#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ২৯)
সায়লা সুলতানা লাকী
ক্লাস শেষ হতেই এখন সরাসরি বাসায় চলে আসে লাবন্য। বন্ধুদের সাথে আড্ডাতে এখন আর আগের মতো মন বসে না। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে ডোরবেল বাজাতেই বুয়াখালা খুলে দিল। লাবন্য আর কোনদিকে না তাকিয়ে খাবার দিতে বলে সোজা নিজের রুমে ঢুকে গেল। পেছনে পেছনে তাসলিমাও ওর রুমে গেল। খাবার না বেড়ে ওর রুমে আসায় ও কিছুটা অবাক হয়ে গেল।
ব্যাগটা টেবিলে রেখে খালার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“খালা কিছু বলবা? নানি কি ঘুমায়?”
“না খালা, খালাম্মাতো রুশ বাবারে নিয়া হাসপাতালে গেছে। আপনে কিছু জানেন না?” তাসলিমার কথা শুনে ওর মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
“কি বলো খালা? কি হয়েছে রুশের? ও আল্লাহ, তুমি রহম কর। কোন হাসপাতালে আছে?” বলতে বলতে কন্ঠ ধরে এল ওর।
“আমিতো কিচ্ছু জানি না। ভাইয়ে ফুন দিছিলো খালাম্মারে, এরপর খালাম্মা দৌড়াইয়া বাইর হইছে। আমিতো আর কিচ্ছু জানি না।”
এতটুকু শুনেই লাবন্য হাইমাউ করে কেঁদে উঠল। কি করবে তা বুঝতে পারছিলো না। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে আছে। সাথে সাথে অন করল। বত্রিশটা মিসড কল হিমেলের। কোনো দিক পাশ না চিন্তা করে হিমেলকে আগে কল দিল-
“তুই কোথায়?”
“রুশ কোথায়?”
“রুশ এখন ভালো আছে, স্কুলে খেলতে খেলতে একটা এক্সিডেন্ট করেছিল। হাতে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। এখন তুই কাঁদবি না এভাবে। নিজেকে কন্ট্রোল কর। রুশের সামনে এভাবে কাঁদলে ও ভয় পাবে।”
“আমি রুশের কাছে যাব। ও কোথায়? আমার ভাই কোথায়?”
” আগে কান্না বন্ধ কর। তারপর বল তুই কোথায়?”
“বাসায়।”
“রেডি হ আমি আসছি।” বলে কলটা কেটে দিল হিমেল। লাবন্য কেনজানি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। কাঁদতেই লাগল অনবরত। মোবাইলটা কখন যে চাপে পড়ে বন্ধ হয়ে ছিল তা খেয়ালই করেনি। নিজের উপর এখন নিজেরই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
এরই মধ্যে ল্যান্ডফোনে কল আসল, বুয়াখালা কলটা রিসিভ করতেই শুনল নানি কল দিছে। উনি কিছু জিনিস লাবন্যের সাথে দিয়ে দিতে বললেন। বুয়া সাথে সাথে তা প্যাক করে দিতে শুরু করল।
হিমেলের সাথে হাসপাতালে আসতেই ও দেখল রুশ ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে ঠিক যেমনটা ওর জ্বর আসলে ধরে রাখতো। ও সামনে গিয়ে রুশের পাশে দাঁড়ালো। ওর কপালে হাত দিতেই রুশ চোখ মেলে তাকালো
“আপু, আপু অনেক ব্যথা। আপু পায়ে অনেক ব্যথা।” বলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল রুশ।
“কাঁদে না ভাইটা আমার।আমার আদর সোনা ভাই। কাঁদে না। ভালো হয়ে যাবে। দেখো ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে।” লাবন্য কথাগুলো বলছিলো খুব সাহস দেখিয়ে ঠিকই কিন্তু ভেতর ভেতর নিজেও রুশের অবস্থা দেখে ভেঙে পড়ল।
রুশের ডান পা প্লাস্টার করা হয়েছে। ডান হাতটাও ফুলেছে তবে হাত ভাঙ্গেনি। পড়ার সময় হাতটা বেকায়দায় ছিল তাতেই মোচড় লেগেছে। লাল হয়ে আছে। নানি হিমেলকে দিয়ে বরফ আনিয়েছে তা দিয়েই এখন হাতে সেঁকতে লাগলেন। একটু ছোঁয়া দিলেই কুঁকড়ে উঠে ব্যথায়। ওর ব্যথাতে মনে হল লাবন্যও কষ্ট পাচ্ছে। এরই মধ্যে সিস্টার আসলেন ইনজেকশন দিতে। লিখন খুব যত্ন নিয়েই রুশকে মেনেজ করছে যাতে ইনজেকশন দেখে ভয় না পেয়ে যায়। একটু সময়ের জন্য লাবন্য ভুলে গেল ওর আব্বু যে আর ওদের সাথে নাই। রুশও সেই আগের মতোই ওর আব্বুকে জড়িয়েই আধশুয়া অবস্থায় বসে থাকল। কিছুক্ষণ পর রুশ ঘুমিয়ে গেল। লাবন্য তখনও কাঁদছে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে। ওর নানি আস্তে করে বললেন
“বোকার মতো কাঁদছিস কেন? আল্লাহর কাছে শুকোর গুজার কর যে বড় কোনো এক্সিডেন্ট হয় নাই। বিপদতো আরও বড় ধরনেরও হতে পারতো।”
“নানি আসলে কি হয়েছিলো স্কুলে? তুমি কিছু জানো? হঠাৎ কি হলো যে এমন এক্সিডেন্ট হল।”
“টিফিন পিরিয়ডে ওরা বন্ধুরা মিলে টিফিন করছিলো তখন পাশের সেকশনের এক ছেলে এসে ওকে বলেছে ও নাকি রুশের নতুন মা’কে দেখেছে ওর বাবার সাথে মার্কেটে। এই কথা শুনে রুশ একটু রেগে গিয়ে বলছে যে ওর কোন নতুন মা নাই। ওর একটাই মা যে কি না চলে গেছে আল্লাহর কাছে। তখন ওই ছেলে জিজ্ঞেস করেছিল যে রুশের আব্বু যাকে বিয়ে করছে তাকে তাহলে রুশ কি বলে ডাকে?
রুশ উত্তরে বলেছে ও তাকে কখনও দেখেনি, আর দেখতেও চায় না। কথাটা রুশ একটু চিৎকার করেই বলেছিলো। তখন পাশে থেকে অন্য এক ছেলে এগিয়ে এসে রুশকে ধাক্কা দিয়ে বলেছে (তোর আব্বু আবার বিয়ে করে তোদের ছেড়ে চলেগেছে, তুই আবার উঁচা গলায় কথা বলিস কোন সাহসেরে? তোর আব্বু আর তোদের সাথে নাই তাহলে এত সাহস কোথায় পাস?)
রুশ খুব কষ্ট পেয়ে যায় সেই কথায়। কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ করেই বলে উঠে ও টিচারকে কমপ্লেন করবে এসব কথার জন্য। আর তা নিয়েই হাতাহাতি শুরু হয়। রুশ একটা সময় সিড়ি থেকে পড়ে যায় নিচে। ” একদমে কথাগুলো বলে হিমেল থামলো।
পাশে থেকে লিখন ডুকরে কেঁদে উঠল। কোন কথা নাই ওর মুখে। ছেলের হাতটা নিজের হাতে চেঁপে ধরে শুধু কাঁদতে লাগল।
লাবন্য স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। একটু পর আস্তে আস্তে করে বলল “জীবনে আরও কত জানি নাজেহাল লিখা আছে কপালে আমাদের। যে যেভাবে পাড়ছে সে সেভাবেই খোঁচা দিচ্ছে মনের সাধ মিটিয়ে। ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোন পথ নাই দেখছি। ইচ্ছে করছে স্কুলে গিয়ে ছেলেগুলোর গালে জোরে একটা চড় মারতে। এতে যদি একটু মনের কষ্ট কমতো আমার।”
“আল্লাহ একেক সময় তার বান্দার পরীক্ষা নেন, যেমন এখন তোদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এতটা ধৈর্যহীন
হলে চলবে না লাবু। বাচ্চা ছেলেদেরকে চড় মেরে কী হবে? ওরা কি আর এসব বুঝে করেছে? ওরা না বুঝেই এসব বলেছে। ” নানি লাবন্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন।
“তুমি কিছু বলোনি স্কুলের টিচারদের? রুশকে যখন অন্য ছেলেরা মারল তখন তারা কি করছে বসে বসে দেখছে শুধু? ”
“আমিতো কিছুই জানি না। ক্লাস মিস তোর আব্বুকে কল দিয়েছিল। ও স্কুলে গিয়ে এই অবস্থা দেখে আর দেরি করেনি সাথে সাথে এখানে নিয়ে আসছে। পথে থাকতেই আমাকে কল দিয়ে জানিয়েছিল। পরে আমি হিমুকে জানালাম।ও ছাড়া আসব কীভাবে? আমিতো স্কুলেই যাইনি। গেলে বিষয়টা ভালোমতো জানতে পারতাম। হিমু যা বলল তা রুশ হিমুকে বলছে। এখন তা কতটুকু সত্য, কতটুকু মনগড়া তা বুঝব কীভাবে? ”
“কি বলছো তুমি? রুশ মনগড়া কথা বলবে কেন? তুমি ওকে বিশ্বাস করতে পারছো না কেন নানি?”
“কে কাকে বিশ্বাস করতে পারে বল? রুশতো ওর আব্বুকে বিশ্বাস করেছিলো, মনে করেছিলো কখনও দূরে যাবে না। কিন্তু সেই বিশ্বাসতো হারিয়েছে ও। তাই না?”
“আম্মা আমিই অপরাধী, আমার জন্যই আমার কলিজার টুকরার আজ এই অবস্থা। আমিই দায়ী। আমি চরম ভুল করে ফেলছি জীবনে।” কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল লিখন।
লাবন্যের কাছে ওর আব্বুর বলা কথাগুলো বিষের মতো লাগল। বিরক্ত হয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে এল। রাগে গা একেবারে গিজগিজ করছে যেন।তখনই পিছনে হিমেল এসে দাঁড়ালো
“কতবার কল দিয়েছি তা বলতে পারবি? নানুমনিকে নিয়ে হাসপাতালে আসার পর এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে, না পারছি তোর কি হল তা দেখতে যেতে না পারছি মাথা থেকে তোর চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে। এমনটা কেন করিস? ”
“মোবাইলটা চাপে পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে তোমার এত কল দেওয়ার কি দরকার ছিলো?”
“দরকারটা আমার ছিলো না, ছিলো রুশের। ও বারবার তোকে খুঁজছিলো। ব্যথায় বারবার কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। হাতটাও নাড়াতে পারছে না। আংকেল কোল থেকে একবার এই বেডে রাখে আবার ওই বেডে নেয়। এক্সরে করাতে যাও, আবার প্লাস্টারের জন্য যাও। এসবের ভয়ে ছেলেটা যে তার আপুকে খুব বেশি কাছে চাচ্ছিলো তাই কল দিয়েছিলাম।”
হিমেলের কথাটা শেষ হতেই লাবন্য হাউমাউ করে কেঁদে উঠল “সরি আম্মু, আমি রুশকে ভালোমতো দেখে রাখতে পারলাম না। আমি ব্যর্থ। তোমার দেওয়া দায়িত্ব আমি পালন করতে পারলাম না। আমি রুশের কষ্টের সময়টাতেও পাশে থাকতে পারলাম না।” কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো যখন বলছিলো তখন হিমেল এগিয়ে গিয়ে ওকে বুকে টেনে নিল। লাবন্য হিমেলের বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে লাগল অঝোরে।
“বোকার মতো কাঁদিস না, এখানে তোর কোনো দোষ নাই।সবই আমাদের ভাগ্য। ”
নানির ডাকে ওরা আবার কেবিনে ঢুকলো। নানি সবার জন্য খাবার বেড়েছে। প্লেট গুলো এগিয়ে দিয়ে জলদি করে খেয়ে নিতে। লিখন ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে বেশ শান্ত হয়েই এক পাশে বসল। হিমেল খাবারের প্লেটটা এগিয়ে দিল কোন কথা না বলেই। লিখনও চুপচাপ প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করল।
লাবন্যের ক্ষুধা লেগেছিলো তাই কোনদিক না তাকিয়ে চুপচাপ খেতে বসল। এখনকার কেন্টিনের খাবারই হাসপাতালের সবার খেতে হয়। বাহিরের খাবার ভেতরে আনা নিষেধ। খাবারের প্লেটটা হাতে নিতেই ওর চোখ ভিজে উঠল। খাবে কি, খাবার দেখেই ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে উপরে উঠতে লাগল। কয়েকবছর আগে দাদিকে নিয়ে এই হাসপাতালে ছিলো ওরা। প্রতিদিন এই সবজি, সালাদ আর ফ্রাই খেতে স্কুল থেকে বাসায় না গিয়ে ওর আব্বুর সাথে বায়না ধরে হাসপাতালে চলে আসতো। রেশমার অনেক বকা শুনতো তবুও আসত। লিখন তখনও সব কিছু উপেক্ষা করে মেয়ের জন্য এভাবেই প্যাকেট অর্ডার করতো। দাদিকে নিয়ে বাসায় ফিরার পর কয়েকদিন দাদিকে বলেছিলো “তুমি আবার অসুস্থ হও আমরা আবার তোমাকে ওখানে নিয়ে যাই। প্লিজ দাদি, প্লিজ। ওখানকার সবজি সালাদকে মিস করছি দাদি, তুমি কেন বোঝো না।”
ওর কথা শুনে ওর দাদি রেগে যেতেন। রেশমা কতদিন ওদের মতো করে বানিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে কিন্তু হুবুহু তেমনটা হয় না। দেখতে কেমন কাচা কাচা লাগে কিন্তু সেদ্ধটা হয় অসাধারন।রংগুলো থাকে অপরিবর্তিত। এমনটা বাসায় হয় না।
আজ হঠাৎ করেই সেই খাবারটা ওর সামনে। একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখল সবার জন্য কি খাবার। দেখল সবারটা নরমাল ভাত সবজি মুরগী। বুঝল ওর আব্বুই ওর জন্য আলাদা করে এই অর্ডার করেছে। কেন জানি আজ আর এই খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। প্লেটটা নামিয়ে রাখল। ওর চোখে পানি দেখে ওর নানি কিছু একটা আন্দাজ করলেন।আস্তে করে ইশারা করলেন খেয়ে নিতে। লাবন্য বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। ওর আব্বুর প্রতি রাগটা কোন ভাবেই কন্ট্রোল করতে পারে না। নানি দিনরাত এত কিছু বোঝান তবুও অবাধ্য মন মানতে চায় না। মনকে বলে “মেনে নে, খেয়ে নে। ”
মন উলটা উত্তর দেয় “মেয়ের প্রিয় খাবারটার কথা মনে আছে, কিন্তু মেয়ের নিরাপত্তার জন্য কি করা উচিৎ তা মনে থাকে না। যত্তসব ভন্ডামি।”
আবারও ওর নানির ধাক্কায় নড়ে উঠে লাবন্য। ইশারা পায় খাওয়ার জন্য। অবশেষে আস্তে আস্তে খাবার তুলে মুখে নেয়। দূরে বসে সবটাই খেয়াল করে লিখন। লাবন্য খাবার মুখে নিতেই ওর চোখজোড়া আবার ভিঁজে উঠে।
রাতে রুশের গায়ের টেম্পারেচার বেড়ে গেল। থার্মোমিটারে রিডিং দেখাচ্ছে ১০৩°F । কিন্তু ওর গায়ে হাত দিলে মনে হচ্ছে তারও বেশি। ওর জ্বর আসলে ও খুব বমি করে। ডাক্তার এসে দেখে গেলেন। সাপোজিটর দিতে বলে গেলেন। লাবন্য বারবার ভিজা রুমাল দিয়ে কপাল মুছিয়ে দিতে লাগল। লিখন বেড প্যানের মাধ্যমে ছেলেরে প্রসাব পায়খানা করালো একবার। ওর নানি মাথার পাশে বসে দোয়াদরুদ পড়ছেন আর বারবার ওর মাথায় ফু দিচ্ছেন। বিকেলে হিমেল বাসায় চলে গিয়েছিলো।
লাবন্য এতক্ষণ মনে মনে চেয়েছিলো ওর আব্বু চলে যাক, তাকে এখানে একদমই সহ্য হচ্ছিল না ওর। কিন্তু ওর নানি বারান্দায় নিয়ে বুঝিয়েছেন যে অসুস্থ ছেলের এটা হক ওর আব্বুর আদর ভালেবাসা পাওয়াটা। এটা থেকে লাবন্য চাইলেই রুশকে বঞ্চিত করতে পারে না। লাবন্য তাই আর কিছু বলে নাই ওর আব্বুর ব্যাপারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওর আব্বু ওদেরকে এভাবে একা রেখে যাতে না যায়। রুশের জ্বর আসলে ওর আম্মু দিনের বেলায় আর রাতে আব্বুই ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো। এখনও ও মনে মনে চায় ওর আব্বু রুশের পাশেই থাক। কারন লাবন্য রুশের পাশে থাকার পরও রুশ ওর আব্বুকেই শক্ত করে ধরে শুয়ে আছে। একটু সময়ের জন্যও ছাড়তে চাচ্ছে না। ঠিক আগের মতো করেই অধিকার খাটাচ্ছে ছেলেটা। যদিও মানুষটা আর আগের জায়গায় নাই বলেই লাবন্যের বিশ্বাস।
ওর আব্বু সাপোজিটার দিয়ে দেওয়ার এক ঘণ্টা পর জ্বরটা কিছু কমলো। কিন্তু গা তখনও কাঁপছিলো। ঠোঁটগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার। লাবন্য একটু পরপর গ্লুকোজ পানি চামচ দিয়ে তুলে ওর ঠোঁটদুটোকে ভিজিয়ে দিতে লাগল।
রাত দশটার দিকে আবার হিমেল আসল ওর নানুমনিকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাতে এখানে থাকার জন্য লাবন্যই থাকবে ওর আব্বুর সাথে। নানির শরীরের কথা চিন্তা করেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। নানি যাওয়ার আগে ওদেরকে খাওয়ায় দিয়ে গেলেন। রুশের জন্য স্যুপ রেখে গেলেন ফ্লাস্কের মধ্যে। লাবণ্য বলল রাতে ও আবার খাইয়ে দিবে। একবারে বেশি দেওয়া যাচ্ছে না। বমি বমি ফিলিং হচ্ছে কেবল ওর।
লাবন্য ওর আব্বুর সাথে কোন কথা বলছে না সেই প্রথম থেকেই। রুশের মাথা নেড়ে নেড়ে টুকটাক ওর সাথেই কথা বলতে লাগল। কিন্তু খেয়াল করল বারবার ওর আব্বুর মোবাইলে লাইট জ্বলে উঠছে। মোবাইলটা সাইলেন্টে আছে তাতেই রক্ষা। নইলে রিংটোনের শব্দে আর থাকতে হতো না এতক্ষণ ।
ওর আব্বু বারবার ইগনোর করছিলো কলগুলো। কিন্তু এবার কলটা রিসিভ করে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। লাবন্য এসব বিষয় এখন আর গায়ে মাখছে না। বলুক কথা যার সাথে খুশি তার সাথে। সে এখন আর ওদের নাই তা ও ঠিকই বুঝে নিয়েছে। মনকে বোঝাতে বোঝাতে দেখল রুশ ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজেও খুব ক্লান্ত ছিল বিধায় রুশের পাশেই মাথাটা হেলিয়ে শুয়ে পড়ল। একটা সময় ঘুমিয়েই গেল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন রুশ খুব জোরে জোরে বমি করছে। ওর আব্বু ওয়াসরুম থেকে মগ ভরে পানি নিয়ে আসল রুশের সামনে। আর রুশ একাই বসে বসে বমি করছে সামনে রাখা বোলের মধ্যে। ধরিমরি করে উঠে ভাইকে ধরল লাবন্য । ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল বমি করতে। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। গায়ে আবারও তাপমাত্রা বাড়ছে। হঠাৎ কি হল লাবন্য কেমন রেগে উঠল
“তুমি ওকে একা রেখে ওয়াসরুমে গেছো কেন? ও যদি বমি করতে করতে বেড থেকে পড়ে যেতো?”
“ওর মুখে একটু পানি দিতে হবে তাই পানি আনতে গিয়েছিলাম। ”
“তাহলে আমাকে ডাকো নাই কেন? আমি আছি কি করতে? আমাকে দেখো নাই?”
“তুই অনেক ক্লান্ত ছিলি। ঘুমিয়েছিসও বেশি সময় হয় নাই, ভাবলাম তোর কষ্ট হবে তাই ডাকিনি।”
“তুমি শুধু ভাবতেই থাকো। নিজ মনমতো ভেবে ভেবে যা মনচায় তা করো। তোমারতো আর কোন ক্ষতি হয় না। যা হওয়ার হয়তো শুধু আমাদের। আমাদের নিয়ে ভবনাগুলো এবার বন্ধ কর।” ভালোমন্দ জ্ঞান হারিয়ে একদমে চিৎকার করে বলে উঠল লাবন্য।
“আপু প্লিজ, চুপ থাকো। আব্বুকে কিছু বলো না। তাহলে আব্বু আবার চলে যাবে আমাদেরকে ছেড়ে। প্লিজ আপু প্লিজ, তুমি থামো।” রুশ বেশ কাতর স্বরে বলে উঠল।
রুশের কথায় লাবন্য পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। নিজের রাগ, দুঃখ কষ্ট সবকিছু এক নিমিষেই মাটি হয়ে গেল অসুস্থ ভাইয়ের কথায়। ছোট্ট রুশ যে এখনও ওর আব্বুকে সেই আগেরমতো করেই কাছে চায় তা মুহুর্তেই উপলব্ধি করল লাবন্য।
চলবে।