শুকতারা পর্ব-২৪ ২

0
841

#শুকতারা (পর্ব-২৪, বর্ধিতাংশ)
# হালিমা রহমান

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।সেই আদিকাল থেকে শুরু।নিরন্তর বয়ে চলছে এই আকর্ষণ। বয়ে চলবে সৃষ্টির শেষ সীমা অবধি।মানব-মানবী একসাথে জুটবে,একে অন্যকে দেখবে,মোহ জন্মাবে,অনুভূতি গাঢ় হবে,প্রনয়ের পথে হাঁটবে, পৃথিবীতে জীবের সংখ্যা বাড়বে– এই তো প্রক্রিয়া,এই তো নিয়ম। এভাবেই তো সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক সভ্যতা।বেচারা পৃথিবীর বয়স বাড়লো,কিন্তু একদিনের তরেও নিয়মের হেরফের হয়নি কোথাও।আর হয়তো কখনো হবেও না। ধরণী আরো বুড়ো হবে,এই আকর্ষণও বৃদ্ধি পাবে।সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালো এক নিয়ামত দান করেছেন।নর-নারী একে-অন্যের প্রতি আকৃষ্ট না হলে মানবসভ্যতা হয়তো অনেক আগেই থমকে যেতো।
নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি এই অদম্য আকর্ষণের উপর রঙ-চঙ মেখে কবি-সাহিত্যিকের দল কতকিছু লেখে।কত সুন্দর প্রেমের গল্প রচনা করে।বিজ্ঞানীরা একে বংশ বৃদ্ধির উপায় হিসেবে আখ্যা দিলো।নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কত শিল্পীর দল আরাধনায় মত্ত হলো।রঙ-তুলির আঁচড়ে তৈরি হলো বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম। বার্থ অফ ভেনাস,মোনালিসা,লেডি উইথ এন আরমিন,লা প্রিমাভেরা,ফ্লেমিং জুন– বলে শেষ করা যাবে না।সৌন্দর্যপ্রিয় ফয়সালও এই সৌন্দর্যের মোহ থেকে বের হতে পারেনি। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে সূচির মাঝে। একই ঘরে এতোদিন একসাথে থাকার পরেও অদৃশ্য একটা বন্ধন, এক ধরনের মোহ সৃষ্টি হবে না,এ ভাবা কেবল বোকামি।বাস্তবে এ চিত্র খুব কমই দেখা যায়।এ কেবল সিনেমাতেই অহরহ ঘটে।সেই কোনো এক মলিন সকালে ফিসফিস করে রত্না শুনিয়েছিলো সূচির প্রেমের কথা।বিশ্বাসঘাতকের মতো প্রিয় বান্ধবীর দুর্বলতার হাঁড়িটা ভেঙে দিয়েছিল ফয়সালের সামনে।রত্না কি খারাপ কোনো কাজ করেছিল? না,সে অজান্তেই বান্ধবীর ভালোই করেছে।
রত্নার কথাগুলো শোনার পর খুব একটা বিশ্বাস হয়নি ফয়সালের।সূচি যেভাবে চোটপাট করে,কে বিশ্বাস করবে রত্নার কথা? কিন্তু ফয়সাল ভাবতো।মাঝে মাঝেই অগোচরে খুটিয়ে খুটিয়ে সূচিকে পর্যবেক্ষণ করতো।রত্নার কথাগুলো মাঝে মাঝে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করতো।সারা গ্রামে এই একটি রমনীর প্রতি মোনাজাতে ফয়সাল ছিল।সে উঠতে-বসতে ফয়সালের জন্য দোয়া করতো, সৃষ্টিকর্তার কাছে ভিক্ষা হিসাবে তাকেই চাইতো— বড়ই ভালো কথা।ফয়সালের অহংকার হয় একটু একটু।নিজেকে সেলিব্রেটি মনে হয়।গ্রামের আর কোন ছেলেটা এই ভাগ্য পেয়েছে?
মনে আছে সেই শীতের রাতের ঝুম বৃষ্টির কথা? জ্বরের ঘোরে প্রিয়তমের পিঠের উপর মাথা রেখে সূচি অভিযোগ করেছিল।জানতে চেয়েছিল– ” আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেন?”
অদ্ভুত অভিযোগ,অদ্ভুত প্রশ্ন।অর্থহীন প্রশ্নটাকে মাথা থেকে ফেলে দিতে পারলো না ফয়সাল।এই মিমাংসাটাই রাত-দিন খোঁচাখুঁচি করতো।নিজের মনেও প্রশ্ন জাগতো।মেনে নিলে কী সমস্যা? তাছাড়া, সূচিকে না মেনেই বা কী করবে ফয়সাল? বিয়ে হয়ে গেছে,সংসার করছে,তবে মেনে নিতে দোষ কোথায়? মনের একাংশ সায় দিলেও আরেক অংশ তীব্র বিদ্রোহ করতো।অহংকারীর মতো পাল্টা প্রশ্ন করতো,” বিয়ে হলেই মেনে নিতে হবে? মা অন্যায়ভাবে ঘাড়ের উপর বসিয়ে দিয়েছে বলেই সুখে-শান্তিতে সংসার করতে হবে? রাগ-জেদ নেই তোর? মেয়েটার না আছে গুণ,না আছে রূপ।মুখও ভাল না।কথায় কথায় চ্যাটাং চ্যাটাং উত্তর দেয়।বেয়াদব একটা।”

ফয়সাল কোনো যুক্তিই ফেলে দিতে পারেনি।সকালে মনে হতো,”কী হবে সূচিকে মেনে নিলে?” আবার দুপুর গড়ালেই অবস্থা বদলে যেতো। মুখ ফুলিয়ে বলতো,” মেয়েটা ভারী বেয়াদব। খালি মুখে মুখে কথা বলে।”
নিজের মাঝের গোপন সংঘাতে ফয়সাল যখন ত্যক্ত,বিরক্ত,জর্জরিত,তখনই এক নতুন ঘটনা ঘটলো।দারুন এক ঘটনা।
ততোদিনে সূচিও একটু পুরোনো হয়েছে এ বাড়িতে।দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করে,মাথা নিচু করে বকা খায়, কাজের সময় তাড়াহুড়ো করে,শাড়ি ঠিক থাকে না,খোঁপা যায় খুলে।কালো মেঘের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।পিঠে গড়িয়ে পড়ে বয়ে চলা দুরন্ত নদীর মতো। কাজ-কর্মের আড়ালে হুমায়রার দুয়ারে যেয়ে গাল-গল্প করে,খিলখিল করে হাসে।ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে একদিন সূচির প্রাণখোলা হাসি শুনেছিল ফয়সাল।সূচি এ বাড়িতে আসার পর থেকে খুব বেশি একটা হাসতো না। সেদিন খুব সম্ভবত মানিকের রিনরিনে কন্ঠের কোনো এক কথা শুনে হেসেছিল।ফয়সাল তখন পশ্চিমের পুকুরে যাচ্ছিলো।হুমায়রার দুয়ারে থমকে দাঁড়ালো।কে হাসে? সূচি! কই তার সামনে তো হাসে না।এক সুন্দর অভিমান ছুঁয়ে গেল ফয়সালের হৃদয় জুড়ে।আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতো সূচিকে।হতভাগীর গায়ের রঙটাই কেবল ময়লা।চাপা রঙে বাকি সৌন্দর্যগুলো ঢাকা পড়ে আছে।সূচির চুলগুলোর কথাই ধরা যাক।কি সুন্দর! মাথায় একরাশ রাতের আঁধারের মতো কালো চুল।ছেড়ে রাখলে বেশ মানায়।সূচির শ্যাম্পুর ঘ্রাণটাও মুখস্ত ফয়সালের।রাতেরবেলা সূচি যখন রুমে থাকে না,ফয়সাল তখন চুপচাপ সূচির বালিশে মুখ গুজে পড়ে থাকে।কি সুন্দর ঘ্রাণ আসে সেখান থেকে! মনে হয় যেন বালিশ নয়, সূচির ঘন চুলেই নাক ডুবিয়ে রেখেছে সে। বিয়ের আগে নিজের রুমে কেবল ঘুমের সময়ই ঢুকতো ফয়সাল। যা নোংরা ছিল ঘরটা।আলস্যের কারণে কখনো ঘর পরিষ্কার করা হয়নি।কিন্তু এখন? পরিস্থিতি সম্পূর্ণই ভিন্ন।হাজার কাজের মাঝেও ফয়সালের মন বসে না।খামারে গেলে মনটা কেবল পালাই পালাই করে।মনে হয় যেন, নিজের ঘরে গেলেই শান্তি মিলবে।এখন এই চার দেওয়ালের মাঝেই শান্তি পায় ফয়সাল।বিছানাটা গোছানো,চাদরটা গোছানো,বালিশগুলো স্ব-স্থানে,আয়নাটা পরিষ্কার,ঘরে ধুলো-ময়লা নেই। কেবল ঘরের পরিপাট্যই কি তাকে শান্তি দেয়? না।বরং চিরুনিতে জড়ানো ছেঁড়া চুল অথবা ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে গোছানো শাড়িগুলো,তেলের বোতল,পাউডার,কাজল,একজোড়া চটি জুতো–সবকিছুই শান্তি দেয় ফয়সালকে। মনের কোনে স্বস্তি পায় এই ভেবে, সে আছে। বাড়ি ফিরে আতিপাতি করে সূচিকে খোঁজে।কিন্তু কাজের ফাঁকে ব্যস্ত গৃহিনীকে একা পাওয়ার জো কোথায়? ফয়সাল তাই গাল ফুলিয়ে সূচিকে ডাকে,” সূচি একগ্লাস পানি দিয়ে যাও।”

ফরমায়েশের অজুহাতে কাজের ফাঁকে সূচিকে একনজর দেখে।সূচি পানির গ্লাস দিয়ে বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করেঃ” এটুকুও কি নিজে করতে পারেন না?”

ফয়সাল চুপ থাকে।উত্তর দেয় মনে মনে।গ্লাস খালি করতে করতে মনে মনে বলেঃ” তুমি কী বুঝবে? বরসিক মহিলা।”

সূচির প্রতি বন্ধনটা কবে তৈরি হলো তা জানা নেই ফয়সালের।নিজের মাঝে হাতড়ে হাতড়েও উত্তর খুঁজে পায় না।লোকে বলে, তিন কবুলের আলাদা জোর থাকে।নয়তো এই একটি শব্দের জোরে অচেনা দুটো মানুষ এক হয় কী করে? ফয়সালের সাথেও বোধহয় তাই হয়েছে।সেও তো কবুল বলেছে।

চোখ বন্ধ করে এসবই ভাবছিলো ফয়সাল।ভাবনাগুলো নতুন নয়।মাঝে মাঝেই ভাবে।যত ভাবে, ততোই সুখ হয়।বিয়ের আগের অতৃপ্তিটা একটু একটু করে কাটে,সূচির প্রতি একটু একটু করে দুর্বল হয়। বিষয়টা সুন্দর।মনের অশান্তি দূর হয়।পৃথিবীতে কে অশান্তিতে থাকতে চায়?

চুলগুলো বিনুনিতে বেঁধে ফয়সালের মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো। আলতো স্বরে বললোঃ” খাবেন না রাতে?”

” আম্মা খেয়েছে?”

” হ্যাঁ।”

” আমি আজ আর খাব না।তুমি খেয়ো নাও।”

” আপনি খাবেন না কেন?”

” ভালো লাগছে না।”

” আচ্ছা,তাহলে আমিও আর খাব না।আমারও ভালো লাগছে না।”

চোখ মেলে দেখলো ফয়সাল।ভ্রু কুঁচকে বললোঃ” ভালো লাগছে না কেন?”

” আরে আজকে কম্বল-টম্বল ধুয়েছি না,হাত-পা ব্যাথা করছে খুব।আমি তো আর কখনো করিনি।”

কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভাবলো ফয়সাল।তারপর ফট করে উঠে বসে বললোঃ” চলো, ভাত খাব।ক্ষুধা পেয়েছে।”

সূচির বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে উঠে গেল ফয়সাল।মেয়েটা বিরক্ত হলো।এই এক লোক,এক মুখে কত কথা বলে?

___________________________

সূচিকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিলো ফয়সাল। এখানেই থেমে থাকলো না।একটা ব্যাথার ঔষধ খাইয়ে আদেশ করলোঃ” এখন চুপচাপ যেয়ে শুয়ে থাকবে।আমি আসছি।”

সূচি অবাক, মহাঅবাক।কিন্তু অবাকের রেশে বুদ্ধি হারালো না।সে পরিনত।আরেকজনের মন বোঝার বয়স তার হয়েছে।ফয়সালের এই অনাকাঙ্ক্ষিত যত্নটুকু পুরো গায়ে ফুটলো।বিদ্যুতের মতো খেলে গেল পুরো শরীরে।এক আকাশ দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলোঃ” আপনার আজ কী হয়েছে? শরীর খারাপ?”

বিপরীতে মুচকি হাসলো ফয়সাল।চোখ টিপে বললঃ” কঠিন অসুখ হয়েছে।ঘরে যাও, এসে বলছি।”

উত্তর দিয়ে দাঁড়ালো না ফয়সাল।জুতোয় শব্দ তুলে মায়ের ঘরের দিকে গেল।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলো,” আসব, আম্মা?”

রোমেলা বানু শুয়ে ছিলেন।সূচির অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।ফয়সালের কন্ঠ পেয়ে বললেনঃ” তুমি? সূচি কই?”

” সূচির জ্বর এসেছে।খাবার খেয়ে শুয়ে আছে।তাই আমি এসেছি আজকে।পা টিপে দিচ্ছে,তুমি ঘুমাও আম্মা।”

ডাহা মিথ্যা বললো ফয়সাল।মিথ্যায় ছিল সূচিকে একটু অবসর দেওয়ার চেষ্টা।রোমেলা বানু মাথা তুললেন।গমগমে গলায় প্রশ্ন করলেনঃ” অনেক জ্বর?”

” জ্বি,আম্মা।বসে থাকতে পারছে না।”

” তাই বইল্লা তোমার আইতে হইব ক্যান? সারাদিন বাইরে কাম করছো না? যাও ঘুমাও।”

“তুমি ঘুমাতে পারবে না আম্মা।”

” পারুম।যাও তুমি।যাওয়ার আগে লাইট বন্ধ কইরা যাও।আর বউয়ের জ্বর বাড়লে খবর দিও।”

” ঠিকাছে আম্মা।”

অন্ধকার ঘরের মাঝ দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে এসে নিজের ঘরে পা রাখলো ফয়সাল।ভেবেছিলো, ক্লান্ত সূচি ঘুমিয়ে যাবে।কিন্তু,না সূচি ঘুমায়নি।খাটের উপর বসে আছে।একদম নতুন বউয়ের মতো হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে।লাইট নিভিয়ে মশারির ভিতর এক লাফে উঠে গেল ফয়সাল।স্বামীর আলাপ পেয়ে সোজা হয়ে বসলো সূচি।অন্ধকারেই অনুমান করে ফয়সালের গা ঘেঁষে বসলো।আদুরে গলায় প্রশ্ন করলোঃ” কী হয়েছে আপনার?”

” কী হবে?”

” আপনাকে আমি চিনতে পারছি না আজ।ভূতে ধরলো নাকি?”

” ভূত না একটা পেত্নী ধরেছে।এখন আমার অসহ্য লাগে নিজেকে।কিছুই ভালো লাগে না।পেত্নীকে কঠিন শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে।”

মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল সূচির।গলার সরে কাঁপন ধরলো।ফিসফিস করে বললোঃ” কী শাস্তি?”

হুট করেই অভাবনীয় এক কাজ করলো ফয়সাল।দু-হাতে শক্ত করে সূচির কাঁধ জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বললোঃ” পিষে মেরে ফেললে কেমন হয়?”

মশারির বাইরে মশার দল কোরাস গাইছে।দক্ষিণের বাতাস কড়া নাড়ছে বন্ধ দরজায়।বাইরে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা।বোবা প্রকৃতি ঘন আঁধারে ঝিমাচ্ছে।আর ভিতরে? ভিতরে ওরা আজ আদিম মানুষ।

চলবে….

(রিচেক করিনি।ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here