#শুকতারা ( পর্ব-৪৪)
#হালিমা রহমান
মাগরিবের নামাজটা কোনোমতে শেষ করে দ্রুত পায়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন সাহিদা বেগম।বুকটা তার চিমসে আছে এখনো।জানা-অজানা ভয় হৃৎপিন্ডকে খামচে ধরে খুশিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। বাইরে বাতাসের বেগ বাড়ছে।বিকালের মতো মৃদুমন্দ বাতাস নেই এখন। হু হু করে বাড়ছে কালবৈশাখীর বাহন।দোরের পাশের লাল মোরগঝুঁটি ফুলগুলো দুলে দুলে একে অন্যের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে।সুপারি গাছের পাতা থরথর করে কাঁপছে হাওয়ার তোড়ে।তার কাঁপন মায়ের বুকের কাঁপনের মতোই।কাঁপছে তো কাঁপছেই,অবিরাম এই কাঁপন মেয়ের একটা ভালো খবর না পাওয়া অবধি থামবে না।পুরোনো খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সাহিদা বেগম।উদভ্রান্ত দৃষ্টি সুযোগের অপেক্ষায়। সুযোগ মিললে আজ কোথায় ছুটে গিয়ে গলা ছেড়ে কেঁদে আসতেন।
মনির ঘরের পিছনের পুকুর থেকে ওযু সেড়ে ঘরের দিকে ফিরছিলো জয়া।সূচিদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো।গলা বাড়িয়ে বললো, ” কাকি, সূচির খবর পাইছেন কোনো? কাকার লগে কথা কইছেন?”
” ফোন ধরে না মা।অনেকবার কল দিছি।”
” ফয়সালরে নাহয় একবার কল কইরা দেখতেন।”
” ফোন বন্ধ কয়।সূচিরেও দিছিলাম,সবসময়ের মতো এহনো ব্যস্ত দেহায়।”
” তাইলে ইচ্ছা কইরা এমন কইরা রাখছে সূচিয়ে।কী একটা সিস্টেম চালু করলে যেন সবসময়ই ব্যস্ত দেখায়।”
” ক তো কী করি মাইয়াটারে নিয়া?এতো গোয়ার,একটুও শান্ত হইলো না এহনো। ভূমির বাসায় কী হইতাছে আল্লাহ মালুম।”– খুব হতাশ দেখায় সাহিদা বেগমকে।জয়ার চোখ ছলছলিয়ে উঠলো। মেয়েটাকে তারা সত্যিই ভালোবাসে।চিন্তা তারও হচ্ছে।কিন্তু তা প্রকাশ না করে বললো, ” চিন্তা কইরেন না কাকি।কিছু হইব না।সূচি পোলাপাইন মানুষ,কতটুকু আর বয়স হইছে? মাথা গরম কইরা বাইরাইছে আবার মাথা ঠান্ডা হইলে ঠিকই ফিরা আইব। বিয়ার প্রথম প্রথম এরকম হয়।কারো কথা গায়ে ছোঁয়াইতে ইচ্ছা করে না।তারপর সব ঠিক হয়া যাইব দেখবেন।”
যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়ে ঘরে ফিরলো জয়া। সাহিদা বেগম ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।প্রত্যাশা একটাই,মেয়ে যদি ফিরে আসে তাহলে তিনিই যেন আগে দেখতে পান।
মমিন শেখ ফিরে এলেন কিছুক্ষণ পরে।ঝড়ের গতিতে যেভাবে গিয়েছিলেন সেভাবেই বাড়ি ফিরলেন। থপথপ করে হেঁটে এসে ঘরের আঙিনায় দাঁড়ালেন।স্বামীর এদিক-ওদিকে উঁকি দিয়েও মেয়েকে দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন গলায় সাহিদা বেগম প্রশ্ন করলেন, ” সূচি কই? কী অবস্থা ওর? আপনের লগে আনেন নাই?”
আকাশসম রাগের মুখে ছিপি দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন মমিন শেখ।স্ত্রীর কথা শুনে চরম আক্রোশে ফেটে পড়লেন।রাগ ফলানোর নীতি নিম্নমুখী। ঝটপট সিঁড়ি বেয়ে উঠে স্ত্রীর পিঠে দু ঘা বসিয়ে দিয়ে বললেন, ” মা*, কী খায়া জন্ম দিছিলি দুইটা অমানুষ? তোর পেটেই ক্যামনে হইলো এগুলি? এহন আর ওগো বাপ লাগে না।ভাই-বেরাদারের অভাব নাই তোর মাইয়ার।আমার লগে আইব ক্যান? আইলে তো খবরই আছিলো।বাইরের মাইনষের সামনে যা অপমান করছে আমারে! আমি ওরে মাটিতে ফালায়া কোবাইতাম।”
বউয়ের চুলের মুঠিতে শক্ত একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জুতোয় শব্দ তুলে ঘরে ঢুকলেন মমিন শেখ।রাগে,ক্ষোভে,অপমানে অন্ধ হয়ে গেছেন তিনি।আজ একটা ঘুমের ঔষধ না গিললে কোনোমতেই দু-চোখের পাতা এক করতে পারবেন না।
এদিকে অপ্রত্যাশিতভাবে মার খেয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সাহিদা বেগম।প্রথম যৌবন থেকে স্বামীর হাত নাড়ার অভ্যাসের সাথে তিনি পরিচিত।কিন্তু মেয়েদের জন্মের পর থেকে মমিন শেখের হাতটা থেমেছিলো।আগের মতো তাকে মারতো না বললেই চলে। আজ এতো বছর পরে মার খেয়ে খারাপ লাগার চাইতে ভয়ই বেশি হলো তার।ভয়টা নাড়ী ছেঁড়া ধনকে নিয়ে। সূচি কি খুব বাড়াবাড়ি কিছু করেছে? সে এখন আছে কোথায়? কী অবস্থায় আছে? মনে হচ্ছে মেয়েকে না দেখলে আজ তার প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে।
দ্রুত পায়ে হেঁটে চম্পার ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।চম্পা মাত্র নামাজ থেকে উঠেছে।এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন সাহিদা বেগম। কাতর গলায় বললেন, ” রায়হানরে একটা কল করবি চম্পা?”
” কী হইছে কাকি? সূচির খবর পাইছেন?”
” না, এর লেগাই তো।রায়হানরে একটু ফোন কইরা সূচির খবর নিতে বল না।ওয় এহন কই আছে এইটা যদি জানতাম!”
স্বামীর সাথে পাঁচ মিনিট টুকটাক কথা বললো চম্পা।সংক্ষেপে সূচির খবর জেনে নিলো।তারপর ফোন রেখে আগ্রহী শ্রোতাকে আশ্বস্ত করলো।
” চিন্তা নাই কাকি।সূচি ফয়সালের লগে বাড়িতে গেছে।ভূমির বাড়িতে নাই ওয়।কিন্তু বিকালে নাকি অনেক ঝামেলা করছে সবার লগে।তালাকের কথা কইছে, ভূমিও নাকি সায় দিছে ওরে।বাইরের মানুষের সামনে কাকার,শ্বশুরবাড়ির একটু ইজ্জতও রাখে নাই।এর মধ্যেই বাজারে ছড়ায়া গেছে খবরটা। যারা নিজ চোখে দেখছে,তারা ছিঃ ছিঃ করতাছে।রায়হানে হেগো থেকাই শুনছে সব।”
মুখের রঙ উবে গেল সাহিদা বেগমের। সহসা কথা বলতে পারলেন না।থপ করে বসে পড়লেন চম্পার বিছানায়।
” এর লেগাই,এর লেগাই তোর কাকায় এতো ক্ষ্যাপা।সূচিটার আর বুদ্ধি হইলো না।মাইয়া মাইনষের চামড়া এতো নরম হইলে চলে?”
” থাক, কী আর করবেন? ওয় হয়তো বুইজ্জা সাড়ে নাই।পোলাপাইন মানুষ একটু-আধটু ভুল করেই।সব ঠিক হয়া যাইব।”
” তাই যেন হয়। বিকাল থেকা একটুও শান্তি লাগতাছে না রে চম্পা।কইলজাডা কেমন যেন খামছাইতাসে।অনেক অস্থির লাগতাছে আমার।চোখে খালি আলিঝালি দেখতাছি সব।তহন নামাজের বিছনায় একটু তন্দ্রা লাগছিলো, হাবিজাবি কী যেন দেখলাম।তন্দ্রা ছুইট্টা গেছে।কয়দিন ধইরা দুইটা চোখের পাতা বন্ধই করতে পারতাছি না।খালি দুঃস্বপ্ন দেহি।”
কাঠের খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলেন সাহিদা বেগম। বুকের একঘেয়ে উঠা-নামা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সে কত ক্লান্ত।বুড়িয়ে যাওয়া মুখের রেখাগুলো আজকাল একটু বেশিই ফুটে উঠেছে।তার ধ্যান ভাঙাতে ইচ্ছা করলো না চম্পার।সে কেবল নির্নিমেষ চেয়ে রইলো খুব দূরে হারিয়ে যাওয়া এক চিন্তাক্লিষ্ট ক্লান্ত মায়ের দিকে।
____________________________
তপুদের বাড়ির সামনের রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ।চার-পাঁচ হাত সমান চওড়া জায়গা।চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে অনেক আগে এদিকের বাসিন্দাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এই হাত কয়েক জায়গা পাকা করা হয়েছিলো।এ অবশ্য বহুদিনের কথা।এরপর থেকে বছরের পর বছর যাবৎ অটোরিকশা,ভ্যান,বাইক অষ্টপ্রহর অত্যাচার করছে এর বুকের উপর।সময়ের সাথে ক্ষয়ে আজ নষ্ট হয়ে গেছে এই পথ।হাড় বেরোনো বুড়োর মতো হাড়-মাংস বেরিয়ে গেছে তারও।কিন্তু এখনো কারো সুনজর পড়েনি।
ভাঙা রাস্তার গা চিড়ে বেরিয়ে আসা ইটের সাথে দুইবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল ফয়সাল।আজ সারাদিন ফোনের সাথে সম্পর্ক নেই তার।ফোনের আলো জ্বেলে পথ চলার সুযোগও নেই।অন্ধকার পথে অসাবধানে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসার সময় কোনো এক গর্তে পা আঁটকে তৃতীয়বার হোঁচট খেলো। সাথে সাথে মেজাজ গেল খিঁচড়ে।নিষ্প্রাণ রাস্তাকে দু-তিনটে অশ্রাব্য গালি ও একটি লাথি দিয়ে গজগজ করতে করতে বললো, ” তুইও শান্তি দিবি না হারামজাদা?”
তপুদের বাড়ি ছোট।ছোট বাড়ির ছোট উঠোনে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে সে ডাকলো, ” তপু,তপু।এই তপু।”
” কে?”
” আমি ফয়সাল।দরজাটা খোলো তনু।”
মিনিট কয়েক পরে নিঃশব্দে দরজা খুলে মুখ বাড়ালো তনু।ভাইয়ের বন্ধুকে দেখে হেসে সালাম দিয়ে বললো, ” ভিতরে আসুন ফয়সাল ভাই।ভাইয়া ঘরেই আছে।”
” খালাম্মা কি বাসায় তনু?”
” না।আমার ফুফুর বাসায় গেছে।”
যে তনুকে দেখলে বুকের রক্ত ছলকে উঠতো,আজ সেই তনুকে নজরেই আনলো না ফয়সাল।এলোমেলো পায়ে মেয়েটার পাশ কাটিয়ে তপুর ঘরের দিকে ছুটলো।এই ঘরের সব তার চেনা।অসংলগ্ন ছন্দে পা টেনে টেনে তপুর ঘরে যেয়ে দাঁড়ালো।তপু তখন পড়ছে।বন্ধুকে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াতেই ফয়সাল খুব অন্যরকম গলায় বললো, ” তুই আমার বন্ধু। তুই আমাকে বাঁচতে দিবি নিশ্চয়ই।তাই এই সন্ধ্যায় তোর কাছেই এসেছি।”
” তোর হয়েছে কী ফয়সাল? এমন করছিস কেন? এই, এক মিনিট দাঁড়া তো।গালে খামচি দিলো কে? নাকের নিচেও দেখছি রক্ত! এ কী অবস্থা তোর!”
সাদা নগ্ন বাল্বের নিচে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ফয়সাল।স্পষ্ট আলোতেই বন্ধুর চেহারার ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়লো।বোকার মতো চেয়ে রইলো তপু।অগোছালো চুল,ঘামে ভেজা মোচড়ানো শার্ট,ধুলো মাখা প্যান্ট ও অস্বাভাবিক জ্বলন্ত চোখে যে আজ ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে সে তার চেনা ফয়সাল নয়।বড্ড অচেনা কেউ।
” বাজে কথা বাদ দিয়ে আসল কথা শোন।আমি বাজারের উত্তর মাথার কিছু মাছ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা পাই। হাজার পাঁচেক টাকা হবে।আজ দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেয়নি।বলেছে পরশু দেবে।তোকে একটা বিকাশ নম্বর দেব।তুই পরশু সকালে আমার নাম করে টাকাটা নিবি।তারপর বিকাশে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি।বুঝেছিস?”
বুঝলো না তপু।মাথার উপর দিয়ে গেল সব।বিস্মিত কন্ঠে বললো, ” তুই কোথায় যাবি? তোর টাকা আমাকে তুলতে হবে কেন?”
” কাল একদম ভোরেই আমি উদয়পুর ছাড়ছি।আর কোনোদিন আসব না।”– কথার শেষে নাকের নিচের রক্তটুকু আঙুলের ডগায় মুছে নিলো সে।মুখে ফুটে উঠলো সুক্ষ্ম এক বেদনাবোধ।
তপু বুঝলো পরিস্থিতি বেগতিক।ফয়সালকে জোর করে খাটে বসিয়ে পাশে বসে প্রশ্ন করলো, ” কী হয়েছে বল তো? ভাবির সাথে ঝগড়া করেছিস? উল্টা-পাল্টা কিছু হয়েছে?”
সূচির কথা আসতেই রক্ত গরম হয়ে এলো ফয়সালের।উদ্দীপ্ত গলায় চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, ” ঐ শালীর নাম নিবি না।বা*টায় আমার জীবনটাকে ভাজা ভাজা করে ফেলছে।এই যে মুখে আঘাতের দাগ দেখছিস,এসব ওর দেওয়া।হারামজাদী আম্মার ভারী পানের কৌটাটা আমার নাক বরাবর ছুঁড়ে মেরেছে।কু** বাচ্চা একটা।”
” বলছিস কী! তুই কী করেছিস বল তো? এমনি এমনিই তো একজন আরেকজনকে মারে না।তোরা কি মারামারি করেছিস? এ তো ভালো কথা না ফয়সাল।ইতরের মতো বউয়ের গায়ে হাত তুললি কী করে? এখন যদি ওরা কেস করে দেয়?”
চরম আক্ষেপে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে বন্ধুর শার্টের কলার চেপে ধরলো ফয়সাল।চেঁচিয়ে বললো, ” তুই কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? আমি কি তোকে বলেছি ভয় দেখাতে? তোরা কেউ আমাকে বাঁচতে দিচ্ছিস না কেন? আমাকে তোদের মানুষ বলে মনে হয় না?”
কথাগুলো তপুকে নয়, অন্য দুটো নারীকে কল্পনা করে বলা তা বেশ বুঝলো তপু। বন্ধুর হাত থেকে কলার ছাড়াতেই নজরে এলো দরজায় ভয়ার্ত চোখে উঁকি দিচ্ছে তনু।চেঁচামেচি শুনেই এসেছে।তপু বোনকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” তাড়াতাড়ি একটা ডিম ভাজ। দুপুরের ডাল থাকলে একটু গরম করে এক প্লেট ভাত দে। দশ মিনিট সময় দিলাম,তাড়াতাড়ি করবি।”
নিজের ইতরতার কাছে বন্ধুর মমত্ববোধ প্রাণে বাজলো ফয়সালের। মাথা নিচু করে বসে রইলো সে।মনে পড়লো আজ সারাদিন ও ভাত খায়নি।এমনকি খামার থেকে বিকালে ফেরার পর থেকে এখনো এক গ্লাস পানিও খায়নি।খাবারের কথা শুনে ক্ষুধা-তৃষ্ণা পেটে দানবের রূপ নিয়েছে।এক প্লেট ভাত ছাড়া একে থামানোর সাধ্য আর নেই।
” আজ সারাদিন ভাত খাসনি?পেটে ক্ষুধা থাকলে তুই এমন রেগে থাকিস।”
” খামারে সারাদিন গাধার মতো খেটেছি।ঘরে ফিরে দু-মুঠো ভাত খাওয়ার সুযোগ হয়নি।দুটো মহিলা আমার জীবনটাকে পায়ের নিচে ফেলে পিষছে।উহ! সে কি অসহ্য যন্ত্রণা।”
” কী হয়েছে ফয়সাল?খুলে বল তো।”
একটু একটু করে সব খুলে বললো ফয়সাল।বলার সময় মাঝে মাঝে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।মাঝে মাঝে চোখ জ্বলে উঠলো ধক করে।সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তপু।বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বললো, ” খালাম্মা কি সত্যিই ভাবির দিকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছে? মারলে কাজটা ঠিক করেনি।”
” কী করে বুঝব কে সত্যি বলছে কে মিথ্যা বলছে? আমার মা-বউ দুজনে মিথ্যুক।একজন আরেকজনকে টক্কর দিতে পারে না,একদম সমানে সমান।আমি ওদের মিথ্যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।কাকে বিশ্বাস করব বল? আর ঐ হারামজাদীর কান্ড দেখ।তোকে মারলে তুই ঘরে থাকবি।তোর কিছু বলার থাকলে আমাকে বলবি।এরপর ভালো-মন্দ আমি বুঝব। তুই কেন বাড়ি থেকে বের হবি? আবার এক উঠান মানুষের সামনে কত ঢং করলো! তুই যদি দেখতি।গ্রামে ওদের সম্মান নেই বলে আমাদেরও কি সম্মান নেই? তার উপরে আছে ভূমি।ভূমিকে আজকে একটা লাথি মারতে ইচ্ছা করেছে আমার।এমনই অমানুষ মেয়ে।”
” কিন্তু তুই যে খালাম্মাকে বাড়িতে যেতে দিলি না,এর ফল কী হতে পারে জানিস? বাড়ি ফিরলে খালাম্মা তোকে জবাই দিবে।”
” না দিবে না,কারণ আমাকে আর খুঁজেই পাবে না।আমি বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগই রাখব না।আমার মাও একটা জিনিস ভাই। আমি রাজি ছিলাম না, নিজে পছন্দ করে মেয়ে ঠিক করলো।জোর করে বিয়ে দিলো।এখন আমি যখন সংসারে মন দিতে যাচ্ছি তখন বাম হাতটা উনিই ঢুকাচ্ছে।সকাল-সন্ধ্যা চিৎকার-চেঁচামেচি আর ভালো লাগে না।আজ আম্মা জোর করে বাড়ি ফিরলে কোনো একটা অঘটন ঠিকই ঘটতো।তার আর কোনো বাড়াবাড়ি আমি নিতে পারব না।”
” এখন কী করবি আর? একজন মা, আরেকজন বউ।ব্যালেন্স করে চলতে হবে তোকে।এখন থেকে শক্ত হতে হবে,সংসারের হাল ধরতে হবে।”
” পারব না আমি।বা*র সংসার নিয়ে ওরা কামড়াকামড়ি করুক।আমি কাল ভোরেই যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকে চলে যাব।গায়ে শক্তি আছে,আমার কাজের অভাব হবে না।দরকার পড়লে রিকশা চালিয়ে ভাত খাব।তারপর কয়েক বছর গেলে টাকা-পয়সা জমিয়ে আরেকটা বিয়ে করব।আমার নতুন সংসার হবে।সেখানে আমিই হব রাজা।না থাকবে ঐ হারামজাদী আর না থাকবে আমার নাক গলানি মা।দেখবি আমিও মানুষের মতো বাঁচব।”
ফিক করে হেসে ফেললো তপু।উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ” আজ রাতে ভাবির সাথে এক ঘরে থাকার পরে কাল সকাল অবধি যদি এসব সাধু সংকল্প থাকে তো তখন বলিস।শুনেছি মাঝে মাঝে ঝগড়া করলে ভালোবাসা বাড়ে।সেখানে তোরা করেছিস মারামারি। দেখবি এরপর থেকে ভালোবাসা চুইয়ে চুইয়ে পড়বে।ভাত এনে দিচ্ছি, ভাত খা।তারপর কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে মাথা ঠান্ডা করে বাড়ি যা।ভাবির সাথে সবকিছু ঠিকঠাক করে নে।ইতরের মতো মারামারি করা ভালো না ফয়সাল।”
সামান্য আয়োজন, তবু তা দিয়ে ভালোভাবেই পেট ভরলো ফয়সালের।সারাদিনের ক্ষুধার চোটে গোগ্রাসে গিললো একেকটা লোকমা।খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই শরীর ছেড়ে দিলো।আলস্যে বুজে এলো চোখ দুটো।বন্ধুকে ঘুমাতে দেখে লাইট নিভিয়ে আস্তে ঘর ছাড়লো তপু। ছেলেটার উপর দিয়ে আজ সত্যিই ধকল গেছে।ও একটু ঘুমাক।
অনুকূল পরিবেশে বেশ অনেক্ষণ ঘুমালো ফয়সাল।সহজে ভাঙতো না ঘুম।কিন্তু সন্ধ্যার ঘটনাগুলো স্বপ্নের মাঝে ফুটে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল।অবচেতন মনে সে একটু আগের ঘটনাগুলোই চিন্তা করছিলো হয়তো।শান্তির ঘুমের মাঝে মূর্তিমান অশান্তির মতো ওসব হানা দিতেই ধরফর করে উঠে বসলো।ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর।দুঃস্বপ্নের রেশে থরথর করে কাঁপছে সে।বালিশের কাছে তপুর ফোনটা ছিল।ধাতস্ত হয়ে ফোনের আলো জ্বালতেই চোখে পড়লো সময়।আটটা পঞ্চাশ বাজে।সাতটা থেকে সাতটা বিশে ঘটা অঘটনগুলো আরেকবার চোখের উপর দিয়ে দৌড়ে গেল।খাওয়া-দাওয়া,বিশ্রামের শেষে রাগ-ক্ষোভ অনেকটাই কমে এসেছে তার।ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অন্ধ হয়ে রাগে,অপমানে যা ঘটিয়েছিল, তা এখন নিজের কাছেই বাড়াবাড়ি ঠেকছে। মনের একাংশ বলছে, এতোটা উচিত হয়নি।একটু বেশি বেশি হয়ে গেছে।অথচ মস্তিষ্কে চলছে ভিন্ন কথা।সে যা করেছে বেশ করেছে।আগেই করা উচিত ছিল।রশি আগে থেকেই টেনে রাখলে এতো ঝামেলা হতো না।মিনিট কয়েক পরে এক লাফে নিচে নামলো।না,এবার সত্যিই বাড়ি ফেরা দরকার।
” যা করেছি বেশ করেছি” ভাবনাটা মাথায় ঘুরলেও কিছুটা অশান্ত দেখাচ্ছে তাকে।তাই তপুকে বলে দ্রুত পায়ে বাড়ির পথ ধরলো ফয়সাল।বাতাসের সাথে ঝরছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।তার মাঝেই হেঁটে নয়,একপ্রকারে দৌড়েই বাড়ির কাছে চলে এলো সে। কাজী বাড়ি থেকে তিন-চার পা দূরেই পূবের বিল।পূবের বিল পেরোলেই নদী।সন্ধ্যার লঞ্চ যাওয়ার সময় শব্দ ভেসে আসে এই রাস্তা অবধি।অন্ধকারে ভেসে আসছে লঞ্চের আওয়াজ।আশ্চর্য! সাড়ে আটটার লঞ্চ আজ নয়টায় ছেড়েছে কেন? বিলের মুখে থমকে দাঁড়ায় সে।কান পেতে লঞ্চের শব্দ শোনে।অকারণে চেয়ে থাকে অন্ধকার বিলের দিকে।চেয়ে থাকাটা উপলক্ষ মাত্র।আসলে মাথায় যাই ঘুরুক বাড়িতে পা ফেলতে তার কেমন একটা ভয় করছে।চেনা,শিরশিরে একটা ভয়।ফয়সাল এখন শান্ত,তার ক্ষুধা-তৃষ্ণার সীমাবদ্ধতা গেছে মিটে।
যখন সে কান্ডটা ঘটিয়েছে তখন সে ছিল ক্লান্ত,ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর,রাগে-অপমানে ক্ষুব্ধ।সুতরাং তখনকার ফয়সাল ও এখনকার ফয়সাল কিছুতেই এক নয়।
বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বাড়িতে ঢুকলো সে।আগের মতোই চারদিক অন্ধকার। উঠোনের লাইটটা এখনো জ্বালানো হয়নি।স্যাঁতসেঁতে উঠোন পেরিয়ে কোনোমতে ঘরের কাছে গেলেও ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছা হলো না আর।আধ ভেজানো দরজার ফোঁকর দিয়ে ঠিকরে পড়ছে বসার ঘরের ক্ষীণ আলো।সেই আলোতেই সিঁড়ি বেয়ে মৃদু হাতে দরজায় ধাক্কা দিতেই ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল তা।দৃশ্যটাকে খুব সহজেই যেকোনো ভূতের মুভির পরিচিত দৃশ্যের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়।চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়লো সব।ঘরটা অগোছালো বললে কম বলা হবে।সোফার এক কোণে পড়ে আছে রোমেলা বানুর বহু পুরোনো সোনালী রঙা ভারী পানের কৌটা।পানগুলো গড়াচ্ছে মাটিতে।মেঝের মাঝামাঝিতে ফেলে রাখা এক জগ পানি জমে আছে।বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো আছে কাচের টুকরা।কুশনগুলো একেকটা একেক জায়গায়। সন্ধ্যার ঘটনাগুলো আরেকবার চোখের উপর দিয়ে ছুটে গেল।সোফার কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে দু’বার ডাকলো ফয়সাল,
” সূচি, সূচি ”
সাড়া নেই।মিনিট কয়েক অপেক্ষা করে আবার আগের মতো ডাকলো সে।ভাবলো এবারে সাড়া পাবে,এবারে দেখবে।টিকটিক করে বয়ে চলছে ঘড়ির কাঁটা,ফয়সাল অপেক্ষা করে।অপেক্ষা করে আর অপেক্ষা করে।কিন্তু লণ্ডভণ্ড ঘর ছাড়া আর কিছুই তার নজরে এলো না।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বুঝতে পারে বড়িতে সে ছাড়া আর কেউ নেই।মা নেই,বউ নেই,পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।এই না থাকাটা স্বস্তির নাকি অস্বস্তির তা বোঝা গেল না।তবে সন্ধ্যার চেনা চিনচিনে একটা রাগ ফিরে এলো শিরায় শিরায়।বসার ঘরের খাটের উপরে সে ধুম করে শুয়ে পড়লো।বিরবির করে নিজেকে শুনিয়ে বললো, ” আবার ঘর ছেড়েছিস? আবার নালিশ করতে গেছিস?আচ্ছা যা, জাহান্নামে যা তুই।আমিও কাল ফজরের পরেই যাচ্ছি।আর কোনোদিন তোর নোংরা মুখ দেখব না।”
_____________________________
নতুন একটি সকাল,নতুন একটি দিন।কাল রাতে খুব ঝড় হয়েছে।বাতাস-বৃষ্টির সাথে ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠেছে পুরো গ্রাম।ঝড় থামার পরে পরিবেশ যেমন শান্ত হয় এখনো তেমন শান্ত চারদিক।ফজরের আযান পড়েছে কিছুক্ষণ আগে। পাখির কলতান কানে আসছে।বাড়ির গরু দুটো ডেকে ডেকে হয়রান।কাজী বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে বাড়িতে ঢুকলো হুমায়রা।গোয়ালঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সূচিদের ঘরের দিকে উঁকি দিলো।দরজা ভেজানো।সূচি কি উঠেছে? গরু দুটোকে শান্ত করছে না কেন এখনো?
হুমায়রাদের যৌথ পরিবার।ছোট্ট একটা বাড়িতে অনেক মানুষ থাকে।কোনো অনুষ্ঠানাদি হলে তো কথাই নেই।বাড়িতে তখন তিল ফেলার জায়গা থাকে না।এর মামা,ওর খালু,তার শ্বশুর,তার ভাসুর-দেবরে পূর্ণ হয়ে যায় ছোট ঘর।এ ওর ঘাড়ে,সে তার কোলে,উপরে,নিচে কোনোমতে একটা কাঁথা-বালিশ ফেলে রাত কাটাতে হয়।আগে বাড়ির অনুষ্ঠানের সময় এভাবে থাকতে ভালোই লাগতো।কিন্তু এখন আর সহ্য হয় না।একা একা থাকতে থাকতেই অভ্যাস হয়ে গেছে। অতিরিক্ত ভীড়-ভাট্টায় দম বন্ধ হয়ে আসে।হুমায়রা পালাই পালাই করেছে কাল বিকাল থেকে।কিন্তু কেউ আসতে দেয়নি।মানিককে রেখে গেছে বলে রক্ষা।এই পাখিটাকে সে কত ভালবাসে তা সবার জানা।তাই ফজরের পরে কেউ আর আটকাতে পারলো না।সারা রাত ঘুমাতে পারেনি।নামাজটা শেষ করেই রিকশায় চেপে বাড়ি চলে এসেছে।
সূচিদের ঘরের দিকে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে নিজের ঘরেই পা বাড়াচ্ছিলো হুমায়রা।সহসা পিছন থেকে আসা একটি প্রশ্নে থমকে দাঁড়ালো।পিছন থেকে ভেসে আসছে রিনরিনে কন্ঠের একটি প্রশ্ন, ” আপনি কি হুমায়রা আপু? আমি ভূমি, সূচির বড় আপা।ওকে একটু কষ্ট করে ডেকে দেবেন?আমি বেশি সময় নেব না।দেখেই চলে যাব।”
কন্ঠে ব্যস্ততা,পায়ের ছন্দে অস্থিরতা,চোখে-মুখে প্রবল ভয়।ভারী শরীরের গোলগাল মেয়েটাকে দেখলো হুমায়রা।সূচির মুখে বোন-দুলাভাইয়ের অনেক গল্প সে শুনেছে।ভূমি-ইশতিয়াক একদম অপরিচিত নয়।
ভূমির পিছু পিছু ঢুকলো ইশতিয়াক।সারাটা রাত মেয়েটা এক ঘন্টাও ঘুমায়নি।অস্থিরতায় ছটফট করেছে কেবল।রাতের খাবারটাও খাওয়াতে পারেনি ইশতিয়াক।রাতেই বোনের কাছে ছুটে আসতে চেয়েছিলো ভূমি।ঝড়-বৃষ্টির দোহাই দিয়ে কোনোমতে আটকাতে পারলেও ফজরের পরে বউকে আর কিছুতে আটকাতে পারলো না ইশতিয়াক। ভূমি আজ ভীষণ নাছোড়বান্দা।
হুমায়রার কাছে এসে ইশতিয়াক মিনতির সুরে বললো, ” একটা চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেবেন আপু?আমার বউ অনেক অসুস্থ।দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।”
” দিতাছি ভাই, একটু অপেক্ষা করেন।আপনে ঘরের সামনে দাঁড়ায়া সূচিরে ডাক দেন।ওয় মনে হয় উঠছে।আপনের গলা পাইলে বাইরাইব।”
দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে গেল হুমায়রা।কেন যেন মনে হচ্ছে তার অনুপস্থিতিতে বিশাল এক কান্ড ঘটেছে।এতো সকালে ভূমির এভাবে হানা দেওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।মনের কোণে একটা খচখচানি ভাব আঁচড় কাটছে।
অভ্যস্ত হাতে তালা খুলে ঘরে পা দিতেই শিরশির করে উঠলো গা।টিনের দরজার নিচে একটু ফাঁক আছে।সেই ফাঁক দিয়ে রাজ্যের ধুলাবালি ঘরে ঢুকেছে।কাল রাতের বাতাসে কোথা থেকে দুটো কাগজও উড়ে এসেছে ঘরে।একদম দরজার কাছেই পড়ে আছে।বৃষ্টির ঝাপটায় একটু ভিজেও গেছে।কাগজ দুটো মাড়িয়ে চেয়ার নিলো সে।বাইরে থেকে ভেসে আসছে ইশতিয়াকের গলা, ” সূচি, সূচিইই,সূচিইই।ফয়সাল,কেউ কি বাড়িতে আছে?”
কোনোমতে বোরকা খুলে চেয়ার নিয়ে তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে ফয়সালকে দেখলো হুমায়রা।ডাকাডাকি শুনে সে বাইরে বেরিয়েছে। সদ্য ঘুম ভাঙার চিহ্ন তার চোখে-মুখে। ভোরের প্রথম আলোয় দেবরের চেহারার ক্ষতচিহ্ন দেখে সে আঁতকে উঠলো।এইবারে নিশ্চিত।কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে।
এতো ভোরে ভূমি-ইশতিয়াককে দেখে চমকে উঠলো ফয়সাল।এদেরকে সে এতো তাড়াতাড়ি আশা করেনি।ওদের মুখোমুখি হতে হবে তা জানতো কিন্তু তাই বলে এতো ভোরে? তার মুখের উপরে ফুটে উঠলো প্রচ্ছন্ন ভয়।তবে কি সূচি বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়নি?
” ফয়সাল সূচি কোথায়? ওকে ডাক দে।”
ভূমির কথায় নিজের ভয় প্রকাশ করলো না ফয়সাল।শান্ত গলায় বললো, ” চিৎকার করবি না।সূচি ঘুমাচ্ছে।”
” তুই ডেকে দে না।”
” এখন না।সারা রাত ঘুমায়নি।এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।বিরক্ত করিস না।বাড়ি যা। আরেকটু বেলা হলে আমি নিজে ওকে নিয়ে তোদের বাড়িতে যাব।এখন বাড়ি যা।”
“আল্লাহর দোহাই লাগে একটু দেখতে দে আমাকে।আমি সারাটা রাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি।একটু কথা বলেই চলে যাব।”– ভূমির কন্ঠে হাহাকার, বিষন্ন আকুলতা।ইশতিয়াকের গায়ে বাজলো খুব।ফয়সালের গোয়ার্তমি থাপড়ে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে।বউকে নিয়ে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় বললো, ” আমি দেখছি,তুমি শান্ত হও।”
ফয়সালের সাথে কথা বলার আগে আরেকবার হুমায়রাকে অনুরোধ করলো সে।বিনীত গলায় বললো, ” ওকে এক গ্লাস পানি দেবেন আপু? কাল রাত থেকে ওটাও গলায় ঢালেনি।”
আরেক দফা ঘরের দিকে ছুটলো হুমায়রা।যাওয়ার আগে কানে এলো ইশতিয়াকের উচ্চ কন্ঠ।ফয়সালকে বলছে, ” সূচিকে ডাক দাও,জলদি।”
গ্লাসে পানি ঢেলে তড়িঘড়ি করে বাইরে যাওয়ার সময় একটু পানি ছলকে পড়লো নিচে।যে দুটো কাগজ পড়েছিলো সেখানে,তার একটি বেশ খানিকটা ভিজে গেল।এবারে নজর কাড়লো এরা।একদম সুন্দর করে ভাঁজ করা দুটো কাগজ।মাথায় এলো দরজার নিচের এটুকু ফাঁক দিয়ে এগুলো বাইরে থেকে উড়ে আসতে পারবে না।ইলেক্ট্রিসিটির বিল নাকি? হুমায়রাকে না পেয়ে দরজার নিচে দিয়ে ঘরে দিয়ে গেছে? নিচু হয়ে ভেজা কাগজটাই তুললো সে।চার ভাঁজের কাগজটা মেলে ধরতেই চোখে পড়লো ত্যাড়াব্যাকা পিঁপড়ার মতো ছোট ছোট কতগুলো অক্ষর।খুবই বাজে লেখা।তবুও নিজের নাম দেখে কষ্ট করে পড়লো।
বড় ভাবি,
দোয়া করছি চিঠি দুটো যেন তোমার হাতে পড়ে।তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করার চিন্তাও করিনি।কারণ আমার সেই ক্ষমতা নেই।বিয়ের পর থেকে বড় বোনের মতো ছায়া দিয়েছো, সাহায্য করেছো।শেষ সময়ে আরেকটু সাহায্য করবে?একটা চিঠি রেখে যাচ্ছি।আমার বড় আপার কাছে একটু কষ্ট করে পৌঁছে দেবে? দুই গলি পরের অশ্বত্থ গাছওয়ালা বাড়িটা আপার বাড়ি।চিঠিটা একটু পৌঁছে দিয়ো ভাবি।শেষ অনুরোধ তোমার কাছেই।
— সূচি।
পাশে পড়ে থাকা বড় কাগজটার দিকে সহসা হাত বাড়াতে পারলো না হুমায়রা।কোনো এক অজ্ঞাত রহস্যের অস্তিত্ব কাঁপন তুললো বুকের গভীর থেকে গভীরে।চিঠিটা খুলে দেখার কৌতূহল জাগলো না।ভাবগ্রস্তের মতো ওটা তুলে নিয়ে গেল বাইরে।
বাইরে তখন বাক-বিতন্ডা চরম পর্যায়ে।দুটো পুরুষ হাতাহাতির অপেক্ষায়।ভূমিও উঠে দাঁড়িয়ে চেচাচ্ছে।বোনের সাথে দেখা না করে ও যাবে না।
উত্তাল পরিস্থিতিতে ভূতের মতো এসে ভূমির পাশে দাঁড়ালো হুমায়রা।চিঠিটা কিন্তু অসুস্থ ভূমিকে দিতে পারলো না।এটুকু সে বুঝেছে কাগজটাতে সুখের কথা লেখা নেই। ইশতিয়াককে উদ্দেশ্য করে বললো, ” ভাই,এই নেন।সূচি একটা চিঠি দিছে।”
কথাটা বুঝতে সময় লাগলো ইশতিয়াকের।কয়েক সেকেন্ড পর কাগজটা হাত পেতে নিতে নিতে ফয়সালের দিকে চেয়ে বললো, ” সূচি না ঘরে? তো চিঠি কীসের?”
ততোক্ষণে ফয়সালের মুখের রঙ উবে গেছে।মিইয়ে গেছে গলা।চোখ তুলে চাইতে পারলো না।অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতর উথাল-পাতাল ঝড় নেমেছে।সে পালাতে পারলে বাঁচে।
” সূচির চিঠি! দাও আমাকে দাও।”
” উঁহু, তুমি যেয়ে বসো।আমি পড়ে শোনাচ্ছি।”
বুকের কোণটা ভার হয়ে উঠলো ইশতিয়াকের।ও বাচ্চা নয়,এতো বছর ধরে পৃথিবী দেখেছে।চিঠিটা হাতে পেয়েই পড়া শুরু করলো না।বস্তুত ওর কেমন ভয় করছিলো।ভাঁজ খোলার সময় হাত কাঁপছিলো।ওধারে ভূমির কন্ঠে উৎকন্ঠা।স্বামীর হাত ঠেলে বলছে, ” কি গো,হয়তো পড়ো নয়তো আমাকে দাও।”
” এই তো পড়ছি।”
লম্বা এক শ্বাস টেনে কষ্ট করে ধীরে ধীরে পিঁপড়ার মতো ছোট অক্ষরগুলো পড়া শুরু করলো ইশতিয়াক।
প্রাণের বড় আপা,
লেখাপড়ার সাথে আমার সম্পর্ক নেই অনেকদিন ধরে।আজ বহুদিন পরে কলম ধরেছি।আঙুলগুলো কাঁপছে অনভ্যাসে।গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছে না।কী রেখে কী লিখব তা বুঝতেই পারছি না। লেখার অবস্থা যা-তা।হয়তো পড়ার সময় তোমার দাঁত ভেঙে যাবে।কিন্তু কষ্ট করে পড়ো।আমি জানি তুমি বুঝবে।কারণ আমাকে বরাবর তুমি ভালো বোঝো। আমার নিজের চাইতেও তুমি আমাকে বেশি চেনো।
চললাম বড় আপা।কেঁদে-কেটে তোমার গলা জড়িয়ে ধরে বিদায় নেওয়ার সাধ্য নেই।নিজেকে নিজে খুন করতে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই কেউ এতো ঢং করে না।আমিও করব না। যা সবার শেষ পরিণতি অথচ যাকে সবাই ভয় পায়,আমি তাকেই আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছি।মরতে যাচ্ছি।সজ্ঞানে,বুঝে-শুনে নিজেকে স্থির রেখে প্রাণ দিতে যাচ্ছি।এই দেওয়ায় কোনো গর্ব নেই।তাই মরার সময়েও আমাকে চোরের মতো লুকিয়ে-চুরিয়ে পথ চলতে হবে।কারো চোখে পড়া যাবে না।
আর কোনোদিন দেখা হবে না। দোয়া করি তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো।আমার ভাগ্নে-ভাগ্নী সুস্থ থাকুক। তারা মানুষের মতো মানুষ হোক।ছানাপোনাসহ ইশতি ভাইয়া ও তুমি খুব সুখী হও।
কোনোদিন তোমার কোনো দরকারে কাছে থাকতে পারিনি।এবারে খুব ইচ্ছে ছিল।তোমার সেবা করব,তোমার সাথে হাসপাতালে থাকব,আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীর আঁতুড়ঘরের কাজগুলো আমিই করব।নিজের সব দুঃখ ভুলে ওদেরকে কোলে তুলে আদর করে চুপিচুপি বলব, আমি তোদের আরেক মা।কিন্তু ইচ্ছেগুলো অপূর্ণই রয়ে গেল সবসময়ের মতো।আমার ভাবনাগুলো কখনো বাস্তবে পূরণ হয় না। আমার কল্পনা-বাস্তবে আকাশ-পাতাল তফাৎ। বিয়ের শুরুতে ভেবেছিলাম আমার সুখের কোনো শেষ সীমা থাকবে না।যাকে ভালোবাসি তার কাছেই যাচ্ছি।এরচেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? সারাদিন কল্পনা করতাম তোমার ঘরের মতো সাজানো একটা ঘর আমার থাকবে।ইশতি ভাইয়ার মতো ফয়সালও আমাকে খুব ভালোবাসবে।কিন্তু কী হলো? থাক,আর বলতে ইচ্ছা করে না।তুমি তো সবই জানো। আমার জন্যে স্বপ্ন দেখা মহাপাপ। আঁকড়ে রাখার মতো দুটো শক্ত হাত, ভরসা করার মতো বলিষ্ঠ কাঁধ,একটা সাজানো-গোছানো ছিমছাম সুন্দর সংসার– এই ছিল আমার জীবনের লক্ষ্য,পুরোনো স্বপ্ন।আজ দুপুরে আরেকটা নতুন স্বপ্ন দেখেছিলাম। তুমি আমার পাশে থাকবে,আমি নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াব, স্বাবলম্বী হব,নিজের একটা পরিচয় হবে,এই ছিল আমার নতুন স্বপ্ন।আমি বিয়ের আগে-পরে তোমার মতোই দুটো ছোট্ট সংসার পেয়েছি, বিপদের সময় তোমাকে পাশে পেয়েছি।তবুও স্বপ্ন পূরণ হলো না। দিনশেষে কেন আমার হাতে কিছুই থাকে না বড় আপা? আমি কেন কিছুই পেলাম না? এই পৃথিবীতে মহাপাপী কি একমাত্র আমি?
এক অমানুষের কাছে মুক্তি চেয়েছিলাম।ও আমাকে সত্যিকার অর্থেই মুক্তি দিয়েছে।একলা ঘরে মেঝেতে ফেলে চেঁচিয়ে তালাক, তালাক, তালাক বলে ছেড়ে দিয়েছে আমাকে।একদিন তিন কবুল বলে আমাকে গ্রহণ করেছিলো, আজ তিন তালাক বলে ছেড়ে দিলো।যাক গে, আমার আফসোস নেই।তুমি ভেবো না আমাকে ছেড়েছে বলে আমি মরছি।আমি মরছি অন্য কারণে। ফয়সালের একটা চামড়ার শক্ত বেল্ট আছে। প্রতিদিন ব্যবহার করে।খামারে যাওয়ার আগে আমিই এগিয়ে দিতাম ওটা।আবার ফিরে এলে সযত্নে রেখে দিতাম। জিনিসটা এতোদিন এতোবার নড়াচড়া করার পরেও কোনোদিন কল্পনা করিনি ওটা একদিন আমার শরীরে পড়বে।কামড়ে ধরবে আমার চামড়া,কালশিটে দাগে ভরিয়ে দেবে আমার হাত-পিঠ-গলা। বুঝতে পারছো কিছু?ফয়সাল আমাকে মারলো।টানা বিশ মিনিট অনবরত। কামড়ে,খামচে, জিনিসপত্র ছুঁড়ে মেরে থামাতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।ওর শরীরে শক্তি অনেক। আজ দুপুরেই তোমাকে বলেছিলাম আমার গায়ে হাত তোলার সাহস ফয়সালের নেই।বেলা গড়াতেই বুঝলাম যার সাথে এতোদিন সংসার করেছি,সে ফয়সাল আজ বদলে গেছে।সে আর ভীতু নেই।এখন আর ওর সাহসের অন্ত নেই।তুমি বলেছিলে মামলা করতে হলে প্রমাণ লাগে।আজ আমার শরীর ভরা প্রমাণ।কিন্তু থানা অবধি যেয়ে গায়ের দাগ দেখানোর মতো শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই।মন চাইছে না আপা।মন বলতে কিছু একটা আজও বেঁচে আছে।তাকে অমান্য করার শক্তি আর একটুও নেই।মামলা,লড়াই,ঝামেলা– এসবে জড়াতে আর ইচ্ছাই করছে না বড় আপা।কী হবে ওকে শাস্তি দিয়ে?যে আঘাত আমাকে করেছে তা কি আর ফিরিয়ে দিতে পারব? আব্বাও তো অনেক মারতো।সে কি কোনো শাস্তি পেয়েছে? পায়নি।আমি জানি ফয়সালও পাবে না।আমার সাথে যারা অন্যায় করে তারা কোনোদিন শাস্তি পায় না। কোন অপরাধে আমার গায়ে দাগ পড়লো জানো? সকালে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অন্ধ হয়ে বাড়ি ছাড়াটা ছিল অপরাধ।ওর উপর ভরসা না করে তোমার কাছে যাওয়াটা ছিল অপরাধ।দশটা মানুষের সামনে নিজের দুঃখের কথা বলে ওদের বাড়ির সম্মান নষ্ট করাটা ছিল অপরাধ।
ভয় বা দুঃখে মরছি না বড় আপা।নিজের জীবন নেওয়ার কথা যে ভাবতে পারে সে সহজে ভয় পায় না।এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরে আর দুঃখও হচ্ছে না। আমি হয়তো সুখ-দুখের ঊর্ধ্বে চলে গেছি। নিজের জীবনের উপরে আমার বিতৃষ্ণা চলে এসেছে।এই এতো বছরের জীবনে সুখ যখন কোথাও পাইনি তখন ভবিষ্যতেও আর পাব না।চড়-লাথিই আমার কপালে আছে। মানুষ সুখী না হলে ভাগ্যকে দোষারোপ করে বেঁচে থাকে।আমার সেই সুযোগও নেই।সেই বারো বছর বয়স থেকে একজনকেই চেয়ে এসেছি।কখনো মোনাজাতে ভালো রেজাল্ট চাইনি,বাবা-মায়ের ভালোবাসা চাইনি,সাফল্য চাইনি,সুখ চাইনি।দয়াময়ের কাছে ভিক্ষা হিসেবে শুধু ফয়সালকেই চেয়েছি।সেই চেয়ে নেওয়া ভাগ্যই আজ গলার ফাঁস। অতএব ভাগ্যকে দোষ দেওয়ার রাস্তা নেই।আমি তবে আর কী নিয়ে বেঁচে থাকব বড় আপা?এই জীবনটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ধৈর্য নেই,শক্তি নেই,ইচ্ছাও নেই।
তুমি বলবে তোমার কাছে যেতে পারতাম।আমিও ভেবেছি এতোক্ষণ।কিন্তু এতেও মন সায় দিলো না।আমি তোমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসি বলেই যেতে পারলাম না। আমাকে দেখলেই তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়বে,অসুস্থ হয়ে যাবে।হয়তো এই রাতেই ইশতি ভাইকে নিয়ে থানায় ছুটবে।এই শেষ সময়ে এসে বাবুর কথা না ভেবে ভাববে আমার কথা।ইশতি ভাই তোমাকে সামলাতে পারবে না।আমার জন্যই তার নতুন বাবা হওয়ার আনন্দে ভাটা পড়বে।জেনে-শুনে তোমাদের এতোবড় ক্ষতি কী করে করব? অতিরিক্ত ভালোবাসাও ক্ষতিকর।তোমাকে আরেকটু কম ভালোবাসলে ভালো হতো। নিজের দুর্ভাগ্যের ভাগটুকু তোমার কাঁধে চাপিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম।এখন পারছি না।আমার ভাগ্য আমার থাক,তুমি ভালো থাকো।বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে। ও বাড়ির দরজা আমার জন্য অনেক আগ থেকেই বন্ধ।
তুমি মোটেও কষ্ট পেয়ো না।আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না বড় আপা।সারা গায়ে ব্যাথা অথচ চোখে পানি নেই।পহেলা বৈশাখের পর থেকেই মরতে চাচ্ছি।আজ দশ পা এগিয়ে যাচ্ছি।ভাবছি গলায় দড়ি দেব না।গ্রামে দড়ি দিলে সবাই লাশ পাবে।জানি মরার পর আমার কদর বাড়বে।যেই দুটো পুরুষকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি হয়তো তাদের কাঁধে ভর করেই সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে যেতে হবে।ছিঃ! ছিঃ! ছবিটা ভাবতেও আমার গা ঘিনঘিন করছে।এ কিছুতেই হতে পারে না। আমি অন্ধকারে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ব যেন ওরা আমার লাশটাও না দেখতে পারে,না ছুঁতে পারে।ওদের জন্যে কবরের মাটিও বিসর্জন দিচ্ছি।মরার আগে আমাদের আম্মাকে ছাড়া আর কাউকে ক্ষমা করতে পারছি না।তিনটে মানুষের বিরুদ্ধে এক আকাশ ঘৃণা নিয়ে যাচ্ছি।ওদেরকে আমি শত চেষ্টায়ও ক্ষমা করতে পারব না।
পরকালে নরক আমার ঠিকানা তা জানি।কিন্তু জানো বড় আপা,আমি বিচার দিবসে বিশ্বাসী।আজ আমার কথা শোনার কেউ নেই।কিন্তু শেষ বিচারের দিনে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক নিশ্চয়ই আমার কথা শুনবেন,আমাকে বলার সুযোগ দেবেন।সেদিন আমি সবার আগে আমার আব্বা,আমার শাশুড়ি ও আমার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করব।
আম্মার কথা ভেবে খুব কান্না পাচ্ছে আমার।মুখে যত যা বলুক না কেন আমার মৃত্যুটা তার প্রাণে বাজবে। যদি সুযোগ হয় তো তাকে একটু দেখে রেখো।তুমি কষ্ট পেলে ইশতি ভাই সামলাবে।কিন্তু আম্মা কষ্ট পেলে সামলানোর মতো কেউ নেই।আমিও সংসার করেছি, বুঝি সব।তার স্বামী ভাগ্য আমার মতোই।শুধু পার্থক্য হচ্ছে আমি মনেও মরেছি,শরীরেও মরছি।আম্মা অনেক আগেই মরে বাঁচার অভিনয় করছে।যে মানুষটাকে আমি-তুমি সহ্য করতে পারি না তার সাথে আম্মা কী করে এতো বছর থাকছে তাই চিন্তা করছি।
আর কখনো কথা হবে না বলে চিঠিটা শেষ করতে ইচ্ছা করছে না।আমি যদি জানতাম আজ আমার শেষদিন তবে বিকালে ওদের সাথে ঝামেলা করে সময় নষ্ট করতাম না।তোমার হাতে মন ভরে খিচুড়ি খেয়ে তোমার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতাম।কেঁদে কেঁদে নিজের ক্ষতি করো না বড় আপা।আজ হোক কাল হোক মরতে তো হতেই।যে উদয়পুর আমাকে চায় না তাকে আমিও চাই না।তাই আমি একটু আগেই যাচ্ছি।চম্পা ভাবি,জয়া ভাবি,মনি ভাবি,রত্না,লিলি,রনি– সবার কথা মনে পড়ছে খুব।জানি আমার মহাপাপের কথা শুনেও ওরা আমাকে কখনো ঘৃণা করবে না।
চিঠিটা তুমি কখন পাবে জানি না। যার কাছে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি সে আমাকে ভালোবাসে।আমিও তাকে ভালোবাসি।আমার শেষ অনুরোধ সে রাখবে।আমার চিঠিটা তোমার কাছে যেদিনই হোক পৌঁছে দেবে।এই আমার ভরসা।আমাকে ভুলে যেও।বাবুদের দুটো নাম ঠিক করেছি। ভাগ্নে হলে ইভান,ভাগ্নী হলে ইভা।অর্থ জানি না।এতোকিছুর মাঝেও এই দুটো নামই মাথায় ঘুরছে।ভালো লাগলে রেখো।
যাচ্ছি বড় আপা।পূবের বিল নদীতে মিশেছে।অন্ধকারে সেই বিলের পথেই পা বাড়াচ্ছি।পশুটা ঘরে নেই।আমাকে মেরে-ধরে বেরিয়ে গেছে।আমিও বেরোবো এখন।কলম থামাতে হচ্ছে তাই।ভালো থেকো বড় আপা।
ইতি
শুধু এবং শুধুমাত্র তোমার সূচি।
চলবে….