যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-২৯

0
2519

যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ২৯

সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে, আবহাওয়া তাই হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছে। এরই মাঝে একুশ দিন পার হয়েছে। রুমি আর রাকিনের সম্পর্কটা একই জায়গায় থেমে আছে বললে ভুল। শরীরে সম্পর্কটা হয়তো হয়নি, কিন্তু রোজই একটু একটু করে মনের দূরত্ব ঘুচে চলছে। এই তো সেদিন টিচার্স রুমে রৌশন আপার সাথে তাল মিলিয়ে হাসান আর মিতু যখন রুমিকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, যেভাবে ওকে আড়াল করে সামনে দাঁড়াল রাকিন, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।

রুমি আর রাকিনের বিয়ের কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। মরিয়মের প্রিম্যাচ্যুর ডেলিভারির কথা জানতে পেরে সহকর্মীরা হসপিটালে ভীর করেছিল, সেখানে সদ্য বিবাহিত রুমি রাকিন জুটিকে আবিষ্কার করে সবাই। রৌশন আপা মাঝেমাঝে রুমির সাথে কখনো হাসান, কখনো রাকিনের নাম জড়িয়ে মুখরোচক আলোচনা করলেও এভাবে বিয়ের খবর সবাইকে অবাক করেছে। তবে বেশিরভাগ মানুষই খুশি হয়েছেন, রুমি আর রাকিনকে ব্যক্তিগত ভাবে অনেকেই পছন্দ করেন। রৌশন আপা আর মিতু মজা পাবে না হিংসা করবে বুঝতে পারছে না, একদিকে তাদের করা গসিপ সত্য হয়ে গেল, অন্য দিকে অজানা কারণে কেমন একটা জ্বালা ধরে মনে। তাই রৌশন আপা আড়ালে আবডালেই না সবার সামনেই বড় গলায় বলতে লাগলেন, “দেখেছ, খুব তো জ্ঞান দিতে তোমরা, এই বলা উচিত না, ঐ বলা উচিত না। মাথার চুল তো আর এমনি পাকেনি। সেই তো ঠিকই কলেজের সেরা এলিজেবল ব্যাচেলরের গলায় মালা দিয়েছে রুমি। হাসানও টার্গেটে ছিল, তার মাঝে যে আগে পটেছে, তার সাথে আর দেরি করেনি।”
মিতুর হিংসেটাও কম নয়, রাকিনের পেছনে কম চেষ্টা তো করেনি, অথচ তার মতো অবিবাহিত মেয়ে বাদ দিয়ে কিনা রাকিন রুমিকে পছন্দ করলো!

এই প্রথম রৌশন আপা আর মিতুর কথার ফোড়নে সায় দেওয়া শুরু করেছে হাসান। ভেতরে ভেতরে অন্তরটা যে তারও জ্বলে যাচ্ছে। যদিও রুমিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনোই নিশ্চিত ছিল না হাসান, কিন্তু ভাবেনি এভাবে তার হাতের উপরের জিনিস অন্য কেউ নিয়ে যাবে। খেলায় হেরে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে হাসানের। আর তাই রুমি রাকিন জুটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। রুমির সাথে তার সম্পর্ককে কখনো প্রকাশ্যে কেন আনেনি তাই নিয়ে এখন তার আফসোস হচ্ছে। মরিয়ম আর রাকিন ছাড়া অন্য কেউ জানতো না হাসানের সাথে রুমির ঘনিষ্ঠতার কথা, এই দু’জনের একজন রুমির কাছের মানুষ, আরেকজন তো স্বামীই হয়ে গেল। এখন আফসোস হচ্ছে কলেজের আর এক দু’জন মানুষকে জানালে কী হতো যে সেদিন তার আর রুমির কোর্ট ম্যারেজ করার কথা ছিল, সে ছেড়ে দিয়েছিল বলেই তো রাকিনের গলায় মালা দিলো রুমি। রুমির এভাবে হাসানকে সহজেই ঝেড়ে ফেলাটা হাসানকে তাই পুড়িয়ে দিচ্ছে। রুমিকে ছোট করার প্রবৃত্তিটা সে সামাল দিতে পারছে না। তাই তো সেদিন টিচার্স মিটিং শেষে সবাই যখন রুমি আর রাকিনের কাছে ট্রিট দাবি করে, তখন রৌশন আপা আর মিতু টিপ্পনী কাটতে শুরু করলে সুযোগ বুঝে তাদের সাথে হাসানও তাল মিলাতে থাকে।

রৌশন আপা- “রুমি, একটু কিছু টিপস মিতু আর হাসানকেও দাও। তুমি দুইটা করে ফেললে, বেচারাদের একটাও হলো না।”

মিতু- “রৌশন আপা ঠিকই বলেছেন। রুমি আপুর ক্লাস লাগবে আমার। এখনো ছেলে ভুলানো মন্ত্র জানি না বলে বিয়েটা আটকে আছে। আমার অবশ্য একটা হলেই চলবে, তিনটা চারটা করার শখ নাই।”

রৌশন আপা আর মিতুর কথার মাঝেই তাল মিলায় হাসান, “মিতু আপা, তিনটা চারটা সবাই পারে না। তারজন্য স্পেশাল হতে হয়। আমাদের তো মানুষের এঁটো খাবার খাওয়ার অভ্যেস নেই। তাই এখনো হয়নি। রাকিন ভাই বিদেশ থেকে এসেছেন, ওপেন মাইন্ডের মানুষ, রুমি আপাও এক্সপেরিয়েন্সড। ওনাদের টিউনিং হওয়ারই কথা।”

রৌশন আপা আর মিতুর উপর সবাই কমবেশি এমনিতেও বিরক্ত, এখন হাসানও ওদের সাথে তাল মেলানোয় উপস্থিত অন্যান্যরা বিরক্ত হলেও কলিগ বলে কিছু বলে না। রুমিও ভাবে পাশ কাটিয়ে যাবে, কিন্তু বাদ সাধে রাকিন “হাসান ভাই, দেশের প্রথম শ্রেণীর পেশাজীবি একজন মানুষের মুখের ভাষা এমন হওয়াটা সত্যি দুঃখজনক। আপনার মনোভাবের সাথে একজন অশিক্ষিত বর্বর মানুষের কী পার্থক্য আছে? আপনি ডাক্তার আর সে অশিক্ষিত, এই টুকুই তফাৎ। রুমির দ্বিতীয় বিয়ের কথা আপনারা জানেন, আমারটা জানেন না। অবশ্য জানলেও আপনাদের কথা পরিবর্তন হতো না। মহিলদের নিয়ে স্থুল রসিকতা করা খুব সহজ কিনা।”

একটু অপ্রস্তুত হলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় হাসান,”আরে রাকিন ভাই দেখি রাগ করলেন। আরে আমি তো দুষ্টুমি করেছি। আপনি ভাই মানুষ, রুমি আপা তো আমার কত ভালো বন্ধু সেটা জানেন না? এখন যদিও আমার ভাবি হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু বন্ধুত্ব তো ছিল। বন্ধুর সাথে বন্ধু দুষ্টুমি করতে পারবে না?”

রাকিন হাসানের কথার উওর না দিয়েই রৌশন আপা আর মিতুর দিকে ফিরে, “রৌশন আপা, আপনি গুরুজন। কত সিনিয়র ম্যাম, এসব সস্তা রসিকতা কী আপনার সাথে যায়? যতটুকু জানি স্যার নির্ভেজাল মানুষ, এসব জিনিস পছন্দ করেন না।
আর মিতু তোমার আগে ব্যবহার শিখতে হবে, তাহলে তিনটা চারটা না হোক, একটা বিয়ে অন্তত হবে। সবশেষে তোমাকে বলি রুমি, তুমি এসব কথা পাশ কাটিয়ে যাও দেখে সবাই বলার সাহস পায়। এক্ষুনি তুমি আমার সাথে পরিচালক স্যারের রুমে যাবে। কলেজে সবাই পড়াতে আসে না অন্যের জীবনে নাক গলাতে আসে, তা স্যারকে জিজ্ঞেস করা দরকার।”

পরিচালকের কাছে যাবে শুনে উপস্থিত সবাই রাকিনকে শান্ত করতে লেগে যায়। সিনিয়ররা হাসান আর রৌশন আপাকে দুটো কথাও শুনিয়ে দেন এবার। রাকিন সে সময়ের মতো ঠান্ডা হলেও কথা ঠিকই পরিচালকের কানে যায়। ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে নোটিশ চলে যায়, অফিস চলাকালীন অফিসিয়ালি কথাবার্তা ছাড়া কোন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যেন কোন রকম অশালীন মন্তব্য করা না হয়, অন্যথায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রৌশন আপা আর হাসান কারন দর্শানোর নোটিশও পেয়েছে। আপাতত কলেজে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।

রাকিন আর রুমির মাঝে এখনো তিতলি ঘুমায়। তবে রোজ একসাথে অফিসে আসা যাওয়া করা আর ছুটির দিনে একসাথে বসে চা খাওয়ার অলস বিকেলগুলোয় দু’জনের মাঝের বরফ গলতে শুরু করেছে। প্রথম পদক্ষেপটা যদিও কেউই নিতে পারছে না। রুমি আড়ষ্টতা কাটাতে পারছে না, আর না রাকিন সহজ হতে পারছে। তাদের দৈনন্দিন আর সব কাজের ফাঁকে নিয়ম করে তারা রোজ রামিসাকে দেখতে যায়।

রামিসা মরিয়ম আপার মেয়ে, মাত্র ঊনিশশো গ্রাম ওজন নিয়ে জন্ম নিয়েছে রামিসা। টানা বিশ দিন NICU তে রাখতে হয়েছে। রাকিন আর রুমি রোজ যেত। মরিয়ম আপা রুমিকে ধরে অনেক কান্না করতো, মরিয়মের মনে হতো হয়তো গর্ভধারণের পর থেকে দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সি কখনো সহজ ভাবে গ্রহণ না করায় আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তাই তো বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে চাইছেন। অপরাধবোধে ভুগতো রুমি আর মরিয়মের শাশুড়ি মাও। রুমির মনে হতে মরিয়ম আপার এই অবস্থার জন্য সে দায়ী, আর শাশুড়ি মা অপরাধবোধে ভুগতেন, কারণ ওনার মনে হতো সেদিন রাতে মরিয়মকে এভাবে মনের উপর চাপ দিয়ে কথাগুলো না বললেই পারতেন। শিহাব একবার NICU আরেকবার মরিয়মের কাছে ছুটোছুটি করতো, তার ব্যবসা বাণিজ্য সব মাথায় উঠেছিল, সাথে ছিল রুমনকে সামলানের চাপ। তবে শেষ পর্যন্ত সবার ভালোবাসার জয় হয়েছে। আজ রামিসাকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। রুমি আর রাকিন তাই এই ঝড় বৃষ্টির ভেতরও বের হচ্ছে, শিহাব আর মরিয়মের পাশে থাকতে চায় এই খুশির সময়। তিতলিকে তার নানা নানুর কাছে নামিয়ে দিয়ে হাসপাতালের পথে রওনা দেয় তারা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here