আমার বোনু পর্ব-২৩

0
1959

#আমার_বোনু
#Part_23
#Writer_NOVA

দরজা খুলতেই ঊষার সামনে মলিন, ক্লান্ত মুখের এক যুবক দৃশ্যমান হলো। সারা মুখে তার ক্লান্তির ছাপ। শরীরটাও বোধহয় নুইয়ে আসছে। সেগুলো ছাড়িয়ে এক টুকরো হাসি বিলিয়ে দিলো জিবরান। যার মধ্যে তার সমস্ত ক্লান্তির অবসান ঘটাতে চেয়েছিলো। এই অসময়ে জিবরানকে বাসায় দেখে ঊষার তেমন খোটকা লাগলো না। কারণ জিবরান সময়ের থেকে অসময়ে বেশি আসে। জিবরান হাসিটুকু মিইয়ে ক্ষীণ গলায় বললো,

— ভেতরে কি ঢুকতে দিবে ঊষারাণী?

— আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

— আজকাল অফিসের অনেক চাপ। একা সামলে উঠতে পারছি না। তাই এই অবস্থা। তাছাড়া জানো, কেমন জানি একটা চাপা ব্যাথা করছিলো মনে। সেজন্য মানসিক শান্তির কাছে ছুটে এলাম।

ঊষা নিষ্পলক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো। কত আকুল করা কন্ঠ। জিবরানের কথা বলার ভঙ্গিতে ওর বুকের বামপাশেও চিনচিন করতে আরম্ভ করলো। দরজা থেকে সরে জিবরানের যাওয়ার জন্য জায়গা করে দিলো। কিন্তু জিবরান সাইড কাটিয়ে না গিয়ে ঊষাকে জড়িয়ে ধরলো। অন্য সময় হলে ঊষা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য একটু হলেও মোচড়ামুচড়ি করতো। আজ তা করতে ইচ্ছে হলো না। জিবরান কিছু সময় জড়িয়ে ধরে রেখে দুই হাতে ঊষার গাল জড়িয়ে ধরে কপালে শব্দ করে একটা চুমু খেলো।

— ঊষারাণী আমার ভালো লাগছে না। আমি ফ্রেশ হয়ে নেই।

— ডিনার করেছেন?

— খেতে ইচ্ছে করছে না।

জিবরান ধীর পায়ে ঊষার রুমের দিকে পা বাড়ালো। ঊষা সদর দরজা বন্ধ করে কিচেনে গেলো। বাসার সবাই ঘুমে। ফ্রীজ থেকে খাবার বের করে গরম করে নিলো। একটা প্লেটে খাবার নিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো।

— ওহ তুমি এসে গেছো?

ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে জিবরান কথাটা বলে উঠলো। ঊষা দরজা বন্ধ করে প্লেটটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখলো। মিনিট খানিক পর ওড়নায় টান পরতেই ঊষা পিছনে ঘুরলো। জিবরান তার ওড়নায় নিজের মুখ মুছতে ব্যস্ত।

— টাওয়াল আছে তো! আমি বের করে দেই?

প্রশ্নটা জিবরানের দিকে ছুঁড়ে দিলো ঊষা। জিবরান মুখ মুছে ঊষাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,

— বউয়ের ওড়না থাকতে টাওয়ালের খোঁজ কেন করবো আমি?

ঊষা কথা বাড়ালো না। প্লেটটা নিয়ে জিবরানের হাতে তুলে দিলো। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো। গ্লাস হাতে সামনে এগিয়ে জিবরানকে বললো,

— নিন এবার শুরু করেন।

— আমার খেতে ভালো লাগছে না, বলেছিলাম।

— আমি খাইয়ে দেই?

জিবরান ফট করে উত্তর দিলো,
— তা কি জিজ্ঞেস করতে হয়?

ঊষা মুচকি হেসে হাত ধুয়ে এলো। জিবরানকে খাটে বসিয়ে ওর বরাবরি বসলো৷ মনোযোগ সহকারে জিবরানকে খাবার খাইয়ে দিতে লাগলো। জিবরানও চুপচাপ ঊষাকে দেখতে দেখতে খাবার খেতে থাকলো। খাবার শেষ করে ঊষা জিবরানের মুখ ধুইয়ে দিলো। এবারও জিবরান ঊষার ওড়না টেনে মুখ মুছে নিলো। তা দেখে ঊষা হাসলেও মুখে কিছু বললো না। হাত ধুয়ে প্লেট কিচেনে রাখতে গেলে জিবরান পেছন থেকে ডাকলো,

— ঊষা!

— জ্বি বলুন!

— এখন আর কোথাও যেয়ো না।

— কেন কি হলো?

— প্লেটটা আপাতত রুমেই রেখে দাও। তুমি আমার পাশে এসে বসো দেখি।

ঊষা কপাল কুঁচকে জিবরানের দিকে তাকালো। জিবরান চোখ, মুখ শুকনো করে অনুরোধের সুরে বললো,

— প্লিজ!

ঊষা আর কিচেনে গেলো না। ওয়ারড্রবের ওপর প্লেট রেখে ওড়না দিয়ে হাত মুছতে মুছতে খাটের কোণায় বসলো। ঊষা বসতে দেরী জিবরান লাফ দিয়ে খাটে উঠে নিজের মাথাটা ঊষার কোলে রেখে বললো,

— মাথাটা একটু টিপে দাও প্লিজ! তোমার ছোঁয়া ছাড়া আজ আমার ঘুম আসবে না।

জিবরানের ঘোর লাগানো কথায় ঊষা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। ছেলেটার কথার মধ্যে মাদকতা আছে। যা ঊষাকে বড্ড পোড়ায়। ঊষা চুলে আঙুল চালিয়ে হালকা করে টেনে দিতে লাগলো৷ আর জিবরান সে তো প্রেয়সীর পেটে মুখ গুঁজে ঘুমানোর প্রস্তুতিতে বিভোর।

অাকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঁকি ঝুঁকি মারছে। কখন মেঘের আড়াল থেকে চাঁদের দেখা মিলছে তো কখনো মেঘের ভেতরে চাঁদ হারিয়ে যাচ্ছে। চারিপাশে মোহনীয় এক পরিবেশ। এমন রোমান্টিক পরিবেশে প্রিয় মানুষের হাত ধরে হাঁটতে পারলে মন্দ হতো না। গাছের পাতা মাঝে মাঝে নড়েচড়ে বাতাসের আগমনের সাক্ষী হচ্ছে। চাপা গরমের থেকে স্বস্তির আভাস এটা।

এদিক সেদিক তাকিয়ে খুব সাবধানে গাড়ির থেকে নামলেন আরাভ সাহেব।আবছা আলোতে সামনে একতলা টিনসেটের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। যদিও এতো রাতে দেখার কথা নয়। তবুও সাবধানের মাইর নেই। বাসার ভেতরে ঢুকেতেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। দূর থেকে বাইকে দাঁড়িয়ে কিন্তু তা ঠিকই আরেকজন লক্ষ্য করেছে।এতরাতে আরাভ শিকদারকে বাসা থেকে বের হওয়ার সংবাদ পেয়ে তার পিছু নিয়েছিলো। সে চোখ, মুখ কুঁচকে চিন্তিত ভঙ্গিতে আপনমনে বলে উঠলো,

— সে এখানে কি করছে?

বাইকটাকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পা টিপে টিপে নিজেও সেদিকে রওনা দিলো। ভেতরে প্রবেশ দ্বার বন্ধ। তাই বাইরে দিয়ে ঘুরঘুর করতে লাগলো। দুই দালানের মাঝে চিপা একটা গলি আছে। কিন্তু সেটা বেশ রিস্কের। আবর্জনা আর ভাঙা মদের বোতলের ছড়াছড়ি। রিস্ক নিয়ে চিপা গলিতে প্রবেশ করলো। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় সাবধানে দেখে শুনে পা ফেলে, একটা রুমের পাশের জানালায় দাঁড়াতেই আরাভ শিকদারের কন্ঠ পেলো।

— তুমি আর কত দেরী করবে বলো তো? এখনো কাজটা কেনো করছো না? বেশি দেরী করলে আমার ধরা পরার সম্ভাবনা আছে। তোমার থেকে আমি এমনটা আশা করিনি। তুমি হাত-পা গুটিয়ে এভাবে বসে থাকলে আমি অন্য পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হবো।

অপরপাশ থেকে হো হো করে হাসির শব্দ এলো। বাইরের ব্যাক্তিটা কান আরো খাড়া করলো। হাসি থামিয়ে আরাভ শিকদারের সামনের মানুষটি বললো,

— আপনি বড় অধৈর্য্য মানুষ শিকদার সাহেব। আমি ধৈর্য্য সহকারে ধীরেসুস্থে কাজ করতে পছন্দ করি। যাতে করে কোথাও কোন ত্রুটি না থাকে৷ মোকা দেখে চৌকা মারা আমার অভ্যাস। আমি এতো সহজে হারি না। আপনি অপেক্ষা করেন। সব হয়ে যাবে।

আরাভ শিকদার উত্তেজিত গলায় বললো,
— কবে হবে? মাসফি আমায় সন্দেহ করে বসেছে। অল্পের জন্য ধরা খাইনি। মিথ্যে, বানোয়াট, সিনেমেটিক গল্প বানিয়ে ওকে ঘোল খাইয়েছি। ও যদি কোনভাবে জানতে পারে সম্পত্তির জন্য আমি ওর বাবা-মা কে মেরেছি তাহলে আমায় শেষ করে দিবে। সেদিন এক ভুলে মরতে বসেছিলাম। কাউকে কলে নিজের ভাই-ভাবীর মৃত্যুর স্বীকারোক্তি দিচ্ছিলাম। সেখানে আমার ভাতিজি অদিতি সব শুনে ফেলেছে।এর জন্য ওকে কতদিন রুমে আটকে রেখেছিলাম।এর মধ্যে জানতে পারলাম অদিতিকে একটা ছেলে পছন্দ করে। নাম আদিল মির্জা। মাসখানিক অদিতিকে না পেয়ে পাগলের মতো করেছে। আমি ওকে বলেছি অদিতি নিউইয়র্কে তার ভাইয়ের কাছে চলে গেছে।কিন্তু সে বিশ্বাস করতে চায় না। বহুকষ্টে কিছু ভুয়া তথ্য জোগাড় করে তাকে দিয়ে শান্ত করলাম। যদিও সে বিশ্বাস করেনি। তবে শেষ অব্দি সে হাল ছেড়ে দিলো।এর পেছনের কারণ অবশ্য আমার জানা। তার আদরের বোন তাকে আরেকটা মেয়ের সাথে বিয়ে করতে জোর করেছে। যাতে অদিতিকে সে একটু হলেও ভুলে ভালো থাকতে পারে।

এতটুকু বলে আরাভ শিকদার থামলেন। সামনের পানির বোতল থেকে বেশ কিছু পানি খেয়ে নিলেন। অপরপাশের ব্যক্তিটা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা লোক নিজের পাপকর্মের কথা কত সহজে বলে দিচ্ছে।মুখে নেই কোন অনুতাপের চিহ্ন। কাহিনীর মাঝে থেমে যাওয়ায় সে বেশ বিরক্ত হলো। কিন্তু মুখে প্রকাশ না করে, গলা ঝেড়ে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তারপর!

আরাভ শিকদার জোরে কতগুলো দম টেনে আবার বলতে আরম্ভ করলেন,

—এদিকে অদিতি পাগলামি শুরু করলো। সে বারবার আমায় বললো মাসফিকে সব বলে দিবে। আমি ভয় পেয়ে একদিন ওর মাথায় স্টীলের স্ট্যান্ড দিয়ে আঘাত করে বসলাম। তারপর থেকে হসপিটালে ভর্তি ছিলো। ওর ভাই নিউইয়র্ক থেকে চলে এলো। আমি শান্তপর্ণে সবকিছু আদিলের ওপর চাপিয়ে দিলাম। এতে মাসফি পুরো মির্জা বংশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। গতকাল আবার ঠান্ডা মাথায় আগুনে ঘি ঢেলেছি।কিন্তু এর মধ্যে আমার ভয় হতে লাগলো। দুই ভাইয়ের যত্নে অদিতি সুস্থ হওয়ার পথ ধরেছে। যেকোনো সময় সুস্থ হয়ে যাবে ভেবে অদিতিকে নিয়মিত আমি ড্রাগ দিয়ে যাচ্ছি। যাতে সে আস্তে আস্তে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিনের মধ্যে অদিতি পুরোপুরি পাগল হয়ে যেতো। কিন্তু আমার ছাগলের বাচ্চাটার জন্য সব ভেস্তে গেলো।

আরাভ শিকদারের কন্ঠে রাগ ঝড়ে পরছে। তার মুখমণ্ডল, চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। নিজেকে কিছুটা দমিয়ে বলা শুরু করলেন।

— আরানের কারণে মাসফি ধরে ফেললো। তাই আমিও ওকেই ফাঁসিয়ে দিলাম৷ আমার ছেলেটা আবার পুরো আমার বিপরীত। মাথাটা একটু গরম। কিন্তু ভাইয়ের মতোই ভালো। ভাই বলতে অজ্ঞান। তাই দিয়েছি ভাইয়ের কাছে ফাঁসিয়ে। এবার ঠেলা সামলা। ভাইয়ের থেকে মার খেয়ে যদি আমার কাছে ফেরে। বেশরমের বাচ্চায় নাও ফিরতে পারে।

চেয়ারের ওপর প্রান্তের ব্যাক্তির মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। মানুষ যখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় তখন আশেপাশের সবার কথা ভুলে যায়। শুধু নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য উঠেপরে লাগে। যেমনটা এখন হয়েছে আরাভ শিকদারের ক্ষেত্রে। লোভ-লালসা তাকে এতটা নিচে নামিয়েছে যে নিজের ছেলেকেও ফাঁসাতে দ্বিধাবোধ করেনি।

জনালার বাইরে থুম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো সে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছিঃ এত নিচ মানুষও আছে! ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। সাথে সাথে মাথায় চিনচিন রাগ উঠছে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে এক কোপে আরাভ শিকদারের মাথাটা ফেলে দিতে। রাগে সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। হঠাৎ পা পিছলে একটা ভাঙা বোতলের সাথে লেগে পায়ের কনিষ্ঠ আঙুল কেটে গেলো। গলগল করে রক্ত পরছে। কিন্তু তার এখন সেদিকে খেয়াল দিলে চলবে না। দেখে ফেলার আগে এখান থেকে ভাগতে হবে।

জানলার দিক থেকে মৃদু শব্দ হতেই আরাভ শিকদার ও লোকটা একে অপরের মুখের পানে তাকালো। তারপর ভেতর থেকে আরাভ শিকদার ও লোকটার আওয়াজ একসাথে ভেসে এলো,

— কে কে ঐখানে?

— কে দাড়িয়ে ছিলে?

ভেতরে আরাভ শিকদারের সাথে থাকা লোকটা জানালা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই বাইরের মানুষটা নিচু হয়ে গেলো। কোনমতে নিজেকে সেই চিপা গলি দিয়ে বের করে ছুট লাগালো নিজের বাইকের দিকে।

~~~ পেছন থেকে ছুড়িটা নিজের আপন মানুষরাই মারে। কারণ আপন মানুষগুলোই জানে আমাদের দূর্বলতা কোথায় আছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here