শুকতারা পর্ব-৩২

0
702

#শুকতারা (পর্ব-৩২)
#হালিমা রহমান

ইশতিয়াকের ব্যস্ততা আজকাল খুব বেড়ে গেছে।বাইরে সারাদিন গাধার মতো খেটে,ঘরে এসেও হাত লাগাতে হয় গৃহস্থালির কাজে। সকালে যাওয়ার আগে একচোট,দুপুরে লাঞ্চের সময় বাড়ি এসে, আবার রাতে বাড়ি ফিরে আরেকচোট কাজ। ভূমির শরীরটা ইদানীং ভালোই যায় না।বাসি ফুলের মতোই কেমন যেন নেতিয়ে যাচ্ছে।সেদিনও অফিস কামাই করে ভূমিকে নিয়ে ছুটতে হলো ডাক্তারের কাছে।কিসব পরীক্ষা-টরীক্ষা করে ডাক্তার রায় দিলো,সব ঠিকঠাক।কোথাও কোনো সমস্যা নেই।আল্লাহর রহমতে এপ্রিলের শেষের দিকেই সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই,মা-বাচ্চা দুজনই ভালো আছে।এতো এতো অভয় বানীর মাঝেও ভয় পায় ইশতিয়াক।ভূমির বিষয়ে সে সবচেয়ে ভীতু। মেয়েটার একটু চোট তার কলিজায় গিয়ে আঘাত করে।রাতের অন্ধকারে বিছানায় চুপচাপ পড়ে থেকে নিজের মনকেই বোঝায় ইশতিয়াক।ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।পৃথিবীর আদিকাল থেকে এই যন্ত্রণা সহ্য করছে মায়েরা।ভূমির চেয়ে কত ছোট মেয়েরাও সহ্য করেছে।সেখানে ভূমি তো প্রাপ্তবয়স্ক,সাড়ে চব্বিশ বছরের শক্ত-সমর্থ নারী।তাছাড়া,এখনকার চিকিৎসা পদ্ধতি কত উন্নত! ভোলায় ভালো চিকিৎসা না পেলে বরিশাল যাবে।বরিশালে ব্যবস্থা না হলে ঢাকা যাবে।দেশে কি ডাক্তারের অভাব?
রাতের অন্ধকারের সান্ত্বনাগুলো কিন্তু সকাল পর্যন্ত টিকে না।ভূমিধসের মতোই ঝরঝর করে ধসে যায়। ভূমির ক্লান্ত চোখের তারায় সব মিলিয়ে যায় অদূরে।সর্বক্ষণ সহ্য করা শারিরীক যন্ত্রণায় মুখে যে অব্যক্ত ছাপ-ছোপ ফুটে উঠে, সেদিকে তাকালেই হু হু করে উঠে ইশতিয়াকের ভিতর।পানি চলে আসা মোটা মোটা হাত-পা,ফুলে উঠা নাক, স্ত্রীর শরীরের অবসন্নতা কাঁটার মতো বিঁধে। মোটা শরীরটার দিকে তাকিয়ে সময়ে-অসময়ে দয়াময়ের দরবারে প্রার্থনা করে ছেলেটা, ” প্রয়োজনে ভূমির যন্ত্রণার কিছু অংশ আমায় দাও, খোদা। তবুও ওকে ভালো রাখো।আমার দুটো অংশকেই তুমি সুস্থ রেখো।তুমি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।”

সত্যিই কেউ নেই।তাই স্বামীর ব্যাথিত,ক্লান্ত,ভীত মুখের দিকে চেয়ে কষ্ট পায় ভূমি। নিজের অসহনীয় ব্যাথা,সারাদিনের কষ্ট ভুলে যায়।আড়ালে চোখের জল মুছে।ঐ লোকের কাঁধের উপর হাত রাখার মতো যদি একটা মানুষ থাকতো! শ্বশুরবাড়িতে আত্মীয়ের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়।নিজের বাবার বাড়ির কথা ভেবেও লাভ নেই।ভূমির কোনো খোঁজ-খবর সূচি ছাড়া ও বাড়িতে কেউ জানে কি-না তাও সন্দেহ। সীমাহীন দুঃখ-কষ্টকে মাটিচাপা দিয়ে তাই ইশতিয়াকের কাঁধে নরম হাত বুলিয়ে দেয়।গলা নরম করে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, ” এতো চিন্তা করছো কেন? সব ঠিক হবে ইশতি।”

” আমীন।”

” তুমি যেভাবে চিন্তা করছো তাতে আমার আগে অসুস্থ তুমি হবে। তখন কী হবে? তোমার কত কাজ!এপ্রিলের শেষে বন্ধ নিতে হবে।তার আগেই অফিসের কাজগুলো এগিয়ে রাখতে হবে,রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে,আমার সাথে হাসপাতালে থাকতে হবে,বাড়ি এসেও আমার সেবা করতে হবে,আরো কতকিছু।বুকে হিম্মত রাখুন সাহেব,এখনি এতো চিন্তায় ডুবলে অসুস্থ হয়ে যাবেন।তখন অসুখের দোহাই দিয়ে আমাদের মা-বাচ্চার সেবায় ফাঁকিবাজি করলে কিন্তু খবর আছে।কান ধরে সেবা করিয়ে নেব।এদিক-ওদিক একচুল ছাড় দেব না।”

সবটাই অর্ধাঙ্গকে সহজ করার প্রচেষ্টা।তবুও ইশতিয়াককে ঠিক সহজ হতে দেখা যায় না।কপালের উপর চিন্তার ভাজ,চোখে-মুখে হাজার টেনশন।ভূমি বোঝে সব।লোকটা আনাড়ি,অনভ্যস্ত।সে ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক।ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা চিন্তা করলে তার গলা শুকিয়ে আসবে,এ একেবারে ধরা কথা।তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভূমি।আগের চেয়েও নরম সুরে বলেঃ” এতো চিন্তা করো না তো।তুমি একা না পারলে কী হবে? দেশে নার্সও আছে। প্রয়োজনে একটা নার্স ঠিক করে দিয়ো।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তাই যেন হয়।ইশতিয়াকের পুরো চিন্তাটা ঠিক ভবিষ্যতের জন্য নয়,কিছুটা বর্তমানের জন্যও আছে।সারা বাড়িতে ভূমি একা থাকে।গ্রামের শেষ প্রান্ত বলেই বাড়ির পিঠে ঘন ঘন বাড়ি নেই।কিছু দূরে সূচির শ্বশুরবাড়ি কিন্তু সেখান থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা একদমই নেই। সবদিকে শুধু নেই আর নেই।অসহ্য,অসহ্য।ভূমির অবস্থা দিনদিন খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। হাত-পায়ের পানি দিনদিন আরো বাড়ছে।মাঝে মাঝে অবাক হয় ইশতিয়াক।আর কত পানি আসবে? হাত-পাগুলো আর কত ফুলবে?এতো ওজনের পা দুটো ফেলে মেয়েটা হেঁটে বেড়ায় একা ঘরে।আল্লাহ না করুক,হোঁচট খেয়ে পড়তে কতক্ষণ? পিচ্ছিল কলতলায় আসা-যাওয়া করে। অঘটনের দুর্ভাবনায় সারাক্ষণ মনটা মিইয়ে থাকে ইশতিয়াকের।অসুস্থতার শুরু থেকে ঠান্ডা বাধিয়েছে ভূমি।এই কাশিটা এখনো ভালোই হচ্ছে না।ডাক্তারী ঔষধের পাশাপাশি বাসক পাতা,তুলসী পাতার রস,আদা চা,আদার রসের সাথে মধু–কতকিছু গিললো ভূমি। তবুও ভালো হয় না।কিছুক্ষণ পর পর খুকখুক করে কাশে।কাশির সাথে কেঁপে উঠে ওর মস্ত শরীর,ঝাঁকুনির যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাত-পা মেলে শুয়ে পড়ে।হাঁপড়ের মতো উঠা-নামা করে বুক।কখনো কখনো কাশতে কাশতে বেঁকে যায় পুরো শরীর।সেদিন তো বমিই করে ফেললো।ঘুমানোর সময় বিছানা আর ইশতিয়াকের শরীরের অর্ধেক ভরিয়ে ফেললো।ঠিক এ কারণেই চিন্তাটা করে ইশতিয়াক।যদি এই অসুস্থতাগুলো একা ঘরেই হানা দেয় তখন কী হবে?
বউয়ের জন্য একটা বাঁধা দাসী রাখার ইচ্ছা ইশতিয়াকের। ওর অনুপস্থিতিতে খেয়াল রাখবে।কিন্তু এখানেও সমস্যা।এরকম বিশ্বস্ত লোক খুঁজে পাওয়া দায়। এক জনকে পেয়েছিলো ইশতিয়াক।ওর এক কলিগের বাসায় ছুটা কাজ করে মহিলাটা।ভেবেছে তাকেই ঠিক করবে।দিনের বেলায় ভূমিকে সঙ্গ দেবে,ঘরের কাজগুলো করে দেবে।কিন্তু বিনিময়ে ভদ্রমহিলা সম্মানীটা অনেক চাইলো।সব কাজ ফেলে সারাদিন এক বাসায় থাকবে,তার চাহিদা যৌক্তিক। কিন্তু বেতন থেকে এতো টাকা সম্মানী হিসেবে দেওয়া সম্ভব না ইশতিয়াকের পক্ষে। এমনিতেও এখন একটু চেপে-চুপে চলছে। সামনেই বিরাট খরচের ধাক্কা।ধার-দেনায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই বলে এখন থেকেই জমাচ্ছে। সেখানে পরিচারিকাকে এতো বেতন দেওয়ার কথা ভাবাও দুঃসাধ্য। ইশতিয়াক মধ্যবিত্ত মানুষ,তার ওতো সামর্থ্য কোথায়? অগত্যা নিজের উপরেই ক্ষোভ জমে মনের ভিতর।রাজা-বাদশাহ-জমিদারের মতো ধন-সম্পদ নেই কেনো ওর? এতো অভাবী কেন ও?বউয়ের কাজগুলো নিজেই করার চেষ্টা করে।সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘর-দুয়ার ঝাড়া-মোছা করে কলতলাটাও একটু ঘসে দেয়।এই পিচ্ছিল জায়গাটা নিয়ে ওর ভয় সবচেয়ে বেশি।দুপুরের রান্নায় সাহায্য করার সময় হয় না।তাই ভূমিকেও ঝামেলা করতে নিষেধ করে।দু-জনের জন্য দুটো ডিম ভেজে, একটু ডাল রান্নার ব্যবস্থা করতে বলে।দুপুরের খাবারের সময়ে ইশতিয়াক আবার ছুটে আসে বাসায়।সময় অল্প,তা হোক ভূমিকে দশ মিনিট সঙ্গ দেওয়াটাও অনেক বড় ভাগ্যের বিষয়। একসাথে খেয়েদেয়ে, বউকে আবারো এক পাতা উপদেশ-আদেশ দিয়ে, কপালে ছোট্ট একটা আদরের স্পর্শ এঁকে আবার ঝড়ের গতিতে কর্মস্থলে ছুটে যায় ইশতিয়াক। নিজের দায়িত্বগুলো সম্পন্ন করতে করতে বিকাল সাড়ে পাঁচটার অপেক্ষা করে।সেই ছাত্রজীবনে ছুটির ঘন্টার জন্য যেমন উদগ্রীব হয়ে থাকতো,এখনো তেমন থাকে।ঘড়িতে ছুটির ঘন্টা হতেই পড়ি-মরি করে দৌড়ায় বাড়ির দিকে।ইশতিয়াকের প্রাণ,অসুস্থ ভূমি যে সেখানেই আছে।দুয়ারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে হয়তো। মুড সুইংয়ের দিনে মেয়েটা একা থাকতে চায় না,সবসময় কেবল সঙ্গী খোঁজে।কিন্তু আফসোস,ওটাই ওর নেই।ওই একটা জায়গাতেই ও সবচেয়ে নিঃস্ব।

ইশতিয়াকের এনজিওতে আজ অনুষ্ঠান।প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে সেখানে যায়নি ইশতিয়াক।অবশ্য দোহাইটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়।কিছুটা জ্বর আছে শরীরে।সেই অযুহাতেই অনুষ্ঠানের ঝক্কি-ঝামেলা থেকে পালিয়ে বেড়ানো সহজ হলো।
বিকাল পাঁচটা দশ। ঘুম থেকে উঠে দশ মিনিট হাত-পা টানটান করে ঝারা-টারা দিয়ে ঘরের বাইরে পা দিয়েছে ইশতিয়াক।ঘরে বাজার অল্প।কিছু শাক-সবজি, মাছ-মাংস কেনা দরকার।বাজারে যাওয়া দরকার।সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তাই এখনি একটু বাজারে যাওয়া দরকার। বাড়ির কাছে অটো বা রিকশা পাওয়া যাবে না।সদ্য ঘুম ভাঙা অলস হাত-পায়ের উপরে ভর করে বাজার অবধি হেঁটে যাওয়া কষ্ট। আলিসেমিরা ভর করছে হাড়ে হাড়ে।তবুও অভিযোগ করলো না সে।হোক কষ্ট। বউ-বাচ্চার পুষ্টি দরকার।বাজার না করলে পুষ্টিটা ঘর অবধি আসবে কী করে?
ইশতিয়াকের পিছু পিছু ভূমিও ঘর থেকে বেরিয়েছে।একা থাকলে হাঁটাচলা কম করে।নামায শেষে নরম পায়ে স্বামীকে অনুসরণ করলো সদর দরজা অবধি।দিনের অবসানের রেশ ধরে সূর্য প্রায় ডোবার পথে।কাল রাতে বৃষ্টি হলেও গরম কমেনি।আগাগোড়া বাতাস জড়ানো হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা গাছের আমগুলোকেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে এসেছিল। গরম কমাতে পারলো না।আজ আধাবেলার সূর্যই আবার পুড়িয়ে দিয়েছে সব। শুকনো মাটিতে দেখে দেখে পা ফেলে রাস্তা অবধি চলে এলো ভূমি।ইশতিয়াক ততোক্ষণে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে।

” তুমি তাহলে ঘরে চলে যাও।”

” তোমার সাথে হাঁটতে ভালো লাগছে।আর কিছুক্ষণ থাকি?”

” আমি তো এখনি চলে যাব।বেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে,এখন না গেলে পরে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”

” আজকে বাজারে না গেলেই তো হয়।আজকে না যেয়ে কাল যেয়ো।একটা দিন বাড়ি আছো তাও শুধু পালাই পালাই।”

ভূমির অভিমানী স্বর,ইশতিয়াক মুচকি হাসলো।বাড়ির সীমানা হিসেবে রাখা ফাটাফুটো টিনের গায়ে হেলান দিয়ে বললো,” কাল আমার ছুটি নেই।”

” ফেরার পথে বাজার করবে। বাজারের উপর দিয়েই তো বাড়ি আসো।”

বুদ্ধিটা মন্দ নয়। আজ-কাল কোনোমতে চালিয়ে নেওয়াই যাবে।তাছাড়া ভূমিও যখন ওর সঙ্গ চাইছে,তখন এটুকু তাকে দেওয়াই যায়। স্মিত হাসলো ইশতিয়াক।সস্নেহে বউয়ের ফোলা নাকটা টিপে দিয়ে বললো,” চলো হাঁটি।”

” ঘরে তালা দিয়ে আসি?”

” না,দরকার নেই। দূরে কোথাও যাব না শুধু এই রাস্তাটায় হাঁটব।”

মাটির এবড়োখেবড়ো নোংরা রাস্তা। কিছু জায়গায় কাদা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখনো। রাস্তায় পা রাখতেই মনটা ভালো হয়ে গেল ভূমির।ভারী হওয়ার পর থেকে খুব একটা বাইরে বেরোয় না ও।একা একা বেরোতে ভালোও লাগে না।আজ বহুদিন পর বেলাশেষের আলো বেশ ভালো লাগছে।বিকালটা সুন্দর। ইশতিয়াক সাথে থাকলে ভূমির প্রতিটা মুহূর্ত সুন্দর লাগে।
দূর থেকে একটা অটো আসছে,রাস্তা থেকেই দেখলো ভূমি।লাল রঙা, ভাঙাচোরা পুরোনো অটো।দু-পা পিছিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল তাই।

” কী হলো?”

” অটোটা যাক,তারপর যাই।”

” আচ্ছা।”

সদর দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো ভূমি।এক মিনিট সময়ও পুরোপুরি লাগলো না।বাড়ির সামনে দিয়ে অটোটা চলে গেল।ফাঁকা রাস্তা দেখে আবারো বেরিয়ে এলো সে।ইশতিয়াকের নজর নেই সেদিকে।সে তাকিয়ে আছে দূরে পালিয়ে যাওয়া সেই পুরোনো অটোর দিকে।

” এই কী দেখো? চল হাঁটি।”

” হ্যাঁ, চলো। ওই অটোতে বোধহয় সূচি ছিল।মনে হলো ওকেই দেখলাম।সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল।”

মুহূর্তেই উদগ্রীব হয়ে উঠলো ভূমি।স্বামীর হাতে খোঁচা দিয়ে বললো,” ঠিক দেখেছো?”

” হ্যাঁ, আব্বাকেও দেখলাম বোধহয়। সূচিকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে হয়তো।”

হ্যাঁ, সত্যি সেখানে সূচিই ছিল।সে আজ বাড়ি যাচ্ছে।কিন্তু আশা পূরণ হওয়ার অগাধ আনন্দ নেই মনে।দুপুরের ঝগড়ার পর থেকে আনন্দটা ফিকে হয়ে গেছে। মনের আনন্দ নেই বলেই শরীরের সেই চনমনে ভাবটা নেই। কেমন একটা বাজে নিস্পৃহের ঢেউ সর্বাঙ্গে। তাই বাড়ি ফেরার এই সংক্ষিপ্ত পথেও চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলো সূচি। কাঁচা মাটির উঁচু-নিচু রাস্তায় ঝাকুনি খেতে খেতে একটু তন্দ্রার ভাব চলে এসেছিলো দু-চোখে।এই সুযোগে বড় আপা চোখের উপর দিয়ে চলে গেল, তা বুঝতেই পারলো না মেয়েটা।

” সূচি,এই সূচি।”

মমিন শেখের ডাকে ধরফর করে চোখ মেললো সূচি। হঠাৎ তব্দ্রাটা ভেঙে যাওয়ায় বোকা বোকা লাগছিলো। কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে ধাতস্ত করে বললো, ” জ্বী আব্বা?”

” তোরে কি অনেক শখ সোফার? জামাইয়ের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করোছ সারাদিন?”

হায়রে! রোমেলা বানুর মিথ্যার প্রভাব এখনো কাটেনি।বিরক্ত হওয়া উচিত ছিল সূচির কিন্তু হলো না।নিজের বাবাকে চেনে সে।লোকটা মানুষের কথায় কতটা প্রভাবিত হয় তা অজানা নয়।

” না আব্বা।খুব শখ নেই আমার।আম্মা একটু বাড়িয়ে বলেছে।”

” আমগো বাড়ি থেকা যে বিয়ার সময় কিছু দেই নাই, এ নিয়া তোরে কিছু কয় ঐ বাড়িতে?”

” দেনা-পাওনার কোনো কথা ছিল আব্বা?”

” না,তবুও দেশচল হিসাবে দেয় না? আবার তোর শ্বাশুড়ি আজকে বলতাছিলো।”

” দেশচল হিসেবে মেয়ে দিয়েছো।আর কী চাই? আম্মা একটু এরকমই৷ তুমি চিন্তা করো না।তোমার জামাই তো কিছু বলেনি।তাহলে আর অকারণে চিন্তা করছো কেন?”

বাইরের দিকে চেয়ে রইলো সূচি।চেনা পথঘাট,কিছুই অপরিচিত নয়। সূচির দৃষ্টি এলোমেলো। মনটা বেশ খারাপ।অবশ্য এ বস্তু কবেই বা ভালো থাকে? আজ দুপুরের ঝামেলার পর থেকে ফয়সালের সাথে আর একটা কথাও হয়নি। এক টুকরো কথা সেও ছুঁড়ে দেয়নি,ফয়সালও না।দুজনের মাঝে কঠোর নিরবতা চলছে। সূচি ভেবেছিলো হয়তো এ যাত্রায় আসতেই দেবে না বাড়িতে।কিন্তু না,আসার সময় কেউ বাধা দিলো না।মা-ছেলের মুখ ছিল থমথমে।আসার আগে শুধু শ্বাশুড়িকে বলে এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় নিতে বলেছে,” আসছি আম্মা।”

” যাও, তাড়াতাড়ি আইবা।তিনদিনের বেশি থাকবা না।”

মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছে সূচি।তর্ক মুখে করেনি,করেছে মনে। গাল ভেঙিয়ে বলেছে,” হুহ,তিনদিন! বললেই হলো? চারমাস পরে কেউ তিনদিনের জন্য বেড়াতে যায়?”

তার সাথে আর কথা হলো না।থমথমে মুখে ব্যাগ অটোতে তুলে দিলো।মমিন শেখ সেধেছে অনেকবার।প্রতিবার এক কথাতেই দাওয়াত ফিরিয়ে দিয়েছে ফয়সাল। বিনীত ভঙ্গিতে বলেছে,” আজ না আব্বা।আম্মা একা,পরে যাব।”

সূচির সাথে কথা বললো না,সূচিও আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি।তবে অটো ছাড়ার পর দুনিয়া কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।সাথে বেজে উঠলো অভিমানী সুর– ” সে আমার অভিমানগুলো কেন বোঝে না?”

দর্জি বাড়ি।দর্জিদের ঘাট ভাঙা পুকুর,বাড়ির পিছনের বাগান।এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা,দূরের নিশানা খেজুর গাছ।এক লহমায় নিজের কষ্ট ভুলে গেল সূচি। গাছপালা,পুকুর,রাস্তা এমনকি হাওয়া,শেষ ফাগুনের উষ্ণ হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিতেই সূচি বুঝলো বাড়ি এসেছে।আজন্ম পরিচিত বাড়িটা,আত্মার আত্মীয় মানুষগুলো দূরে নেই আর।মাত্র চারমাস। অথচ, সূচির কাছে মনে হচ্ছে হাজার বছর পর বাড়ি এসেছে ও।এদিকের আলো-হাওয়া গায়ে লাগতেই কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে মেয়েটা! সূচির মনে উচ্ছ্বাস। মনে হচ্ছে ফাল্গুনী হাওয়া ওকে আহ্বান করছে।মিইয়ে যাওয়া আলোয় রাঙা বিকালের গরম হাওয়া ওর গাল ছুঁয়ে আন্তরিকভাবে বলছে,” মেয়ে এসেছিস? তোর জন্যই পথ চেয়ে আছি।এবার কিন্তু পালিয়ে গেলে চলবে না।অনেকদিন থাকতে হবে।”

চনমনে হয়ে উঠল সূচির দেহ-মন।মিলনের আকাঙ্ক্ষায় চোখের কোনটা ভিজে উঠলো।বাড়ি ফিরার আনন্দও বুঝি এমন হয়?

সদর দরজার বুড়ো খেজুর গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রনি,লিলি। সেই আগের মতো,ওরা ওর অপেক্ষায়। তর সইলো না সূচির।অটো থামতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়লো। দৌড়ে এলো দুটো।লতার মতো প্যাঁচিয়ে ধরলো দুজনে।লিলির কন্ঠে অভিমান।

” তুমি এতোদিন পর এসেছো কেন ফুপি? আমার পুতুল বৌয়ের বিয়ে হচ্ছে না।”

” আহ, লিলি! ছাড় সূচিরে।পরে কথা কইছ।”

চমকে সামনে তাকালো সূচি।মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে তিন সই।অসমবয়সী তিনটে বান্ধবী সাথে জননী। সবার ঠোঁটে হাসি।সূচির আত্মা জুড়িয়ে গেল।প্রিয় মানুষদেরকে দেখে সহসা পা নাড়তে পারলো না।ওখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললো বাড়ি ফেরার আনন্দে।

” হায় হায়! ঠাডা পড়া মাইনষের মতো খাড়ায়া আছে।আয় এদিকে বলদী।দৌড়ায়া আসবি। দেখি জামাই কতো দৌড় শিখাইছে।”

সত্যিই দৌড় দিলো সূচি। জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টা আজ দিলো।বাড়িতে পা দেওয়ার সাথে সাথে ফিরে এসেছে তার স্বস্তি, চপলতা,আনন্দ।তার উচ্ছ্বাস দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায়,বহুদিন পর হতভাগীর আজ অবসর মিলেছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here