শুকতারা পর্ব-৪

0
1897

#শুকতারা (পর্ব-৪)
#হালিমা রহমান

দোকানদার মোহন একবার বিড়াল ছানার দিকে নজর দিলো, একবার চশমা পরা ছেলেটার দিকে নজর দিলো।মিনমিন করে বললোঃ” অন্তু ভাই,আটশ টাকা কম হয় একদম।নয়শ দেন,দুইটা নিয়া যান।”

একটু বোধহয় বিরক্ত হলো অন্তু।গম্ভীর গলায় বললোঃ” যা বলেছি তাই,এর বেশি আর না।বরিশালে এর চাইতে সুন্দর ছানা কিনেছি আটশ টাকায়।তুই না দিলে না দে।”

_” আচ্ছা নেন।”

সূচি বুঝতে পারলো লোকটার নাম অন্তু।অন্য গ্রামের হয়তো।এ গ্রামে কখনো দেখেনি।তবে লোকটা ভীষণ বাজে। গড়গড় করে এতো দাম না বললে বিড়াল ছানাটা সূচিই কিনতে পারতো।সূচির খুব আফসোস হচ্ছে।তুলার মতো নরম তুলতুলে ছানাটা হাতছাড়া হয়ে গেল একদম।

_” খুকি,তুমি চাইলে ছয়শ টাকায় আমার থেকে একটা বিড়াল নিতে পারো।দুটো বিড়াল না হলেও চলবে আমার।”

_” আমি খুকি নই আমার নাম সূচি।”– মুখ ঝামটা দিলো সূচি।

_” সূচি! এ আবার কেমন নাম? সূচির আগে-পরে কিছু নেই?”

_” আপনাকে আমি চিনি? আপনাকে কেন বলব? আশ্চর্য লোক!”

হিজাবের ভিতর মুখ ভেংচি দিয়ে জায়গা ছাড়লো সূচি। দু-পা সামনে এগিয়ে একবার পিছু ফিরে দেখলো।চশমা পরা লোকটা এখনো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

_” বেয়াদব একটা।মেয়ে দেখলেই খেজুরে আলাপ জুড়ে দেয়।”— বিড়বিড় করে অন্তু নামের ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে আরো দু-তিনটে অশ্রাব্য গালি দিলো সূচি।

_” কি রে কই আছিলি? আমি খুঁজতে খুঁজতে শেষ।”

রত্নার কথায় অকারণেই বিরক্ত হলো সূচি। গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললোঃ” প্রেমিক খুঁজতে গেছিলাম।তুই যাবি?”

_” কি হইছে তোর?”

_” কিছু না। চল বাড়ি ফিরে যাই।”

_” ফুসকা খাবি না? ভূমি আপার লেগা আচারও কিনা হয় নাই।”

সূচি বড় একটা দম নিয়ে নিজের বিরক্তি গিলে নিলো। কতদিন পর ঘুরতে এসেছে। এভাবে সবকিছু মাটি করে লাভ নেই। সূচি এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে রত্নাকে বললোঃ” চল কিছু খাই।আর আমি দুটো লিপস্টিক কিনব।আজকে তোর কাছে রেখে,কাল আম্মার সামনে আমাকে দিবি। আম্মাকে বলবি আমার জন্য কিনেছিস মেলা থেকে।ঠিকাছে?”

_” আচ্ছা।এতো মিথ্যা কথা তুই ক্যামনে বলছ?”

_” এমনেই।লিপস্টিক দুটো তোর কাছে রাখতে দেব।খবরদার ব্যবহার করবি না।”

সূচি ও রত্না পা বাড়ালো অন্যদিকে। মেলার পুরো সময়টা পুরোপুরি উপভোগ করতে চায় ওরা।

***

বাংলায় খুব সুন্দর একটা প্রবাদ আছে– ” যেখানেই বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যা হয়।”

সূচি ঠিক যেই ভয়টা পেয়েছিল সেটাই হলো। সূচি ধরা পড়লো।খুব বাজে ভাবে মমিন শেখের হাতে ধরা পড়লো। ঠিক সাড়ে চারটা বাজার সাথে সাথে মেলা থেকে বেরিয়েছে রত্না ও সূচি। একগাদা মানুষ ঠেলে,ধুলো মাখা পথে তড়িঘড়ি করে পা চালিয়ে যখন মেলার বাইরে পা রাখলো,সূচির মন তখন আনন্দে টইটম্বুর। কতদিন পরে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই সূচি একটু বাইরে ঘুরতে পারলো।ঘরবন্ধি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলো মেয়েটা।
ভূমির জন্য জলপাই ও তেঁতুলের আচার কিনেছিল।সেগুলো নিয়ে খুব খুশি মনে বাড়ি ফেরার পথ ধরলো।

এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক থাকলেও, বিপত্তি ঘটলো বড় রাস্তায় রিকশা থামার পর। ভূমির বাড়ি যাওয়ার জন্য বড় রাস্তায় রিকশা থেকে নেমে গেল দুজনে। সূচি সবে পা রেখেছে রাস্তায়। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই সূচির দৃষ্টি আটকে যায়।বড় রাস্তার মাথায় কদম আলীর ছোট্ট চায়ের দোকান।মমিন শেখ সেখানে বসা।তার স্থির দৃষ্টি সূচির দিকেই।চোয়াল শক্ত,কপালের রগ ফুলে আছে। সূচির গলা শুকিয়ে কাঠ। পা দুটোকে অদৃশ্য কোনো কিছু আটকে রেখেছে মনে হচ্ছে। রত্নাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো সূচি,কিন্তু স্বর ফুটলো না গলা দিয়ে।

_” সূ.. সূচি কাকায় দেইখা ফেলছে।”

রত্না আলগোছে ভাড়া দিয়ে বিদায় করলো রিকশাওয়ালাকে।মমিন শেখ ততোক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন মেয়েকে।

_” কই গেছিলি?”

সূচি কিছুই বললো না।শুধু মাথা নিচু করে রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো।ভয়ে দু-ফোটা পানি বেড়িয়েছে চোখ থেকে।রত্নার নজর এড়ালো না তা।সে জবাবদিহির সুরে বললোঃ” আমি একটু মেলায় গেছিলাম, কাকা।সূচি যাইতে চায় নাই আমি জোর কইরা নিয়া গেছি।”

_” তুই বাসায় যা, রত্না।”

_” কাকা, বিশ্বাস করেন। আমিই জোর কইরা নিয়া গেছি সূচিরে।ওয় মোটেও.. ”

_” বাসায় যাইতে কইছি তোরে। সূচি বাড়ি চল।”

মেয়ের হাত শক্ত করে ধরলেন মমিন শেখ।সূচিকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত বেগে হেঁটে চললেন ধুলোমাখা রাস্তায়।
সূচির হাতের হাঁড়গুলো মনে হচ্ছে ভেঙেই যাবে।বাবার সাথে পা মেলাতে কষ্ট হচ্ছে খুব।হোঁচট খেয়েছে দুইবার।সরু রাস্তার দু-ধারে কাঁটাগাছ।সূচির বোরকার একাংশ কাঁটাগাছের সাথে ছিড়ে গেল।সূচি নজরও দিলো না।ভূমির জন্য কিনে আনা আচারের প্যাকেটগুলো পড়ে গেছে অনেক আগেই।সূচি মনে মনে আল্লাহর নাম জপে।আজ বেঁচে গেলে জীবনেও আর একা কোথাও যাওয়ার দুঃসাহস দেখাবে না — এই প্রতিজ্ঞাও করে মনে মনে।

***

সাহিদা বেগম উঠোনে পিঁড়ি পেতে কাঁথা সেলাই করছেন।তার মন-মেজাজ খুব খারাপ।মেয়েটাকে নিয়ে আর পারছেন না তিনি।বেলা শেষ অথচ মেয়ের দেখা নেই।রত্নার সাথে আর কোথাও যেতে দেওয়া যাবে না সূচিকে।আজ বাড়ি ফিরলে শাসন করতে হবে মেয়েকে।অতিরিক্ত বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।

চম্পা আরেকটা পিঁড়ি পেতে বসলো সাহিদা বেগমের সামনে। শীতের দিনে চুল শুকাতে ঝামেলা।শুকাতেই চায় না।চম্পা ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বললোঃ” চাচি আম্মা,সূচিরে দেখলাম না যে আজকে।কই ওয়?”

_” রত্নাগো বাড়িতে গেছে।”

_” ওর তো পরীক্ষা শেষ।কোথাও বেড়াইতে যাইবেন না?”

_” না।”

_” আহারে! মাইয়ার কপালটাই খারাপ।এক জায়গায় থাকতে আর কত ভালো লাগে?”

বাড়িতে ঢুকলেন মমিন শেখ। টেনে-হিঁচড়ে সূচিকে ঘরে ফেললেন। গলা উঁচিয়ে ঘরে ডাক দিলেন স্ত্রীকে।

_” সাহিদা,ঘরে আসো তাড়াতাড়ি। ”

সাহিদা বেগমের সাথে সাথে চম্পাও হতবাক।মমিন শেখের কন্ঠে তীব্র রাগের আভাস।চম্পাও সাহিদা বানুর সাথে পা চালায় সূচিদের ঘরের দিকে। বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করেঃ” কি হইছে,চাচি আম্মা?”

সাহিদা বেগমের কন্ঠ শোনা যায় না।ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসে সূচির কান্নার শব্দ।চিৎকার করে কাঁদছে মেয়েটা।কাঁদতে কাঁদতে কি যেন বলছে বিড়বিড় করে।স্পষ্ট বোঝা যায় না কিছু।

মমিন শেখ আরো শক্ত করে চুলের মুঠি ধরলেন সূচির।ডানহাতে ধরে রাখা চ্যালাকাঠ দিয়ে মেয়ের পিঠে সজোরে আঘাত করলেন।প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা।অশ্রাব্য দুটো গালি দিয়ে বললেনঃ” তোর কইলজা কাইট্টা মেঘনায় দিমু।এতো সাহস কে দিলো? কারে জিগায়া গেছিলি? কে আছিলো লগে?”

পিন খুলে মাথার দিকে হিজাব খুলে গেছে অনেক আগেই।চোখের পানি,নাকের পানি এক করে কাঁদছে সূচি।মমিন শেখের পা দুটো আলগোছে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললোঃ” আর যাব না,আব্বা।আজকের মতো মাফ করো,আর জীবনেও যাব না।”

মমিন শেখ মানলেন না।মেয়ের হাত ছাড়িয়ে সজোরে চড় মারলেন সূচির গালে। খোঁপা ছেড়ে আবারো চ্যালাকাঠ দিয়ে পিঠে মারলেন।শক্ত গলায় বললেনঃ” মেলায় কার লগে গেছিলি? সত্যি কইরা ক সূচি।রত্না আর তোর লগে আর কে আছিলো?”

সূচি মাথা নাড়ে।কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে উত্তর দেয়ঃ” আর কেউ ছিল না। বিশ্বাস করো আব্বা,আর কেউ ছিল না।আমরা দুইজন ছিলাম শুধু।”

সাহিদা বেগম নিরব দর্শক।স্বামীর কথা বিপরীতে কথা বলার সাহস তার কোনোদিন ছিল না, আজও নেই।অবশ্য স্বামীর কথার বাইরে কথা বলাও অপছন্দ তার।মমিন শেখের কথা শুনে বুঝতে পারছেন সূচি না বলে মেলায় গিয়েছিল। কত বড় সাহস! সাহিদা বেগমও মেয়ের সাহস দেখে দু-তিনটে গালি দেন স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে।

সূচির কান্নার শব্দে ভীড় জমে গেছে ঘরের বাইরে। ঘরের বাইরে ভীড় করেছে মহিলা মহল।সবাইকে ঠেলে-ঠুলে ঘরে ঢুকলো উত্তরের ঘরের বউ জয়া।মমিন শেখ চ্যালা কাঠ তুলেছিলো আরেকবার আঘাত করার জন্য,তার আগেই জয়া পৌঁছে যায় সেখানে।মাটিতে বসে, পড়ে থাকা সূচিকে বুকে আগলে নেয়।অসাবধানে মমিন শেখের চ্যালাকাঠের আঘাত লাগে জয়ার গায়ে।জয়া একবার জ্বলন্ত চোখে তাকায় মমিন শেখের দিকে। কঠিন গলায় বলেঃ” আপনে পাগল হইছেন,কাকা? সূচিরে মাইরা দম নিবেন?”

_” বউ ঘরে যাও তুমি।ওর সাহস কতবড়, ওয় কাউরে না বইলা মেলায় যায়! ওর পাও দুইটা গুড়া গুড়া কইরা ভাঙমু আজকে।”— আবারো সূচির চুলের খোঁপা ধরে ঝাকুনি দেয় মমিন শেখ।

সূচির শরীর ভেঙে আসছে।পিঠ বেয়ে কি যেন পড়ছে।রক্ত নাকি? সূচি আতকে উঠে।এতো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে? পুরো পিঠ জুড়ে চ্যাটচ্যাট করছে আঠালো কিছু।সূচির চোখ বুজে আসে।আশেপাশে সবাই চিৎকার করছে।মায়ের কন্ঠ কানে আসছে সূচির।কি যেন বলছে মা।সূচি স্পষ্ট বুঝতে পারে না।আরো অনেক মানুষের কন্ঠে কানে তালা লাগার জোগাড়। এরা এতো কথা বলে কেন? বাবার হাতটা মনে হচ্ছে সূচির খোঁপায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।বাবা হাতটা সরাচ্ছেই না।সূচির চুলের গোড়ায় গোড়ায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়।সূচি চোখ বন্ধ করে ফেলে।গলা শুকিয়ে আসছে।একটু পানি হলে এবারের মতো বেঁচে যেত সূচি।জয়া ভাবির কন্ঠ অস্পষ্টভাবে কানে আসে সূচির।গালে হাত বুলিয়ে কি যেন বলছে,সূচি বুঝতে পারে না।জয়ার বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে পানি চায় সূচি।একবার,দু’বার — তারপর বাসি ফুলের মতো নেতিয়ে যায় জয়ার বুকে।

***

গালে একটা মশা কামড় দিলো।এই জায়গার এই এক সমস্যা।দিনেও মশা,রাতেও মশা।একটু অন্ধকার হলেই মশার দল সমস্বরে গান গায়।গাল চুলকে সোজা হলো সূচি। সাথে সাথেই পিঠের ব্যাথায় আবার ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।পিঠের হাঁড় বোধহয় ভেঙেই গেছে।চোখের পাতায় কে যেন কয়েক কেজি জিনিস তুলে দিয়েছে। চোখ মেলে দেখতে কষ্ট হয় সূচির।তবুও চোখ খোলে।পিটপিট করে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করে।খাটের বিপরীতেই ব্যবহার্য আলনা চোখে পড়ে।
আলনার উপর বোরকাটা মেলে দেওয়া।
সূচির রুমে ঘন অন্ধকার।রাত নেমেছে? জয়া ভাবির বুকে নেতিয়ে যাওয়ার পর কি হয়েছিলো? মনে পড়ে না সূচির।সূচি কি তবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? এখন কয়টা বাজে?

সূচি উঠার চেষ্টা করে।শরীর,মাথা — সব ব্যাথা। গলাটাও শুকিয়ে আছে।সূচি খুকখুক করে কাশে।চম্পা বোধহয় রুমের বাইরেই বসা ছিল।সে দৌড়ে আসে।সাহিদা বেগমও পিছু পিছু আসেন। হাতে হারিকেন।কারেন্ট নেই।সাহিদা বেগম এসে পাশে বসেন।বিছানার পাশের টুলের উপর হারিকেন রেখে প্রশ্ন করেনঃ” কখন উঠলি? শরীর কেমন এহন?”

সূচির পা থেকে মাথা অবধি অভিমানের স্রোত বয়ে যায়।মায়ের প্রতি খুব বেশি শ্রদ্ধা কখনোই ছিল না।বাবার প্রতি মায়ের অতিরিক্ত আনুগত্য, অতিরিক্ত বশ্যতা ওদের মা-মেয়ের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে।দুজনের মাঝের সম্পর্কটা ঠিক ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের মতো।একপক্ষ শুধু হুকুম করে আরেক পক্ষ অনিচ্ছায় তা পালন করে।সাহিদা বেগমকে দেখতেই সূচির বিকালের দৃশ্য মনে পড়ে যায়।মা কি থামাতে পারতো না বাবাকে? সূচি যদি আজ মরে যেত? মা কি কাঁদতো? উহুঁ,মা বড্ড পাষাণ।

_” কি রে কি জিগাই? শরীর ক্যামন এহন?”

_” বেঁচে আছি,মরিনি এখনো।আব্বাকে ডাক দিয়ে বলো গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলতে।”

মেয়েটা অতিরিক্ত বেয়াদব।সাহিদা বানুর খুব অসহায় লাগে।এমন গোঁয়ার মেয়ে তিনি জীবনেও দেখেননি।সাহিদা বেগম আবার প্রশ্ন করার আগেই থমকে যান সূচির কথা শুনে।সূচি তার দিকেই চেয়েই আছে।বড় বড় চোখ দুটোতে পানিতে টইটইটম্বুর।

_” আম্মা,আমি কি মানুষ না? আমার কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করে না? তোমরা কোনোদিন আমাকে নিয়ে কোথাও গেছো? কোথাও যাও নাই।একটা পছন্দের জিনিস কোনোদিন কিনে দিছো? তাও দেও নাই। বড় আপার দোষের জের টানছি আমি।কেন? আমার কি দোষ? আমাকে কোনোদিন কারো সাথে দাঁড়ায় কথা বলতে দেখছো? তাও দেখো নাই।তবুও কেন সন্দেহ করো আম্মা? এতো শাসন-বারণের মাঝে মানুষ থাকতে পারে? আমি মন খুলে কিছু করতে পারি না।একটা কিছু না।বিরক্ত লাগে আমার।তোমারেও বিরক্ত লাগে,আব্বারেও বিরক্ত লাগে।তোমাদেরকে দেখলেও দম বন্ধ হয়।তোমরা এতো না মেরে এক কাজ করতে পারো, একবারে মেরে ফেলতে পারো।আমিও বেঁচে যাই, তোমরাও বেঁচে যাও।”

আবারো কাঁদে সূচি।সাহিদা বেগম এগিয়ে না এলেও,এগিয়ে আসে চম্পা।সূচির খাটে সূচির গা ঘেষে বসে।সান্ত্বনা দিয়ে বলেঃ” থাক কান্দিস না।বাপ-মা শাসন করেই।পিঠের রক্ত পড়া বন্ধ হইছে? দেখি কামিজটা একটু উপরে তোল।চ্যালাকাঠে তারকাঁটা আছিলো।নাইলে কাটতো না।”

সূচি কামিজ তোলে না।সাহিদা বানুর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে বালিশে। চম্পার দিকে ফিরে বলেঃ” মা-বাবার শাসন আর আমার আব্বা-আম্মার শাসনে অনেক তফাৎ ভাবি।সেবা করা লাগবে না।আমি এতো সহজে মরব না।তবে একটা উপকার করতে পারো।রায়হান ভাইয়ের ফার্মেসী থেকে পারলে এক পাতা ঘুমের ঔষধ এনে দিও। এক পাতা ঘুমের ঔষধ খেলে নাকি মানুষ মারা যায়। তুমি চাইলে এই উপকারটুকু করতে পারো।”

মেয়ের কথা শুনে আত্মা শুকিয়ে আসে সাহিদা বানুর।সূচির কন্ঠ অন্যরকম শোনাচ্ছে। একদম অন্যরকম,মনে হয় যেন সূচির উপর ভর করেছে অশরীরী কিছু। মেয়ে কি আত্মহত্যার চিন্তা করছে? সাহিদা বেগম কল্পনায় যেন দেখতে পান সূচির অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।আম গাছে পা দুটো ঝুলছে,ঝুলছে।মাথাটা কাত হয়ে আছে।সাহিদা বেগম ঢোক গিলে। এই প্রথম প্রশ্ন জাগে সাহিদা বানুর মনে।তিনি কি মা হিসেবে সত্যিই ব্যর্থ??

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here