আমার বোনু পর্ব-২৭

0
2434

#আমার_বোনু
#Part_27
#Writer_NOVA

মুখের ওপর কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস পরতেই ঊষার ঘুম হালকা হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে কেউ গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কপালে ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই সে হকচকিয়ে উঠে গেলো। উঠতে গিয়ে অপর মানুষের সাথে মাথায় বারি খেলো। ঊষা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেখে জিবরান কপাল ডলছে। ঊষা জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো,

— কোথায় লাগলো আপনার?

জিবরান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— এভাবে কেউ উঠে? বাপরে আমার কপাল গেলো!

ঊষা উঠে গিয়ে জগ থেকে পানি নিয়ে জিবরানের কপালে ডলতে ডলতে মুখ কাচুমাচু করে বললো,
— আপনি ছিলেন বুঝতে পারিনি। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।

জিবরান ঊষার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
— এতো ভয় পাও কেন তুমি?

ঊষা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— আমি এমনি।

জিবরান খাটে বসে ছিলো। ঊষা দাঁড়িয়ে ওর মাথায় পানি ডলে দিচ্ছিলো। এই সুযোগে জিবরান ঊষার কোমড় দুই হাত টেনে নিজের মাথা ওর পেটে চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,

— ভালোবাসি ঊষারাণী!

ফিসফিস কন্ঠ শুনে ঊষার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। ভালোবাসার মানুষের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনলেও অন্য রকম অনুভুতি হানা দেয়। ঊষার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। হঠাৎ জিবরান দাঁড়িয়ে ঊষার পেছনে দাঁড়ালো। তারপর ফট করে পকেট থেকে কালো ফিতা বের করে ঊষার চোখ বেঁধে দিলো। ঊষা চেচিয়ে উঠলো,

— কি করছেন?

জিবরান কোন কথা না বলে ঊষাকে কোলে তুলে ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। ঊষা এক নাগাড়ে চেচিয়ে যাচ্ছে,

— মিস্টার জেব্রা কি শুরু করছেন?

জিবরান থেমে গেলো। অনেক দিন পর সেই অদ্ভুত ডাক শুনতে পেয়েছে সে। মুখে গুরুগম্ভীর ভাব এনে জিজ্ঞেস করলো,

— কি বললে ঊষারাণী?

— জেব্রা বললাম আপনাকে জেব্রা।

জিবরান মুচকি হাসলো। কোন কথা বললো না। ঊষা বেশ কিছু সময় চেচিয়ে ক্ষান্ত হলো। কাজ হবে না ভেবে জিবরানের বুকে ঘাপটি মেরে রইলো। ধীরে ধীরে জিবরান ওকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে লাগলো। ছাদের মধ্যিখানে এনে জিবরান ঊষাকে নামিয়ে চলে গেলো। ঊষা কারো উপস্থিতি টের না পেয়ে চোখের ফিতা টেনে খুলে ফেললো। সারা ছাদে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে৷ ঊষা ঢোক গিলে মৃদুস্বরে জিবরানকে ডাকতে লাগলো।

— জেব্রা, মিস্টার জেব্রা!

মুহুর্তের মধ্যে সারা ছাদে আলো জ্বলে উঠলো। ঊষার ওপর গোলাপের পাপড়ির বর্ষণ নেমে এলো। ধীরে ধীরে ছাদে উঠলো তার পাঁচ ভাই।সাথে জিবরান, জিনিয়া, নুহা ও অনল আছে। সবাই সমস্বরে চেচিয়ে বললো,

— হ্যাপি বার্থডে ঊষা!

— বস, আগামীকাল সন্ধ্যায় ঊষার বার্থডে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।

মাসফি চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর একটা পেপারওয়েট ঘুরাচ্ছিলো। সেটা থামিয়ে জিকুর দিকে তাকালো। চোখ কুঁচকে সিউর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো,

— সত্যি?

— জ্বি বস। আপনি এখন কি করতে চাইছেন?

— তাহলে তো আগামীকালই প্ল্যানটা কাজে লাগাতে হয়। কি বলো জিকু?

মাসফি বাঁকা হাসলো। জিকু তার কারণ খুঁজে পেলো না। জিকু কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো,

— কি প্ল্যান বস?

মাসফি একগালে রহস্যময় হাসি দিলো। চোখ বন্ধ করে কপালের কাছটা জোরে চেপে ধরলো। মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠেছে মনে হচ্ছে। কপালের ডান দিকটা মনে হচ্ছে ব্যাথায় ছুটে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ অবস্থায় জিকুকে আদেশ দিলো।

— জিকু লাইট বন্ধ করে দাও তো। আমি আলো সহ্য করতে পারছি না।

জিকু দ্রুত লাইট বন্ধ করে দিলো। মাইগ্রেনের রোগীদের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো আলো ও উচ্চ শব্দ। মাসফি চেয়ারে শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে নিচুস্বরে বললো,

— কালকের পার্টিতে কি আমাদের ইনভাইট করেছে?

— জ্বি বস। আমাদের সাথে তো তাদের দুটো টেন্ডারে এখনো চুক্তিবদ্ধ আছে।

— দ্যাটস ইট প্লাস পয়েন্ট। এটাকে কাজে লাগিয়ে সিদ্ধ হাসিল করতে হবে।

— কিন্তু বস কি করবেন?

— ওদের বোনকে কিডন্যাপ করবো।

জিকু চমকে উঠলো। বিস্মিয় তার চোখে মুখে উপচে পরছে। বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,

— কিডন্যাপ!

— হ্যাঁ, কিডন্যাপ। ঊষাকে কিডন্যাপ করবো আমরা।

— বস, এটা একেবারে অসম্ভব।

— অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে তোমাকে।

জিকু নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। তার বস কি প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে গেলো নাকি? সব যাচাই-বাছাই না করে এতবড় সিদ্ধান্ত নিলো। মাসফি মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। সে যেমন কষ্ট পেয়েছে তা মির্জাদের দিতে পারবে বলে।

— কোন অসম্ভবকে সম্ভব করবে তোমরা?

মাসফি,জিকু কন্ঠ অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো। সেদিক তাকিয়ে দেখতে পেলো অদিতি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রশ্নটা তাদের দিকে ছুঁড়ে মেরেছে। মাসফি চেয়ারে বসেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

— আরে অদিতি বাইরে কোনো ভেতরে আয়?

অদিতি মুখ গোমড়া করে উত্তর দিলো,
— আমি ভেতরে বসতে আসিনি। তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।

মাসফি একবার জিকুর দিকে তাকিয়ে অদিতিকে বললো,
— কিসের জরুরি কথা?

অদিতি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এক মিনিট চুপ থাকলো। তারপর শান্ত, স্বাভাবিক গলায় বললো,

— সেই কথা বলতেই আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি একটু আমার সাথে এসো। আমার তোমাকে অনেক কিছু জানানোর আছে। আমি জানি আজ না বললে সামনে বিশাল বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

মাসফি, জিকু একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। অদিতি নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মাসফির মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বাড়ছে। তবুও সে ধীর পায়ে অদিতিকে অনুসরণ করতে লাগলো।

ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আরাভ শিকদার ও তার স্ত্রী সবেমাত্র খেতে বসেছিলো। এলোমেলো পা ফেলে টলতে টলতে আরান সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ডাইনিং টেবিলে বাবা-মা কে বসে থাকতে দেখেও কোন ভ্রুক্ষেপ করলো না। নিজের রুমের পথ ধরলো।আরাভ শিকদার পেছন থেকে আরানকে ডাকলো।

— আরান!

আরান মাথা ঘুড়িয়ে তার লাল রঙের চোখ তুলে তার বাবার দিকে তাকালো। আরাভ শিকদার ছেলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি কি ড্রিংক করেছো?

আরান মুচকি হাসলো। তারপর বোকার মতো মাথা চুলকে মাথা উপরনিচ নাড়ালো। আরানের মা চোখ কপালে তুলে আরানকে বললো,

— আরান বাবা কি বলিস এসব? তুই হঠাৎ ড্রিংক কেন করলি?

আরাভ শিকদার ধমকে উঠলেন স্ত্রীকে,
— হয়েছে আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। তোমার আশকারায় ছেলেটা এমন বিগড়ে গেলো।

আরানের মা চুপ হয়ে গেলেন। আরান বাবার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। লোকটাকে আজকাল আরানের সহ্য হয় না। নিজের বাবা পরিচয় দিতেও ঘৃণা হয়। একটা মানুষ কতটা নিচে নামলে এতবড় ঘৃণ্য কাজ করতে পারে। তাই তার মাথায় খেলে না। থাক সেসব কথা। আরান এসব মনে করতে চায় না। এসব ভুলতেই তো ড্রিংক করলো। তবুও সেসব কথা মনে পরে যাচ্ছে। আরাভ শিকদার কড়া গলায় বললো,

— ভাই-বন্ধুদের সাথে চলতে চলতে এসবও শিখে নিছো? সারাদিন আড্ডাবাজি ছাড়া আর কি আছে?

আরাভ শিকদার চেয়ার ছেড়ে আরানের সামনে এসে দাড়িয়েছেন। আরান ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নিলো। সে তার বাবাকে ছোট থেকে দেখতে পারতো না। তার বাবা কারণে-অকারণে তার মায়ের গায়ে হাত তুলতো।এসব দেখে ছোট থেকেই আরান বাবার প্রতি চাপা ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছিলো।মাসফির সংস্পর্শে বাবার কথা ভুলে যেতো সে। মাসফি ওকে বড় ভাইয়ের মতো গার্ড করতো এবং এখনো করে৷ তাই সে বাবার থেকে বেশি মাসফিকে ভালোবাসে। এছাড়াও তার বাবা তার মায়ের সাথে ছোট থেকে ছোট কারণেও বাজে ব্যবহার করতো সাথে অকথ্য গালিগালাজ আছেই। আরানের মা সবকিছু ছেলের দিকে তাকিয়ে মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। মাঝে মাঝে ভাবে তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেলে সে কি করতো? কিভাবে বড় হতো?

আরাভ শিকদার ছেলের দিকে চোখ গরম করে তাকালো৷ আরান সেদিকে নজর দিলো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

— আমি বেঁচে থাকতে আপনার স্বার্থ হাসিল হবে না। এত নিচ কেন আপনি? আর কত নিচে নামবেন? জায়গায় সম্পত্তির জন্য নিজের ভাই-ভাবীকে মেরে দিলেন? নিজের ভাতিজি সেসব শুনে ফেলেছে বলে তাকেও মারতে উঠেপড়ে লাগলেন? অবশ্য আপনার মতো মানুষকে দিয়ে এছাড়া বা কি আশা করা যায়?

আরাভ শিকদার আৎকে উঠলেন। তার ছেলে এসব জানলো কি করে? তাহলে কি সেদিন জানালার বাইরে সে ছিলো? বিব্রত ভঙ্গিতে সে আরানকে জিজ্ঞেস করলো,

— তাহলে কি তুমি সেদিন….

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে আরান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

— হ্যাঁ, সেদিন আমি ছিলাম। আপনাকে মাঝ রাতে বাসা থেকে বের হতে দেখে বাইক নিয়ে ফলো করেছিলাম। সেদিন জানালার বাইরে থেকে এসব না শুনলে তো জানতেই পারতাম না আপনার এতো কুকর্মের কথা। একটা কথা শুনে রাখেন শিকদার সাহেব। এই আরান বেঁচে থাকতে আপনার দ্বারা কারো ক্ষতি হতে দিবে না। হোক সেটা আমার ভাই মাসফি কিংবা আমার বোন অদিতি হোক।

আরান ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যতদ্রুত পারলো নিজের রুমের দিকে ছুটলো। তার হাতে সময় কম। যা করার এরমধ্যে করতে হবে। আরানের মা আরানকে ডাকতে ডাকতে ছেলের পিছু নিলো। আরাভ শিকদার স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে চিন্তায় পরে গেলো। বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেদিনের ব্যাক্তিটাকে কল দিয়ে বললো,

— যা করার দ্রুত করতে হবে। আরান সবকিছু জেনে গেছে। আরান যাতে কোন ভেজাল না করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখো।দরকার পরলে ওকেও গুম করে দিবে। যেভাবে হোক আমার কাজ হওয়া চাই। আমার স্বার্থে নিজের ছেলে আটকালেও তার ক্ষতি করতেও আমি দ্বিধা করবো না।

আচ্ছা, আরাভ শিকদার কি লোভ-লালসায় পাগল হয়ে গেলো? নয়তো নিজের ছেলেকে নিয়ে এসব কেউ বলতে পারে? তার পতন এগিয়ে আসছে না তো? কথিত আছে কিছু মানুষ মৃত্যুর আগে অতিরিক্ত বাড় বাড়ে। আরাভ শিকদারের ক্ষেত্রেও কি তেমনি হবে?

~~~ স্বার্থপর মানুষ হতে সাবধান। এরা নিজের স্বার্থের জন্য বহু নিচে নামতে পারে।🖤

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here