শুকতারা পর্ব-২৪

0
914

 

#শুকতারা (পর্ব-২৩)
#হালিমা রহমান

মাঘের শেষদিক।শীতের তীব্রতা ইদানীং কম। অবশ্য শীত নেই বললেই চলে।লেপ-কম্বল লাগে না।রাতে পাতলা কাঁথা হলেই চলে। এখনো সকাল-সন্ধ্যা পাতলা কুয়াশা পড়ে।এ বছর শীতটা কম পড়লো। দরজায় বসন্ত কড়া নাড়ার আগেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিচ্ছে শীত।
ফেব্রুয়ারির দশ তারিখ আজ।দেখতে দেখতে বিয়ের অনেকদিন পেরিয়ে গেছে।এক মাসের বেশি।কম সময় না।নতুন বউয়ের তকমা ঘুচে গেছে পিঠের উপর থেকে।অবশ্য,বিয়ের ছয়-সাতদিনের মাঝেই সূচি বুঝেছে এখানে কোনো ছাড় পাওয়া যাবে না। সত্যি বলতে,এই কয়েকদিনে ছাড় পায়নি একচুলও।শ্বাশুড়ির বাধ্যগত বউ সূচি।যেভাবে বলে ঠিক সেভাবেই নড়ে।রোমেলা বানুর চোখের দিকে তাকানোর সাহস আজ অবধি হয়নি সূচির।কাঠখোট্টা সেপাইয়ের মতো মুখটা দেখলেই কলিজা কাঁপে।পৃথিবীতে ওই একটা মানুষের ছায়া দেখলেও সূচির হাঁটু কাঁপে। কেমন শক্ত শক্ত কথা বলে! সূচির আত্মা থরথর করে কাঁপে।তাই তো হাজারবার বকা-ঝকা করার পরেও সূচি রা কাড়ে না।চুপচাপ কান পেতে শুনে নেয়। এমনকি কোনো কাজ ঠিক করে করার পরেও রোমেলা বানু যদি বলে ভুল হয়েছে,সূচি তাও চুপচাপ মেনে নেয়।একবারের জন্যেও প্রতিবাদ করে না।শ্বাশুড়ির কথামতো আবার করার চেষ্টা করব।সূচি পুরোপুরি অনুগত।বিয়ের আগের তর্কবাজ, বেয়াদব, চঞ্চল সূচি পুরোদস্তুর বদলে গেছে।সূচির দেহটুকু আছে আগের মতো।দুষ্টু, দুরন্ত,মুখরা,প্রাণে টইটম্বুর আত্মাটা আর আগের মতো নেই।পুরোটা ছেঁয়ে গেছে অবসন্নতায়। প্রতিরাতে মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলেন সাহিদা বেগম। কখনো কখনো কথা বলতে বলতে ঘন্টা পেরোয়।সূচির কন্ঠ,কথা বলার ধরন দেখে অবাক হন সাহিদা বেগম।মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এখনো পা রাখার সুযোগ হয়নি।কেবল কথা বলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।মেয়ের নেতিয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর মায়ের কানে খট করে বাজে।গলায় খানিক চিন্তা ঢেলে প্রশ্ন করেনঃ” ওই বাড়িতে কিছু হইছে সূচি? তোর কন্ঠ এমন লাগে কেন? জামাই,বেয়াইন সবাই ভালো আছে?”

সূচি মুচকি হাসে।ফোন কানে চেপে ধরে বলেঃ” সবাই ভালো আছে আম্মা। ঘুম এসেছে বলেই কন্ঠটা এমন শোনাচ্ছে।”

সাহিদা বেগম তাড়াতাড়ি করে ফোন রেখে দেন।কল কাটার আগে তাড়া দিয়ে বলেনঃ” তাড়াতাড়ি ঘুমায়া পর তাইলে।ঘুমের জ্বালায় কথাই কইতে পারতাছোছ না।রাখি আজকে।আল্লাহ হাফেজ।”

এ প্রতিদিনের ঘটনা।সূচি ফোন রেখে দেয়।মনটা খারাপ হয়ে যায় হুট করেই। মলিন কন্ঠ শুনে মা সবার কথা জিজ্ঞেস করলো,শুধু সূচির কথা ছাড়া।এতোদিনে কেউ একবারও জিজ্ঞাসা করেনি, সূচি কেমন আছে। বাবা কল করলেও একই কাহিনী।সূচির এখন আর রাগ হয় না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে বুঝ দেয়,এমনই হয়। নিজের মেয়ের খবর এতো আড়ম্বর করে জিজ্ঞাসা করার কী আছে? মায়ের জায়গায় সূচি থাকলেও হয়তো এমনই করতো।এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
ফোন রেখে সূচি দ্রুত পায়ে আবার শ্বাশুড়ির ঘরে চলে যায়।রোমেলা বানুর বাতের ব্যাথা।হাত-পা নাকি শিরশির করে। শীতের দিনে এই শিরশিরানি বাড়ে। একটু হাত-পা টিপে দিলে আরাম করে ঘুমাতে পারে।সূচি তাড়াহুড়ো করে শ্বাশুড়ির মশারির ভিতর ঢুকে যায়। ক্লান্ত শরীরটাকে সোজা করে রেখে দুর্বল হাতে রুগ্ন পা দুটো টিপে দেয়।সূচির অস্তিত্বের খোঁজ পেয়ে বুজে রাখা চোখ দুটো ঝট করে খুলে ফেলেন রোমেলা বানু।শক্ত গলায় ঘোষণা দেনঃ” তুমি অনেক ফাঁকিবাজ বউ।এইটুকু কাজও সময় মতো না করতে পারলে,খাইবা কী কইরা? ভাত খাইছো সেই কখন! আরো আগেই আসতে পারতা।”

বাড়িতে কথা বলার বিষয়টা উল্লেখ করে না সূচি।মাথা নিচু করে বলেঃ” আর হবে না,আম্মা।”

এতো আনুগত্যের কারণ শ্রদ্ধা নাকি ভয়, তা বলা মুশকিল।সূচির মনের কোনে কী চলে তা আমার জানা নেই।তবে সূচিকে দেখলেই বেশ বোঝা যায়।মেয়েটা মানিয়ে নিতে শিখে গেছে।মানিয়ে নেওয়ার অনেক গুণ।

এ বাড়ির একটা মানুষের সাথে সূচির অনেক ভাব।গলায় গলায় খাতির।সে হলো হুমায়রা।এই কাজী বাড়িতে হুমায়রার ছোট্ট ঘরটাতেই সূচি একফালি সুখ খুঁজে পায়।একটু শান্তির খোঁজে সময় পেলেই ছুটে যায় হুমায়রার ঘরে। মানুষটাকে বেশ পছন্দ করে সূচি। চম্পা ভাবি,মনি ভাবি,জয়া ভাবি অথবা ভূমি আপা,এই চারজনের সাথে অনায়াসে মিলিয়ে নিতে পারে বড় ভাবিকে। তবে হুমায়রার মাঝে সূচি বড় আপার ছায়া দেখে।ভূমি,সূচির বড় আপা– যে স্বস্তির ভিন্ন নাম। হুমায়রাকেও এভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারে সূচি।হুমায়রা,এ বাড়িতে স্বস্তির আরেক নাম। সূচি একটু সময় পেলেই হুমায়রার ঘরে যায়।তবে প্রকাশ্যে যাওয়ার সু্যোগ নেই।যায় গোপনে।রোমেলা বানুর চোখ বাঁচিয়ে,আড়ালে আবডালে।
হুমায়রার সাথে ভাব সেই প্রথম থেকেই।সূচি টুকটাক কাজ জানতো ঠিকই কিন্তু গোটা সংসার চালানোর কাজ জানতো না।বাবার বাড়িতে মাঝে মাঝে শখ করে রান্নাঘরে গেছে। সিলিন্ডারের গ্যাসে দু-এক কাপ চা অথবা আলু ভাজা,বেগুন ভাজা,একটু ডিম ভাজি করেছে শখের বশে।মা অসুস্থ থাকলে বাধ্য হয়েই রান্নাঘরে যেতে হতো।সূচি তখন শর্টকাটে রান্না সেড়ে ফেলতো।গ্যাসে এক পট চাল বসিয়ে,দু-তিনটা আলু সেদ্ধ করে ফেলতো। মাটির চুলা,লাকড়ির ধারে-কাছেও ঘেঁষত না। ওসব ভীষণ ঝামেলা মনে হতো সূচির। উনুনে মা চ্যালাকাঠ গুজে দিলে সুন্দর আগুন হতো।সূচি দিলেই সব গোলমাল।আগুনের বদলে ধোঁয়ায় ভরে যায় রান্নাঘর।আগুন জ্বলে না,লাকড়িগুলো নষ্ট হয় কেবল।এই সূচিই যখন এ ঘরে কাজের সাগরে পড়লো,তখন একদম দিশেহারা হয়ে গেল। এই তো এক মাস আগের কথা।সূচি দু’বেলা রুটি বানায় অথচ রুটি গোল হয় না।ভাতের মাড় ফেলার সময় হাত-পায়ের আঙুল পুড়িয়ে ফেলে। রান্না করতে গেলে ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক।পাতিল পুড়ে যায়,মাটির চুলায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে জানে না সূচি।জামা-কাপড় সাবানে ভেজানোর সময় সাবান বেশি হয়।শতবার ধোয়ার পরেও সাবানের গন্ধটা লেগেই থাকে।গরুকে খাবার দেওয়াও আরেক যন্ত্রণা।এরা সেই শেষ রাত থেকে ডাকা শুরু করে। পুবের আকাশে শুকতারা যখন জ্বলজ্বল করে,সূচি তখন চোখ রগড়ে ঘুম তাড়ায়।ক্লান্ত দেহটাকে জোর করে খাড়া করে গোয়ালঘরের দিকে ছুটে যায়। উবু হয়ে ভুসি গোলায়।অবলা জীব দুটোর গায়ে থাবড়ে-থুবড়ে তাদেরকে চুপ করায়।এসব একেবারে নতুন কাজ সূচির জন্য।জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এসব করেনি। এমনকি মাকেও কখনো করতে দেখেনি। এরপর ভোরের আগ থেকেই শুরু হয় সূচির কর্মযজ্ঞ। এটা-ওটা করতে করতে কখন ফজরের আযান পড়ে যায়,সূচি বুঝতেই পারে না।আনাড়ি বলেই কাজে সুবিধা করতে পারতো না।সময়ের সাথে পাল্লা দিতে চাইতো সূচি,কিন্তু ঠিক হয়ে উঠতো না।দুরন্ত সময়ের সাথে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য কোথায় সূচির?
রোমেলা বানু হুকুম করেই খালাস।সারাদিন এটা-ওটা করার কথা তার ঠোঁটের আগায়।কিন্তু হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার গুণ তার কম।অবশ্য, এক্ষেত্রে সূচিরও কিছুটা দোষ আছে।রোমেলা বানু কাজের কাছে এলে সে তটস্থ হয় বেশি।ভয়ে সিটিয়ে থাকে।হাত-পা কাঁপে।পারা কাজটাও ভুলে যায়।এই তো সেদিন, সূচি বেগুন কাটছিলো।রোমেলা বানু যেয়ে পাশে বসলেন।সূচি মুহূর্তেই তটস্থ হয়ে গেল ভয়ে।পোকাসহ বেগুনটা কেটে ফেললো।রোমেলা বানুর অভিজ্ঞ চোখ।ভুলটুকু চোখে পড়তে সময় লাগেনি।অমনি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ধমক দিলেন।ধমকের চোটে কেঁপে উঠলো সূচি।হাতটা অসাবধানতায় পড়ে গেলো বটির উপর।বুড়ো আঙুলটা ফ্যাচ করে কেটে গেল।রোমেলা বানুর ধমক কমলো না। এমন বেকুব মেয়ে তিনি জীবনেও দেখেননি। যেমন অলস, তেমন জ্ঞান কম। সূচির মা-মাসি এক করে বকলেন রোমেলা বানু।সূচি আর কী করে? হাতে ময়লা একটা কাপড় প্যাঁচিয়ে আবার রান্নার কাজে গেল।ভাগ্যিস সূচি ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে না।কথায় কথায় কান্নার স্বভাব থাকলে ভুগতে হতো সূচিকে।এতোদিনে হয়তো কাজী বাড়িতেই আরেকটা পুকুর হতো সূচির চোখের জলে।
রোমেলা বানুর কাছে কিছু শিখতে পারেনি সূচি।কিছু না বলতে কিছুই না। সর্বদা বকাবকি, চোখ রাঙানোর মাঝে মানুষ কতটুকু শিখতে পারে? সূচিও পারেনি।এই একমাসে মেয়েটা যতটুকু কাজ শিখেছে,তার নব্বই ভাগ শিখিয়েছে হুমায়রা।হুমায়রা এ ঘরে নিষিদ্ধ ব্যাক্তি। সামনে বসে থেকে হাতে-কলমে শিখাতে পারেনি সূচিকে। প্রথমদিকে সূচি যখন চুলা জ্বালাতে না পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো,ভালোভাবে তরকারী না রাঁধতে পেরে ভাতের থালা সামনে রেখে চুপচাপ বসে থাকতো,সকাল-সন্ধ্যা শ্বাশুড়ির কথা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হতো,তখন সাহায্যের হাতটা এগিয়ে এলো হুমায়রার দিক থেকে।রোমেলা বানু দুপুরে ভাত খেয়ে আসর পর্যন্ত ঘুমান।ফয়সালও ঘুমিয়ে থাকে।সেসময়ে হুমায়রা এসে সূচির জানলার পিছে দাঁড়াতো।চুপিচুপি সূচিকে নিজের ঘরে ডাকতো।প্রথমদিকে যেতে চাইতো না সূচি।কারণ রোমেলা বানুর নিষেধ আছে।হুমায়রার সাথে কথা বলা যাবে না,এ আদেশ করেছেন তিনি বিয়ের পরপরই। হুমায়রাই জোর করে নিয়ে যেতো সূচিকে।হাত টেনে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলতোঃ” চল তাড়াতাড়ি, আম্মা উঠার আগেই আইসা পইড়ো।”

সূচি ভাব করতে চাইতো না।আপত্তি জানিয়ে বলতোঃ” ভাবি,আমি ঘুমাব এখন।পরে যাব।”

শ্বাশুড়ির নিষেধাজ্ঞার কথা বলতো না সূচি।তবে হুমায়রা বোধহয় বুঝতে পারতো।মুচকি হেসে বলতোঃ” বাঁইচ্চা থাকলে আরো ঘুমাইতে পারবা।ভয় নাই।আম্মা আসরের আগে উঠে না।”

এভাবেই শুরু।প্রথমদিন হুমায়রা শিখিয়ে দিলো চুলা জ্বালানোর নিয়ম। সূচি পারে কিন্তু ঠিকঠাকভাবে পারে না।তারপর একে একে সব শিখলো সূচি।আগুন নিয়ন্ত্রনের নিয়ম,ঠিকঠাকমতো মশলা দিয়ে তরকারি রাঁধার নিয়ম, কাপড় ধোয়ার নিয়ম,গরুকে খাবার দেওয়ার নিয়ম– সব শিখলো সূচি।একে একে সব।ঘরের কাজে সূচির মাথা ভালো ছুটে। শিখতে সময় লাগেনি।এক মাসের মাঝেই মোটামুটি সব শিখেছে।তবে তাড়াতাড়ি কাজ শেখার জন্য যন্ত্রণাও কম পোহাতে হয়নি। সূচির হাতগুলোর দিকে তাকানো যায় না এখন।নখ ভেঙে,পুরো হাত কালচে হয়ে গেছে।পাক্কা গৃহিনীদের মতো দুটো হাত।পিঠ ভাসানো চুলগুলো সর্বদা রুক্ষ থাকে।চুলের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়? সূচির গায়ের রঙ চাপা।চোখগুলো ডাগর ডাগর।বড় বড় চোখ দুটোর নিচে এক আঙুল কালি পড়েছে। এখন আর কাজল দিলে ভালো লাগে না।কাজল লেপ্টে বিভৎস দেখায়।শাড়ির আঁচল সবসময় মোচড়ানো থাকে।কুঁচিগুলো এলোমেলো।কাজের চাপে কখনো কখনো শাড়িই ঠিক থাকে না।নিজের দিকে দেখার সময় কোথায়?তবে এখন রান্নাবাড়ার সময় দুর্ঘটনাগুলো কম ঘটে। কাপড়গুলোও বেশ ভালোই পরিষ্কার হয়।উঠোন ঝাঁট দিলে পরিষ্কার হয়।সবই মোটামুটি ঠিকঠাক হয়।কিন্তু সূচিও মানুষ।আগের খোলসটাকে পুরোপুরি ফেলে দিতে পারেনি।এখনো কলতলায় ময়লা হাঁড়ি-পাতিল দেখলে মন খারাপ হয়।রান্নার কাজে মন বসে না। নিয়ম করে রোজ সকালবেলা কাপড় ধোয়ার সময় বিরক্ত লাগে।শেষ রাতে তো ঘুম থেকে উঠতেই বেগ পেতে হয়।বারোটা-সাড়ে বারোটার দিকে ঘুমিয়ে আবার রাতের শেষে উঠতে ইচ্ছা করে না। বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে।এলার্মের শব্দেও উঠতে ইচ্ছা করে না।প্রায় প্রতিদিন ফয়সালই তুলে দেয়।এলার্ম বন্ধ করে সূচির হাতে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে বলেঃ” এই উঠো সূচি।তাড়াতাড়ি উঠো।প্রতিদিন ডাকা লাগে কেন? এতোদিনে অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা।”

সূচির অভ্যাস হয় না বলেই হাত-মুখ ধোয়ার সময় কলের কাছে দাঁড়িয়ে একচোট কেঁদে নেয় ।তখন খুব রাগ উঠে সবার প্রতি।রোমেলা বানু তখন ঘুমিয়ে থাকে বলেই রক্ষা।নাহয় সূচি কবেই রাগের মাথায় বিদ্রোহ করে ফেলতো।অন্ধকার আকাশে শুকতারা দপদপ করে জ্বলে।সূচি রক্তজবার মতো টকটকে চোখ দুটো নিয়ে গোয়ালঘরে যায়।গরুকে খাবার দেয়।বিশাল উঠোনটার এ মাথা-ও মাথা ঝাঁট দেয়।বাসি ঘর ঝাঁট দেয়।রোমেলা বানু নাকি বাসি উঠোন, বাসি ঘরে পা রাখতে পারেন না।মাঝে মাঝে সূচির মনে প্রশ্ন জাগে।ফয়সালের বিয়ের আগে তিনি কী করতেন? হুমায়রা আলাদা থাকে।তখন এই এতো কাজ কে করতো? শ্বাশুড়ির এতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বাতিক বিশ্বাস কর‍তে কষ্ট হয় সূচির।বিয়েরদিন দেখেছে সে এ বাড়ির অবস্থা। ধুলাবালির গড়াগড়িতে সূচির মতো অগোছালো মেয়েরই শরীর ঘিনঘিন করতো।বাথরুমে ঢুকতে পারতো না সূচি, এতোই নোংরা ছিল সবকিছু।সেসব তো বেশিদিন আগের কথা নয়।তাই তো শ্বাশুড়ির দিকে মাঝে মাঝে আড়ালে-আবডালে কপাল কুঁচকে তাকায় সূচি।এতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কেবল অতিরিক্ত উপদ্রব বলেই মনে হয়। এতো পরিষ্কার মানুষের ঘর আবার নোংরা ছিল কী করে?

এ বাড়িতে আরেকটা মানুষ আছে। সূচির স্বামী,কাজী ফয়সাল।এই মানুষটাকে ঠিক চিনতে পারে না সূচি।বুঝতেও পারে না ঠিকঠাক।কখন রেগে যায়,কখন খুশি হয় হয়,কখন কষ্ট পায়,তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি সূচি।তাদের দুজনের মাঝে খুব বেশি সুসম্পর্ক নেই। আবার চোখে পড়ার মতো লাঠালাঠির সম্পর্কও নেই।একমাস আগে যেমন ছিল,তার চেয়ে খানিকটা বদলেছে।এখন আর কথায় কথায় চোটপাট করে না ফয়সাল।চোখ রাঙায় না। কথা বলে, তবে বেরসিকের মতো।বেরসিকের কথায় আনন্দ পায় না সূচি।লোকটা হাসি-ঠাট্টা করতে জানে না,মজা করতে জানে না,প্রেমে পরতে পারে না এমনকি ভালোবাসতেও তার তীব্র আপত্তি।সূচি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ফয়সালকে।অবশ্য চেনার,বোঝার সময় কোথায়? সকালে ফয়সাল যখন খামারে চলে যায়, সূচি তখন রান্নাঘরে থাকে।দুপুরে খাওয়ার পরে পাতিল-থালা ধুতে ধুতেই ফয়সাল ঘুমিয়ে যায়।ফয়সাল ঘুমায়,সূচি কাজ-কর্ম শেষ করে হুমায়রার কাছে যায় কাজ শিখতে।কখনো কখনো একটু গাল-গল্পও করতে যায়। একাকিত্ব আর কতক্ষণ ভালো লাগে? রাতেরবেলা খাওয়ার পরে সূচি ছুটে যায় রোমেলা বানুর ঘরে।ঝুঁকে ঝুঁকে সে যখন শ্বাশুড়ির পা টিপে,ফয়সাল তখন ঘুমের রাজ্যে। রোমেলা বানুর সেবা শেষ করে সূচি যখন ঘরে ফিরে আসে,তখন আর কোনোদিকে খেয়াল করার মন-মানসিকতা, শক্তি– কোনোটাই থাকে না।ধপ করে ফয়সালের পাশে শুয়ে পড়ে।সারা পৃথিবী গোল্লায় যাক,সূচি তখন প্রাণভরে ঘুমায়। ফয়সালের সাথে ভাব হবে কী করে?
তবে সময়ে-অসময়ে কথা শুনাতে ছাড়ে না ফয়সাল।লোকটা একটু পাগল গোছের।সূচিকে রাগিয়ে সে দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায়।এই তো সেদিনের কথা।গোসল সেড়ে সূচি তাড়াতাড়ি করে ঘরে ঢুকলো।চুলায় শিমের তরকারি বসানো।দ্রুত শাড়ি পরে রান্নাঘরে যেতে হবে।শাড়ি পরা প্রায় শেষ,কুঁচিটা কেবল দেওয়া বাকি।দরজায় ছিটকিনি দেওয়া ছিল না।খামার থেকে বাড়ি ফিরে তখনই রুমে ঢুকলো ফয়সাল। সূচির দিকে একনজর দেখে দ্রুত হাতে ছিটকিনি তুলে দিলো দরজায়।গম্ভীর গলায় বললোঃ” ছিটকিনি লাগিয়ে নেওয়া যায় না?”

সূচির হাত তখন কুঁচির ভাঁজে মত্ত। কাজ করতে করতেই হালকা চালে বললোঃ” সবসময় এতো বকেন কেন? শাড়ির কুঁচিটা একটু ঠিক করে দিলেই পারেন।দেখছেন তাড়াহুড়ো করছি।সবসময় খালি বেশি কথা।”

কথাটা সূচি বলেছিল এমনিই।ভেবেছিল ফয়সাল আরেকটা শক্ত কথা বলবে।কিন্তু না,তা করলো না।হাঁটু গেড়ে বসে ঠিকই কুঁচিগুলো ঠিক করে দিলো।সূচি চমকে গেল।ভাবলো, এই তো আল্লাহ তার কথা শুনেছে।আগের মতো এবারেও খোদা তার প্রার্থনা কবুল করেছে।মুহুর্তেই চাঙ্গা হলো সূচি।ভালোবাসা মাখা আনন্দে মাখামাখি হয়ে ফয়সালের গলায় দু-হাত জড়িয়ে দিলো। ঘনিষ্ঠ হয়ে চোখ টিপে প্রশ্ন করেঃ” কী ব্যাপার? শরীর খারাপ নাকি আজ? এতো ভালো ব্যবহার কেন?”

ফয়সাল কিন্তু প্রশ্রয় দেয় না সূচিকে। গলা থেকে বউয়ের হাত সরিয়ে নিজেও সরে যায় দূরে। ত্যক্ত স্বরে বলেঃ” তোমার সাথে ভালো ব্যবহারও আর করা যাবে না।পারছো না বলেই একটু হেল্প করলাম।ওমনি গলায় ঝুলে গেলে।গায়ে পড়া মেয়ে দু-চোখে দেখতি পারি না।”

সূচি থমকে গেল।সেও কম কী? নিজেকে ধাতস্ত করে গলা শক্ত করে বললোঃ” বিয়ে করেছেন কেন এতো সমস্যা থাকলে? ঠিক আছে,আপনার গায়ে পড়ব না আর।কিন্তু তার আগে আরেকটা উপকার করুন।গায়ে পড়ার জন্য আরেকটা মানুষ খুঁজে দিন।আরেকজনকে পেলে আমি আর আপনার গায়ে পড়ব না।”

বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলো ফয়সাল।বিস্মিত কন্ঠে বললোঃ” তুমি আমার সামনে আরেকজনের কথা বললে? স্বামীর সামনে বউ কীকরে আরেকজন পুরুষের কথা বলতে পারে?”

সূচি দ্বিগুণ অবাক হওয়ার ভান করে।চোখ-মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দেয়ঃ” আপনি স্বামী! সত্যিই? আল্লাহ,আপনি না বললে আমি জানতামই না।ভাগ্যিস বললেন।নাহয় আমি জানতেই পারতাম না আমার স্বামী কে।”

তাচ্ছিল্যের শেষে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল সূচি।
ওদের সম্পর্কটা ঠিক এমনি। বাক-বিতন্ডার সম্পর্ক, তর্কের সম্পর্ক, লড়াইয়ের সম্পর্ক। ফয়সাল সূচির জন্য মস্ত এক ধাঁধা।এ যে আসলে কী চায় তা বোঝাই যায় না।একে ধরেও ঠিক ধরতে পারে না সূচি। এই কয়েকদিনে বেশ উন্নতি হয়েছে ফয়সালের।সূচির প্রয়োজনগুলো মুখ ফুটে বলার আগেই বুঝে ফেলে।দুপুরে সূচির তেল শেষ হলে রাতের মাঝেই তেল এনে দিচ্ছে।পাউডার,শাড়ি,শ্যাম্পু কিছুই বাদ রাখে না।বাজারের ফুচকাটা খুব পছন্দ সূচির।মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা ফুচকার পলিথিনও দেখা যায় ফয়সালের হাতে।আগে খামার থেকে আসতো দেরি করতো।খাওয়া-ঘুমের সময়টুকু বাদ দিয়ে বেশিরভাগ সময় খামারেই থাকতো।এখন বদলেছে।সময়ে-অসময়ে বাড়ি আসে। খামারে যাওয়ার আগে সূচির ডাক-খোঁজ করে।প্রতিদিন সকালে গোসল সেড়েই গলা ছেড়ে সূচিকে ডাকে।ঘরের এ মাথা-ও মাথা হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ” সূচি,আমার মোবাইল দাও।মানিব্যাগটা দাও।আকাশের খাবার দাও।শার্টটা ইস্ত্রি করোনি এখনো।শার্ট দাও।”

এতো ফরমায়েশের পরেও ক্ষুব্ধ হয় না সূচি।বরং উৎসাহ নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে সব এগিয়ে দেয়।সিনেমায় দেখেছে নায়কগুলো অফিসে যাওয়ার আগে এমন করে।এ তো ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।মনে মনে ভাবে, এই তো প্রিয়তম দুর্বল হয়েছে।আর কয়েকটাদিন। সে নিশ্চয়ই তারপর থেকে চোখে হারাবে।

কিন্তু তারপর আর আসে না।সূচির সুদিনও আসে না।কথায় কথায় ফয়সালের তীক্ষ্ণ বাক্যবান মনে করিয়ে দেয়,সে আগে যেমন ছিল তেমনই আছে।আশায় বুক বাঁধার কোনো কারণ নেই।
প্রতিরাতে রোমেলা বানুর ঘরে যাওয়ার আগে ফয়সাল চোখ বুজে নরম গলায় বলেঃ” তাড়াতাড়ি চলে এসো।”

সূচি খুশি হয়।ভাবে, বেশিক্ষণ তাকে না দেখে ফয়সাল থাকতে পারবে না।তাই এই আবদার করছে।কাতর স্বরে প্রশ্ন করেঃ” কেন? আমাকে ছাড়া আপনার ভালো লাগে না?”

ফয়সাল চোখ মেলে না।তেমনি চোখ বুজে বলেঃ” আবার এক প্যাঁচাল।তুমি এলেই তো লাইটটা অফ করবে। লাইট জ্বালানো থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।তাই বলছি।”

অবহেলায় সূচির চোখে জল আসে।তেজ দেখিয়ে খট করে লাইটের সুইচ অফ করে দেয়।ধপধপ করে হেঁটে ঘর ছাড়ে।মনে মনে প্রার্থনা করে, ” আমাকে আরো ধৈর্য দাও খোদা।শরীরের চামড়াটাকে সত্তরগুন মোটা করে দাও।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here