#শুকতারা (পর্ব-২৫)
#হালিমা রহমান
বাইরে আলো ফুটছে সবে।একটি নতুন সকাল,নতুন দিনের সূচনা।সূর্যের অবসর শেষ। সন্ধ্যা অবধি নতুন করে আকাশে ঝুলে থাকার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে।চারদিকে বেলা শুরুর মিটমিটে স্নিগ্ধ আলো।আধো আলো,আধো অন্ধকারে একাকার চারদিক।শীতের শেষ বলেই কুয়াশার দেখা নেই খুব একটা।তবে ভোরের দিকে একটু একটু ঠান্ডা পড়ে।হাত-পায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। পুকুরের ঠান্ডা পানিতে ওযু করা দায়।মাঝ পৌষের কনকনে শীতের অনুভূতিরা ফিরে আসে।আমের মুকুল এসেছে গাছে গাছে।সবুজ পাতার ফাঁকে থোকা থোকা হলদেটে মুকুল।এসময়ে মশা বেড়ে যায়।কানের কাছে প্যানপ্যান করে বিরক্ত বানিয়ে ফেলে।
ধুলোমাখা উঠোনে দাঁড়িয়ে হাত-পায়ের কাছে দু-একবার থাপড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লো অন্তু।ফজরের নামায শেষ করে উঠোনে দাঁড়িয়েছিলো একটু।মশার যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে গেল মুহূর্তেই।সে যখন নামাজে গেছে,ঘরে সবাই তখনো ঘুমাচ্ছে।এখন কেউ উঠেছে কি না জানা নেই।নিস্তব্ধ ঘরে ফিরার ইচ্ছা হলো না।তাই মশার মাঝেই দাঁড়িয়ে রইলো।বহুদিন সকাল দেখা হয় না।সে ব্যাচেলর।স্কুল,রান্নাবান্না, ধোয়া-মোছা শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই বারোটা বেজে যায়।সকালে উঠতে হয় দেরি।খালি পেটে কোনোমতে এক গ্লাস পানি ও দোকানের বাসি রুটি অথবা একমুঠ মুড়ি চালান করেই ছুটতে হয় স্কুলে।তবুও হরহামেশাই দেরি হয়ে যায়।নাক বোঁচা এসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপালের বকা শুনতে হয় প্রায় প্রতিদিন।এতোকিছুর মাঝে একটু শান্তিমতো সকাল দেখার সু্যোগ কোথায়?
গোয়ালঘরের গরু দুটো ডাকছে আরো আগ থেকে।আজ এখনো অবধি এদেরকে খাবার দেওয়া হয়নি বোধহয়। মশার যন্ত্রণাও কম নয়।অন্তুর মতো হাত-পা ওয়ালা মানুষকেই ছাড় দিচ্ছে না,আর এরা তো অবলা প্রাণি। নিজেদেরকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই।হতচ্ছাড়া মশার জ্বালায় এদুটো এখনো পাগল হয়নি,এই ঢের।
কিছুক্ষণ পর হুমায়রা এলো।নামাযের সাদা হিজাবটায় এখনো মাথা ঢাকা।অন্তুর সাথে চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসলো মেয়েটা। পা থামিয়ে প্রশ্ন করলোঃ” আজকে এতো সকালে উঠলা ক্যামনে?নবাবগো ঘুম আবার এতো তাড়াতাড়ি ভাঙ্গে?”
” নবাব কাল খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছিলো। তাই সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল।কিন্তু তোমার কী হয়েছে ভাবি? আজ হঠাৎ শত্রুপক্ষের সীমানায় যাচ্ছো যে?”
বাম হাতের আঙুলে নিজের গালে দু’বার চাপড় দিলো হুমায়রা।ব্যস্ত গলায় বললোঃ” তওবা,তওবা।শত্রুপক্ষ আবার কী জিনিস? আমরা সবাই আপন মানুষ।গরুগুলা ডাকতাছে তাই খাবার দিতে যাইতাছি।সূচি আজকে উঠে নাই এখনো?”
হুমায়রার মতো অন্তুও একবার তাকালো ও ঘরের দরজার দিকে। ভিজানো দরজা।স্পষ্ট বোঝা যায় কেউ এখনো উঠেনি।অন্তুর জবাব দেওয়ার প্রয়োজন হলো না।হুমায়রা নিজেই বুঝলো।চিন্তিত সুরে বিরবির করলোঃ” আল্লাহ রক্ষা করুক সূচিরে।আজকে খবর আছে মাইয়াটার।”
অন্তু এ বাড়িতে নতুন নয়।বুঝলো কথাটা।মুচকি হেসে বললোঃ” খুব ভাব হয়েছে দেখছি তোমাদের।চাচিমা জানে?”
” এইটা জানার কী আছে?কী হইব জানলে?”
” অনেককিছু। আমি একবার চুপিচুপি বলে দেই যেয়ে? তারপর দেখো,কী হবে।”
” তুমি দিনদিন কূটনা হইতাছো অন্তু।তোমার বউ টিকব না দেইখো। বউরে জ্বালায়া খাইবা এক্কারে।”
” আমার বউ আমাকে পেয়ে তিনবেলা নফল নামাজ পড়বে,হুহ।”
” আল্লাহ কবুল করুক।”
” তোমার একটা বোন আছে না, ভাবি? শশী না কি যেন নাম।ওর বিয়ের বয়স হয়নি এখনো? আমি কিন্তু পাত্র হিসেবে ফার্স্টক্লাস। অতিশীঘ্রই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দাও।আমি আপত্তি করব না। এই অফার অল্প সময়ের জন্য। আমি খুবই ভালো ছেলে।ভালো ছেলেদের স্টক সীমিত।”– অন্তুর ঠোঁটের কোনে ফিচেল হাসি।
হুমায়রা মাথা নাড়লো।খুব হতাশ হওয়ার ভান কিরে বললোঃ” মানুষ হইলা না, অন্তু।হাতে-পায়েই বয়স বাড়ছে খালি।”
ভুসি গোলানো শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো হুমায়রা।অন্তু বাড়ির এমাথা-ওমাথা হাঁটছে।অকারণে গাছের পাতা ছিঁড়ছে,আমের মুকুল নেড়েচেড়ে দেখছে অষ্টম আশ্চর্যের মতো।কখনো জুতো খুলে হাঁটছে,আবার কখনো জুতো পরছে।গলায় খেলছে দারুন এক রবীন্দ্রসংগীতের সুর,” ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান….”
হুমায়রার ভালো লাগলো।মাঝে মাঝে মনে হয়,এ পৃথিবীতে এই একটা মানুষই অস্বাভাবিক রকমের ভালো আছে। তার ভালো থাকার বাড়াবাড়িতে কোনো ঝামেলারা ভর করেনি কোনোদিন।এর সবটা সহজ, কোথাও এতুটুকু ভণিতা নেই।
ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সূচিদের বদ্ধ দরজার দিকে চাইলো হুমায়রা।আজ এখনো উঠলো না যে? অসুস্থ-টসুস্থ নাকি? মনের কোনে চিন্তারা বাসা বেঁধেছে।কিন্তু সাহস করে সূচির ঘরে ঢু মারার সুযোগ নেই। রোমেলা বানি দেখলে খবর আছে।হুমায়রার চৌদ্দ পুরুষ এক করবে।তার মুখের ভাষাকে রেকর্ড করে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা যাবে।পান থেকে চুন খসলেই যেই ভাষণ শুরু হয়,তাতে কানে আঙুল দিতে হয়। শ্রবণশক্তির প্রাণ থাকলে এতোদিনে সে দেশ ছেড়ে পালাতো। এ এমনই এক অত্যাচার।
” মেজ ভাবি,ক্ষুধা পেয়েছে খুব।কী আছে তোমার ঘরে?”
” তোমার লেগা তেলের পিঠা বানাইতাছি।সব ঠিক কইরা আসছি ঘরে। দশ-পনেরো মিনিট কষ্ট কইরা সহ্য করো একটু।আমার বেশিক্ষণ লাগব না।”
” এ কারণেই তোমাকে আমি এতো ভালোবাসি।আহ! কতদিন খাই না।চিনি কম দিও কিন্তু।”অন্তুর মুখে সন্তুষ্টির হাসি।
ভাইয়ের সমান আদরের দেবরের হাসি দেখে হাসি ফুটলো হুমায়রার মুখেও।নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললোঃ” জানি আমি।তুমি কিন্তু দেরি কইরো না।একটু পরেই রান্নাঘরের বারান্দায় আইসা বইসো।গরম গরম খাইতে পারবা তাইলে।”
বাতাসের গতিতে নিজের ঘরের দিজে ছুটে গেল হুমায়রা।অন্তু ফোনে সময় দেখলো।মাত্র ছয়টা বাইশ বাজে।ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হলো না।বরং একটু দূরের পুরোনো ঘরটার দিকে চেয়ে রইলো অপলক।নাক বরাবর সামনেই আরেকটা টিনের ঘর।পুরোনো, ফাটাফুটা টিন।এতো বছরের অযত্নে,প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝাপটায় দূর থেকে ভূতের ঘরের মতো লাগে দেখতে। এবাড়িতে তিনটে ঘর। একটা সূচিদের,একটা হুমায়রার আরেকটা অন্তুদের। অন্তুর বাবা কাজী বেলায়েতের হাতে তোলা পুরোনো কাঁচা ঘর।বড় আদরের,বড় সাধের ঘর।কত বছর এলো-গেলো। এ ঘরে এখন আর কারো পা পড়ে না।দিনের পর দিন যায়,অন্ধকার ঘরে একটু আলো জ্বলে না।সহসা চোখ ভিজে আসে অন্তুর। কতবছর হলো ও-ঘরে কেউ কথা বলে না,হাসে না! কবরের মতোই ওটা অন্ধকার। ওখানে আলো জ্বালানোর মতো কেউ নেই।
মান্ধাতার আমলের জং ধরা তালাটা খুলে পকেটে পুরে ফেললো অন্তু।ভাগ্যিস এবার চাবিটা এনেছিলো পকেটে করে।না-হয় এবারেও ঘরে পা রাখতে পারতো না। বিরক্তিকর ক্যাচক্যাচে শব্দ তুলে দরজা খুললো।বহুপুরোনো ভ্যাপসা গন্ধরা একযোগে ধাক্কা দিলো যেন।নাক টিপে একটু পিছিয়ে গেলো অন্তু। কবরের অন্ধকারের মাঝে জংলী মশার ভনভনানি,উটকো গন্ধ।বৃষ্টি-বাদলার দিন নয় বলেই রক্ষা।বর্ষাকাল হলে এখানে নিশ্চিত দু-তিনটে সাপ পাওয়া যেতো।
একটু রয়ে-সয়ে,নাকে আঙুল চেপে,ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো অন্তু।জুতোগুলো খুলে রাখলো দরজার পাশে।শুকনো, খরখরে মাটি।বসার ঘরে দুটো জানালা।জানালার পাল্লা বহু বছর যাবৎ বন্ধ।টেনেটুনে পাল্লাগুলো খুলে ফেললো।মুহূর্তেই এক পশলা দক্ষিণী মুক্ত বাতাসে ভরে গেল ঘর।ক্ষীণ আলোয় জানলার কাছের হাত দুয়েক জায়গা আলোকিত হলো। ঘরের সাথেই লাগোয়া জারুল গাছ।গাছের সবচেয়ে নিচু ডালটা ছুঁয়ে গেছে উত্তরের জানালা।জানালার অক্ষত শিকগুলোর ফাঁক-ফোকড় দিয়ে ঢুকে পড়েছে দুয়েকটা পাতা।অন্তু ঘুরে ঘুরে দেখে।সবকিছু আগের মতোই আছে।কেবল একটু বেশি পুরোনো হয়ে গেছে জিনিসগুলো।বসার ঘরে মাঝারি আকারের চৌকির পায়া চারটের নিচের দিকটা পঁচে গেছে।বর্ষার পানির বদৌলতেই এই অবস্থা।একটা ছোট আম কাঠের টেবিলের একপাশে কাঠের চেয়ার।শেষবার যেভাবে রেখে গিয়েছিল ওরা,এখনো সেভাবেই আছে। গরমের ছুটিতে বেড়াতে এসে ওরা দু’ভাই এই বসার ঘরেই ঘুমাতো।মাঝের রুমটা ছিল বাবা-মায়ের।একটা খাট,খুঁটির সাথে ঝুলানো আয়না আর একটা নড়বড়ে আলনা।ছুটি কাটানোর জন্য এরচেয়ে বেশি আর কী লাগে?
অবশ্য আরেকটা জিনিস আছে এঘরে।টিনের সাথে লাগানো একটা সাদাকালো বাধানো ছবি।একটি সুখী পরিবারের ছবি।বাবা-মায়ের পায়ের কাছে বসে শান্ত ও অন্তু।বরিশালের কোনো এক অখ্যাত ফটোগ্রাফারের হাতেই ছবিটা তোলা। নিষ্প্রাণ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো অন্তু।কত সুন্দর একটা পরিবার ছিল! এখন কেউ নেই।শান্ত ছাড়া এ পৃথিবীতে আপন বলতে অন্তুর কেউ নেই।
অন্তু তখন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র।বাবা-মাসহ বরিশাল থাকে।শান্ত পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় থাকে।হলে থেকে পড়ে।ছুটির সময়ে গ্রামে চলে আসে।একসাথে ছুটি কাটাতে ওরা চলে আসে এ বাড়িতে।সেইবার গরমের ছুটিতে শান্ত এলো না। তখন তো আর ফোনের এতো প্রচলন ছিল না।সকাল-সন্ধ্যা খোঁজ নেওয়ার উপায় নেই।বেলায়েত সাহেব বাজারের দোকান থেকে শান্তর কাছে কল করেন,কিন্তু কথা বলার সুযোগ মেলে না।শান্তর ফোনটা বন্ধ। অন্তুর মা ঘরে কেঁদে ভাসান।ঢাকা শহরের গুন্ডা-মাস্তানদের সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শুনেছিলেন লোক মুখে।কে জানে ছেলে সেই খপ্পরেই পড়েছে নাকি! কেঁদে-কেটে স্বামীর কাছে আবদার করেন।যেভাবেই হোক ছেলেকে ফিরিয়ে দিতেই হবে।
দিন দশেক পরে ঢাকা থেকে খবর এলো।শান্ত পড়াশোনা বদলে অকাজ করেছে ঢাকায়।সহপাঠী লাবনীকে বিয়ে করে ফেলেছে।বন্ধুর বাসায় আছে বউ নিয়ে। মেয়ের বাড়ির কেউ মেনে নেয়নি।শান্ত সাহস নিয়ে বাড়িতে কল করে কেঁদে-কেটে সব বললো। বেলায়েত সাহেব নিজেও এ পথের যাত্রী।বাপকা বেটা,মনে মনে ছেলেকে ক্ষমা করলেন।কিন্তু উপরে ভাব-ভঙ্গিতে তা প্রকাশ করলেন না।ফোনে হুমকি-ধমকিতে তটস্থ করে ফেললেন ছেলেটাকে।এমনকি ঢাকায় পৌঁছে আগে শান্তর কলিজা কেটে মাজারে সিন্নি দেওয়ার কথাও ঘোষণা করলেন বুক ফুলিয়ে।অন্তুর মা বরাবরের ভীতু মানুষ।স্বামীর হম্বিতম্বিতে আরো ভয় পেলেন।লোকটা ঠান্ডা প্রকৃতির কিন্তু রেগে গেলে হুশ থাকে না।কে জানে কী থেকে কী হয়! পরিস্থিতি সামাল দিতে অগত্যা তিনিও ব্যাগ গোছালেন স্বামীর সাথে।স্বামী ও ছেলের মাঝে মধ্যস্থতা তাকেই করতে হবে।তাছাড়া,ছেলের বউকে দেখার বাসনাও ছিল মনে।পোড়ামুখী সহজ-সরল-ভদ্র ছেলেটাকে কী করে বশ করলো,তা দেখতে হবে না?
অন্তুকে এবাড়িতে রেখে দুজনে ছুটলেন ঢাকায়।গরমের ছুটি তখনো বাকি।এবাড়িতে চাচা-চাচীর কাছে হেসে-খেলে তার দিন কাটে। বাবা বলেছে আসার সময় নতুন ভাবি নিয়ে আসবে।অন্তুর দিন কাটে আঙুল গুনে।ওদের আসতে আর কতদিন বাকি?
ঠিক সাতদিন পরে ঢাকা থেকে ভোলার লঞ্চে উঠলেন কাজী বেলায়েত ও তার স্ত্রী।শান্ত ও লাবনী রওনা দেয়নি তাদের সাথে।ওদের সামনে পরীক্ষা।ছেলে ও বউকে একটা বাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন বেলায়াত সাহেব।ছেলে বেকার।মাসে মাসে টাকা পাঠাবেন। এই বিলি-ব্যবস্থা করে সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠলেন তারা।
পরদিন সকালে খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে খবরটা ছাপা হলো।তীরে এসে তরী ডুবেছে।ভোলাগামী লঞ্চ ঘাটের প্রায় কাছাকাছি এসে ডুবে গেছে। তবে হতাহতের সংখ্যা কম।দুই হাজার যাত্রীর মাঝে প্রায় সবাই জীবিত।ঘাটের কাছাকাছি হওয়ায় সাতরে পাড়ে এসেছে সবাই।এক-দুইশ যাত্রীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সকাল থেকে মানুষের ঢল লঞ্চঘাটে।অন্তুরাও গেল।অন্তু,ফয়সাল,আফজাল–সবাই।বোরকায় শরীর ঢেকে রোমেলা বানুও গেলেন।ঠেলেঠুলে ঘাটের শেষ সীমানায় যেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অন্তু। নিষ্প্রাণ চোখে অপলক চেয়ে রইলো ডুবে যাওয়া লঞ্চের মাথার দিকে। পানির নিচ থেকে বকের মতো মাথা তুলে রেখেছিল লঞ্চটা।ছাদের একটু অংশ ভেসে ছিল পানির উপরে। এরপর কতদিন অন্তু যেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতো! সকাল সকাল লঞ্চঘাটে যেয়ে অপেক্ষা করতো।যদি বাবা-মা আসে! যদি কোনোভাবে তাদের লাশটা ভেসে উঠে!
আশা পূরণ হয়নি। দুটো মানুষের মুখ আর কোনোদিন দেখতে পায়নি অন্তু।শান্ত এলো,লাবনী এলো, কিন্তু বাবা-মা আর ফিরে এলো না।মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ পর্যায়ের হতভাগা মনে হয়। বাবা-মায়ের লাশ দেখার সৌভাগ্যও কেন হলো না?
_________________________________
গোসল সেড়ে তড়িঘড়ি করে ঘরে পা রেখেই মেজাজটা চড়চড় করে বেড়ে গেল সূচির।চুলে প্যাঁচানো গামছাটা টান মেরে খুলে হিসহিসিয়ে বললোঃ” আপনাকে কখন বললাম নাস্তা আনতে? ঘরে মেহমান। সকাল আটটা বাজে।”
ফয়সালের কোনো হোলদোল নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে আঙুল বুলিয়ে জবাব দিলোঃ” সকালে উঠো নাই কেন? এখন আবার আমাকে তাড়া দাও।”
” আশ্চর্য।আপনিই তো এলার্মটা বন্ধ করে দিলেন।এখন আমার দোষ!”
” প্রত্যেকদিন উঠো তবুও অভ্যাস হয় না কেন?”
” ভাত খেয়ে নাক ডেকে ঘুমান তো,তাই বুঝেন না অভ্যাস হয় না কেন।আমার মতো মাঝরাতে ঘুমিয়ে শেষরাতে উঠুন দুই-একদিন।এতো বড় বড় কথা ওদিক দিকে বেরিয়ে যাবে। এখন তাড়াতাড়ি বাজার থেকে নাস্তা এনে দিন। নাস্তা বানাতে গেলে সকালের রান্না সাড়তে দেরি হবে।”
” এই তো যাচ্ছি।”– অলসের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফের আয়না দেখছে ফয়সাল।
চূড়ান্ত পর্যায়ের মেজাজ খারাপ হলো সূচির।ফয়সালকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিলো।আঙুল নেড়ে বললোঃ” ঠিক দশ মিনিট সময় দিলাম।তাড়াতাড়ি করবেন।”
বসার ঘরেই রোমেলা বানু বসা।গালের ডানদিকটা উঁচু।ডানদিকের দাঁতের ফাঁকে পান ধরে রাখা।ফয়সালকে দেখেই হাতের ইশারায় ডাকলেন।শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেনঃ” সূচি কই?”
” ঘরেই আম্মা।আসছে।”
” তোমার লগে জোড়া ধইরা ঘুমের থেকা উঠছে? জ্বর হইলেই এমন করতে হইব? বউ মাইনষের জ্বর আবার এক রাইতের বেশি ক্যামনে থাকে?”
উত্তর নেই ফয়সালের কাছে।ঢোক গিলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে।
” তুমি কই যাও?”
” বাজারে আম্মা।পরোটা নিয়ে আসি।”
” পরোটা! কী করবা? ”
” অন্তু ভাই আছে তো।আপাতত নাস্তা করুক।সকালের ভাত রাঁধতে তো দেরি হবে।”
মা-ছেলের কথার মাঝেই সূচি এলো।দ্রুত পায়ে বসার ঘরে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলোঃ” আম্মা,কী রান্না করব?”
জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইলেন রোমেলা বানু।সূচির গলা শুকিয়ে এলো।এই চোখ তার চেনা।আজকের সকালটাই শুরু হবে কালবৈশাখী দিয়ে।
” আটটা বাজে ঘড়িতে। তোমার আক্কেল-জ্ঞান আছে কিছু?”
” আর হবে না আম্মা। মাফ করে দিন।”— সূচির কন্ঠ কাঁপছে।মাথা নিচু করে দাঁড়াতেই ঘোমটায় টান লেগে আঁচল পড়ে গেল মাথা থেকে। মাথা ভরা ভেজা চুল নজর এড়ালো না রোমেলা বানুর।ভ্রু কুঁচকে বললেনঃ” জ্বরের মইধ্যে এতো সকালে গোসল করলা ক্যান? তোমার বুদ্ধি কি কোনোদিন হইব না? আর তোমার এতো জ্বর আসে ক্যান? তোমার বাপ-মায়ে বিনা পয়সায় একটা অসুস্থ মাইয়া ধরায়া দিছে আমগোরে।”
” জ্বর!”– অবাক না হয়ে পারলো না সূচি।তাচ্ছিল্যের বিপরীতে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে শ্বাশুড়ির দিজে চাইলো।রোমেলা বানু অবুঝ নয়।মানুষ চড়িয়ে ভাত খেয়েছেন। বউয়ের চোখ পড়ে নিলেন।আগুন চোখে ছেলের দিকে চাইলেন।ফয়সালের অবস্থা তখন বেগতিক।কালরাতের মিথ্যাটা নগ্নভাবে ধরা পড়ে গেছে।সূচিকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতে ইচ্ছা করছে তার।
” আফজালের বেশ ধরছোছ? কিরে?”
কিছুই বললো না ফয়সাল।কেবল মাথা নিচু করে দম খিঁচে বসে রইলো।
” জানোয়ার জন্ম দিছি কতগুলি।বউয়ের আঁচলের গন্ধ পাইলে আর কিছুই বুঝে না।মায়ের সামনে চরকি ঘুরায়।যা এইখান থেকা। চোখের সামনে থেকা যা।”
রান্নাঘরে কাজ করছে সূচি।হাত দুটোয় অসাধারণ ক্ষিপ্রতা। লম্বা,ছিপছিপে শরীরটা কাঁপছে ক্ষনে ক্ষনে।রাগে নাকি ভয়ে, তা বোঝার উপায় নেই।
” বুঝি না কিছুই।বিয়ার আগে দেইক্ষা-শুইন্না আনি মাইনষের ছাও।আমার ঘরে দুইদিন সংসার করলেই হইয়া যায় কুত্তার ছাও। বাপ-মায়ে কিছুই শিখায় নাই।খালি জন্মই দিছে……”
ও ঘর থেকে ভেসে আসছে রোমেলা বানুর গলা।পুঁথি পড়ছে যেন।কথাগুলো সূচিকে উদ্দেশ্য করেই বলা,তা বেশ বোঝা যায়।বউয়ের তরফদারি করে তার ছেলে কাল মিথ্যা বললো।কত বড় সাহস! সূচি নিশ্চিত তাবিজ করেছে।নাহয় যে ছেলে বিয়েতে রাজি ছিল না,সে এতো দুর্বল হলো কী করে? রোমেলা বানুর মুখ ছুটেছে আরো আগেই।ফয়সালের পালা শেষ।এখন সূচির পালা।বাবা-মাকে জড়িয়ে যেসব গালিগুলো দিচ্ছে মহিলা,তা শোনার অযোগ্য। সূচির কান-গাল গরম হয়ে আসে।চোখ-মুখ ঝা ঝা করে লজ্জায়, অপমানে।
দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে এলো ফয়সাল।বউকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলেঃ” তোমার কমন সেন্স নেই? একটু মিথ্যাও বলতে পারলে না?”
” আপনি আমার জ্বরের দোহাই দিয়েছেন, তা আমি জানি? আপনি বলেছেন আমাকে? আর আমি জ্বর সম্পর্কে একটা কথাও বলেছিলাম?”
” সব তোমার দোষ।বেয়াদব মেয়ে।তোমাকে আমার দু-চোখে দেখতে ইচ্ছা করে না।”— সূচির কাঁধ খামচে ধরলো ফয়সাল।ছেলেটার দু-হাতের বুড়ো আঙুলের নখ বড়। ব্যাথায় মুখ কালো হয়ে গেল সূচির।চোখদুটো টইটম্বুর হয়ে গেল পানিতে। ওদের সন্ধি সেতুর ভিত্তিটা কাল রাতেই স্থাপিত হয়েছিল সবে।আজকের বেলা শুরুর ঝামেলায় ফাটল ধরলো যেন।রোমেলা বানুর ঝাঁঝালো কথা এখনো ভেসে আসছে। সূচি হিসহিসিয়ে বললোঃ” বাইরে যে একচোট হচ্ছে, ওটা কি কম ছিল? এখন রান্নাঘরেও চলে এসেছেন বীরপুরুষের মতো। আমাকে আপনারা শান্তি দেবেন না?”
” আরে অন্তু ভাই,ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে এসো।কিছু দরকার?”
রান্নাঘরের দরজার সামনে অন্তুকে দেখেই চোখ-মুখের ভাব পাল্টে গেল ফয়সালের। সূচির কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিলো। সূচিও একবার তাকিয়ে দেখলো অন্তুকে।চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।সবকিছুই নিজেদের বিরোধটাকে মানুষের চোখ থেকে আড়াল করার চেষ্টা।
অন্তু এসেছিল পানি খেতে।কিন্তু ভিতরের অবস্থা দেখে আর ঢুকলো না। পরিস্থিতি বোঝার বয়স তার হয়েছে। জোর করে ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললোঃ” না, কিছু দরকার নেই।এমনিই এসেছিলাম।”
“বাজারের হোটেল থেকে নাস্তা খেয়ে আসি চল।”
” খাব না এখন।মেজ ভাবি পিঠা বানিয়েছিল, ওটাই খেয়েছি।থাক তুই।আমি গেলাম।”
রান্নাঘরের দুয়ার থেকে সরে এলো অন্তু।সকালের প্রসন্নতার ভাবটা আর নেই। হুট করেই বিষাদেরা ভর করলো মনে।টলটলে চোখদুটোতেও ছিল এমনই বিষাদ।ডাগর ডাগর চোখ দুটো ঠিক আনন্দময়ী স্কুলের পাশের তালপুকুরের মতো।তালপুকুরে বৃষ্টি হচ্ছে যেন।আহা,সূচি।মেয়েটার জন্য সহসা মন খারাপ হয়ে গেল অন্তুর।ওইটুকুই তো একটা মেয়ে! এতোখানি সহ্য করছে কী করে??
চলবে…..