#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–22
মিরার অভিব্যক্তি দেখে সামান্য হাসে ইমান। সে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে, “অবাক হচ্ছো কেন?”
মিরা নিজের অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু সম্ভবত চোখ-মুখ থেকে তার চমকে যাওয়ার সেই আভা মুছে যায়নি। সে বিষ্মিত চোখে বলে উঠে, “আপনি চলে যাবেন?”
ইমান হাল্কা হেসে বলে, “চলে যাব না, বরং ফিরে যাব। তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমি এখন বাংলাদেশের মেহমান। আর আমেরিকার সিটিজেন৷”
মিরা একবার তার পানে তাকালো। এরপর সোজা হয়ে বসে পরে৷ ইমান দেয়ালের সঙ্গে ঘেঁষে আরাম করে বসে বলে,”হুট করে কাবুলিওয়ালাদের কথা মনে পড়ল।”
সে জানার আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকালো। ইমান বলতে থাকে, ” আগেকার দিন অন্য লোকালয় থেকে সুদর্শন ব্যবসায়ীরা এদেশে এসে ব্যবসা করত। এরপর সুযোগ পেয়ে এদেশের ধনবান ব্যক্তিদের কন্যাকে বিয়ে করে কিছুদিন সংসার করে, সংসার, বউ রেখে নিজ দেশে ফেরত যেত আর আসত না৷”
“আর আসত না” শুনে মিরার বুক কেঁপে উঠে। সেও কী তাহলে মিরাকে রেখে বিদেশ পাড়ি দিবে এবং আর ফিরে আসবে না? তখন তার কী হবে? সে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাকে।
” আপনি কী তাহলে কাবুলিওয়ালাদের মতো করবেন? ”
ইমান আবারো হাসল। উত্তর দিল না।
সে ভীতগ্রস্থ হয়ে বলে, “আমার প্রশ্নের জবাব দিন?”
— “করতেও পারি। আমি তোমার জীবনে পলাতক সুদর্শন কাবুলিওয়ালাও হতে পারি। ইউ নেভার নো!আর হলেও অসুবিধা কী? আমি তো আর তোমাকে বউ হিসেবে মানি না। বরং প্রতিশোধ নিতে এসেছি।”
— “প্রতিশোধ তো নিতে পারলেন না৷”
ইমান তার দিকে আরেকটু ঘেঁষে বসল। দুইজনের মধ্যে দূরত্ব রইল না একবিন্দু৷ সে তার কাঁধের কাছে হামাগুড়ি খেতে থাকা চুলের গাছি নিজের আংগুলের ভাঁজে তুলে নিল। এরপর কিছুক্ষণ চুল নিয়ে খেলা করল।সম্পূর্ণ সময় মিরা মূর্তির মতো বসে রইল৷ এই লোকটার স্পর্শ তাকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেয়। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা তখন।
ইমান তার কানের পেছনে চুল গুটিয়ে দিয়ে বলে, “বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেলে, এই সমাজের মানুষ তোমাকেই দোষী ভাববে। তোমার চরিত্রেই দোষ খুঁজবে৷ কাহিনি রটাবে৷ তখন তোমার বাবা-মা অপমানিত হবে। এর চেয়ে ভালো প্রতিশোধ আর কী হতে পারে?”
মিরা মাথা নিচু করে নিল। এরপর বলে উঠে, ” “আপনি খুব নিষ্ঠুর।”
–” কী জানি। লোকে বলে আমি মানুষটা ভালো৷”
মিরা তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে বলে, “ভালো মনের মানুষরা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়না। আপনি কাপুরষ। এজন্য আমাদের পেছন থেকে আঘাত করলেন তাও ছলনা করে। বিশ্বাসঘাতকতা করে৷”
ইমান তার কাধে মাথা রেখে বলে, “মিরা আমার হাতে তোমার সর্বনাশ লেখা আছে৷ বিশ্বাসঘাতকতা যুদ্ধের অংশ। প্রতিটা যুদ্ধেই বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা পরোক্ষভাবে জড়িত৷ ”
মিরা তার মাথা সরানোর চেষ্টা করে বলে, “আপনার উদ্দেশ্য আমি সফল হতে দিব না৷”
ইমান তার হাত চেপে ধরে বলে, “ওকে, লেটস সি, তুমি কী করতে পারো৷ আগামী একমাসের মধ্যে তোমাদের এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে৷”
মিরা আতকে উঠে প্রশ্ন করে, “কেন?”
— “বিল্ডারর্সকে দিব। দশতলা বিল্ডিং হবে৷”
মিরা কথাটা শুনে থমকে দাড়ালো। তার জন্ম এই বাসাটায়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কত স্মৃতি আনাচে-কানাচেতে লুকিয়ে আছে৷ অথচ ইমান মুহুর্তের মধ্যে সেই স্মৃতি গুলো হত্যা করবে৷
তার চোখ ফেটে কান্না উপচে পড়তে থাকে।
ইমান হেসে ফেলে বলে,” এই মনোবল নিয়ে আমার সঙ্গে গেম খেলতে নেমেছো? প্রথম রাউন্ডেই তুমি হেরে গেলে! আরো তো তিন রাউন্ড বাকি আছে।”
— “আমি হেরে যাইনি, বরং আপনি আপনার বিবেক হারাচ্ছেন৷”
অবশ্য এই কথার পালটা জবাব দিল না সে। চুপচাপ বসে থাকলো দুইজন। পাশ দিয়ে কেউ গেলে ভাববে, দুইজনের মধ্যে কত কম দূরত্ব। অথচ সম্ভবত এই মূহুর্তে তারাই সবচেয়ে পর। যোজন যোজন দূরত্ব তাদের মধ্যে! একজনের মনে কুৎসিত সব ভাবনা। প্রতিশোধের আগুনে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে তার৷
_____________
সূর্যের আলো চোখে এসে বারি খেতেই মিরার ঘুম ছুটে যায়। সে নিজেকে বদ্ধ কিছুর মধ্যে অনুভব করলো। নিজেকে ধাতস্থ করতেই পরিচিত ব্যক্তির গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। মাথা সামান্য উচিয়ে সে দেখল, ইমানের বুকে তার মাথা। তারা দুইজনই চেয়ারে বসে, একে অপরের গায়ে হেলে পড়েছে। মিরাকে আবার সে নিজের বাহু দ্বারা ধরে রেখেছে যেন সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে না যায়৷ মিরা আশেপাশে তাকালো। ভোর হওয়ায় কেউ নেই কলিডোরে। সে ইমানের গায়ে একটা চিমটি কাটে। সঙ্গে সঙ্গে সে নড়েচড়ে বসে৷ মিরা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে আসতে গেলেই টান লাগলো চুলে৷ সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে, ইমানের শার্টের বোতামের সঙ্গে তার চুল জট পেকে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিরক্ত হয় সে। যতোই সে দূরে যেতে চাচ্ছে, কেন ততোবারই নিকটে আসছে তারা? শার্টের বোতামের সঙ্গে এক প্রকার টানা-হেঁচড়া শুরু করে মিরা৷ কিন্তু এতে চুল আরো জট পাকিয়ে যাচ্ছে৷ এক সময় সে ঝুঁকে কাজে মনোনিবেশ করে৷ বোতাম থেকে চুলকে মুক্ত করতেক হবে তার। জেদ চেপে গেছে যেন৷
ইমানের বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা বোতামের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে কখন যে, সে জেগে গেছে সেদিক হুশ নেই মিরার। নিজের কাজে ব্যাহত ঘটে যখন তার হাতজোড়া ইমান নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে।
তড়িঘড়ি করে মিরা সরে আসতে চাইলে, ইমান বলে উঠে,” ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিচ্ছিলে নাকী?”
— “ছিঃ!”
— “ছিঃয়ের কী দেখলে? স্বামীর কাছ থেকে সুযোগ লুফে নেওয়া যায়। প্যারা নাই।”
মিরা নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, “আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মানি যে সুযোগ নিব?”
ইমান সপ্রতিভ হয়ে বলে, “মানো না?”
–” ততোদিন অব্দি মানব না, যতোদিন অব্দি আপনাকে আমাকে মেনে নিচ্ছেন না৷”
— “নাইস। তাহলে মনে হয় এই জামানায় তোমার জামাই হওয়ার সাধ মিটবে না৷”
বলেই ফিচেল হাসি দেয় সে।
মিরা সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং নিজের আটকে থাকা চুলগুলো বেশ জোরে করেই ছিঁড়ে ফেলে। এরপর গটগট করে হেঁটে অন্য বেঞ্চে বসে৷ ইমান বসে রইল। তার শার্টের বোতলে লম্বা চুল প্যাচ লাগিয়ে পড়ে আছে। বিষয়টা বিব্রতকর!
দু’দিনের অবজারভেশন শেষে আজমল তালুকদার সাহেবকে বাসায় আনা হয়৷ এখন উনি মোটামুটি সুস্থ। গতকাল রাতেই সে এসেছে বাসায়। তার সঙ্গে হাসপাতালে প্রতিনিয়ত ইমান ছিল। সোনালী আপুও থেকেছে৷ ইমান বাসায় এসে নিজের রুমে ফ্রেস হতে গিয়ে দেখে, মেঝেতে ওলরেডি তোষোক পেতে রাখা হয়েছে। সে ভাবলো, নিশ্চয়ই তার জন্য মিরা আধিখ্যেতা দেখিয়ে ফ্লোরিং করে সাহায্য করছে৷ কস ম্যাডাম তো আর ফ্লোরে ঘুমাবে না৷
সে বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে, রুমের দরজা লাগানো। এবং আশ্চর্যজনকভাবে মিরা ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ দরজা বন্ধ করার ব্যাপারে ইমান নিজেই লজ্জা পেল। না জানি বাইরে কে কী ভাবছে! ইশ! বাংলাদেশে এইসব এতো কমপ্লিকেটেড কেন?
সে বিছানায় এসে বসে। এবং বেডে শুয়ে পড়ে।হাত-পা ছড়িয়ে শুলো। দুইদিন পর এমন আরাম করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে পেরে চোখ আপনা-আপনি বুজে গেল তার৷ শান্তিতে তার গা ছেড়ে দিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ইমান বুঝলো, এই বাসার পরিবেশ আবারো আগের মতোই। তার শ্বাশুড়ি রান্না করছে। শ্বশুড় রুমে বসে পেপারে চোখ বুলাচ্ছে। বড়মামা ড্রয়িংরুমে বসে আছে৷ ইরা স্কুলে গেছে। বাসায় মিরা আছে। তার তাকে সাহায্য করছে৷
ইমান বড়মামাকে নিয়ে খেতে বসে৷ দাদীও এসে বসলেন৷ মিরা রুটি এনে প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছিলো৷ এমনই সময় ইমান বলে উঠে, মামা, “আমার ফ্লাইট আগামী বুধবার। মানে আর দু’দিন পর৷”
মামা আহত গলায় বলে,” তোমার যাওয়ার সময় হয়ে গেল!”
–“জি।”
আজমল তালুকদার কিছু বললেন না। ইমান বিয়ের সময়ই বলেছে তার সবটা গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে। এবার তার পক্ষে মিরাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তবে খুব শ্রীঘ্রই সে মিরাকে নিয়ে যাবে। আজমল সাহেব চাচ্ছেন মিরা ভার্সিটি ভর্তি হোক। স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাক৷ কিন্তু আদৌ এটা বাস্তবায়ন সম্ভব কীনা তিনি জানেন না। তবে ইমানকে সে সময় দিবে। আর মিরারও পরিবার থেক্ব দূরব থাকার জন্য সাহস, সময় ও মানসিক প্রস্তুতি দরকার
মিরা আর বাকিটা শুনলোনা। সে প্লেট হাতে রান্নাঘরে ঢুকে পরে। আচমকা তার চোখ বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে৷
পরের দু’টো দিন খুব দ্রুত কাটলো৷ ইমান ট্রলি গুছাতে ব্যস্ত ছিল। রাতে মিরা নিচে ঘুমালো। ইমান খাটে। তাদের মধ্যে কথা হত না কোন। অবশ্য যাওয়ার দিন সকালে ইমান ঘুম থেকে উঠে তাকে বলে, ” আজকে থেকে তুমি বেডে ঘুমাতে পার। আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে সরাসরি। আমি নেক্সট কবে ঢাকা আসব নিজেও জানি না। সো গুডবাই৷”
মিরা ঘুম ঘুম গলায় বলে, “গুডবাই।”
এয়ারপোর্টে সবাই তাকে সি অফ করতে গেল৷ মিরাও সঙ্গে ছিল। তার কোন অনুভূতি হচ্ছে না। সে চুপচাপ সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ইমান আজকে ধূসর রঙের একটা টিশার্ট পরেছে। মিরা তাকে অনেকবার দেখল। প্রতিবার দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুক মোচড় দিয়ে উঠছিল। সে সবার কাছ থেকে আলাদা ভাবে বিদায় নিল। দাদী ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। সোনালী আপু প্রান্ত ভাইয়ার সঙ্গে কথা বললো। এর সুপ্তি বেগমকে বলল, ” নিজের যত্ন নিবেন মা৷”
এই প্রথম মিরার মাকে সে মা বলল। মিরা ও সুপ্তি বেগম দুইজনই চমকে উঠে। সুপ্তি বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। পাশেই মিরা দাড়ালো ছিল। তাকে ইগনোর করে সে ইরার কাছ থেকে বিদায় নিল৷
এয়ারপোর্টে ঢুকে যায় সে সবার কাছে বিদায় নিয়ে। তখনো তাদের মধ্যে কোন আলাপ হলো না৷ মিরা বিষন্ন চোখে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল৷
ইমান ইমিগ্রেশন শেষ করে সামনে পা বাড়ালো। তখনই এক জায়গায় লেখা দেখল, “ওয়েলকাম টু নিউইয়র্ক। ”
কেমন শিহরণ বয়ে গেল তার মনের কুঠরীতে। বাংলাদেশ থেকে সে চলে যাচ্ছে। অনেকদূর। এতো খারাপ কেন লাগছে? কেন মন চাচ্ছে সব ছেড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেতে? কোন পিছুটান কী কাজ করছে?
চলবে।
[ সবাইকে নিউইয়র্কে স্বাগতম৷ ইমানের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ছোটো-খাটো নিউইয়র্ক ট্যুর দেই। কি বলেন পাঠক? আমার পাশে থাকবেন তো নিউইয়র্ক ট্রাভেলে? ]