#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–8
ভর সন্ধ্যা। সূর্যের মোলায়েম কিরণ ক্রমশ মিলে গেছে৷ আযানের মৃদ্যু শব্দে মিরার ঘুম ভেঙে যায়৷ সে ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারল, তার বড্ড পিপাসা পেয়েছে। ঘুমটা বড্ড অসহ্যকর লাগছে কিন্তু পুরাপুরি ভাবে সে জাগ্রত হতে পারছে না। ঘুমু-ঘুমু চোখে তাকালো সে। রুম অন্ধকার হয়ে আছে। আচমকা কানে মশার গুনগুন আওয়াজ ভেসে আসতেই সে বিরক্তি চরম বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে উঠে বসে। পানি পান করতে হবে তাকে। আযানের আওয়াজ তখন তীব্র হতে লাগে। তাদের বাসার কাছেই মসজিদ আছে। অবশ্য পুরান ঢাকায় মসজিদের অভাব নেই। সে উঠে দাঁড়িয়ে লাইট জ্বালানো। এখনো ঘোর কাটেনি তার। টেবিল থেকে জগ উঠিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে সে ধপ করে বিছানায় বসে পরে। তার এইমাত্র দুপুরের কথা স্মরণ হলো। দুপুরে ইমান তাকে প্রোপোজ করেছিল। না, না প্রোপোজ না ডেয়ার পূরণ করেছিল। সে একটা শুকনো ঢোক গিলে রুমের বাইরে বের হলো। আজ আপুর ব্যাচেলর পার্টি হওয়ার কথা৷ ইমান তো চাচ্ছিলই না সে জয়েন করুক তাদের সঙ্গে। এখন অবশ্য মিরাও চায় না যেতে৷ দুপুরের ঘটনার পর আর ইমানের সম্মুখীন হতে মন চাচ্ছে না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে ইমান সুক্ষ্মভাবে তাকে অপমান করে। সে বিদেশে পড়ালেখা করেছে।তাও ইঞ্জিনিয়ারিং! ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আর এদিকে মিরা টেনেটুনে সবসময়ই বেচে যায়। এসএসসি তে কানের গোড়া দিয়ে এপ্লাস তার ভাগ্যে থেকে মিস হয়। আর এবার এইচএসসিতেও বুঝি ডাব্বা মারবে সে। উফফ! ছেলেটা বড্ড নাকউঁচু। এই নাকউচু ছেলেটার কথা আর ভাববে না মিরা৷ ওর সাথে কিছুই হবার নয়। আর হয়ে গেলেও সেটা বড্ড বেমানান।
মিরা চুল আছড়ালো অনেক সময় নিয়ে। এরপর রুমের বাইরে গেল। বাসায় সব স্বাভাবিক। তার মানে কালবৈশাখী ঝড়টা কেবল তার মনের মধ্যে ঘটছে৷ এমন কী কালবৈশাখীর জনক স্বয়ং ড্রয়িংরুমে পা তুলে বসে টিভি দেখছেন আর বিকেলের নাস্তা খাচ্ছে৷ মিরা ভেংচি কাটলো। যার সঙ্গে দেখা করতেই চায় না, সে কেন বারবার তার চোখের সামনে এসে বসে বসে নাস্তা খাবে? হুহ!
ইমান মিরাকে দেখে বিশেষ কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। এতে যেন গা জ্বলে যায় মিরার৷ কেন দুপুরেই না কী প্রেম-প্রেম ভাব নিয়ে গদগদ হয়ে ডায়লগ ছুড়লোঃ “I need you like sky needs moon.” এখন একবার তাকিয়ে হাসাও যায় না? মিরা সেই লাইনটা অজস্রবার মনে মনে আওড়াচ্ছে। তার মনে ধরেছে খুব। নিজেকে চাঁদ মনে হচ্ছে তার৷
সে ডাইনিং রুমে যেতেই ইমান চিল্লিয়ে বলে, আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যাও তো৷
মিরার খেয়াল হলো ডাইনিং রুমে সে ব্যতিত দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি নেই। মানে জনাব তাকেই আদেশ দিচ্ছে চা বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য? এদিকে তার জন্য মিরা অসুস্থ হয়ে একাকার অথচ দ্যাখো কাণ্ড সে নাকি আয়েশ করে চা খাবে! মানে তার কী মিরাকে দেখলেই কিছু না কিছু খেতে মন চায়? সেদিন রাত একটায় তাকে দিয়ে ভাত রাধালো। এরপর ঝালমুড়ি এখন আবার চা! অসহ্যকর!
সে বিড়বিড় করে এক মনে কথাগুলো বলছিল আর সেই সময় পলকহীন ভাবে ইমান তাকে পরখ করেই যাচ্ছিল।
সে যখন সটাং করে দাঁড়িয়ে গেল, মিরার ভয় হতে লাগলো। উহু, ভয় এইজন্য নয় সে দাঁড়িয়ে গেছে বরঙ ছেলেটা যদি ঘূণক্ষরেও তার মনে মাটি চাপা দিয়ে রাখা অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হয়? মিরা ঢোক গিলে কথা ঘুরানোর জন্য বলে, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি৷
ইমান টিভির রিমোট নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলে, “দরকার নাই।”
দুটো শব্দই যেন মিরাকে বুক বরাবর করাত দিয়ে কেটে ফেলার সমযন্ত্রণা দিল৷ সে নিজের মনকে বুঝ দিল, তার চায়ের দরকার নেই। সে তো আর বলেনি যে মিরাকে তার দরকার নেই।
মিনিট পনেরো পর সে রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে মিরার দিকে তাকিয়ে বলে, চা খাবে?
মিরা মাথা ঝাকালো যার অর্থ হ্যাঁ। সে ফিচেল হেসে বলে, “তাহলে যাও নিজে বানিয়ে খাও। ফ্রিতে সবকিছু পাওয়ার আশা বাদ দাও।”
কথাটায় মিরা প্রচন্ড অপমানিত বোধ করল। তার হুট করে কী যেন হয়েছে। সবকিছুতেই হীনমন্যতায় ভুগছে সে। এই যে সাধারণ একটা কামিজ পরে আছে এতেও হীনমন্যতা হচ্ছে তার। ছেলেটা কতো সুন্দর একটা টি-শার্ট পরে আছে৷ মিরার কেন এতো সুন্দর জামা নেই? এই বাসায় পরা ড্রেসে নিশ্চয়ই তাকে ভালো দেখাচ্ছে না৷
ইমান ডাইনিং রুম ক্রস করতে গিয়ে থেমে বলে উঠে, লিসেন,রাত দশটায় তুমি আর ইরা রেডি থাকবে। বড় আব্বু যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে কী বলবে?
— আপুর ব্যাচেলর পার্টিতে যাচ্ছি৷
ইমান উত্তর শুনে হাসবে নাকী কাদবে বুঝে উঠতে সক্ষম হলো না। সে একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলে, বলবে আমরা সবাই ছোট ফুপুর বাসায় যাচ্ছি।
মিরার বলতে মন চাইলো, সে যেতে যায় না কোন ব্যাচেলর পার্টিতে। কিন্তু মুখ দিয়ে তার মনের কথা বের হলো না। সে নীরবে সায় দিল৷
__________________
রাত আটটা থেকে সোনালী আপু আর ইরা মিলে ঘুটঘাট শব্দ তুলে সাজ-গোজ করতে লাগলো। মিরা অবশ্য সাজলো না। সে বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগে। একসময় সোনালী আপু ঝাড়ি মেরে বলে, রেডি হ তুই। ইমান একটু পর বের হবে আমাদের নিয়ে।
সে তবুও শুয়ে থাকলো। আপু তার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলে, এতো অলস এই মেয়েটা! দেখবি তোর কপালে খাটাশ জামাই পরবে। যে সারাদিন তোকে দিয়ে কাজ করাবে।
মিরা একটা হাই তুলল। এরপর নিজের রুমে ফিরে এসে মায়ের একটা কালো শাড়ি পরে ফেলে। চুল ছেড়ে দিল আর কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ পরে। ব্যাস তার সাজ কমপ্লিট। এমনিতেই তাকে দেখার সময় কারো নেই৷ সেই বুঝি সবার শেষে নামল।
মা আবার বাটি ভর্তি খাবার দিয়ে বলে, ফুপুর হাতে দিবি।
সে খাবারের ক্যারিয়ার বাক্স হাতে নিয়ে নেমে দেখল, পিছনে ইরা আর সোনালী আপু বসে পড়েছে। শুধু সামনের সীটটাই ফাকা। সে ফাকা সীটে বসে পরে। খানিক বাদে ইমান এসে ড্রাইভিং সীটে বসতেই তার হুট করে গরম লাগতে লাগলো। কপাল বেয়ে ঘাম বেয়ে পড়ল টুপ করে। ছেলেটার গায়ের পারফিউম একদম অন্যরকম। মন চায় তার বুকে নাক গুজে পারফিউমের কড়া ঘ্রাণ নিতে।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। আজ প্রচুর গরম পরেছিল বিধায় এখন আবহাওয়ার মুড সুয়িং হচ্ছে। মানে হুট করে ঝড়ো বাতাস বইতে লাগলো তবে অত্যন্ত আস্তে।
তারা যখন প্রান্ত ভাইয়ার বন্ধুর বাসায় পৌঁছে তখন রাত দশটা৷ ভাইয়ার ফ্রেন্ডরাও এসেছে। ছাদে লাইটিং করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন বলতে বারবিকিউ। মিরারা যেতেই তাদেরকে বারবিকিউ খেতে বসিয়ে দেওয়া হলো। গান বাজছে। হাসাহাসির শব্দ আসছে। মিরা চোখ ঘুরিয়ে ইমানকে খুজতে লাগলো। তাদের দুইবোনকে রেখে আপু আর ইমান গায়েব৷ সে এজন্য খাওয়ায় মনোযোগ দিতে পারল না। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় কীভাবে পারল ইমান তাদের রেখে যেতে?
খাওয়া শেষ করে তারা দুইবোন পাশাপাশি চেয়ারে বসে আলোকসজ্জা দেখছিল। প্রায় আধঘন্টা পর ইমান ফিরে আসল। সে তাদের সামনে আসতেই মিরার নাকে সিগারেটের গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। ইমান শান্ত গলায় বলে, নিচে মুভি দেখার আয়োজন হবে।তোমরা ওখানে যাও। নিচে তোমাদের বয়সী অনেকেই আছে।
ইরা উঠে আসলেও, মিরা অভিমান কিংবা অপমানবোধ থেকেই বলে উঠে, আমি এখানেই থাকব।
ইমান কেন যেম জোর করল না। ইরাকে নিয়ে নিচে নেমে গেল। মিরাও আশপাশ ঘুরে ঘুরে দেখবে বলে হাটা ধরল। তখনই তার নজর গেল টেবিলের উপর। সেখানে হরেক রকমের চকলেট, চিপস সাজিয়ে রাখা। পাশেই সাত-আটটা কোকের বোতল। মিরার চকলেট খেতে মন চাইল। সে এগিয়ে গিয়ে একটা চকলেট হাতে নিল তখনই ইমান ছাদে ফিরে এলো।
সে চকলেট খেতে খেতে গুনগুন করে গান গাইলো। চকলেটটা দারুণ মজা ছিল৷ সে আরেকটা খাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। দ্বিতীয়বার টেবিলের সামনে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার আগেই ইমান কোথা থেকে এসে যেন বেশ তাড়া নিয়ে বলে, “তুমি কী ছোটবাচ্চা যে চকলেট খেতে হবে? এগুলো প্রান্ত ভাইয়ার ফ্রেন্ডদের জন্য।”
সেই মুহূর্তে প্রান্ত ভাইয়ার ফ্রেন্ড পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে, উদ্দেশ্য করে, মিরা জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া এখান থেকে চকলেট নিলে কী সমস্যা আছে?
ভাইয়াটা সৌজন্যবশত বলে, আরে না। তোমাদের জন্যই আনা হয়েছে। আমাদের কী আর চিপস-চকলেট খাওয়ার বয়স আছে?
প্রান্ত ভাইয়ার ফ্রেন্ড যেতেই মিরা মিষ্টি করে হাসল ইমানকে দেখে। সে অবশ্য সেই মিষ্টি হাসি উপেক্ষা করে বেশ রাগ নিয়ে জায়গাটা প্রস্থান করল।
পর পর দু’বার চকলেট খাওয়ার পর মিরার পিপাসা পেল। সে পানি খুজতে লাগলো। আশেপাশে এই মূহুর্তে কেউ নেই। তবে টেবিলের উপর কোকের বোতল পরে আছে৷ সে একটা বোতল হাতে নিয়ে খোলার ট্রাই করল, কিন্তু পারল না। এরপর আনপ্যাক করা একটা কোকের বোতল হাতে নিয়ে গ্লাসে ঢাললো। গ্লাস হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে, সে থেকে থেকে চুমুক দিতে লাগে। আজ বুকে ভালোবাসার বেদনা চেপে রেখে এই মধ্য রজনীতে মৃদ্যু গানের শব্দে তার কোক খেতে বড্ড ভালো লাগছে। সে ঢুলু ঢুলু পায়ে আরো এক গ্লাস কোক আনল। হুট করেই কেন যেন সবকিছু বিরক্ত লাগতে লাগলো। গানের আওয়াজে সে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। মন চাচ্ছে সাউন্ড বক্স ভেঙে ফেলতে। সে ঢকঢক করে কোক খেয়ে নিল।ক্রমই এক সেকেন্ডের ব্যবধানে তার সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে। তবে শরীরে চিন-চিন ব্যাথা অনুভব করে সে। হাটুতে ব্যাথা করছে। ঠিকমতো দাড়াতেও পারছে ন তবুও সামনে পা বাড়াতেই ইয়া বড় একটা খাম্বার সঙ্গে সে ধাক্কা খেল। নাকে ভীষণ জোরে লাগলো তার৷ সে রাগে গজগজ করতে করতে, খাম্বা তোর সমস্যা কী রে? তোর সাহস তো কম না আমাকে ধাক্কা মারিস। এখনি তোকে রাজ্য থেকে বনবাসে পাঠানো হবে৷
কারো শীতল স্পর্শ পেয়ে মিরা পিটপিট করে তাকায় কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। আবছা শুনতে পেল পরিচিত গলায় কেউ একজন তাকে বেশ শক্ত করে ধরে রেখে বলছে, ওহ মাই গড, তুমি ড্রাংক! কেউ এতো ড্রিক একবারে করে? কীভাবে মাতাল হলে ? মানে হাউ?
মিরার বড্ড ফুরফুরে লাগতে লাগলো। সে খাম্বার কাধে হাত রেখে দাড় হয়ে বলে, আমার না খুব ড্যান্স করতে মন চাচ্ছে।
চলবে৷
[ নিয়মিত না দিলে পাঠকরা আগ্রহ হারায় আমি জানি। এককালে আমিও যখন পাঠিকা ছিলাম, তখন রাইটাররা গল্প না দিলে মন খারাপ হত। আমি জানি না, আমি গল্প না দিলে কারো মন খারাপ হয় কীনা! তবে পাঠকদের অপেক্ষায় রাখতে আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আগের মতো লেখায় ফ্লো আসে না। মাথায় স্ক্রিপ্ট রেডি কিন্তু লেখা আগায় না। যাইহোক নিয়মিত দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। লেইট করার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। আপনারা সরব হয়ে রেসপন্স করলে হয়তোবা লিখতে আনন্দ পাব।আজকে রিচেক দেওয়ার সময় পাই নি। ভালোবাসা অবিরাম। ]