স্রোতের টানে পর্ব-১৪

0
3944

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১৪

রাতে আয়ান বাসায় ফিরে রুমে এসে দেখলো ফারিহা স্টাডি টেবিলে বসে আছে।সামনে একটা বই খোলা,কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর পড়াশোনায় কোনো মনোযোগ নেই।একদৃষ্টিতে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
আসলে ফারিহা আয়ানের কথা ভাবছে!ফারিহাকে জোর করা হচ্ছে আর সেই চিৎকার ওর বাপিকে শোনালো!ওর বাপির মনের অবস্থা কি হবে সেটা ভেবেই ফারিহার বুক কেঁপে ওঠলো।ফারিহা জানে মিস্টার আজাদ আজকে অনেক কষ্ট পেয়েছে।মুখে না বললেও ফারিহা ওর বাবাকে বুঝতে পারে।

আয়ান একটু শব্দ করে ল্যাপটপটা টি-টেবিলের উপরে রাখলো।শব্দ শুনে ফারিহার চমকে ওঠে পাশ ফিরে দেখলো আয়ান এসেছে।ফারিহা স্টাডি টেবিল থেকে উঠে আয়ানের সামনে গেলো।ওর চোখ মুখ অস্বাভাবিক রকমের শান্ত।
আয়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ঘড়ি খুলতে থাকলো।ফারিহা আয়ানের কাছে গিয়ে বললো,

“আপনি বাপিকে কি বলেছেন?”

আয়ান না বোঝার ভান করে বললো, “কী বলেছি?হেই তুমি কি আবার মিস্টার আজাদের সাথে কথা বলেছ নাকি?”

“একদম না জানার নাটক করবেন না।আপনি বাপিকে ওই অডিওটা দিলেন কেনো?আপনি কি করে এটা করতে পারলেন?”

“কেনো অডিওটা শুনে মিস্টার আজাদ কান্না করেছে নাকি?ইশশশ.. আমি মিস করলাম।আচ্ছা মিস্টার আজাদ কিভাবে কান্না করলো? কতটা কষ্ট পেয়েছে?ফারিহা বলোনা..”

ফারিহা অবাক চোখে আয়ানকে দেখছে।আয়ান এতটা জঘন্য ফারিহা ভাবতে পারেনি।ফারিহা বললো,
“আপনি অমানুষ জানতাম কিন্তু এতটা অমানুষ সেটা কল্পনাও করতে পারিনি।ছি… ”

ফারিহার কথা শুনে মুহূর্তেই আয়ানের রাগ উঠে গেলো।আয়ান রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টাা করছে কিন্তু পারছে না।আয়ান তেড়ে গিয়ে ফারিহার গাল চেপে ধরে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে বললো,

“একদম আমাকে ছি বলবি না।আর কি বললি তুই আমি অমানুষ? হ্যাঁ আমি তো অমানুষই।জানিস না তুই?”

শক্ত করে ধরায় ফারিহা ব্যাথা চোখে জল এসে পড়লো।তবুও নিজেকে শক্ত রেখে বললো,
“জানি তো। কিন্তু আপনি কি করে ওই কাজটা করতে পারলেন?আপনি আমাকে যা করার আমাকে করেন কিন্তু বাপিকে কেনো কষ্ট দিলেন?আপনি কাজটা ঠিক করেননি”

আয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “তোর বাপিকে কষ্ট দেওয়াই আমার মূল উদ্দেশ্য”

ফারিহা আর যাই হোক ওর বাপির কষ্ট সহ্য করতে পারে না। তাই ফারিহা রেগে গেলো।ফারিহার সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করার পরেও ফারিহা আয়ানকে কিছু বলতে পারেনি।কিন্তু আজকে মিস্টার আজাদের কান্না মাখা চেহারা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।ফারিহা আয়ানের শার্টের কলার ধরে বললো,
“আমার সাথে যা করার করেন।আমাকে মেরে ফেলেন,আরো একশোবার আমাকে ধর্ষণ করেন!কিন্তু আমার বাপিকে কিছু করলে আমি আপনাকে ছাড়বো না”

শার্টের কলার ধরায় আয়ান রেগে গেলো।এত বড় মাফিয়া হওয়া স্বত্বেও,,এতো জনকে মারার পরেও কেউ আয়ানের গায়ে হাত তুলতে পারেনি। আর ফারুহা ওর শার্টের কলার ধরলো!
আয়ান রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “আমাকে ছাড়ো”

ফারিহার রাগ উঠে গিয়েছে।ও কি করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। ফারিহার খেয়াল নেই যে এই মুহূর্তে ও আয়ানের শার্টের কলার ধরে রয়েছে। ফারিয়া আরো শক্ত করে ধরে বললো,
“ছাড়বো না!কি করবেন আপনি?”

আয়ান ফারিহাকে ঝটকা মেরে সরিয়ে ফারিহার দুগালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মেরে দিলো।চড় খেয়ে ফারিহা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আয়ান ফারিহার মুখটা সোজা করে ধরে বললো,

“এই আয়ান খানের হিংস্র তুই এখনো দেখিস নি।আর তুই কি বললি আমি তোকে ধর্ষণ করেছি।শুনে রাখ তোকে আমি এমনি এমনি বিয়ে করিনি।তুই আমার বিয়ে করা বউ, তোর সাথে আমি যা ইচ্ছা তা করতে পারবো।
আরেরটা কথা,আর কখনো আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলতে আসলে চড় তো দূরে থাক এর থেকে ভয়ঙ্কর কিছু হবে।মাইন্ড ইট”

আয়ান ফারিহাকে ধাক্কা মেরে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ফারিহা মূর্তির মত ফ্লোরে বসে রয়েছে।আর চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে..

.
মিস্টার আজাদ বসার রুমে সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে। দুপুরে ফারিহা রেস্টুরেন্টে থেকে চলে যাওয়ার পর উনিও বাসায় চলে আসে।মিস্টার আজাদ দুপুর থেকে এখনো কিছু খাই নি।ফারিহার চিন্তায় বারবার অস্থির হয়ে উঠছে।মিস্টার আজাদের নিজের উপর নিজের ঘেন্না হচ্ছে। তার মেয়ের চিৎকার করে ওকে বাঁচাতে বললো কিন্তু মিস্টার আজাদ কিছু করতে পারলো না।অডিওটা শোনার পর মিস্টার আজাদ ঠিক করেছিল,যেভাবেই হোক ফারিহাকে আয়ানের কাছে যেতে দেবে না। কিন্তু এখন তো ফারিহা ই আসতে চাচ্ছে না।
মিস্টার আজাদ জানে আয়ান নিশ্চয় ফারিহাকে কোনো হুমকি দিয়েছে।মেয়েটা ওনাকে প্রচুর ভালোবাসে তার বাবার কোন ক্ষতি হোক এমন কিছু করবে না।দরকার হলে নিজে কষ্ট হবে কিন্তু বাবা কে ভালো রাখবে।
হল রুমের দেয়ালের ফারিহার একটা বড় হাসিমুখের ছবি আছে।ছবিটাতে ফারিহার কাঁধ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।ফারিহা অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছে আর চুলগুলো উড়ছে।দুগালে দুটো টোল পড়ে আছে। মিস্টার আজাদ একদৃষ্টিতে মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।এ মেয়েটাই যে উনার সবকিছু,, মেয়েটা কষ্টে থাকলে উনি কি করে ভালো থাকবে! আর যেখানে ফারিহা আসতে চাচ্ছেনা সেখানে মিস্টার আজাদ কি করতে পারে??

“স্যার ডিনার করবেন না?আপনি দুপুর থেকে কিছু খাননি।এভাবে থাকলে তো শরীর খারাপ করবে”

মিস্টার আজাদ হনুফা বেগমের কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো।হনুফা বেগম ফারিহার মা থাকতেই এই বাড়িতে কাজ করতো।মিস্টার আজাদ রাজনীতির কাজে ব্যস্ত থাকতো,তাই মা মারা যাওয়ার এই হনুফা বেগমই ফারিহাকে বড় করে।যেদিন ফারিহা কিডন্যাপ হয়েছিলো সেদিন সব শুনে হনুফা বেগম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।কারণ উনিও ফারিহাকে মেয়ের মত ভালবাসে।এবাড়িতে আরো সার্ভেন্ট আছে কিন্তু ফারিহা হনুফা বেগমের কাছে বেশি থাকতো। কিছুক্ষণ পর মিস্টার আজাদ বললো,
“আমি খাবো না।যাও”

“স্যার এরকম করলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।আমি কিন্তু ফারিহা মামনি কে বলে দিবো”

“হ্যাঁ বলো না। প্লিজ তাড়াতাড়ি বলো,ও যেন চলে
আসে।আয়ান আমাকে যা করার করুক তবু আমি ওকে আর কষ্ট পেতে দিবোনা”

“স্যার মামনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে।ও যা করেছে নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে করেছে”

“না ও যা করেছে ঠিক করছে না।ও আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজে এভেবে কষ্ট পেতে পারে না। আর এখন তো আমার কথাও শুনছে না।আমি কোথায় যাবো?”

“স্যার প্লিজ চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি খাবারটা খেয়ে নিন। না হলে মামুনির সবসময় শুনলে কিন্তু আরো কষ্ট পাবে। আপনি তো জানেন আপনি অসুস্থ হলে মামনি কত অস্থির হয়ে পড়ে”

হনুফা বেগমের কথা শুনে মিস্টার আজাদ মুচকি হাসলো।মেয়েটা ওনাকে প্রচুর ভালোবাসে।একবার মিস্টার আজাদের সামান্য জ্বর হয়েছিলো।ফারিহা সে কি কান্নাকাটি! যতক্ষণ না মিস্টার আজাদ সুস্থ হয়ে উঠেছে ততক্ষণ মিস্টার আজাদের বিছানার পাশে বসেছিলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, জলপট্টি দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো সব নিজ হাতে করেছে।ফারিহা ছোট হলেও বাবাকে অনেক যত্ন করতো।
কিছুক্ষণ পর হানিফ আহমেদ এসে বললো,
“স্যার আপনি খেয়ে নিন।আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কিন্তু আয়ানের ই লাভ”

মিস্টার আজাদ চোখ তুলে হানিফ আহমেদের দিকে তাকালো। হানিফ আহমেদ হনুফা বেগমের স্বামী।ওরা দুজন একই গ্রামে থাকতো।পরিবারের লোক ভালোবাসা মেনে নেয়নি বলে পালিয়েছে শহরে আসে।তারপর একটা সংস্থার মাধ্যমে ফারিহার মায়ের সাথে পরিচিত হয়।ফারিহা মা ওদের এই বাড়িতে নিয়ে আসে।
হানিফ আহমেদ মিস্টার আজাদের সাথে থাকে, রাজনীতির কাজে সাহায্য করে।হানিফ আহমেদ মিস্টার আজাদের কাছে এসে বললো,

“স্যার আপনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন।তাহলে তো ফারিহা আরো কষ্ট পাবে।আপনি তো জানেন আপনি অসুস্থ হলে ফারিহা ঠিক থাকতে পারে না।আর তাছাড়া আয়ানের থেকে ফারিহাকে মুক্ত করতে হলে আপনাকে তো সুস্থ থাকতে হবে”

মিস্টার আজাদ কিছু না বলে চুপচাপ বসা থেকে উঠে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেলো। হানিফ আহমেদ ইশারায় হনুফা বেগমকে খাবার দিতে বলে।

.
আয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো ফারিহা এখন ফ্লোরে বসে আছে।আয়ান ফারিহার কাছে গিয়ে বললো,
“এখানে বসে আছো কেনো?ওঠো”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহা কেঁপে উঠলো। আয়ানের রাগটা এখন কমে গিয়েছে তাই ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আলতো করে ফারিহার গালে হাত রাখলো।চড় মারার কারনে গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট।আয়ান আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ফারিহার দুগালে দুটো চুমু খেলো।ফারিহা আগের মতোই বসে আছে।বলতে গেলে এক প্রকার স্টেচু হয়ে গিয়েছে। আয়ান দুহাত দিয়ে ফারিহার চোখের অশ্রু মুছে দিলো।তারপর বললো,

“আমার রাগ উঠাও কেনো বলোতো?তুমি যদি আমার কথা মত চলো তাহলে তো আমি তোমাকে মারবো না।শুধু শুধু আমার সাথে তর্ক করে কেনো আমার রাগ উঠাও?আর এরকম করো না,,ঠিক আছে?এখন উঠো দেখি”

ফারিহা চুপচাপ আয়ানের দিকে তাকালো কিছু বললো না।আয়ান ফারিহার কাঁধ ধরে ফ্লোর থেকে উঠালো।তারপর বললো,
“আজকে ভার্সিটি থেকে এসে তো কিছু খাওনি।এখন ডিনার করবো চলো”

ফারিহা কিছু বলতে যাবে তখন আয়ান ফারিহাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার কথা অমান্য করা আমি পছন্দ করি না। আর কোনো কথা নয়।এখন খাবে মানে এখনই খাবে..চলো”

আয়ান আর একমুহূর্ত দেরি না করে ফারিহাকে কোলে তুলে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।ফারিহা অবাক চোখে আয়ানকে দেখছে।এই তো কিছুক্ষণ আগে ওর সাথে এতো রুড ব্যবহার করলো।এমনকি চড় ও মারলো আর এখন এসে ওকে চুমু খাচ্ছে!আদর করে কথা বলছে,কেয়ার করছে।আয়ানের আসল স্বত্বা কোনটা ফারিহা নিজেই বুজতে পারছ না!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here