#শুকতারা (পর্ব-৩৬)
#হালমা রহমান
সূচির বয়স কত? আঠারোর শেষ অথবা ঊনিশ ছুঁইছুঁই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবার ঘরে খুব আদুরে ননীর পুতুলের মতো আহামরি আনন্দে দিন কেটেছে, বিষয়টা তেমন না।তার বেশিরভাগ দিনগুলো ছিল খুবই ম্যাড়মেড়ে, খুবই স্বাভাবিক,সাধারণ।অতিরিক্ত শাসন,শৃঙ্খলার বাঁধন,বাবার চোখ রাঙানী,মায়ের হাজারটা বারনে বছরের প্রায় সব দিনই খুব কড়াকড়ি,বাড়ির ভাবি মহল,রনি-লিলি, বান্ধবীর সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত — এই ছিল সূচির স্বাভাবিক দিনের কার্যকলাপ।একটু আশেপাশে ঘুরতে যাওয়ার অভ্যাসও ছিল না,সুযোগও ছিল না। আনন্দঘন শৈশব-কৈশোর অথবা এতো বছরে মনে রাখার মতো স্মরণীয় দিন বলতে কোনো দিন সূচির জীবনে নেই।তার অলি-গলি খুবই সাধারণ। মাঝে মাঝে স্বাভাবিক ছন্দে ভাঙন ধরতো অবশ্য। কোনো ভুল হলেই বাবার মারধর,মায়ের নিরব সমর্থন,তীব্র ভর্ৎসনা– অতিরিক্ত শাসন ও সন্দেহের কারণেই হয়তো এসব হরহামেশাই লেগে থাকতো তাদের ঘরে।ঘরে এসব অঘটনের আগমন মানেই একটি অস্বাভাবিক দিন,কিছু নিষ্ফল কান্নাকাটি,ব্যর্থ অভিমান,গাল ফুলিয়ে বাবা-মায়ের সাথে আড়ি নেওয়া,কিছুদিন গম্ভীর হয়ে তাদের সাথে কথা বন্ধ রাখা।এই তো হয়েছে চিরকাল।বিয়ের আগের দিনগুলো এমনই ছিল।বিয়ের পরের দিনের কথা বলে লাভ নেই।পাষাণ বাবা তাকে এক নিরাসক্ত লোকের হাতে সঁপে দিলো।অবশ্য তাতে বিয়ের দিন অবধি কোনো সমস্যা ছিল না সূচির।সেই নিরাসক্ত মানুষটাই ছিল তার কৈশোরের প্রেম,বিধ্বংসী প্রথম প্রেম। বাবার বাড়ি থেকে মুক্তির আনন্দ,প্রিয়তমকে একদম নিজের করে পাওয়ার আনন্দে মেয়েটা প্রায় ভেসেই যাচ্ছিলো।বিধি বাম! ভেসে ভেসে আনন্দের অতলে পৌঁছানো আর হলো না।অনাগত দিনগুলোকে কল্পনায় মন মতো সাজানোর আগে বিশাল এক চড় খেয়ে নতুন জীবনের শুরুতেই বাস্তবের মাটিতে পা পড়লো সূচি রানীর।নতুন সূচনায় ফয়সালের নিরাসক্ত ভাব,কঠিন কথাগুলো তো চড়ের মতোই ছিল।তারপর জীবন নামক রঙ্গমঞ্চে দেখা মিললো খুব কর্তৃত্বশীল এক চরিত্রের।রোমেলা বানুর সবকিছুতেই বাঁধা-ধরা নিয়ম।পৃথিবী উল্টে গেলেও নিয়মের বাইরে এক পা নড়চড়ের সুযোগ নেই।অলস কাঁধ দুটোর উপর ভূমিধসের মতোই ধসে পড়লো কাজী বাড়ির পুরোনো এক সংসারের সকল কর্মভার। একদিকে স্বামীর অসহযোগিতা আরেকদিকে শ্বাশুড়ির কঠিন মুখ,গালিগালাজ, অষ্টপ্রহর ধমক আর নিত্যদিনের মানসিক যন্ত্রণার মাঝে বহুদিনের লালিত বিধ্বংসী প্রথম প্রেমটা কবে ফিকে হয়ে এলো,তা বুঝতেই পারলো না সে। বিশাল কর্মযজ্ঞে আনাড়ি সূচি খড়কুটোর মতো ভেসেই যাচ্ছিলো প্রায়,সেখান থেকে এক টানে তাকে তুলে আনলো হুমায়রা।নিদারুণ অসহযোগিতার মাঝে এক টুকরো স্বস্তি।সূচিকে গড়ে-পিটে পাকা গৃহিণী বানিয়েছে হুমায়রা।তার সাথে সাথে বড় আপার জন্য যে শ্রদ্ধার জায়গাটা ছিল,সেখানেও ভাগ বসিয়েছে।এরপর গেল কিছুদিন।অর্ধাঙ্গ গললো ঠিক,নিরাসক্ত মানুষটার আসক্ত হলো তার প্রতি।তবুও কোথাও একটা তার ছেঁড়া ছিল।দৈনিক চাওয়া-পাওয়ার হালখাতায় শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সম্মান-সহযোগিতা ছিল না। তাই ওদের সম্পর্ক কখনো ঠিকঠাক চলেনি।কাছাকাছি যাওয়ার সুবাদেই মেয়েটা বুঝলো তার প্রিয়তমের কোনো নিজস্বতা বা স্বকীয়তা নেই।সে খুব দুর্বল,ভীতু,অন্যের হাতের কলের পুতুল।চাবি যেভাবে ঘুরানো হবে সে ঠিক সেভাবেই ঘুরবে। তার ছোটখাটো কাজগুলোও আরেকজন নিয়ন্ত্রণ করে।ফয়সালকে যত চিনলো ততোই তার উপর থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি চলে গেল।তার কল্পনার ফয়সালের সাথে সত্যিকারের ফয়সালের কোনো মিল নেই।সূচির চাহিদা ছিল একটু মানসিক শান্তি।ফয়সাল তাকেই আখ্যা দিলো অভিযোগ আর নালিশ হিসাবে।সর্বত্র একটা বিশ্রী অশান্তি। সম্পর্কের সমীকরণটাও অন্যরকম।অর্ধাঙ্গের মন কুটিরের সামনে কেবল হাতড়ায় সূচি কিন্তু মন অবধি পৌঁছাতে পারে না।তাই তো তাদের কোনোকিছুতেই মিল হয় না। এতো কিছুর মাঝে বিয়ের আগের সেই প্রাণে ভরা,মুখরা,চপলা সূচি পুরোপুরি বদলে গেল। সে এখন কাঠখোট্টা সেপাই। প্রতিপক্ষের প্রতি অশ্রদ্ধায় তার মন-মস্তিষ্ক পুরোপুরি পরিপূর্ণ।অহর্নিশ অশান্তির আশঙ্কায় তার হৃদয় ভীত থাকে সবসময়।
এই তো সূচির আঠারো বছরের জীবনের গল্প।বিচিত্র তার জীবন।কাকতালীয় বা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সবসময় আরেকজনের ভাগ্যের জের টানতে হয় তাকেই।বাবার বাড়িতে ভূমির অপরাধের দন্ড এলো তার উপর।শ্বশুরবাড়িতেও একই কাহিনী।কবে না কবে রোমেলা বানু অত্যাচারিত হয়েছে তার শ্বাশুড়ির হাতে,সেই জের এখন টানতে হয় সূচিকে। শ্বাশুড়ি যেমন শিখেছে,তার সাথে তেমনই করবে।এই তো চলে আসছে সেই বিয়ের পর থেকে। সবক্ষেত্রে পরিস্থিতির বলির পাঠা সূচির কল্পনা ও বাস্তবে বিস্তর তফাৎ। তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে আকাশ-পাতাল বৈশাদৃশ্য।
এই তো সূচির আঠারো বছর জীবনের সারাংশ।কিশোর কবি বলেছেন,আঠারো বছর বয়সে দুঃসাহসেরা উঁকি দেয়।সূচিও দুঃসাহসে ভর করে বার কয়েক মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে,কিন্তু পারেনি।বরাবরের মতো পরিস্থিতি তার দুকাঁধে আসন গেড়ে বসেছে।কেউ তার কথা শুনতে চায় না।শ্বশুরবাড়িতেও না, বাবার বাড়িতেও না।এই যে,এ বাড়িতে অষ্টপ্রহর মা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে।প্রথমদিনই সূচি তার মাকে ও বাড়ি নিয়ে একটা কথাও বলতে নিষেধ করেছিলো।বলেছিলো,এখানে ও একটু শান্তিতে দম ফেলতে এসেছে,নীতিকথা শুনতে নয়। কিন্তু কে শোনে ওর কথা?
সাহিদা বেগম মেয়ের কথায় কান দেননি একবারের জন্যেও।সুযোগ পেলেই মেয়ের পাশে বসে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাজী বাড়ি নিয়ে কথা বলে।একটু একটু করে সূচির সংসারের খবর সংগ্রহ করে।তারপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় শুরু করে নীতিকথা।মেয়ের পাশে বসে হাজারটা উপদেশ দেয়।গলা নিচু করে বলে, ” শোন মা,অশান্তি কইরা লাভ আছে? তোর সংসারে বুড়া মানুষ আছে। তারে নিয়াই বাঁচতে হইব।সে ধমক দেয়,বকাবকি করে, হাজারটা কাজ করায়,কটু কথা বলে,বলুক।এক কানে ঢুকাইলে আরেক কানে বাইর কইরা দিবি।”
” আম্মা,তুমি জানো না কত বাজে কথা বলে।শুধু আমাকে বললেও চলতো কিন্তু আমার….
চুপ মেরে যায় সূচি। বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে,তাদের চরিত্র নিয়ে, সর্বোপরি ঘরের বউয়ের জন্ম নিয়ে যেসব বিশ্রী কথা বলে তা কী করে মুখে উচ্চারণ করবে সে? ছিঃ! তার চেয়ে মুখ খসে যাক।মায়ের সামনে সূচি কিছুতেই সেসব উচ্চারণ করতে পারবে না।
” সূচি,মাইয়া মাইনষের চামড়া সত্তর গুণ মোটা করা লাগে।তুই ঐসবে কানই দিবি না।দরকার পড়লে কানে তুলা গুইজ্জা রাখবি।যখন বকব তখন আরেক ঘরে যায়া বইসা থাকবি।মুখে মুখে কথা বলিছ না মা।তোর চাপার জোর তো আমি জানি।পরের ঘরে এই চাপা কেউ সহ্য করব না।আর তোর শ্বাশুড়ি কয়দিনই বা বাঁচব? একটু সহ্য কর মা।অশান্তি কইরাই কী হইব? তুই কি সংসার ছাইড়া আসতে পারবি।বিয়া কইরা ঢুকছোছ, একবারে মরার পরে বাইর হবি ঐ বাড়ি থেকা।তাইলে ঝামেলা করার কী দরকার? তাছাড়া দেখবি একটা বাচ্চা-কাচ্চা হইলে সব ঠিক হইয়া যাইব। তখন বেয়াইনে নাতি নিয়া ঢং কইরাই কুল পাইব না, তোর পিছে কী লাগব?”
মা কথায় কথায় এই কথাটাই বলে।একটা নিষ্পাপ বাচ্চা এলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে।সবখানেই নাকি এমন হয়।সূচির কম বয়স,কথাটা যে মনে প্রভাব ফেলে না তা কিন্তু না।মায়ের আর কোনো কথা মনে না ধরলেও এই কথাটা ঠিক মনে ধরে।মনে পড়ে যায় মানিক আসার পরেই বড় ভাবি শান্তি পেয়েছিলো।আফজাল ভাই বউয়ের কষ্ট বুঝতো।সূচির বেলায়ও কি তাই হবে? ফয়সাল তাকে বুঝবে? শ্বাশুড়ির মুখ বন্ধ হবে? তবে তাই হোক।একটি ছানা-পোনা আসুক কাজী বাড়িতে।সূচি একটু শান্তি চায়।একটি বাচ্চা আসুক শান্তির পয়গাম নিয়ে।তার মায়ের ভালো থাকার মন্ত্র শিখে সে আসুক।
এতো বছরের জীবনে এই কয়েকটা দিন ঠিক মনে রাখার মতো। বাবার বাড়িতে যে এতো স্বস্তি আছে তা বিয়ে না হলে জানতেই পারতো না সুচি। পায়ের ব্যাথাটা এখন নেই বললেই চলে।প্রতিদিন ফজরের নামাজটা শেষ করে দৌড়ে খাটে যাওয়ার আগে খপ করে তাকে ধরে ফেলে সাহিদা বেগম।আগের রাতের পান্তা ভাতে বাসি তরকারী মেখে মেয়ের মুখে ঠেসে দেয়।প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগতো সূচির।কিন্তু এখন আর লাগে না।তার রুগ্ন শরীর মাকে ঠিক কতটা পোড়ায় তা বেশ আন্দাজ করতে পারে।মায়ের একটা নেশা চড়ে গেছে যেন।মেয়েকে খাইয়ে-দাইয়ে আগের মতো করতেই হবে।তাই স্নেহের বিপরীতে আর উচ্চবাচ্য করে সূচি।খাওয়ার পরে আবার ঘুমায়,এক ঘুমে পুরো সকাল দশটা।মমিন শেখ এখন সকালের খাবার মেয়েকে ছাড়া খান না।সূচিকে তাড়া দিতে ঘুম থেকে টেনে তুলেন।তারপর একসাথে পাটিতে বসে ভাত খান।খেতে খেতে হরেক রকম কথা বলেন।ভালো-মন্দ থেকে শুরু করে ক্ষেত-খামারের কথা অবধি মেয়ের সাথে বলেন।সূচি অবাক হয় মনে মনে।জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবা কখনো এতো গল্প করেছে বলে মনে পড়ে না। একটা প্রশ্ন মাথায় দাপটের সাথে ঘুরে বেড়ায়।আচ্ছা,বিয়ের সব বাবারাই মেয়েদের সাথে এতো আহ্লাদ করে? সূচির বাবা তো আগে করেনি কখনো।এখন করে কেন?
খাওয়ার পর পুরো বাড়ি চষে বেড়ায় সূচি।এঘর- ওঘর ঘুরে ভাবিদের সাথে গল্পে মাতে।এখন আর দৌড়াদৌড়ি করে না। দৌড়াদৌড়ি করলে কষ্টই হয় কেবল। মনি ভাবির ফোনে কখনো নাটক দেখে,কখনো জয়া ভাবির সাথে গল্প করে আবার কখনো চম্পা ভাবির বয়ামের আচার খায়।বাকি সময় কাটে আলেয়া দাদির সাথে ঝগড়া করে ও রনি-লিলির সাথে পুতুল খেলে।পুতুল খেলার বয়স নেই তবুও খেলতে বেশ লাগে।লিলির খুব আগ্রহ বলেই হয়তো এতো ভালো লাগে।
সারাদিনের আড্ডার পরে রাত নামতেই একরাশ ভালোলাগা নেমে আসে সূচির ছোট্ট ঘরে।বিছানায় যাওয়ার পরে এগারোটা থেকে অপেক্ষার প্রহর শুরু।এগারোটা বিশ থেকে সাড়ে এগারোটার একটু এদিক-ওদিকেই ফয়সাল ফোন দেয়।তারপর চলে একটি মিষ্টি ফোনালাপ।বিয়ের পর এই দু-তিনটে দিন স্বামীর সাথে যতো কথা বলেছে সূচি,এতো কথা সে জীবনে বলেনি। সচরাচর সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হয়।এরপর চলতেই থাকে। এপ্রান্তে সূচি,ওপ্রান্তে ফয়সাল।যতক্ষন ফোনে ব্যালেন্স থাকে ততোক্ষণ তাদের থামার নাম নেই।বেশ ভালোই লাগে সূচির।বলতে গেলে সারাদিনে সে রাতের অপেক্ষা করে। পারিবারিক কলহ,ঝগড়া-বিবাদ,মনোমালিন্য,মানসিক দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে তাদের আলাপচারিতা। একে অন্যে জেনে নেয় পস্পরের পছন্দ-অপছন্দ,আগ্রহ-অনাগ্রহ,ভালো লাগার বিষয়গুলো।কার কোন ফুল পছব্দ,কার কোন রঙ পছন্দ,কোন নায়ককে দেখলে সূচি হা করে চেয়ে থাকে,চিত্রনায়িকা পূর্ণিনা নাকি মৌসুমী–কোন নায়িকার উপরে ফয়সাল ক্রাশ খেয়েছিলো এককালে, এসব কথা-বার্তাই হয় বেশিরভাগ।রাতেরবেলায় আবিষ্কারের নেশায় মাতে দুজনে।যেই জানাশোনা বিয়ের পরপরই হওয়ার কথা ছিল, তা এখন হয়।মন্দ নয়,বেশ ভালোই লাগে। সেদিন প্রিয়তমের মুখের সহজ স্বীকারোক্তিতে এখনো আচ্ছন্ন সূচি।নিজের স্ত্রীর কাছে যে মন খারাপ করে নিজের দুর্বলতা,ভীরুতা প্রকাশ করতে পারে,সে সত্যিকার অর্থেই ঠিক কতটা দুর্বল তা ভাবে মাঝে মাঝে।প্রিয়তমকে কতটুকু হীনমন্যতা সর্বদা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তা চিন্তা করে প্রায়ই।ভাবতে ভাবতেই অবাক না হয়ে পারে না সূচি।একটা মানুষ কী করে এতো ভীতু হতে পারে, তা ভেবেই পায় না।ভাবনাগুলো যতোই গাঢ় হয়,ততোই একটা কোমল সহানুভূতি ছড়িয়ে পড়ে সারা হৃদয় জুড়ে।ভালোবাসা নয়,দয়া-করুণা আসে ভিতর থেকে। মনে একটা বিশ্বাস আসন গেড়ে বসে হাত-পা ছড়িয়ে।ঐ লোকটা চিরকাল মাথা নিচু করেই রাখবে।কখনোই সূচির পাশে দাঁড়াতে পারবে না।
যে নিজের জন্যেই জোর খাটাতে পারে না,সে তার ভালো-মন্দে কী করে নাক গলাবে?
শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলো সূচি।শুধু এখন নয়,প্রায়ই ভাবনাগুলো হানা দেয়। আজ সারাদিনে ফয়সাল একবারের জন্যেও ফোন দেয়নি।কারণটা অজানা নয়।কাল শুক্রবার ছিল।ফয়সালের ইচ্ছা ছিল কালকেই বউকে নিয়ে যাবে।সূচিই কথা শোনেনি।সে তার সিদ্ধান্তে অনড়।আর তিন-চারটে দিন থাকবে। ফয়সাল প্রথমে আদর মেখে কথা বললো,তারপর অনুরোধ করলো,তারপর রাগ করলো।নিজের সমস্যার কথাও জানিয়েছে দুই-তিনবার।সূচিকে ছাড়া তার চলছেই না।তিনবেলা বাসি-টাসি খেতে খেতে পাকস্থলী পঁচে যাচ্ছে।ঘরের দিকে তাকানো যায় না।ফয়সালের এক কথা।মোবাইলের ওপ্রান্তে বসে খুব অনুনয়ের গলায় বলে,” তুমি চলে এসো না সূচি।খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট।আমার ভালো লাগছে না।আজকে রাতে কালকের ডাল খেয়েছি।বুঝতে পারছো কিছু?”
সূচি হাসে আর হাসে।তাকে বাড়ি ফেরাতে কত বাহানা! ওবাড়িতে কবে বাসি খাওয়া হয়?
ফয়সালের এতো অনুনয়-বিনয় দেখে বেশ ভালোই লাগে। প্রিয়তম তাকে অনুভব করছে,তার অভাব বুঝতে পারছে,এর চেয়ে বেশি আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে?
শুয়ে শুয়ে ভাবলো সূচি।ফয়সাল বোধহয় খুব রাগ করেছে আজকে।এইবারে যাওয়া উচিত।আবার কয়েক মাস পরে আসা যাবে।তারও খারাপ লাগছে ফয়সালকে ছাড়া।দিন কয়েকের দূরত্ব বেশ কাজে দিয়েছে।এতোদিন জানতো দূরত্ব বাড়লে গুরুত্ব বাড়ে।এবার আরেকটা জিনিস শিখলো।দূরত্ব বাড়লে গুরুত্বের পাশাপাশি সম্পর্কের মাধুর্যও বাড়ে। আজ আর ফয়সালের অপেক্ষা করলো না।সাড়ে এগারোটা বাজার আগেই তার নম্বরে কল করলো সূচি।অন্ধকার ঘরে কেবল ফ্যানের শব্দ শোনা যায়।বালিশে মাথা পেতে ওপাশে কন্ঠের অস্তিত্ব জাগা অবধি অপেক্ষা করলো চুপচাপ।
” হ্যালো ”
” রাগ পড়েনি আপনার এখনো?”
” চুপ করো তুমি ফাজিল মেয়ে।কখনো বুঝতে চাও না আমাকে।”
কন্ঠের উত্তাপে ভয় পেলো না সূচি।বরং অন্যরকম এক আনন্দে হেসে গড়িয়ে পড়লো।ফোন কানে চেপে খুব আদুরে গলায় বললো, ” আমি না বুঝলে কে বুঝে?”
” আর কিছু বলবে?”
” আমাকে নিয়ে যান এসে।”
” সত্যি বলছো? আসবে কালকে?”
ফয়সালের কন্ঠে আনন্দ।সূচি হাসলো।
” হ্যাঁ, সত্যি বলছি।নিয়ে যান এসে।কালকে আসবেন? আসলে একটু তাড়াতাড়ি আসবেন।আমরা আগে বাড়িতে যাব না।আসরের আগে বের হব।বাড়ি যাওয়ার আগে একটু নদীর পাড়ে ঘুরতে যাব।ঠিক আছে?”
” ইয়ে সূচি,বলছি কাল আসলে তুমি আব্বার সাথে চলে আসো।আমার না একটু কাজ আছে,একটু ব্যস্ত থাকব কাল।”
সূচির কপাল কুঁচকে গেল।গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো, ” কী কাজ আপনার?”
” ঐ খামারের একটু কাজ।”
” তো শেষ করেই আসবেন।সারাদিন তো আর লাগবে না।”
” না সারাদিনই লাগবে।”
” এদিকে আসার সময় হবে না একটুও? আপনি না আসলে আমি যাব না।আসার সময়েও আব্বা নিয়ে এসেছে।এবারেও আব্বা নিয়ে যাবে কেন? আপনি আসুন।আধঘন্টা সময়ও হবে না আপনার?”
” এতো কথা বলো না সূচি,বলছি তো সময় হবে না।আব্বার সাথে চলে এলে কী হবে?”
সূচির মেজাজ চটে গেল। হিসহিসিয়ে বললো,” আপনি জানেন আপনি আসেননি বলে সবাই কত প্রশ্ন করেছে আমাকে? নতুন বউরা স্বামী ছাড়া আসে? এবার অন্তত আসুন।গ্রামের মাঝে বাড়ি আপনার।না এলে সবাই বাজে কথা বলবে।”
গললো না ফয়সাল।ওপাশ থেকে খুব অনুনয়ের সুরে বললো,” চলে এসো না লক্ষ্মী।এতো প্রশ্ন করো না তো।সুযোগ হলে তো আমি যেতাম তাই না? এখন কিছুতেই পারব না।আব্বার সাথে চলে এসো প্লিজ।”
চট করে একটা প্রশ্ন মাথায় খেলে গেল সূচির।কপাল কুঁচকে গলায় দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলো, ” আপনাকে আম্মা নিষেধ করেছে? সত্যি কথা বলবেন।”
” ইয়ে.. মানে না,তেমন কিছু না।”
সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে সময় লাগলো না।উত্তেজনায় উঠে বসলো সূচি।প্রায় চেঁচিয়ে বললো,” আমি আবার কী করেছি? আমি তো বাড়িতেও নেই।তাহলে,আম্মা আপনাকে নিষেধ করলো কেন?”
” জানি না তো।”
” আপনি জিজ্ঞেস করতে পারলেন না? আমার দোষটা তো জানাতে হবে আমাকে।আপনারা আমার সাথে এমন শুরু করেছেন কেন?আম্মার কথার বাইরে আপনি এবাড়িতেও আসতে পারবেন না? আশ্চর্য! ”
” সূচি, বারবার আমাকে লজ্জা দিয়ে কি আনন্দ পাও তুমি? তুমি তো জানোই আমি কেমন। জানো না? আমি খুব ভীতু সূচি।আমার সাথে থাকলে তুমি কখনোই আনন্দে থাকবে না।”
ভীরু স্বামীর সহজ স্বীকারোক্তি।এরপরে আর কী বলার থাকে? তেঁতো হয়ে উঠলো ঘরের বাতাস,সূচির কন্ঠ।দুর্বল মানুষের শাস্তি কী হতে পারে? আর কথা বলতে পারলোন্না সূচি।কত পরিকল্পনা করেছিলো।ভেবেছিলো স্বামীর হাত জড়িয়ে প্রথমবারের মতো বাড়ির পাশের নদীর পাড়ে ঘুরতে যাবে।তারপর নতুন বউদের মতো আরেকবার স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন করবে।তা আর হলো কই? আর একটা কথাও বলতে পারলো না সূচি।কেবল ফোন রাখার আগে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, ” রাখছি,ঘুম পাচ্ছে খুব।”
টুট টুট শব্দ করে লাইন কেটে গেল।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ফয়সাল। মায়ের ভাব-গতিক ঠিক বুঝে না সে।সূচি যাওয়ার পর থেকেই তার এক কথা।সূচির দেমাগ বেড়েছে।নিজের বাবার সাথে গেছে,তার সাথেই আবার আসবে।ফয়সাল ওবাড়িতে গেলে ওর ঠ্যাং ভেঙে ফেলবে মেরে।এ বয়সে তো আর মার খাওয়া যায় না।তাই বউকে আনতে যাওয়ার সুযোগ নেই।সেদিন ও বাড়িতে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে যেয়ে ভালোই হয়েছে।একটা জিনিস চোখে পড়েছে।একটু নরম গলায় নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করলেই খুব গলে যায় সূচি। মেয়েটার চোখ কেমন যেন নরম হয়,গলার স্বরটাও আর কঠিন থাকে না।খুব ইমোশনাল হয়ে পড়ে।এদিকে মায়ের কথার বাইরে পা ফেলার সাহস নেই।তাই বউয়ের তোপ থেকে বাঁচার জন্য সূচির ইমোশনে টুক করে একটা টোকা দিয়ে দিলো ফয়সাল।একটু নরম গলায় নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করলে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে,তবে তাই হোক।ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে হলে নিজের ভীরুতাকে সামনে দাঁড়া করাতেই হয়।বউয়ের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে হবে।ইমেজ নষ্ট হবে,তা হোক। ঘরের বউয়ের সামনে আবার কীসের সম্মান? সূচির মুখ বন্ধ করতে হলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
হাহ! এই মানুষটার জন্যেই সহানুভূতি জেগেছিলো সূচির মনে।কিছু কিছু মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখানোও পাপ।
চলবে…..
( আসসালামু আলাইকুম। অনেক দেরি হয়ে গেল পর্বটা দিতে। আসলে রোজার মাসে লেখার অভ্যাস আমার নেই।নয়-দশ মাস যাবৎ লিখছি।তাই সারাদিন রোজা রেখে তার ফাঁকে ফাঁকে লেখার অভিজ্ঞতাও আমার নেই। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আমার ভর্তি পরীক্ষার দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেছে।তাই শেষ সময়ের প্রস্তুতির মাঝে সময় বের করে গল্প দেওয়া অনেক অনেক কঠিন।গল্পটাও শেষের দিকে। চূড়ান্ত পরিনতির দেরি নেই খুব।কাটা সুতোগুলো গুছিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা মাত্র।তাই তাল ঠিক রাখতে পারছি না।এতো ব্যস্ততার মাঝে আমি আসলে মানিয়ে নিতে পারছি না।তাই গল্প দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
রোজার মাস না হলে হয়তো লেখালেখি চালিয়ে যেতাম।কিন্তু সারাদিন রোজা রাখার পরে, পড়াশোনার বাইরে দুটো মিনিট বের করাই খুব কঠিন কাজ।চারদিনের প্রচেষ্টার পর এই পর্বটা লিখলাম। তাই পাঠকের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, অপেক্ষা করে থাকবেন না প্লিজ।পরীক্ষার আগ অবধি অনিয়মিত হওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।এরপরের পর্ব কবে দেব তা জানি না।তবে একবারে বন্ধ করে দেব না।আমি লেখার চেষ্টা করব।যদি সময় হয় তবে লিখব (নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।)