শুকতারা পর্ব-৩১

0
960

#শুকতারা (পর্ব-৩১)
#হালিমা রহমান

খরখরা রোদে চোখ-মুখ কুঁচকে গেছে প্রকৃতির।চোখ মেলে তাকানো দায়।সজীব প্রকৃতিকে তপ্ত রোদে পুড়িয়ে দেওয়ার পায়তারা করছে সূয্যি মামা।সে কি কঠোর চেষ্টা তার! থালার মতো সূর্যের তেজ শুষে নিয়েছে মাটির গন্ধ।কড়কড়া শুকনো জামার মতো মাটিও শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই।ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ মিলিয়ে গেছে সেই কখন!জায়গায় জায়গায় কাদা মাটি,মাটিতে হরেক রকম জুতোর ছাপ।সকালে বৃষ্টির চিহ্ন বলতে এটুকুই আছে।আরো আছে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা ঝরা পাতা,বোঁটা খসা ছোট আম।গত রাতের অবাধ্য দমকা হাওয়ায় খামারের গোয়ালঘরের এক পাশের টিনটা খুলে গিয়েছিল।সকাল থেকে ফয়সালের সময় হয়নি এটা ঠিক করার।শ্বশুর এসেছে বলে বাড়িতেই থাকতে হলো।এখন অবশ্য সময় আছে।কিন্তু কাজে মত্ত হওয়ার মন-মানসিকতা নেই।ফয়সালের মনটা আজ খারাপ।একটু-আধটু নয়,অনেকটাই খারাপ।কাজ করতে ভালো লাগছে না,কোনোদিকে নজর দিতে ভালো লাগছে না,হাত চলছে না,বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না।তাই সহকারী আকাশের উপরেই টিন ঠিক করার ভার ন্যস্ত হলো।
গোয়ালের পিছনে দাঁড়িয়ে টিন বাঁধছিলো আকাশ।মোটা দড়িতে চালের খুঁটির সাথে শক্ত করে বাঁধতে হবে টিন,যেন আবার কোনো দমকা হাওয়ায় লাল ওড়নার মতো উড়ে না যায়।টিন বাঁধার কাছে গভীর মনোযোগ আকাশের।তবে পুরোপুরি মনোযোগ নেই।কাজের ফাঁক-ফোকড়ে একটা চোখ পেতে রেখেছে ফয়সালের উপর।সে এখন পুকুর পাড়ের খরখরা মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে।অবশ্য অলস বসে নেই।কিছুক্ষণ পর পর মাটির ঢেলা ছুঁড়ে মারছে কাছের পুকুরে।এই ভর দুপুরে মাছকে খাবার হিসেবে মাটির ঢেলা দিচ্ছে যেন।ফয়সালের আচরণ বিশেষ সুবিধার ঠেকছে না আকশের কাছে।সচরাচর সাড়ে বারোটার পরে ফয়সাল আর খামারে থাকে না,বাড়ি চলে যায়।আজ আড়াইটা বাজার পরেও যাওয়ার কোনো নাম-গন্ধ নেই।এগারোটার দিকে বাড়ি চলে গিয়েছিলো।কিন্তু ঘন্টা দেড়েক পরেই আবার ফিরে এসেছে।মুখখানা ম্লান,বিষাদের মেঘ সেখানে স্পষ্ট। ফর্সা মুখটায় অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার।হাঁটা-চলায় খুব মন খারাপের ভাব।খামারে এলো কিন্তু কথা বললো না আকাশের সাথে। প্রথমে গেল লাউয়ের মাচার কাছে।মাচার নিচে ঝুলছিলো একটা ছোট লাউ।এক আঙুল হবে হয়তো।দু-আঙুলে লাউটা ছিঁড়ে দূরে ফেলে দিলো ফয়সাল।আকাশ দেখেছে দূর থেকে।সন্তানসম সবজির করুণ দশা দেখে মনটা কেমন চিড়বিড়িয়ে উঠলো।হাহাকার জাগলো একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। গলা উঁচিয়ে কিছু বলার ইচ্ছায় জ্বিভটা লাফালাফি করছিলো মুখের ভিতর।কিন্তু বলতে পারেনি কিছুই।খামারের মালিককে কিছু বলা অসঙ্গত।এসব জিনিস একান্ত ফয়সালের।সে এগুলো ধ্বংস করবে নাকি বুকে আগলে রাখবে সেই সিদ্ধান্তও তার।অগত্যা মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ তামাশা দেখতে হলো।

ফয়সাল প্রথমে লাউ ছিঁড়লো।তারপর ছিঁড়লো সগর্বে ফুটে থাকা কুমড়ো ফুল।গায়ের বৃষ্টির পানি শুকানোর পর কি সুন্দর দেখাচ্ছিলো ফুলটাকে!সজীব, সুন্দর, চকচকে,আদুরে।সেই ফুলটাকেই ডান হাতের তালুতে নিয়ে পিষে ফেললো ফয়সাল।তারপর গেল বেগুন গাছের কাছে।গোটা পাঁচেক ছোট বেগুন ছিঁড়েই ক্ষান্ত হলো না।মাটি থেকে দু-তিন আঙুল উপরে মাথা তুলে রাখা সুন্দর দু-তিনটে লাল শাকের চারা তুলে ফেললো। লেবু গাছের একটা মাঝারি লেবু ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেললো পুকুরে।
না,আর সহ্য করা যায় না।ফয়সালকে ঠিক রাগী জানোয়ারের মতোই লাগলো। রাগে অন্ধ হয়ে সুন্দর প্রকৃতি ধ্বংস করতে এসেছে।আকাশের পেটে মোচড় পড়লো।এই সবজিগুলো তো ঠিক সন্তানের মতোই।কত আগলে এগুলোকে বড় করতে হয়।পানিতে গোসল করানোর ব্যবস্থা করতে হয়,গায়ের পানি শুকানোর জন্যে রোদের ব্যবস্থা করতে হয়,যত্ন করতে হয়।এগুলো তো আকাশেরই বাচ্চা-কাচ্চা।ছেলেটা সমস্ত দিন পড়ে থাকে এই খামারে।হোক না বেতনভুক্ত কর্মচারী। সে তো তার কাজটাকে ভালোবেসেই এখানে আছে।এতো ধ্বংসলীলা সহ্য হলো না তার।নিচু গলায় বললো,” ফয়সাল ভাই,কিছু লাগবে আপনার? কোনো সমস্যা হইছে?”

একজোড়া জ্বলন্ত চোখের অগ্নি দৃষ্টি। ভিতর-বাহির এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়ার চেষ্টা। সহসা কুঁকড়ে গেল সাহসী আকাশ।আসন্ন মধ্যাহ্নের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে বেজে উঠলো ফয়সালের কর্কশ কন্ঠ।

” নিজের কাজে যাও আকাশ।আমার কাজে নাক গলাতে আসবে না।আমার খামারে আমি যা মন চায় তাই করব।এখানে কারো কিছু বলার অধিকার নেই।”

কথা বলার অধিকার নেই।মাথা নিচু করে চলেই যাচ্ছিলো ছেলেটা।গমগমা কন্ঠে আবার থমকে গেল।

” গোয়ালঘরের টিনটা কি বাঁধা হয়েছে আকাশ?”

” না, ভাই।”

” বাঁধা হয়নি কেন এখনো? আমি হাত না দিলে কি কোনো কাজ হবে না? সব কাজ যদি আমাকেই করতে হয় তো তোমাকে কেন রেখেছি? মাস শেষে গুনে গুনে বেতনগুলো কেন দিচ্ছি? তোমরা কেউ কি আমাকে একটু শান্তি দিবে না?মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কর্মচারী আর তুমি খামারের মালিক।সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাও খালি।ফাঁকিবাজ কোথাকার।এরকম ফাঁকিবাজি করলে আমার এখানে তোমার আর দরকার নেই। তুমি অন্যকোথাও চাকরির চেষ্টা করো।এতো যন্ত্রণা আমার আর সহ্য হয় না।ঘরে-বাইরে সব জায়গায় আমাকে জ্বালিয়ে মারার চিন্তা।যত্তসব।”

ঘেউ ঘেউ করে নিজের পুকুর পাড়ে চলে গেল ফয়সাল।বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলো আকাশ।সে বকা খেলো কেন তা বুঝলো না ঠিক।ঘন্টা দুয়েক আগে আকাশ ঠিকই টিন ঠিক করতে চেয়েছিলো। কিন্তু ফয়সালই দেয়নি।তখন তার মন ভাল ছিল খুব।আকাশকে কাজ করতে না দিয়ে বলেছিল, নিজেই পরে করে নেবে।আকাশের বাঁধা হবে না। তাই তো আকাশ করল না।নয়তো কোন কাজটা সে মনিবের জন্য ফেলে রাখে? অভিযোগ করার সুযোগও তো দেয় না।রাগ হচ্ছিলো আকাশের।রাগে দু-চারটে কথা শুনিয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার অদম্য চিন্তাও চেপেছিলো মাথায়।কিন্তু চিন্তাটাকে তাড়িয়ে দিলো,প্রশ্রয় দিলো না।ফয়সালের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে বাড়িতে কিছু হয়েছে।কোনো এক ঝামেলার জের ধরেই তার মন ভাল নেই।রেগে আছে।তাই হয়তো আকাশের উপরেই রাগ ঝেরেছে।পরিস্থিতি বুঝতে পেরে খুব একটা ঘাটাঘাটি করল না আকাশ।আমসিপানা মুখে ছুটে গেল নিজ কাজে।

দূর থেকে আঁড়চোখে ফয়সালকে দেখছে আকাশ।হাতে-পা,বসার ভঙ্গিতে মন খারাপের লেশ।আকাশের মনে প্রশ্ন জাগলো।খুব মন খারাপ নাকি?বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়েছে?

হ্যাঁ, ঝামেলা হয়েছে। ফয়সালের মনটা সত্যি খারাপ।খুব,খুব,খুব খারাপ।সকাল থেকে মনটা ভালোই ছিল।দুপুরের আগে আগে মন-মেজাজ ঘেটে চচ্চড়ি হয়ে গেল একদম।শ্বশুরের সামনে তখন মায়ের ঐ মিথ্যা কথাগুলো বাস্তবিকই ভালো লাগছিলো না তার।কি সুন্দর অবলীলায় বলে যাচ্ছিলো একের পর এক মিথ্যা! থরে থরে সাজানো বিশ্রী মিথ্যা কথা।ফয়সালের পেট গুড়গুড় করছিলো।কিছু বলার চেষ্টা জাগছিলো আড়ষ্ট জ্বিভে।কিন্তু ভালো-মন্দে কখনো নাক গলায়নি সে।মা ভালো-খারাপ যাই বলুক, তাই মেনে নিয়েছে চিরকাল।রোমেলা বানুও ভুল করতে পারেন,তিনিও মানুষ,তার ভুল হলে ধরিয়ে দেওয়া উচিত, শুধরে দেওয়া উচিত তাকে— এসব কথা কখনো মাথায় আসেনি ফয়সালের।সে নিতান্ত মাতৃভক্ত ভীতু ছেলে।মায়ের কথার বাইরে এক পা নড়ার সাধ্য,ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই তার নেই।শ্বশুরের সামনে কর্তৃত্ববাদী মায়ের কথায় প্রতিবাদ করলে তামাশাটা ঠিক কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে তা বেশ জানা আছে ফয়সালের।তাই কিছু বলেনি।চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনে গেছে মায়ের মিথ্যার ঝুড়ি।জং ধরা জ্বিভ নেড়ে কিছু বলতে চেয়েছে ঠিকই কিন্তু সাহসে ভর করে বলা হয়নি।তাই মাথা নিচু করে ছিল।
এরপর নাটকে সূচির আগমন।হাঁটাচলায় ফুটে উঠা তেজ,গা ঠিকরে বেরিয়ে আসা জ্বলন্ত রাগে ভিতরটা শুকিয়ে আসছিলো ফয়সালের।রাগলে সূচি ঠিক কতটা অবাধ্য হতে পারে তার নমুনা দেখেছে বহু আগেই। যে হারে রেগে আছে তাতে মায়ের সাথে ঝামেলায় জড়ানো সূচির অসাধ্য নয়।একজন তৃতীয় ব্যাক্তির সামনে মা-বউয়ের ঝগড়ার দৃশ্য কল্পনা করতেই ভয়ে কণ্টকিত হয়ে উঠলো ফয়সালের মন।ঝগড়া যদি বেধেই যায় তো তার দশা হবে সবচেয়ে বেহাল।না পারবে মাকে কিছু বলতে,না পারবে বউকে থামাতে।মনে মনে লজ্জাজনক অধ্যায়ের অবসানের প্রার্থনা করছিলো ফয়সাল।
দয়াময় ফিরিয়ে দেননি।লড়াই হলো ঠিকই কিন্তু খোলামেলা, নির্লজ্জ লড়াই না।লড়াই হলো মিথ্যার লড়াই,সুক্ষ্ম স্নায়বিক যুদ্ধ।এ যেন মিথ্যার ছড়াছড়ি।গলা বাড়িয়ে কাজ করতে করতে কি সুন্দর অবলীলায় মিথ্যা বলে ফেললো সূচি! বউয়ের আচরণের এদিকটা এতোদিন অচেনা ছিল।আজ চেনা হয়ে গেল।কাজের মাঝে ঠান্ডা মাথায় কেউ এতো সাজিয়ে-গুছিয়ে বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা বলতে পারে, তা সূচিকে না দেখলে ফয়সাল নিজেই বিশ্বাস করতো না।মা-বউয়ের কথার যুদ্ধ, দৃষ্টির উত্তাপ তৃতীয় ব্যক্তি বুঝতে পারলো না।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারো বিব্রত হয়ে উঠলো ফয়সাল।দূরে বসে থাকা মায়ের চোখে তখন খেয়ে ফেলার দৃষ্টি। চোখেই চোখেই হুমকি দিচ্ছে যেন।চোখের দৃষ্টি যেন ঘোষণা দিচ্ছে, ” বউয়ের হাজার টাকার শখ পূরণ করবি! আমারে একবারও জিজ্ঞেস করলি না ক্যান? এতো সাহস হইছে তোর? টাকা বেশি হইছে? পকেট থেকা গড়ায়া পইড়া যায়? তুই অপেক্ষা কর।তোর শ্বশুর যায়া নেক আজকে।তারপর তোর একদিন তো আমার একদিন।”

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বউয়ের দৃষ্টিতে তখন আরেক কথা।দু-একবার চোখাচোখি হয়েছিল বটে।কিন্তু শশব্যস্ত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে ফয়সাল।সূচির চোখে-মুখে তখন ফুটে উঠা রাগ,বড় বড় চোখ দুটিতে রক্তজবার রঙ।মেয়েটা রাগ করলেই তার চোখ রাঙা হয়ে যায়।ময়লা মুখেই একগাদা প্রশ্ন।আঁড়চোখে দু-একবার বউকে দেখেছে ফয়সাল।তার থমথমে মুখে ফুটিয়ে তোলা প্রশ্নগুলো চোখের সামনে স্পষ্ট তখন। সতেজে দূর থেকেই ঝগড়া করছে যেন।সূচির চোখে-মুখে স্বামীকে প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করার ইচ্ছা।ফয়সাল বেশ বুঝলো।যত বুঝল ততোই ভয় বাড়লো।শ্বশুরের চোখ থেকে একটু আড়াল হলেই মা-বউ যে ঝাঁপিয়ে পড়বে একযোগে তা বেশ জানা। মমিন শেখকে তাই বোতলের মুখের ছিপির মতোই লাগছে। ছিপি খুললেই ভিতর থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসবে ঝামেলা।তাই ফয়সালের দৃষ্টিতেও তখন আকুল আবেদন।পেয়ারা কামড়ে মনে মনে আকুতি জানাচ্ছে, ” আপনি আজ আমাদের বাসায় থাকুন আব্বা।দয়া করুন শুধু আজকের জন্য।একটা পুরুষ হয়ে আরেক পুরুষের কষ্ট বুঝুন।”

কিন্তু না,মমিন শেখ বুঝলেন না।তিনি অনভিজ্ঞ মানুষ,ফয়সালদের ভাব-গতিক বোঝার মতো ক্ষমতা তার নেই। এই পরিবারে তিনি তৃতীয় ব্যক্তি।পারিবারিক দ্বন্দ্বের ধরন বুঝবেন না, এটাই স্বাভাবিক।নাস্তা-পানি খাওয়ার পরে সূচিকে ডেকে বললেন, ” আমি একটু আশপাশ থেকা ঘুইরা আসি সূচি।”

” দুপুর হয়ে যাচ্ছে তো আব্বা।এখন কোথায় যাবে?”

” এই তো একটু সামনেই।আধঘন্টা পরে চইলা আসুম। ঘরে বসতে ভাল্লাগতাছে না।”– মমিন শেখের মুখটা মলিন।কিছুটা গম্ভীরও।এগুলো শ্বাশুড়ির বলা তখনকার কথাগুলোর প্রভাব।সূচি আর কিছু বললো না।রাগে দিশেহারা লাগছিলো নিজেকে।বিয়ের পরে এই প্রথম নিজ বাড়ি থেকে কেউ হাসিমুখে বেড়াতে এলো।তাও সহ্য হলো না কারো।মা-ছেলে দুজনের উপর রাগ উঠলো খুব।কিন্তু শ্বাশুড়িকে আগেই কিছু বললো না।এই মুহূর্তে বলার জো নেই অবশ্য। বাবা বাড়ি এসেছে।একটু উত্তাল মেজাজে কিছু বললেই হয়তো নতুন নাটক শুরু হয়ে যাবে এখানে।পরে দেখা যাবে বাড়িতেই আর যেতে দেবে না।তাই আসন্ন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই রাগ গিলে ফেলার চেষ্টা করলো।কিন্তু না, হলো না।রুমে পা দিয়ে ফয়সালকে দেখেই মেজাজ চড়চড় করে চড়ে গেল সপ্তমে। স্বামীর তখনকার নীরবতা গায়ে সুচের মতো ফুটছে।ঠাস করে দরজা দিল বন্ধ করে।ফয়সাল তখন খাটে বসে ফোন ঘাটছিল।সূচির অগ্নিমূর্তি দেখে থমকে গেল।জ্বিভ নেড়ে কিছু বলার আগেই বদ্ধ ঘরে প্রায় হামলে পড়লো ফয়সালের উপর।একপ্রকারে উড়ে গিয়ে বসলো ফয়সালের মুখোমুখি।

” কী বলেছিলাম কাল রাতে আমি? কী বলেছিলাম আপনাকে? বলিনি, আম্মার সাথে সাথে সকাল সকাল কথা বলবেন? বলেছিলাম? উত্তর দিন।”

” হ্যাঁ, বলেছিলে।কিন্তু আমি ভেবেছিলাম…

” কী ভেবেছিলেন আপনি? আমি মিথ্যা বলছি? আম্মাকে আপনি চেনেন না? কাহিনী করেন আমার সাথে? কালকে এতোবার বললাম আব্বার সামনে যেন কোনো বাড়াবাড়ি না হয়।ঠিক সেটাই হলো।আমার কথা আপনি শুনতে চান না কেন বলুন তো? আম্মা কি সাধু-সন্ন্যাসী? তিনি কি ভুল করতে পারেন না? আপনার কি উচিত না তাকে শুধরে দেওয়া? এটা করেন না কেন আপনি? কেন করেন না? ভদ্র ছেলে সাজতে চান? মায়ের উপরে কথা বলেন না,অন্যায় দেখে চোখ বন্ধ করে রাখেন– কী প্রমাণ করতে চান এসব করে? আপনি খুব মা ন্যাওটা ছেলে এটাই? হাহ! এইসব নাটক আপনি আমার সামনে আর কখনো করবেন না।আপনারা যে কি জিনিস,তা আমার খুব ভালোমতো জানা আছে।”

একের পর এক তীক্ষ্ম প্রশ্নবাণ।ফয়সাল জর্জরিত হয়ে গেল।রেগেও গেল কিছুটা।একটা দেড় আঙুলের মেয়ের সাহস হয় কী করে এভাবে কথা বলার? তার গলাও চড়ে গেল কিছুটা।

” এই, এতো সমস্যা থাকলে তুমি সংসার করছো কেন? এই ঘর নিয়ে এতো সমস্যা থাকলে তুমি বেরিয়ে যাও,তোমাকে নিষেধ কে করেছে? তোমার সাহস তো কম না, তুমি আমাকে আসো ধমকাতে! বেয়াদব মেয়ে।তোমার আগে বড় ভাবিও এই ঘরে সংসার করেছে। তার তো কোনোদিন এতো সমস্যা দেখিনি।বড় ভাবি সহ্য করতে পারলে তুমি কেন পারবে না? ঢং করো? বড় ভাবির নখের যোগ্য তুমি? সে পেরেছে আর তুমি পারবে না? এহ আসছে,জমিদারের মেয়েটা।”

আগুনের উপরে দু-একফোঁটা ঘি।এদিকে একটু ভুল হলো ফয়সালের।তখন মায়ের অন্যায় বুঝেও চুপ করে থাকাটা ছিল দিনের প্রথম ভুল।অন্যায় করার পরেও গলাবাজি করে দিনের দিনের দ্বিতীয় ভুলটি নির্ভুলভাবে সম্পাদন করলো।
স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সূচি।কাঁপছে তিরতির করে।জ্বিভ জড়িয়ে আসছে।রাগে নাকি দুঃখে তা বোঝা গেল না।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠা আঙুলটা ফয়সালের দিকে তাক করে হিসহিসিয়ে বললো,” আল্লাহ মালুম, আমি কী করে এতোটা সহ্য করছি।বিশ্বাস করুন, আমি সহ্য করার মতো মেয়ে না।আপনাদের কপাল ভালো আমার পাশে কেউ নেই।আমাকে সমর্থন করার জন্য আমার বাবা-মাও নেই।আমার ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলার জন্য যদি একটা মানুষও থাকতো তবে আমি আপনাদেরকে দেখিয়ে দিতাম।নাকে দড়ি পড়িয়ে আমাকে ঘুরাবেন! আপনাদের মা-ছেলের এতো সাহস! আমাকে আপনারা যতোটা নিরীহ, ভালো মানুষ মনে করেন ততোটাও আমি নই।আর তুলনা দিচ্ছিলেন হুমায়রা ভাবির সাথে? সত্যিই? গলা কাঁপলো না আপনার? ছিঃ! হুমায়রা ভাবি সহ্য করেছে বলে আমিও সহ্য করব? তাছাড়া,তখন যদি মানিক পেটে না আসতো তবে দেখতেন হুমায়রা ভাবিও কতদিন সহ্য করে। আর আমাকে তুলনা দেওয়ার আগে একবার নিজের দিকে তাকান।দেখুন আগে,নিজেকে আফজাল ভাইয়ের মতো দেখা যায়? বড় ভাবি আর কিছু না পেলেও বড় ভাইয়ার কাছ থেকে সান্ত্বনাটুকু পেয়েছে।সারাদিনের গাধার পরিশ্রম,লাঞ্ছনা-গঞ্জনার পর মানসিক শান্তি পেয়েছে ভাইয়ার কাছে।আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি আমায় কী দিয়েছেন? কতটুকু মানসিক শান্তি আপনি আমাকে দিয়েছেন? সেই বিয়ের প্রথম রাত থেকে কেবল অবহেলাই পেয়ে আসছি আমি।একের পর এক মানসিক আঘাত করে এসেছেন শুধু।কখনো বুঝতে চাননি আমি কী চাই।কখনো শুনতে চাননি আমার পছন্দ-অপছন্দ।সমর্থন,শ্রদ্ধা-ভালোবাসা,সম্মান— এসব তো আপনি জানেনই না।শারিরীক অত্যাচারই কি সব? শুধু ভাত-কাপড় আর থাকার জায়গা দিলেই সবাই স্বামী হয়? আপনার আর আমার সংসারটা কেবল কবুলের জোরে টিকে আছে।বিশ্বাস করুন, এখন আপনাকে আমার দুই চোখেও দেখতে ইচ্ছা করে না।এককালে আমি ভাবতাম আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।কিন্তু এখন মনে হয় তখন আমি ভুল ছিলাম।আপনাকে না পেলেই আমি বেঁচে যেতাম।খুব সুন্দরভাবে বাঁচতে পারতাম আমি।”

টপটপ করে দু-ফোটা পানি ঝরে পড়লো সূচির চোখ থেকে। কন্ঠ ভিজে আসছে।রেগে গেলে সূচি কাঁদে না।কিন্তু আজকের রাগের আগাগোড়া দুঃখ মেশানো আছে বোধহয়। পুরোনো ক্ষতে ঘা পড়েছে।তাই শক্ত থাকার চেষ্টাও করলো না।বালুচরের বালুর ঘরের মতো ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লো। একটানা অনেক্ষন কথা বলে দম নিলো এক সেকেন্ডের জন্য।বিস্মিত ফয়সালকে একদন্ড কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আবার শুরু করলো।

” আমি যতবার আমাকে সমর্থনের কথা বলি ততোবার আপনি উল্টা বুঝেন।আমাকে একটুখানি সমর্থনের মানে কি আম্মার সাথে বেয়াদবি করা? আমাকে নিয়ে আলাদা থাকা? সারাদিনের কথাগুলো আপনার সাথে বললেই, আপনি বলেন আমি অভিযোগ করছি,নালিশ করছি আম্মার নামে।আচ্ছা আপনি বলুন,আপনাকে কিছু না বললে আমি কাকে বলব? সংসারের কথা সব বাবার বাড়িতে চালান করব? ওটা ভালো হবে? আমাদের সংসারের গোপনীয়তা আরেকজন জানুক, আপনি কি এটাই চান? আমি তো তা চাই না।নিজের কথাগুলো বলার মতো আর কেউ নেই আমার আশেপাশে। এক আপনি ছাড়া হুমায়রা ভাবির সাথেও কথা বলা নিষেধ আমার।আমি একটু সান্ত্বনা খুঁজি আপনার কাছ থেকে।মাথার উপরে আপনার স্নেহময় একটা হাত খুঁজি।একটু মানসিক শান্তি খুঁজি।আপনি তাই কখনো দেননি আমাকে।আম্মা যখন আমার সাথে অন্যায় করে তখন আপনি একটু আম্মাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন না? ঠান্ডা মাথায়,হাসিমুখে কথা বলে আম্মাকে একটু বুঝিয়ে দিলে কী হয়? ভুল ধরিয়ে দিলে কী হয়? আজকে যখন আব্বার সামনে আম্মা আমার মিথ্যা চাহিদার কথা বলছিলো,তখনও কিছু বলেননি।অন্তত আমি যা বলেছি সেই কথাটুকুও নিজে থেকে বলতে পারতেন।আমার হয়ে আমি যা বলেছি তা যদি আপনি বলতেন, তবে আম্মা কি আপনাকে খেয়ে ফেলতো? আমাকে খেয়ে ফেলেছে? সঠিক কথা সঠিকভাবে বললে কোনো দোষ হয় না।কিন্তু আপনি তো কথাই বলেন না। সেখানে সঠিক কথা তো আরো দূরের কথা।আমার নামে মিথ্যাগুলো আম্মা বললো,আপনি চুপচাপ শুনলেন।আচ্ছা কয়টা চাহিদার কথা বলেছি আপনাকে? বিয়ের পর নিজের ভাঙাচোরা বাটন ফোনটা দিলেন আমাকে।কিছু বলিনি,মেনে নিয়েছি।বিয়ের সময় শাড়ি দিয়েছিলেন।এই চারমাসে বাড়তি একটা শাড়ি দেওয়ার কথা আপনার মাথায় আসেনি।শখ করে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা আপনার মাথায় আসেনি।আমি আবদারও করিনি কখনো। ভেবে দেখুন তো এযুগের কয়টা মেয়ে এরকম করে? আমার একটা বাড়তি চাহিদা আপনি আমাকে দেখান।পারবেন? অথচ,আমার আব্বা এ বাড়িতে প্রথম পা রেখেই শুনলো আমার চাহিদার কথা, আমার শখের কথা।আর আমার স্বামী দূরে বসে সমর্থন করছিলো সব।মুখ ফুটে আম্মাকে বলতে পারেনি,বউয়ের শখ সে নিজেই পূরণ করতে পারবে।বউয়ের বাবা-মায়ের কাছে এসব বলার দরকার নেই। আমার স্বামীর কথাটাই ছুটে যেয়ে আমাকে বলতে হয়।এবার আপনি ভাবুন। আমি কোন জায়গায় সংসার করছি।আমার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করান।দেখুন, আপনি কতটুকু সহ্য করতে পারতেন।”

দাঁড়ালো না সূচি। জলোচ্ছ্বাসের মতো তীব্র কান্নাকে আড়াল করতেই ঝড়ের গতিতে ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। হলো না,বাধা পেল প্রবলভাবে। বাধাটা ফয়সালের দিক থেকে আসেনি,এসেছে নির্জীব ওয়ারড্রবের কাছ থেকে।ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডান কাঁধে ধাক্কা খেলো ওয়ারড্রবের সাথে। মড়মড় করে উঠলো যেন কাঁধের হাড়। মেজাজ সপ্তম ছাড়িয়ে অষ্টমে উঠে গেল সূচির।কেউ একটু শান্তি দেয় না কেন? বাম পা বাড়িয়ে সজোরে লাথি দিলো ওয়ারড্রবের গায়ে।একটু আগে ফয়সালকে করা প্রশ্নের উত্তরটা নিজেই দিলো। দু-তিনবার লাথি দিয়ে আক্ষেপের সুরে বললো,” একটা বা** সংসার করি আমি। কারো সাথে পারে না,পারে শুধু আমার সাথেই।বা*।”

হতভম্ব ফয়সালকে একা ঘরে রেখেই প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল সূচি।ফয়সাল বিস্ময়ে নির্বাক।একটা কথার উত্তর নেই তার কাছে।অভিযোগের উত্তরে কিছু বলার নেই। তাই চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোনো গতি নেই।আজকের ভালোবাসাময় সকালে খুশি হয়ে সূচিকে বলেছিলো সবসময় বুদ্ধি করে কথা বলতে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা না বললেই বেশ হতো। মেয়েটা এতো সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা না বললেই পারতো।ঘরের বউ আরো নির্বোধ হলেই চলতো।নির্বোধ হলে এরকম বলিষ্ঠভাবে কথা বলতে পারতো না,অভিযোগ করতে পারতো না,শান্তির জন্য হাউকাউ করতো না।ফয়সালদের ঘরের জন্য আসলে বোবা, নির্বোধ, বোকা মেয়েই দরকার।অবশ্য রক্ত-মাংসের মানুষের চেয়ে একটা রোবট হলে আরো ভালো হয়।এদের অভিযোগ থাকবে না,অভিমান থাকবে না,রাগ থাকবে না।থাকবে না কোনো ধরনের অনুভূতি।এরকম হলেই বেশ হতো।
মৌচাকে শুধু একটা টোকা দিয়েছিলো ফয়সাল।তার বিনিময়ে মৌ রানী এতোগুলো হুল ফুটিয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।

চমক শুধু এটুকুই না,আরেকটু বাকি ছিলো।বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পরে ঘরের বাইরে পা দিয়েছে কেবল।মনের অবস্থা ভঙ্গুর।মাঝের ঘরে পা রাখতেই চোখ কপালে উঠলো। রোমেলা বানু বসে আছেন খাটের উপর।স্থির দৃষ্টি ফয়সালের উপর।ফয়সালের গলা শুকিয়ে এলো।রুমের কথা এখানে শোনা যায়।সূচি তো খুব একটা আস্তে কথা বলেনি। চোখাচোখি হতেই ছেলেকে কাছে ডাকলেন হাত বাড়িয়ে।কাছে যেতেই হিসহিসিয়ে বললো,” তুই এমন ম্যান্দা ক্যান? আচ্ছা বল তো,আমার ঘরেই ক্যান দুইটা কুত্তার ছাও জন্মাইলো? গ্রামের আর মহিলা কি আছিলো না? সারা গ্রামে একমাত্র আমিই পাপ করছিলাম? আমি যদি জানতাম তোরা এমন জানোয়ার হবি,এমন বউ ভাউড়া হবি, তাইলে তোগোরে কোনোদিন বিয়া দিতাম না।নিজের আঁচলেই রাখতাম।বিয়ার সময় কত ঢং করলি, বিয়া করবি না,মাইয়া পছন্দ না।এখন কই এগুলি? বউয়ের আঁচলের গন্ধে সব পলাইছে?বউয়ের ভেড়া,জানোয়ারের জাত একটা।বউ ছ্যাচা দিয়া চোখের সামনে দিয়া বাইড়ায়া গেল আর হেয় কাইন্দা-কাইট্টা মাত্র বাইড়াইছে।আয়নার সামনে দাঁড়ায়া নিজের চেহারা দেখোস ক্যামনে তুই? লজ্জা করে না? যা, চোখের সামনে থেকা, দূর হ।”

দিনটা শুরু হয়েছিলো নিখাদ ভালোবাসায়,পরস্পরের সমঝোতায়,সুন্দর কিছু অনুভূতির মধ্য দিয়ে।একবেলাও যায়নি এর মাঝে।কাল রাতের কালবৈশাখীর তান্ডবের মতো একটা বিশ্রী তান্ডবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সব। কল্পনার মতো সুন্দর সকাল থেকে টান মেরে রূঢ় বাস্তবে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ওকে। সূচি অভিযোগ করে, ও শান্তি পায় না।একটুখানি শান্তির জন্যে ছটফট করে মেয়েটা।কিন্তু এই দূর্লভ বস্তুটা ফয়সালের মাঝেই কতটুকু আছে? এই বিয়ের পর থেকে সেই বা কতটুকু শান্তি পেয়েছে? এ ঘরে একটা দিন একটু নির্বিঘ্নে কাটানোর জো নেই।মা-বউয়ের যন্ত্রণায় হাসিখুশি বাঁচার সুযোগ নেই।আজ থেকে নয়,সেই আদিকাল থেকে।প্রথমে কাজী আকরাম,তারপর আফজাল,এখন ফয়সাল।এখানে কেউ শান্তিতে থাকে না।বাড়িটা অভিশপ্ত, সত্যিই অভিশপ্ত।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here