যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব২২ +২৩
“আপু কেমন আছ? আমার উপর মনে কষ্ট আছে এখনো?”
“রুমি, থাক না পুরানো কথা বাদ দাও। মন খারাপ তো তোমারও হয়েছে, সব ভুলে তুমি যে আমাকে দেখতে এসেছ এতে যে আমি কী খুশি হয়েছি।”
“আপু আরও আগে আসতাম, লজ্জা লাগতো, মনে হতো কত অবুঝের মতো আচরণ করেছি। অথচ এটাই স্বাভাবিক, হঠাৎ রাত বারোটায় একটা মেয়ে বাচ্চা নিয়ে আসতে চাইলে রাজি হওয়া সহজ না। বিশেষ করে যখন তুমি নিজে শ্বশুর বাড়ি আছে, বাচ্চা স্বামী নিয়ে নিজেও নানা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। আসলে ঐ সময় তুমি ছাড়া আর কারও কথা মাথায় আসেনি।”
“রুমি, আমি সেদিন আসলে খুব নাজুক অবস্থায় ছিলাম। তুমি তো জানো রুমনকে নিয়ে আমি কতটা পসেসিভ। এত বছর আরেকটা বাবু নেইনি শুধু এই ভয়ে যে রুমনকে অবহেলা না করা হয়, আর ওকে সময় যদি দিতে বা পারি। সেই আমি একদম হঠাৎ করে এই বয়সে আরেকটা প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পারি সেইদিন।”
“আপু আসলে ভালোই হয়েছে সেদিন রাগ করে বের হইনি। এটা আসলে কোন সমাধান না। আমাদের সমাজে একা মেয়ের নিরাপত্তা কই? তোমার জায়গায় আমি থাকলে আমিও না ই করতাম। তখন এতটা ক্লান্ত আর বিধস্ত ছিলাম যে পুরো পৃথিবীটা নিজের বিরুদ্ধে মনে হচ্ছিল। বরং এখন বাসার পরিবেশও অনেকটা ভালো। রশ্মির বিয়ে নিয়ে সবাই আনন্দে আছে। আদিল অবশেষে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছে। আমার প্রমোশন হয়েছে। কয়েকমাসে অনেকগুলো ভালো খবর পেয়ে আব্বা আম্মাও অনেক খুশি। আব্বা তিতলিকে অনেক সময় দেয়। স্কুলে দেব সামনে, নিজ থেকেই বলেছেন তিনি আনা নেওয়া করবেন। ভেবে দেখ পরিবার থেকে রাগ করে বের হয়ে গেলে কী সব ভালো হতো! হতো না, ভাই বোনের সাথে আরও দূরত্ব হতো।”
“আলহামদুলিল্লাহ রুমি সব শুনে খুব ভালো লাগছে। তোমার কোর্সও শেষের দিকে। দেখবে সামনে সব আরও ভালো হবে।”
“আপু তোমার কথা বলো। বাসায় সবাই তো অনেক খুশি তাই না? বিশেষ করে আন্টি। শরীর কেমন?”
হ্যাঁ খুশি। কিন্তু এই খুশিটাই আমার চিন্তার কারণ হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে আমার ভয় হয়। একদিকে আমার শাশুড়ি নতুন বাবুর আগমনে এত খুশি যে রুমনকেই এখন আর আগের চোখে দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো আমার মনের ভুল, কিন্তু তিনি রুমনকে অসম্পূর্ণ ভাবেন।প্রতিমুহূর্তে একটা চাপা দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়ে গিয়েছি আমরা দু’জন। আর শিহাব দু’জনের দ্বন্দ্বের মাঝে হাসফাস করছে।”
আরও অনেক অনেক কথা হয় রুমি আর মরিয়মের। এত দিনের জমানো কথার ফুলঝুরি ছুটেছে যেন। রুমি আজ বিকেলটা মরিয়মের সাথে কাটাবে বলে সকালে অফিস যায়নি। একবারে দুপুরে বের হয়েছে যেন অনেকটা সময় একসাথে গল্প করতে পারে। তাদের গল্পের মাঝে রুমির, “হ্যালো, হ্যাঁ আছি ভালো।
আজ মরিয়ম আপুর বাসায় এসেছি।
না সকালে আসিনি, দুপুরে এসেছি।
ছুটি নিলাম কারণ একটানা এতক্ষণ বাসার বাইরে থাকলে আম্মার কষ্ট হয়ে যায়।
আরে এক ঘন্টায় কী গল্প হয়! হ্যাঁ সন্ধ্যা হওয়ার আগে চলে যাব।”
রুমি ফোন রাখলে মরিয়মকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে।
“রুমি কিছু একটা কথা তুমি আমাকে বলতে এত কষ্ট করে এখানে এসেছ তাই না? আমার সাথে কিছু শেয়ার করতে চাও। যে ফোন দিয়েছে সে বিশেষ কেউ?”
মরিয়মের কথা রুমি ইতস্তত করে, কিভাবে কথা শুরু করবে জানে না। আসলেও মরিয়ম আপুকে সে অসম্ভব মিস করছিল, মনে হচ্ছিল একমাত্র আপু ওর মনের অবস্থা বুঝবে।
“আপু, আমি তোমাকে দেখতেই এসেছি। তবে হ্যাঁ আমি মিথ্যা বলবো না, কিছু কথা তোমার সাথে শেয়ার করার জন্য তর সইছে না। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভরসা করতে পারি না আপু।”
মরিয়ম শুরু থেকেই মন দিয়ে রুমির কথা শোনে। এরমাঝে রুমনকে বিকেলের নাস্তা দেয়। রুমির ফোন আরও দুবার আসে, রুমির মাঝে বাসায় যাওয়ার তাড়া দেখতে পায় মরিয়ম। রুমনকে পড়তে বসিয়ে দিয়ে চা বানায় মরিয়ম, দুই মগ চা নিয়ে রুমি আর মরিয়ম বারান্দায় বসে। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়াটা বেশ ভালো, ঠান্ডা একটা বাতাস শরীর জুড়িয়ে দেয়।
“রুমি, তুমি উঠে যাওয়ার জন্য উসখুস কেন করছো? তুমি বাসায় বলে এসেছ সন্ধ্যায় যাবে তাই না? তাহলে পাঁচটা না বাজতে চলে যেতে চাওয়ার কারণ কী ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষ টা? এটাকে তুমি কী ভাবে দেখছ? কেয়ার না ডমিনেশন?”
“আপু আসলে হাসান বারবার বলছে সন্ধ্যা না করতে। তাই ফোন দিয়ে দেখছে বের হলাম কিনা।”
“এটা তোমার কেমন লাগছে তাই তো জিজ্ঞেস করলাম। তুমি কী ওর এই আচরণকে ভালোবাসা রূপে দেখছ? আমরা যখন কারও আচরণে ভালোবাসা খুঁজে পাই, তখন এই বিষয়গুলোকে খেয়াল রাখা ভাবি। কিন্তু বিষয়টা যখন নিয়ন্ত্রণ করার মনোভাব মনে হয় তখন মুগ্ধতার রেশ কেটে যেতে সময় লাগে না। এই যে তুমি কখন আসলে, কখন যাবে, কোথায় আছে, কার সাথে আছ এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা কী কৌতুহল মনে হয় তোমার, না হাসানের সন্দেহ মনে হয়? মাঝে একবার ভিডিও কল দিয়েছে দেখলাম। ও যদি তোমাকে নিয়ে এতটা চিন্তা করে থাকে, তাহলে সবার সামনে গ্রহণ করতে পিছিয়ে যাচ্ছে কেন? রুমি তুমি যথেষ্ট পোড় খাওয়া মেয়ে। একজন মানসিক সঙ্গ দেওয়ার সঙ্গী শক্ত মনের মানুষটারও লাগে। তবে পোড়া মনের মলম যাকে ভাবছ সে কী মলম না এসিড তা তোমাকেই বুঝতে হবে।”
যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ২৩
রাকিন বারবার চশমাটা ঠিক করার বাহানায় রুমিকে দেখে নিচ্ছে। কী মিষ্টি লাগছে রুমিকে, গোলাপি জামদানীর সাথে হালকা সোনার গয়না, আর মাথার হাত খোঁপায় সাদা বেলীফুল। মুখে যতটুকু প্রসাধনী না হলেই নয়, চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক, দুই হাত ভর্তি একরাশ কাঁচের চুড়ি। সবমিলিয়ে চমৎকার।
আজ রুমির ছোটবোন রশ্মির বিয়ে। রৌশন আপা ছাড়া রুমির কলিগরা মোটামুটি সবাই এসেছেন। রুমি বাবা মায়ের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেয়। হাসান বেশ আগ্রহ নিয়ে রুমির বাড়ির সবার সাথে কথা বলে। রুমির ছোটভাই আদিলের সাথেও পরিচিত হয়। রাকিন বরাবরই চাপা স্বভাবের, কুশল বিনিময় ছাড়া তেমন কিছু তার মুখ দিয়ে বের হয় না। কয়েকবার রুমির সামনে এসে ভেবেছে দুটো প্রশংসার কথা বলবে। কিন্তু গলা শুকিয়ে যায়। তারচেয়ে বরং তিতলির সাথে মেশা রাকিনের জন্য সহজ হয়।
আড় চোখে বারবার রুমিকে দেখতে দেখতে রাকিনের মনে হচ্ছে কতদিন বিয়ে বাড়িতে এত স্নিগ্ধ সুন্দর সাজে কাউকে দেখে না। ইদানীং বিয়ে বাড়িতে আসা প্রত্যেক মেয়ের একই রকম পার্লারের চড়া সাজের প্রলেপ, সেট করা চুল, আর ভারী গয়নার বাহার দেখতে দেখতে কেমন একঘেয়ে লাগে। বৌর সাথে সাথে বাড়ির অন্য মেয়েরাও ব্রাইডাল সাজে ঘুরে বেড়ায়। টিকলি, নোলক আর লেহেঙ্গার ভীরে কে যে কনে, কে যে কনের বোন, তা বোঝা দায়। রুমি তিতলিকেও সুন্দর একটা ফ্রক পরিয়েছে। রাকিনের সাথে তিতলি বেশ মিশে গিয়েছে, এখন রুমির কলিগদের ভীরে তিতলি রাকিনের কোলেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“মরিয়ম আপু, তুমি এসেছ, এত এত খুশি হয়েছি। আর শিহাব ভাইয়া আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ আপুকে নিয়ে এসেছেন।”
“রুমি তুমি নিজে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছ, না এসে পারি। তবে বেশিক্ষণ থাকব না। রুমনকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর দাদু আর ফুপির কাছে রেখে এসেছি।”
“ওকেও নিয়ে আসতেন আপু। ওর এখানে কোন সমস্যা হতো না, আমি খেয়াল রাখতাম।”
“জানি রুমি। তবে ইচ্ছে করেই আনিনি, এত লোকের ভীর ও পছন্দ করে না। থাক বাদ দাও, তোমার কথা বলো, এত সুন্দর লাগছে, আজ অনেকের নজর ঘুরে ঘুরে তোমার দিকেই আটকে যাচ্ছে।”
“আর নজর আটকানো আপু। যখন আমার সাথে তিতলির কথা শুনবে, নজর ঘুরতে সময় লাগবে না। এই দায়িত্ব সবাই নিতে পারে না।”
মরিয়ম ঘুরে একবার হাসান, আরেকবার রাকিনকে দেখে। হাসান আড্ডায় ব্যস্ত। রাকিন একপাশে বসে তিতলিকে জিলাপি খাওয়াচ্ছে।
“রাকিনকে দেখ। এমনি মুখচোরা, কিন্তু তিতলির সাথে কেমন মিশে গেল।”
“হ্যাঁ আপু, আমিও অবাক।”
সময় গড়িয়ে যায়, বিয়ের আয়োজন ভালো ভাবেই শেষ হয়। কলিগরা একে একে সবাই বিদায় নেয়। হাসানও রুমির কাছে বিদায় নিতে আসে। “রুমি তোমাকে কিন্তু আজ একদম একদম গোলাপি পরী লাগছে।” সেই একই রকম হৃদয় মোচড় দেওয়া মিষ্টি হেসে বলে হাসান।
রুমির মনে অনেক প্রশ্ন আছে, যা সে মরিয়ম আপার বাসা থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, আর রশ্মির বিয়ে শেষে যার জবাব খুঁজবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে হাসানের সামনে তার সেসব কিছুই মনে পড়ে না। তার মনে হয় এই তো সত্য, এই তো সুন্দর। তারপরও কিছু প্রশ্ন করার সময় এসেছে, “হাসান, আব্বা আম্মার সাথে তোমাকে আলাদা করে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আর তিতলির সাথেও।”
“সবার সাথে পরিচিত তো হয়েছি। নতুন করে কী হবো? আর তিতলি তো রাকিনের সঙ্গই ছাড়ছে না। মানে রাকিন সবাইকে দেখাতে চায় সে বাবাহীন মেয়েকে কত আদর করছে।”
‘বাবাহীন মেয়েকে আদর’ কথাটা রুমির বড় কানে লাগে। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “রাকিন ভাই তো বড়দের সাথে অতটা কথা বলেন না। হয়তো বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। আর বাচ্চারা যেখানে আদর পায় সেখানে যায়। তুমি তো ওভাবে তিতলিকে সময় দাওনি। যাক সে কথা, আমি বলছিলাম অফিসিয়াল ভাবে আমাদের দুই পরিবারে পরিচিত হওয়ার কথা। আমার পরিবারে তোমার, আর তোমার পরিবারে আমার।”
“রুমি, তুমি এক বাচ্চার মা, কোন টিনএজ মেয়ে তো না যে এত অস্থির হচ্ছ। তুমি আমার সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করো, আর আমিও। এর বাইরে অফিসিয়াল দিকে আস্তে আস্তে যাই। আমরা তো একসাথে একান্তে সময়ও কাটাইনি এখনো। রিলেশনে থাকাকালীন যতটা কাছাকাছি আসা দরকার তাও তো আসা হলো না। আমি বুঝতে পারছি দীর্ঘদিন একা থাকায় একটা স্থায়ী সম্পর্কের জন্য তুমি অস্থির হয়ে আছ। কিন্তু তার আগে আমাদের দুজন দুজনকে আরও কাছ থেকে জানা প্রয়োজন, তাই না? চলো কাল তো ছুটির দিন, আমার সাথে বাইকে করে আশুলিয়া যাবে, একান্তে সময় না কাটালে বিশ্বাস আর ভালোবাসা আসবে কি করে। যাবে বলো?”
রুমি সহসা কোন জবাব দেয় না। হাসান জানাতে বলে চলে যায়। রুমি খেয়াল করিনি, কিন্তু রুমির মা সাহেদা বেগম দূর থেকে হাসান আর রুমি দু’জনকেই খুব ভালো করে খেয়াল করছিলেন।
(ফুলের ছবি সংগ্রহীত)