# যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
# পর্ব ১৮
“বাসায় আসতে পারবে এখন? জরুরি।”
মরিয়মের ম্যাসেজ পেয়ে শিহাব কল করে, কিন্তু মরিয়ম ঠিক করেছে সরাসরি কথা বলবে, ফোনে না। তাই ফোন শিহাবকে বলে, দোকানে সমস্যা না হলে এখনি বাসায় আসতে বলে, জরুরি কথা আছে।
মরিয়ম আজ আর পাশের রুমে যায় না, রুমনের পাশে ঠায় বসে থাকে। ওর খুব ইচ্ছে করছে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে একটু শুয়ে থাকতে। কিন্তু রুমন আর দশজনের মতো না, হঠাৎ আলিঙ্গনে ও সহজ হতে পারে না। ওর অনুমতি নিয়ে ওকে ধরতে হয়, কখনো কখনো ও নিজেই ওকে জড়িয়ে ধরতে বলে। তবে হুটহাট কেউ গায়ে হাত দিলে রুমন বেশ বিরক্ত হয়। তীব্র আলো, উচ্চস্বরের গান, হঠাৎ আলিঙ্গন এই সবকিছুই ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মরিয়মকে শাশুড়ি মা কয়েকবার ডেকে শুতে বলেছেন, কিন্তু মরিয়ম বলেছে ও রুমনের পাশেই থাকবে এখন, শোবে না। শাশুড়ি অবাক হয়েছেন, হঠাৎ কী হলো মরিয়মের।
“মরিয়ম, রুমন উঠলে তখন মন চাইলে ওর সাথে থাকবা। এখন শুধু শুধু বসে আছ কেন? এই না বললা শরীর খারাপ?”
“শিহাব আসবে মা, ওর জন্য অপেক্ষা করি। ও আসলে রেস্ট নেব।”
“শিহাব মাত্র না গেল দোকানে! দুই ঘন্টাও হয়নি, এখন বাসায় আসবে কেন?”
“একটা দরকারে আছে মা।”
“ডাক্তারের ডেট আজ? আমি তো ভাবছি মাসের শেষে ডেট।”
মরিয়ম জবাব দেওয়ার আগেই বেল বাজে। মরিয়মের শাশুড়ি রাবেয়া বেগম দরজা খুলতে যান। মরিয়ম ঔষধের বক্সটা নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। কলিংবেলের শব্দে রুমনও নড়েচড়ে ওঠে।
শিহাব রুমে ঢুকলে মরিয়ম দরজাটা লাগিয়ে দেয়, আপাততঃ শাশুড়ি মায়ের কানে কোন কথা যাক তা চায় না মরিয়ম।
“মরিয়ম এত জরুরি তলব? কিছু হয়েছে?”
“রুমনকে রোজ ঘুমের ঔষধ তুমি দিচ্ছ?
“রোজ ঘুমের ঔষধ! কী বলো? দুপুরে আমি ভাত খাওয়ানোর পর তো কোন ঔষধ দেই না। ওর ঔষধ তো এখন শুধু রাতে একটা। হ্যাঁ একদিন খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিল তোমার জন্য, শান্ত করতে পারছিলাম না। ঐ যে তুমি আলট্রা করতে গেলে, সেদিন আম্মা বললো ঘুমের ঔষধ হাফ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।”
“আর তুমি ওকে ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলে?”
“আমি ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছিলাম। স্যার বললেন মাঝেমাঝে ও খুব রেস্টলেস থাকলে, বা একদম ঘুমাতে না চাইলে ঔষধ দিতে পারব।”
“তাই বলে রোজ রোজ ঘুমের ঔষধ দিবা? টানা ঘুমের ঔষধের সাইড এফেক্ট হতে পারে জানো না? এই ঔষধের উপর ওর একটা ডিপেন্ডেন্সি চলে আসবে, ঔষধ ছাড়া ও ঘুমাতে পারবে না, সারাক্ষণ অবসাদে ভুগবে, ঝিমুনি হবে, পানির তৃষ্ণা চলে গিয়ে ডিহাইড্রেশনে ভুগবে। সবচেয়ে বড় কথা ঘুমের ঔষধে ওর এডিকশন হয়ে যাবে। তোমার কাছে এই অবহেলা আশা করিনি।”
“মরিয়ম, আমি না হয় ডাক্তার না, কিন্তু বাচ্চার বাবা তো তাই না? এগারো বছরে আমি কখনো রুমনকে অবহেলা করেছি, না ওর জন্য কোন ক্ষতিকর কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাতের পর রাত যখন রুমন ঘুমাতো না, সুর করে কাঁদত, তখন তোমার সাথে আমিও তোমার সাথে রাত জেগেছি। কখনো বলিনি ওকে সিরাপ খাইয়ে ঘুম পাড়াও। যদিও তখন এই ধরনের পরামর্শ কম পাইনি। তাহলে এখন এতদিন পর কেন বিরক্তি দেখাব? আরেকজন সন্তান আসছে বলে?”
মরিয়ম ঔষধের বক্স খুলে দেখায়, একপাতায় দশটা ঔষধের চারটা শেষ, একটার হাফ আছে। শিহাবও অবাক না হয়ে পারে না। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দ হয়, কেউ কিছু আছড়ে ফেলেছে যেন। দ্রুত দরজা খুলে বের হয় মরিয়ম আর শিহাব, আওয়াজ এসেছে রুমনের রুম থেকে।
“কেন আম্মু যাব না? কেন যাব না? কেন যাব না?”
রুমন একের পর এক জিনিস আছড়ে ফেলছে, মরিয়মের শাশুড়ি রুমের একপাশে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আতংকে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে।
মরিয়ম আর শিহাব রুমনকে জড়িয়ে ধরে, ওর নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলার আগেই থামাতে হবে, রীতিমতো কাঁপছে রুমন।
“এই যে আম্মু বাবা। এই যে আম্মু। তুমি শান্ত হও বাবা। এই যে আম্মু।”
অনেক কষ্টে রুমন শান্ত হয়েছে। বারবার মায়ের কাছে যেতে বাঁধা পাওয়ায় ওর মনে অভিমান বাসা বেঁধেছে, তারউপর এখন নিয়মিত কাউন্সিলিংও হয় না, ওর দিক হতে সবার মনোযোগ সরে যাওয়াটা বেশ প্রভাবিত করেছে রুমনকে। রুমনকে শান্ত করে শুইয়ে দিয়ে যখন বসার ঘরে আসে মরিয়ম আর শিহাব, ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টা ছুঁয়েছে। শিহাবের বেন আর দুলাভাইও এসেছেন। ওনাদের শিহাব বা মরিয়ম ডাকেনি, বোধহয় রুমনের দাদীমার কান্না ফোনে শুনে তারা ছুটে এসেছে। শিহাব আর মরিয়ম যে ওনার উপর প্রচন্ড রাগ করেছে তিনি তা বুঝতে পেরেছেন। ওনার ধারণা ছিল ঘুমের ঔষধ অর্ধেক করে খাওয়ালে কোন ক্ষতি নেই, রুমন রোজ বিকেলে ঘুমাবে, মরিয়মও তাহলে ওর পেছন পেছন দৌঁড়াবে না।
“আম্মা আপনি কাজটা ভুল করেছেন। এভাবে ঘুম পাড়ানোর বুদ্ধি আপনার মাথায় আসলো কিভাবে? এই আপনি তো কোনদিন আগে এত বিরক্ত হননি রুমনের উপর। এখন এমন কী হলো যে ওকে আপনি দুপুরে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন?”
শিহাব যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে মাকে প্রশ্ন করে। জাহানারা বেগম বুঝতে পারছেন সবার চোখে তিনি অপরাধী হয়ে গিয়েছেন, ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে, কেন তিনিএমন করলেন। ওনার মেয়েও মায়ের এই কাজে ভীষণ অবাক হয়েছে। মরিয়ম কিছুই বলছে না। একটানা অনেকক্ষণ রুমনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে, এখন প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগছে। কিন্তু সবার সামনে বসে এই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আসলে মরিয়মের কিছুই ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়া ভুল হয়েছে। এখনি এসব হচ্ছে, আরেকজন এই দুনিয়ায় আসলে যদি পরিবারের সবাই এভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়, রুমনকে নিয়ে মরিয়ম কী করবে! সে ও কি আর সবার মতো রুমনের উপর থেকে মমতার আঁচল সরিয়ে নেবে!