যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ২৫
দুপুর একটা থেকে বিকেল চারটা বেজে গেল, হাসানের দেখা নেই। কাজী সাহেব স্বাভাবিক ভাবেই অন্য দম্পতিদের নিয়ে নিজের কাজ করছেন, বসার ঘরের একপাশে বিধস্ত রুমিকে নিয়ে ওনার কোন মাথাব্যথা নেই। এত বছরের কর্মজীবনে এই ঘটনা ওনার জন্য নতুন নয়, শেষমুহুর্তে এসে ছেলে বা মেয়ে যেকোন একজন গায়েব হয়ে যাওয়াটা অহরহই হয়। অনেক সময় সাইন করার মুহূর্তেও পাত্র পাত্রীকে বেঁকে যেতে দেখেছেন। তবে তাদের বেশিরভাগই কমবয়সী। পূর্ণবয়স্ক মানুষজন যারা কাজী অফিসে বিয়ে করতে আসেন তারা যথেষ্ট ম্যাচুয়র থাকেন, এভাবে গায়েব হয়ে যান না। তাই এইটুকুই শুধু কাজী সাহেবকে অবাক করেছে। সত্যি বলতে প্রাপ্ত বয়সী কোন পুরুষ যদি এই সময় এসে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তাকে কাপুরুষ বলাই শ্রেয়।
“আপু, তুমি বাসায় যাও। এই শরীরে তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম। স্যরি আপু, স্যরি শিহাব ভাইয়া, স্যরি রাকিন ভাই।”
“রুমি, জনে জনে স্যরি বলা লাগবে না। আমি আর শিহাব আছি, তাছাড়া রুমন তো কোন বিরক্ত করছে না। আমরা কোথাও যাচ্ছি না তোমাকে ছেড়ে। আর তুমি চলো আমাদের সাথে, তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।
রাকিন একপাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফোন ট্রাই করে যাচ্ছে, কিন্তু বারবার হাসানের নাম্বার আনরিচেবল পাচ্ছে।
“রাকিন ভাই, বাদ দেন ও আসবে না। আমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে অন্য একটা নাম্বার থেকে। সেই নাম্বারও বন্ধ করে দিয়েছে।”
“কী লিখেছে? এতক্ষণ বললে না তো এই কথা রুমি। কী লিখেছে হাসান?” মরিয়ম আপা মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
“হাসান লিখেছে তার আম্মা নাকি কোর্ট ম্যারেজের ব্যাপারে টের পেয়েছেন, আর তিনি একদম রাজি না। কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন। আমাকে তাই আজ চলে যেতে বলেছে। পরে বিয়ের জন্য অন্য কোনদিন ঠিক করবে।”
“রুমি! আবারও দিন ঠিক করবে! মানে কী এইসব কথার? তুমি বিশ্বাস করো এইসব? আসল কথা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তোমার প্রতি আকর্ষণ এড়াতে পারছে না, আবার তোমাকে গ্রহণ করতেও অনীহা।”
“আমি বুঝতে পারছি আপু। এতদিন যে বুঝিনি তা নয় আপু, তবু মন বড় বোকা, বারবার বিশ্বাস হারাতে ভয় পায়। ডুবন্ত মানুষ তো খড়কুটো আঁকড়ে ধরে হলেও বাঁচতে চায়। আমি হাসানের কাছে টাকা পয়সা, আর্থিক নিরাপত্তার আশ্বাস এইসব কিছু চাইনি। আমার আর তিতলির জন্য আমি নিজেই যথেষ্ট। আমি শুধু নির্মল ভালোবাসা চেয়েছিলাম আপু, যে আমাকে শুধু ভালোবাসা দেবে। খুব কী বেশি কিছু চেয়েছিলাম আপু?”
“না খুব সামান্যই চেয়েছ। তবে ভুল মানুষের কাছে। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যদি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হয়, তবে সেই ভালোবাসা মনকে শান্তি দেয় না রুমি। যেই তুমি একদিন আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে প্রতারক স্বামীর সংসার করতে রাজি ছিলে না, সেই তুমি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য একজন কাপুরুষের সাথে সংসার করতে চাও? আমার চেনা রুমি এত দুর্বল না, তাই না?”
রুমি দুই হাতে চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়, ” চলেন আপু বাসায় যাই। তবে আমার কী ইচ্ছে করছে জানেন আজ এই মুহূর্তে বিয়ে করে ফেলতে। ঐ কাপুরুষটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে চাই। ও ভাবছে সে ছাড়া আমার গতি নাই, যা মন চায় করবে। আব্বা আম্মা তো বিয়ের জন্য কতদিন ধরে বলছেন। রশ্মির দূর সম্পর্কের ভাসুর বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছেন। পারিবারিক কারণে বিয়ে করতে দেরি হয়েছে ওনার। লোক নাকি খারাপ না। হাসানের কথা ভেবে আমি না করে দিয়েছিলাম, কিন্তু আজ গিয়েই হ্যাঁ বলে দেব।”
“এইটা কী বলো রুমি! সেই তো আবার জিদের বশে অবুঝের মতো কথা বলছো। হাসানের উপর জিদ করে চেন না জানো না এমন একজনকে হুট করে বিয়ে করবা? তা করবেই যখন রাকিন কী দোষ করলো? বেচারা যে তোমার পেছনে আধা দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়ায় সেটা তুমি চোখেও দেখ না।”
“আপু, রাকিন ভাইয়ের কথা আমি জানি না। তিনি কখনো আমাকে কিছু বলেননি। আর ইশারার কথা বললে, তা বোঝার ক্ষমতা বোধহয় আমি হারিয়েছি। তবে আপু এখন আমার মনে হয় সব পুরুষ একই পাখির পালক। আজ হয়তো রাকিন ভাইও হাসানের মতো খেয়ালের বশে আবেগ দেখাচ্ছে, কাল দায়িত্ব নেওয়ার সময় আসলে এমনই পিঠ দেখাবে। আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই আপু। তিতলির জন্য আগেও তার মা একাই যথেষ্ট ছিল, সামনেও একাই যথেষ্ট থাকবে। আর নিজের কথা বললে আমার মনকে আমি বেঁধে নেব। হিমেলের এত বড় প্রতারণার কথা কারও অজানা নয়, একটা মেয়ে মরতে মরতে বাঁচলো, মেয়েটা আবার তারই স্টুডেন্ট ছিল। অথচ দেখ তার অপরাধ সমাজ কত দ্রুত ভুলে গেল। বহাল তবিয়তে একটা মেডিকেলে জব করছে, আবার বিয়ে করেছে। আর স্বামীর প্রতারণা মেনে না নেয়ে বের হয়ে এসে আমি আর আমার মেয়েটা একা হয়ে গেলাম। কেউ সুযোগ নিতে চায়, কেউ করুণা করে। এই সমাজের মুখে থুথু মারতে মন চায় আপু।”
মরিয়ম শক্ত করে রুমিকে জড়িয়ে ধরে। আর এখানে বসে থাকার মানে হয় না। রুমিকে সাথে করে মরিয়ম, শিহাব আর রাকিন রুমির বাসায় চলে আসে। যদিও বাসায় কাউকে কিছু রুমি জানায়নি, শুধু মাকে সামান্য ধারণা দিয়েছিল হাসানের ব্যাপারে। তাই এই অসময়ে এত মানুষসহ বিধস্ত চেহারার রুমিকে দেখে সানোয়ার সাহেব আর সাহেদা বেগম অবাক হয়ে যান। মরিয়ম আর শিহাব ওনাদের নিয়ে আলাদা ভাবে বসেন। রুমির ভাই আদিল বাসায় নেই, অফিসে আছে, আর রশ্মি শ্বশুরবাড়িতে।
রুমির বাবা মায়ের কাছেই সবাই শোনে যে, চাকরি পাওয়ার পর থেকেই আদিল তার বান্ধবী জিনিয়াকে বিয়ে করতে অস্থির হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জিনিয়ার পরিবার বিয়ের জন্য রাজি হতে যে গড়িমসি করছেন, তার একটাই কারণ, তার চান আদিল জিনিয়া সংসার নির্ভেজাল ভাবে শুরু হোক। রুমি এবং তিতলি এই বাসাতেই থাকে এটা জানার পর ওনারা বিয়ের ব্যাপারে মত পরিবর্তন করেছেন। রুমির তিতলিকে নিয়ে আলাদা সাবলেট বাসায় উঠতে চেয়েছে, কিন্তু রুমির বাবা মা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। মেয়ে আর নাতনির নিরাপত্তার কথা ভেবে অচেনা কারও সাথে সাবলেট থাকতে দিতে রাজি নন তারা, আবার একা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করার মতো সামর্থ্য এই মুহুর্তে রুমির নেই। ভালো একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া, তিতলির প্লে স্কুলের বেতন, দৈনন্দিন খরচ সবকিছু শুধু ডেন্টাল কলেজের চাকরি দিয়ে ম্যানেজ করা সহজ নয়। কিন্তু আদিল নিত্যদিন বাসায় অশান্তি করছে, জিনিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে হুমকি দিচ্ছে। রুমি অবাক হয়ে যায় ভাইয়ের রাগ আর বিরক্তি দেখে, মাত্র ছয় মাস আগেও যখন আদিলের চাকরি ছিল না, রুমি নিজের হিসাবের বেতন থেকে ভাইকে হাতখরচ দিয়েছে, যতটা সম্ভব করেছে। আজ পরিস্থিতি বদলাতে আদিল স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে। একের পর এক রুমির জন্য যা তা বিয়ের প্রস্তাব আনছে, যেন বোনের বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলে শান্তি। রুমির মতো বাস্তববাদী মেয়ে যে কেন হাসানের এলোমেলো কথায় জালে জড়িয়েছে এখন বুঝতে পারছে মরিয়ম। রুমির কাছে বাসার এইসব অশান্তি থেকে পালানোর উপায় মনে হয়েছে হাসানের সাথে নতুন জীবন শুরু করা।
“রাকিন ভাই, আপনি নাকি আব্বা আম্মার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন? জানতে পারি কেন? অসহায় মেয়ে মানুষ ভেবে করুণা করছেন? আমি মোটেও অসহায় নই। আব্বা আম্মা যতই রাগারাগি করুক না কেন, আমি আদিল আর জিনিয়ার মাঝে বাঁধা হয়ে থাকব না, আমি কলেজের কাছাকাছি ছোট কোন ফ্ল্যাটে উঠে যাব। আমার বন্ধুর চেম্বারে কমিশনে কাজ শুরু করবো। আমার যোগ্যতা আছে, বাড়তি আয় করা কোন ব্যাপার না। আমার এফসিপিএসও শেষের দিকে। আমার কারও দয়া দাক্ষ্যিণের প্রয়োজন নেই।”
“আমি জানি আপনার অনেক যোগ্যতা আছে। আর আপনাকে আমার পাশে চাওয়ার উদ্দেশ্যও এটাই। সম্পর্কে আপনিও ধোঁকা খেয়েছেন, আমিও খেয়েছি। দু’জন ভাঙা হৃদয়ের মানুষ হয়তো একটা পূর্ণাঙ্গ হৃদয় বানাতে পারব।”
“ব্রেকআপ আর ডিভোর্সে পার্থক্য আছে জানেন তো? আপনার ব্রেকআপ হয়েছে, আর আমার একট সংসার ভেঙেছে, একটা ছোট মেয়ে আছে, যার দায়িত্ব আমি কারও কাঁধে দিয়ে ওকে বোঝা বানাতে চাই না।”
“আপনি বারবার তিতলিকে বোঝা কেন বলছেন? শায়না যদি আমাদের বাচ্চাটা এবরশন না করতো তাহলে তিতলির মতো আমারও একটা আদর আদর বাচ্চা থাকতো। তিতলিকে দেখলেই আমার হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে।”
“শায়না কে?”
“আমার প্রাক্তন। আমার বাবা বেঁচে নেই, বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে মায়ের জোরাজুরিতে শায়নাকে বিয়ে করি। শায়না মায়ের বান্ধবী সেলিনা আন্টির মেয়ে, ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাসায় আসা যাওয়া ছিল। হাতের উপর বড় হওয়া মেয়ে ছেলের জন্য সবচেয়ে ভালো বৌ হবে এমনটাই ভেবেছিল মা। আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি শুনে শায়নার পরিবারও রাজি হয়ে যায়। সারাজীবন লেখাপড়া ছাড়া অন্য কোনদিকে মন দেওয়ার সময় পাইনি, সত্যি বলতে শায়নাকে নিয়ে আমি সুখী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিদেশ বলতে যে লাক্সারি আমরা কল্পনা করি, একজন স্ট্রাগলার পোস্ট গ্রাজুয়েশন স্টুডেন্টের জন্য তা এফোর্ড করা সহজ নয়। এরজন্য প্রয়োজন ধৈর্য আর সময়। শায়না কোন অড জব করতে রাজি ছিল না, কিন্তু বাইরে বসে খাওয়া সম্ভব না, ছোট একটা ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে ওয়েট্রেসের কাজ নেয় ও। আর আমি পড়াশোনার পাশাপাশি দুই সিফটে কাজ করতাম। এরমাঝে আবিষ্কার করি শায়না প্রেগন্যান্ট, কিন্তু বিদেশের সেই অভাবের সময় ও কিছুতেই বাচ্চাটা রাখতে রাজি হয় না, এবরশন করে ফেলে। আমার সেই সময় নিজেকে চরম ভাবে ব্যর্থ একজন মানুষ মনে হয়। সমস্ত সময় দিয়ে দেই টাকা আয়ের পেছনে। শায়না আর আমার দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এক আকাশ পরিমাণ হয়ে গেল। একই ছাদের নিচে দুই অচেনা মানুষ যেন। আসলে আমরা কেউ কারও জন্য পারফেক্ট ছিলাম না, যেমন জীবন শায়না চেয়েছিল তা আমি দিতে পারিনি, যেমন সঙ্গী আমি চেয়েছি, শায়না তেমন ছিল না। দু’জন অতৃপ্তি বয়ে চলা মানুষ বিচ্ছেদেই সমাধান খুঁজেছি। শায়না সেই ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট মালিককে বিয়ে করে সেখানেই থেকে গিয়েছে, আমি পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষে দেশে ফিরে এসেছি। আসলে আমি আর বাইরে থাকতে পারছিলাম না, সেই আলো ঝলমলে দেশে নিজের জীবনটা বড়ই শীতল লাগলো। বরফে আমার শরীর জমতো না, তবে ভালোবাসাহীন হৃদয় জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। বহুদিন পর কারও জন্য হৃদয়ে বসন্তের গান টের পেয়েছি। করুণা নয়, আমি নিজের জন্যই তোমার হাত চাই রুমি। তুমি রাজি থাকলে মা কে আমার কয়েকজন কাছের মানুষ নিয়ে তোমাদের বাসায় আসতে বলবো।”
কথা বলতে বলতে রাকিন কখন রুমিকে তুমি ডাকা শুরু করেছে জানে না। রুমি কী বলবে বুঝতে পারে না। শূণ্য চোখে রাকিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।