#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ( পর্ব ৪৭)
সায়লা সুলতানা লাকী
বৃহস্পতিবার রাতে লিখন বাসায় ফিরল দুই হাত ভরে বাজার নিয়ে। লাবন্যের নানিই ওকে আশ্বস্ত করেছেন যে নাজমুল সাহেব আসবেন বিয়ে বিষয়ক কথা বলতে। বিষয়টা জানার পর থেকে ওর মনের মধ্যে মিশ্র একটা প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। এমন দিনকে সামনে রেখে ওর আর রেশমার মধ্যে কত রকম স্বপ্ন পরিকল্পনা ছিল একটা সময় ।কত কত সময় ওরা পার করেছে একসাথে এই দিনগুলোর কথা ভেবে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে উত্তেজনাটা অবশ্য লিখনের চেয়ে রেশমারই বেশি ছিল। তাইতো হাতে টাকা জমলেই মেয়ের জন্য গহনা বানিয়ে রাখতো। ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে গহনায় মুড়িয়ে বৌ সাজাবে। নিজের ভাগ্যে বৌ সাজটা ছিলো না। কোনো রকমের একটা উড়না মাথায় দিয়ে কবুল বলে রেজিস্ট্রার খাতায় সাক্ষর দিয়েছিলো সেদিন। মেয়েকে বৌ বেশে দেখে নিজের মনের স্বাদ মেটানোর বড় ইচ্ছে ছিলো ওর। তখন অবশ্য লিখনও হাসতো আর বলতো মেয়ের পাশাপাশি তুমিও বৌ সেজে এসো, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব তোমাকে তখন। ওর কথা শোনার সাথে সাথেই রেশমা রেগে যেতো , বলতো “তোমার কি বিবেক বুদ্ধি সব নষ্ট হয়ে গেছে? মেয়ের বিয়ের দিন আমিও বৌ সাজবো? সেদিন আমার মনের অবস্থা কি হবে তা কি একবার ভেবে দেখেছো? একজন মায়ের জন্য দিনটা কতটা সুখের তা সবাই জানে কিন্তু কতটা প্যাথেটিক তা অনুমানও করতে পারে না কেউ । ” কথাটা শেষ করেই কেঁদে ফেলেতো ।
লিখনের আজ সেসব স্মৃতিগুলো ঘুরে ঘুরেই মনে পড়ছে। আর ওকে আরও বেশি ইমোশনাল করে তুলছে। আজ সারাদিন ও কাকে কাকে যে কল দিয়ে কথা বলেছে তা ও নিজেও মনে হয় না খেয়াল করেছে। মনে যা ভালো লেগেছে তাই কিনে এনেছে আগামীকালের জন্য। ভেতরের উত্তেজনাকে কোনোভাবেই সামাল দিতে পারছে না।
এদিকে লাবন্যের নানি সারাদিন লিখনের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসে আজ তাও আসে নাই তাতে তার চিন্তাটা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছিলো। মেহমানদারী নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা নাই, তার চিন্তা ছিলো এমন দিনে মেয়েটা ওর বাবাকে কাছে পাবেতো? মা নেই কিন্তু মাথার উপর বাবার ছায়াটাও যদি না থাকে তবে যে ওর মন আরও বেশি খারাপ হয়ে যাবে।এমনিতেই মেয়েটা বড় অভিমানী। রাতে যখন লিখনকে বাজার সমেত আসতে দেখলেন তখন ভেতর থেকে শান্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। মনকে স্থির করলেন যে, না লাবুর বাবার সব কিছু মনে আছে। রাতের খাবার ততক্ষণে তারা খেয়ে নিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখলেন তাসলিমা টেবিলে খাবার দিচ্ছে আবার। বিষয়টা জানতে সামনে আসতেই দেখলেন লিখন স্লিপিং ড্রেস পরে খেতে বসেছে। দেখেই বুঝলেন ও আর আজ কোথাও যাবে না, এই বাসাতেই থাকবে রাতে। মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। ডাইনিংএ তাকে দেখে লিখন বলে উঠল
“আম্মা এখনও জেগে আছেন? আমি ভেবেছি ঘুমিয়ে পড়েছেন তাই আর ডাকিনি। বাজার এনেছি একটু দেখে জানিয়েন কিছু বাকি রইল কি না?”
“বাজারের দরকার ছিলো না, তুমি থাকলেই হবে। বাচ্চাদের শুধু তাদের বাবার সঙ্গটা দরকার। আর কিছু না।”
“আম্মা আমি কোনো কমতি রাখতে চাই না….”
“এখন আর কোনো কমতি নাই।”
“ভুল বললেন আম্মা, রেশমার কমতি আমাদের জীবনে সবসময় থেকেই যাবে।”
“তুমিও ভুল বললে, তোমার জীবনে রেশমার জায়গাটা ভরাট হয়ে গেছে। তুমি কোনো কমতিতে নেই। বাদ দাও এসব কথা, খাও।” কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না, সোজা লাবন্যের রুমের দিকে চলে গেলেন। লিখন কোন উত্তর দিলো না, চুপচাপ বসে রইল টেবিলে।
“কিরে কি করিস? এই রাতে মেহেদী পরছিস হাতে? ঘুমাস নাই?” নানি একটু এগিয়ে এসে পাশে বসল লাবন্যের।
“জি না নানিজান, ঘুম আসে না তাই শখ করে মেহেদী পরছি হাতে। আগামীকাল আমার জীবনের জন্য একটা বিশেষ দিন কি না তাই একটু হাতটাকে সাজাচ্ছি। এক কথায় বলতে পারো… ”
“উফফ চুপ থাকতো! কত খুশি! একেবারে…
“একেবারে উছলায়ে পড়ছে, বুঝলা তুমি?” কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল লাবন্য।
“দুষ্টমি ছাড় এবার। একটু বোঝ জ্ঞান রেখে কথা বলতে শিখ।”
“উফফ তুমি যে কি না নানি একেবারে রস বিহীন মানুষ একজন। আগামীকাল আমাদের বাসায় আমার বিয়ে নিয়ে কথা হবে। জানো এই দিন নিয়ে আম্মু কত এক্সাইটেড ছিলো? আম্মুতো পুরাই বোকা ছিল, আমার কোনো একদিন বিয়ে হবে, আমি শ্বশুর বাড়ি চলে যাব তা ভেবেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করতো।আর তা নিয়ে দাদি রাগারাগি করত। দাদি বলতো “মাইয়্যা বিয়া দিও না, সারাজীবন আইবুড়ি কইরা কাঁধে ঝুলাইয়া রাখো। কোনদিন না কোনদিন বিয়া দিব আর এখন সেই দুঃখে কাঁদে, এমন পাগল দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আর একটাও নাই।”
“ওর মনটা অনেক নরম ছিলো। অল্পতেই গলে যেত। ”
“আমার কি মনে হয় জানো নানি! আম্মু এখন থাকবে না তাই হয়তো সেই সময়তেই কেঁদে নিয়েছিল আমার বিয়ে নিয়ে। আম্মু আগেই বুঝতে পেরেছিল এমন ইম্পর্ট্যান্ট সময়েই তিনি থাকবেন না আমার পাশে। তাইতো নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারতো না।”
“এসব কি কথা? মনগড়া কথা বলিস না। এখন এসব কথা থাক। ”
“কীভাবে রাখবো, আজ যে আরও বেশি আম্মুকে মনে পড়ছে। আজ আম্মু থাকলে কত খুশি হত। কত কি করতো আমার জন্য। ”
“কি করতো বল, আমি করি…”
“তুমিতো করছোই। আমাকে সঙ্গ দিচ্ছো।”
“রেশমার বিয়ে নিয়ে আমারও অনেক ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু তা পূরণ করতে পারি নাই।”
“ইন্না-লিল্লাহ, আমি আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভুলেও কোন স্বপ্ন দেখব না। ভালো করেছো তোমার কথা বলে। শিক্ষা নিলাম, ধন্যবাদ বস। নো স্বপ্ন টপ্ন।”
“এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব বদমাশ। এভাবে কেউ বলে? স্বপ্ন বলে কয়ে কেউ দেখে না এই স্বপ্ন এমনি এমনিই আসে। তুই….”
“প্লিজ নানি এবার আমি বলছি বাদ দাও এই টপিক। এখন মনটাকে রাঙাতে ইচ্ছে করছে, কষ্টের নীলে ঢাকতে চাই না। দেখো না মেহেদীর রঙে হাত রাঙাইতেছি।”
“দেখি কি দিলি?”
“দেখো, দোখো, তোমার হিমু দেখলেই ফিদা হয়ে যাবে।”
“হুমম সুন্দর। ”
“দাও তোমাকেও দিয়ে দিই।”
“আমার এত শখ নাই। ”
“আরে তুমি নানু শাশুড়ি হবে তোমার আবার শখ নাই মানে ….”
“থাম, আমি আরও দুজনের নানি শাশুড়ি হয়েছি অনেক আগেই ।”
“তাতে কি? ওই দুইজন তোমাকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু তোমার ছোট নাতনি জামাই দেখো তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচবে। কি আদর যত্ন করবে তা শুধু দেখো।”
“তাই নাকি? তেমনটা বলেছে নাকি সে?”
“বলবে কেন, আমি জানি না বুঝি? ওকে আমি ঠিক চিনি। ও আমার ভালোবাসার মানুষগুলোর যত্ন নিবে পুরোপুরি। একটুও অবহেলা করবে না।”
“এতটা বিশ্বাস? ”
“হুমম, যাকে মন প্রান দিয়ে ভালোবাসি তাকে বিশ্বাস করবো নাতো কাকে করবো? আম্মুর উপর একটা সময় খুব রাগ হতাম যখন ভাবতাম আম্মু একটা অজানা অচেনা ছেলেকে ভালোবেসে নিজের বাবা মা পরিবার ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। ওই ছেলে কি নিজের পরিবার আর বাবা মায়ের চেয়ে বেশি হয় গেলো? খুব রাগ করতাম আম্মুর সাথে প্রশ্ন করতাম কেন এমনটা করে ছিলো? আম্মু বলতো এর কোন উত্তর তার কাছে নাই। এখন নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেই। খালামনি তাদের বাসায় একদিন আমাকে অনেক অনেক বাজে কথা বলেছিলো আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। ভেবেছিলাম আর না, এই সম্পর্ককে আর টানবো না। এটাকে এখানেই ক্লোজ করবো। কিন্তু কেনোজানি তা করতে পারিনি। একটু একটু করে আরও জড়িয়ে পড়েছি।আবার যখন আব্বু বিয়ে করল তখন ভালোবাসার উপরই বিশ্বাস উঠে গেল। মনে হলো পুুরষদের ভালোবাসা বলে কিছু নেই যা আছে তা শুধু প্রয়োজন। যে তার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম তখন কেবল তারই আরাধনা করে পুরুষ । যখন মেটাতে পারে না তখন অন্যপাত্র খোঁজে প্রয়োজন মেটাতে। মনে হল হিমেলও ঠিক এমনটাই করবে আমার ভালোবাসার সাথে।মনকে শক্ত করতে চাইলাম, আর কাউকে ভালোবাসার নামে বিশ্বাস করব না। কিন্তু দেখো এবারও পারলাম না। হেরে গেলাম ভালোবাসার কাছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয় তাই সে এর বাহিরে আর কিছু ভাবতে পারে না। আম্মু বেঁচে থাকলে আম্মুকে বলতাম যে প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে ছিলো না, আমি সেই উত্তরটা খুঁজে পেয়েছি। আম্মু তার ভালোবাসাকে হারাতে চায়নি। আম্মু তখন অন্ধ ছিলো তাই তোমাদের বিষয়টা খেয়াল করতে পারেনি।”
“দোষ আমাদেরও ছিলো, আমরাও আমাদের সন্তানের মনকে বুঝিনি, ওর কাছে যেতে পারিনি। আমাদের সাথে ওর দূরত্বটাকে খেয়াল করিনি।”
“কি একটা অবস্থা তাই না? আমরা কোনো সমস্যা সময় মতো বুঝি না। যখন বুঝি তখন সব শেষ।”
“তাতে কি? সব সমস্যাই কিছু না কিছু শিক্ষা রেখে যায়। যা থেকে সামনে যেনো একই ভুল আর দ্বিতীয়বার না হয় তার জন্য সতর্কতা বার্তা দিয়ে যায়। তাই বা কম কিসের? ”
“হুমম ঠিকই বলছো। আমি আমার মেয়েকে…”
“ইশশ,একটুতো শরম কর, বিয়ে না হতেই মেয়ে মেয়ে শুরু করেছিস। বিয়েটতো আগে হতে দে।”
“হায় আল্লাহ! এখন কি করলা নানি? আমার যে এখন শুধু লজ্জা লজ্জা লাগছে। ইশশ এত লজ্জা এখন কোথায় রাখি। প্লিজ নানি একটু উপকার কর একমুঠ লজ্জা একটু তোমার কাছে রাখো না!” কথাটা শেষ করেই খিলখিল করে হেসে উঠল লাবন্য ।
“ওরে নির্লজ্জ একটু আস্তে হাস, বাহিরে তোর বাপ খেতে বসেছে। শুনলে বলবে মেয়েটা বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে।”
“আব্বু এসেছে? আমি জানতাম আব্বু আসবে। এই টেবিলে বসে দুজন কত কি পরিকল্পনা করতো আমার বিয়ে নিয়ে। কি মিষ্টিসুরে গুটুর গুটর করতো দুজন! প্রায় সময় আমি আড়ি পাততাম তাদের প্রেমালাপ শুনতে।”
“কী?”
“হুমম, জানোইতো আমি নির্লজ্জ। শুনতাম আর একটু একটু করে ভালোবাসতে শিখতাম। আব্বু যখন বিয়ে করে আসল আমার মনে হল এই টেবিলে বসে আম্মুর জায়গায় অন্য কেউ…… ”
“চুপ,চুপ,চুপ একদম চুপ। অতিরিক্ত কথা বলিস তুই। এত কথা বলা বন্ধ কর। হাত ধুয়ে শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে। সকাল সকাল উঠতে হবে। কাল অনেক কাজ আছে। আমিও যাই ঘুমাই।” বলেই নানি উঠে রুম থেকে বের হয়ে এলেন।
চলবে