললো,
“আমি কিনিনি। আমায় গিফট দিয়েছে।”

জুহি পুলকিত হয়ে উঠলো,
“গিফট দিয়েছে? কে? সাজিদ ব্রো? ইওর ফিয়ন্সে?”
বলতে বলতে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ইরতিজার হাত থেকে বক্সটা নিলো জুহি।

ইরতিজা বললো,
“না, এটা সাজিদ দেয়নি।”

থামলো জুহি। কিঞ্চিৎ অবাক হয়েই তাকালো।
“ব্রো দেয়নি? তাহলে কে দিয়েছে?”

ইরতিজার বলতে কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে। ক্যানিয়লের কথা শুনলে জুহি কী ভাববে? জুহি এমনিতেই পছন্দ করে না ক্যানিয়লকে। ওদিকে জুহি উত্তরের আশা করে চেয়ে আছে। ইরতিজা কুণ্ঠাবোধকে উপশম করে বললো,
“এটা…এটা ক্যানিয়ল দিয়েছে।”

“ক্যানিয়ল?” বিস্ময়ের দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল জুহিকে। হাতের বক্সটা ফেলে দিলো ফ্লোরে। ইরতিজার হাত ধরে ওকে নিয়ে বক্সটার থেকে দূরে সরে এলো।
“তুমি কি পাগল হয়েছো টিজা? ক্যানি গিফট দিলো আর তুমি সেটা নিয়ে এসেছো? ক্যানি কি গিফট দেওয়ার মানুষ? এটার ভিতর তো বোমাও থাকতে পারে। দেখা গেল এর ঢাকনা খুলেছি আর অমনি বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ হয়েছে। আমাদের বাসা, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পছন্দের ড্রেস ইত্যাদি সকল প্রিয় জিনিস পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। তুমি কি ম/র/তে চাও?”

“কিন্তু আমার মনে হয় না এটায় কোনো বোমা আছে।”

“কথার কথা বলেছি আমি। হতেও তো পারে এমনটা। মানুষজন বলে ও না কি রোবট! রোবটের কি আর কোনো অনুভূতি থাকে? সে মানুষের জন্য মায়া অনুভব করবে কীভাবে? মানুষ খু’ন করতে তো তার একটুও কষ্ট হবে না।”

ইরতিজা কিছু বললো না। এই মেয়েটার অদ্ভুত সব কথা!
জুহি বললো,
“ঠিক আছে, বক্সটা ওপেন করে দেখি চলো।”

বক্সটা নিয়ে জুহি ইরতিজার বেডরুমে এলো। এ সময় বাসায় কেউ নেই। শুধু ওরা দুজন আছে। অন্যরা নিজের কাজে বের হয়েছে। জুহি বক্স খুললো। খুলেই চমকালো সে,
“এগুলো কী?”

ইরতিজার কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টি বক্সের ভিতর। হিজাব?
জুহি একটার পর একটা হিজাব বের করতে লাগলো। অনেকগুলো হিজাব পাওয়া গেল। অতঃপর জুহি গুণে দেখলো কতটি হিজাব আছে। মোট একশটা হিজাব। সে হতভম্ব হয়ে বসে রইল কিয়ৎক্ষণ। তারপর ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কী ব্যাপার? ক্যানি তোমায় হিজাব কেন দিলো? তাও আবার এতগুলো? তোমার হিজাব নিয়ে ওর এত মাথা ব্যথা কেন? আগেও একদিন তোমার মাথায় হিজাব পেঁচিয়ে দিয়েছিল! সমস্যা কী ওর?”

ইরতিজা নিজেও জানে না ক্যানিয়লের সমস্যা কী। এত মানুষ থাকতে তাকে কেন একগাদা হিজাব দিলো ক্যানিয়ল?

জুহি বলতে লাগলো,
“ক্যানিয়ল এমন একজন মানুষ যার কোনো বন্ধু নেই। ও কারো সাথে মিশে না তেমন। একা একা থাকে। মানুষজনও ওকে এর জন্য বিশেষ একটা পছন্দ করে না। কিন্তু সেই ক্যানি তোমার জন্য হিজাব কিনেছে, তোমাকে গিফট দিয়েছে! বিষয়টা আশ্চর্যকর নয় টিজা? এছাড়াও ও অন্য কারো সাথে না মিশলেও তোমার সাথে যেন বেশিই মেলামেশা করে। এমনটা কেন? এটা অবশ্যই সন্দেহজনক!”
জুহি ইরতিজার দিকে সন্দিহান দৃষ্টি দিয়ে হঠাৎ বললো,
“কোথাও এমনটা নয় তো যে তোমার আর ওর মাঝে গোপন রিলেশনশিপ চলছে?”

কথাটায় ইরতিজার অন্তর শিরশিরে এক অনুভূতি নিয়ে কেঁপে উঠলো। বললো,
“তুমি ভুল ভাবছো জুহি। এমনটা নয়।”

“তাহলে ব্যাপারটা কেমন? ও কেন তাহলে এমরকম করে? তুমি ক্যান্টিনে গিয়েছিলে, আমি পরে আসছি বলে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আর ক্যান্টিনে গিয়ে তোমাকে পাইনি। ক্যানি এসে তোমাকে ওই সময় নিয়ে গিয়েছিল, তাই না? তারপর এই বক্সটা দিয়েছে। কোথায় নিয়ে গিয়েছিল ও তোমাকে?”

জুহির শেষ প্রশ্নে ইরতিজা একটু ইতস্তত বোধ করলো। ইতস্ততা নিয়েই বললো,
“ওর সেকেন্ড হোমে।”

জুহির চোখে বিস্ময় স্ফীত হলো,
“ও তোমাকে নিজের বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিল? অবিশ্বাস্য! তুমি কি শিওর তোমাদের মধ্যে আসলেই কোনো রিলেশনশিপ নেই?”

“অবশ্যই। তুমি যেটা ভাবছো এটা সেরকম নয়। তোমার ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল।”

জুহি উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি বাসায় যাচ্ছি। মাথার ভিতর ছোটো ধরনের বিস্ফোরণ ঘটছে মনে হচ্ছে!”

জুহি চলে যাওয়ার পর ইরতিজা হিজাবগুলোর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে ক্যানিয়লকে নিয়ে ভাবতে লাগলো। ছেলেটার সমস্যা কী? তবে ক্যানিয়লের থেকে হিজাবগুলো পেয়ে তার মনের গহীন প্রান্তরের ঝাপসা ভালোলাগাটা আরও খানিক প্রখরতা পেল। কেমন আনন্দের একটা রেশও দোল খাচ্ছে তার মনে। অনুভব করতে পারছে সেটা।

_______________

‘তুমি আকাশের তারা, আমার স্পর্শের বাইরে।
ছুঁতে চেয়ে হাত বাড়ালে যাও আরও দূরে সরে! এমন কেন তুমি? আমার হৃদয় যে অন্ধকারে পড়ে রয়!
আকাশের বুকে যেমন তারা হয়ে জ্বলজ্বল করো,
তেমনি আমার হৃদয়েও একটু-আধটু আলো জ্বেলো।
আমি পারি না এত অন্ধকারে থাকতে, সত্যিই পারি না প্রিয়!
একটুখানি আলো আমার হৃদয়েও জ্বেলো।’

সকাল সকাল এমন একটা ভয়েস মেইল পেয়ে একটুখানি নয়, বেশি পরিমাণেই মন খারাপ হলো ইরতিজার। জোনাস একটা পাগল! আজ থেকে আর এই পাগলের কথায় মন খারাপ করবে না বলে শপথ নিয়ে বিছানা ছাড়লো সে।
এক্সারসাইজের জন্য বাবার সাথেই বাসা থেকে বের হলো। বের হতো রিশনের সঙ্গে, কিন্তু রিশন ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে। জিমে গেছে সে।
ইরতিজা এমনিতেও জিমে যেত না। সে জগিং করবে। আজাদ চৌধুরী সাইক্লিং করছে। ইরতিজা তাই তার থেকে অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছে। একা একা দৌড়াচ্ছে। সাথে সঙ্গী নেই। জুহি একটা অপদার্থ। এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সকাল সকাল উঠে একটু জগিং করতে বের হলে কী হয়? তাহলে কি আর সঙ্গীহীন জগিং করতে হতো তাকে? ইরতিজার মন বেজায় খারাপ হলো জুহির কথা ভেবে।

নিরিবিলি রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে লম্বা পাইন গাছ। গাছগুলো যেন রাস্তাটাকে পাহারা দিচ্ছে। বাড়ির পাশেই এই রাস্তাটা। বিকেল বেলাও হেঁটে বেড়াতে দারুণ ভালো লাগে। ইরতিজা হঠাৎ থেমে গেল। তার কিছুটা সামনে দিয়ে একটা হরিণ দৌড়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেল। রাস্তার এক সাইড দিয়ে এসে অন্য সাইডের ফরেস্ট এরিয়ায় প্রবেশ করেছে।
ইরতিজা একটু হাঁপিয়ে নিয়ে আবারও দৌড়াতে শুরু করলো। হঠাৎ তার মনে একটা ভাবনার উদয় ঘটলো–এখন যদি ক্যানিয়লের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে কেমন হবে? মাথায় হিজাব পরে বের হয়নি। ক্যানিয়ল দেখলে তো বলবে, ‘আমি এতগুলো হিজাব কিনে দেওয়ার পরও তুমি হিজাব ছাড়া বের হয়েছো পাকিস্টানি গার্ল? এর অপরাধে তোমার শিরশ্ছেদ করা হবে!’
ইরতিজা মাথায় হুডি টেনে দিলো। ছেলেটা তো বড্ড জ্বালায় তাকে, একটুও শান্তিতে থাকতে দেয় না!
মাথায় টেনে দেওয়া হুডিটা হঠাৎই মাথা থেকে সরে গেল ইরতিজার। পিছন থেকে একটা হাত টেনে নামিয়ে দিয়েছে তার হুডি।
ইরতিজা চমকিত হয়ে পিছন ফিরলো। পরপরই প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে,
“ইউ?”

“আমার বাসা এই এলাকাতেই, এই রাস্তায় আমি থাকবো স্বাভাবিক।”

ইরতিজা ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের ছাপ ফেলে বললো,
“তুমি কি আমার পিছনে ছিলে? জগিং করছিলে তুমি? তুমি না আহত? জগিং করছো কীভাবে তাহলে?”

ক্যানিয়ল একটু পিছনে থাকা বেঞ্চটা দেখিয়ে বললো,
“আমি ওখানে বসে ছিলাম ইডিয়ট!”

“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ!” চোখ কঠিন করে বললো ইরতিজা।

“চুপ থাকো ইডিয়ট গার্ল।”
নিজের নামকরণ করা হাতের ‘ভায়োবিন’ ফুলগুলো ছুঁড়ে ফেললো ক্যানিয়ল। অতঃপর ইরতিজার মাথার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আগামীকাল তুমি আমার দেওয়া হিজাবগুলো ফিরিয়ে দেবে। যদি ওগুলো ইউজ না করো তাহলে ওগুলো তোমার কাছে রেখে লাভ কী? ভেবো না যে আমার উডবি ওয়াইফ হিজাব-টিজাব পরে না। ওগুলো আমাকে ফেরত দিয়ে দেবে, ওগুলোর সাথে আরও দুইশ হিজাব যোগ করে আমি আমার কিউট উডবি ওয়াইফকে গিফট করবো।”

বলে ক্যানিয়ল পা বাড়িয়ে দিলো সামনে।
ইরতিজা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিষণ্নতা যেন গ্রাস করে নিতে চাইছে তাকে। মনে মনে বললো,
‘পাজি! গিফট দিয়ে তা আবার ফেরত চাচ্ছে উডবি ওয়াইফকে দেওয়ার জন্য!’

রাস্তা থেকে ক্যানিয়লের ফেলে দেওয়া ভায়োলেট রঙের ফুলগুলো হাতে তুলে নিলো ইরতিজা। কিছু না ভেবেই কিছু ফুল গুঁজে নিলো কানে। আর জগিং করবে না। খানিক সময় ওয়াকিং করে বাড়ি ব্যাক করবে। ডান দিকে বাঁক নিয়ে ক্যানিয়ল চোখের অদৃশ্য হয়ে গেল। ইরতিজা ফুলগুলোকে দেখতে দেখতে ধীর পায়ে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। ফুলগুলো পছন্দ হয়েছে তার। নাম কী এগুলোর? অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল ইরতিজা।
যখন হেঁটে এসে বাঁকের মুখে দাঁড়ালো তখন পুরো শরীর স্তব্ধ হয়ে গেল তার সামনের দৃশ্যটা দেখে। হৃৎপিণ্ড নড়ে উঠলো। দু চোখে ভয় আর বিস্ময়ের বিস্ফোরণ। যে মানুষটা একটু আগে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে এসেছিল সেই মানুষটা এখন আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে! কপাল বেয়ে একটা রক্তের স্রোত নেমেছে। হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে পেটের এক অংশ। যে অংশ দিয়ে রক্ত নির্গত হচ্ছে। রক্তে ভিজে গেছে হাত। ক্যানিয়লের এই অবস্থা দেখে দম বন্ধ হয়ে এলো ইরতিজার। পড়ে গেল হাতে থাকা ভায়োবিন ফুলগুলো। সে এগিয়ে এলো ক্যানিয়লের দিকে। ওর সামনে বসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাকলো,
“ক্যানিয়ল!”

ক্যানিয়লের জ্ঞান আছে, কিন্তু সেই জ্ঞান আর কিছুক্ষণ পরই হারিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এই শীতের মাঝেও তার শরীর ঘামে একাকার। নিঃশ্বাস টেনে তোলায় যে কষ্ট হচ্ছে ইরতিজাও উপলব্ধি করতে পারছে তা। ঘোলাটে চোখ জোড়া বুজে আসতে চাইছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে ইরতিজাকে দেখতে পেল সে। কণ্ঠ আর কথা বলার শক্তি রাখে না, তবুও সে কষ্ট করে অস্পষ্ট গলায় কথাটা উচ্চারণ করলো,
“আমি মরে গেলে তুমি খুশি হবে ইজা?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here