ফেইরিটেল পর্ব-৩৯

0
1355

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–39 (বোনাস)

আকাশ পরিষ্কার৷ আরামদায়ক ও প্রশান্তিকর প্রভাতের কিরণ উঁকি মারছে বারান্দার দরজার কোল ঘেঁষে। নাম না জানা নানারকমের পাখির কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখরিত। আজকাল ভোরে খুব শীত পরে৷ ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো৷ উষ্ণ কম্বল মাস্ট নিতে হচ্ছে৷ মিরা চোখ খুলল৷ সে কালরাতে বেডে ঘুমিয়েছিল। এবং চোখ খোলার পর নিজের অবস্থান বেডেই পেল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য গত তিনদিন ধরে মিরা স্লিপ ওয়াক করেনি। সে গতিকাল ডিভানে ঘুমিয়েছিল এবং ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে নিজেকে ডিভানেই পেয়েছে৷ আজও সেইম। বেডেই আছে সে। তবে কী তার স্লিপওয়াক ইমান থাকলেই কার্যকর? নিউইয়র্কের বুকে যে সামান্যটুকু রোদ, উষ্ণতা ছিল তাও ক্ষণে ক্ষণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে৷ ধীরে ধীরে শীত নেমে পড়ছে। মিরা কোনদিন তুষারপাত দেখেনি৷ এবার তুষারপাত হলে কী দেখতে পারবে সে?

সে দ্রুত পদে পা ফেলে বারান্দায় গেল। তাদের বাসার সামনের গ্যারেজে কালো গাড়িটা কভার দিয়ে ঢাকা। ইমানের গাড়ি এটা। সে নেই আজ সাতদিন হতে চলল। মিরা ভেবেছিল দু-তিন দিনের মধ্যে ব্যাক করবে৷ কিন্তু আজ সপ্তম দিন৷ ইমানের কোন খবর নেই৷ ফোনও করেনি আর৷ কাউকে জিজ্ঞেস করতে তার ভারী অস্বস্তি হয়৷ সাদ ক’দিন ধরে বেশ ব্যস্ত৷ ভার্সিটির এসাইনমেন্ট দিয়েছে৷ সে গাল ফুলালো। কীজন্য এতো অভিমান হচ্ছে তার? কার উপর মিথ্যা মিথ্যা অভিমান করছে সে? যে ব্যক্তির উপর অভিমান করছে সে কী আদৌও অভিমান বুঝে? ওর নিশ্চয়ই মিরার ঠুনকো অভিমানে কিচ্ছু যায়-আসে না৷

মিরা রুম ছেড়ে নিচে গেল। যথারীতি হাসনাহেনা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। উন্নত দেশেও যে হাসনাহেনা একদম পাক্কা গৃহিনী রুপে সেবা দিচ্ছে এটা দেখে ভারী অবাক লাগে। উনি দারুণ স্মার্ট। তবুও কেন জব করে না কে জানে? মিরা অবশ্য মাইনরোড সংলগ্ন একটা কফিশপে কাজ পেয়েছে৷ পার্ট টাইম জব। একদিন কাজও করেছে। তার ভালোই লেগেছে। তবে কথা বলার সময় সামান্য অসুবিধা হচ্ছে। তার একসেন্ট ভালো না। যার জন্য আমেরিকানদের তার ইংলিশ শুনে বুঝতে সামান্য কষ্ট হয়েছে৷

ব্লান্ডারের শব্দে তার ঘোর কাটে। তরমুজের জুস করা হচ্ছে। হাসনাহেনা তাকে দেখে বলে, ” টেস্ট করে দেখো তো সুগার লাগবে কীনা?”

মিরা এগিয়ে এসে চেকে দেখল। “একদম পারফেক্ট” বলে উঠে সে৷

আন্টি বলল,” তোমার আংকেলের সাথে কথা হলো। ওনার আসতে আরো তিনদিন লাগবে৷ ইমানের আব্বুর কথা বলছি৷”

–” আচ্ছা৷”

তার খুব বলতে ইচ্ছা করল, ইমান কবে ফিরবে এ সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কীনা৷ কোন এক কারণে বলতে পারল না। কথাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে আটকে গেল৷

হাসনাহেনা বলে উঠে, “আজকে লাঞ্চে স্পেশাল ডিশ করব৷ তোমার সাহায্যে লাগবে। তুমি কী থাকবে? ”

–” জি থাকব, আন্টি। কিন্তু স্পেশাল ডিশ কেন?কেউ আসছে?”

–” সাদের খালামনি আসবে।”

মিরা অপ্রতিভ বনে গেল। এরপর হাসনাহেনা জুস জগে ঢালতে ঢালতে বলে,” আজকে সাটার ডে না?”

–” হ্যাঁ।”

–” ইমানেরও আজকে আসার কথা। এতোক্ষণে রওমা দিয়েছে মনে হয়।”

কথাটা শোনামাত্র মিরার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে৷ অপ্রতিভ ভাব মুছে সপ্রতিভভাব চোখে-মুখে ফুটে উঠে। এমন কিছু শোনার জন্য সে তীর্থের কাক হয়েছিল। তার কেমন আনন্দ-আনন্দ ভাব হচ্ছে৷ কিন্তু কেন? উফফ!

সে তরমুজের জুস নিয়ে সোফায় বসল। এবং মোবাইল অন করল। আশ্চর্য ইরাকে এখনো এক্টিভ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো রাত। মেয়েটার এক মাস বাদে বোর্ড এক্সাম আর সে ফেসবুক চালায়৷ ওহ ভালো কথা হলো আচমকা ইরা তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে। এক্সাম না দেওয়ার ভুত তার ঘাড় থেকে সরেছে। সে নাকি এক মাস খুব পড়বে৷ এরপর এবছর এক্সাম দিয়ে পাশ করবে৷ এ সিদ্ধান্তে মিরা খুব খুশি। কিন্তু কী এমন হলো যে ইরা নিজের ডিসিশন চেঞ্জ করল। করেছে ভালো হয়েছে। ভাগ্যিস সময় থাকতে মেয়েটার টনক নড়েছে৷ মায়ের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ডাক্তার কিছু মেডিসিন দিয়েছে। মেডিসিন রেগুলার নেওয়ায় সে বলতে গেলে সুস্থ এখন৷ সে ধীরে ধীরে নিউইয়র্কের লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। সামনের রোডের একটা মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয়ও হয়েছে৷ মুসকান নাম৷ ইন্ডিয়ার লখনৌ থেকে এসেছে সে। তিনজন মিলে থাকে। ভারী মিষ্টি মেয়েটা৷ তার সঙ্গে সে কাল শপিং এ গিয়েছিল। এ বাসার সবার জন্য গিফট কিনেছে। ইমানের জন্যও কিনেছে৷ এবং ওর ক্রেডিট কার্ডের অনেকটা খরচ করে ফেলেছে এক প্রকার জেদ করে৷

সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই আন্টির ব্যস্ততা বেড়ে গেল। সাত-আট পদের রান্না করতে গিয়ে বেচারি হিমশিম খাচ্ছে। ইন্ডিয়ান তিনটা ডিশ করেছে৷ ইডলি, হারিয়ালি কাবাব, রেশমি কাবাব করেছেন৷ পাউ ভাজি বলে একটা নতুন আইটেম দেখল মিরা। বানানো খুব সহজ। নাকী আন্টি এক্সপার্ট বুঝতে পারছে না সে। আরোও একটা বিষয় হলো, আন্টি প্রচুর ইন্ডিয়ান ডিশ রান্না করেন। আর তার হাতের ইন্ডিয়ান ডিশ গুলোও খুব দারুণ হয়৷ এসবের পাশাপাশি পিজ্জা আর প্যানকেক করা হচ্ছে। সাদের কাজিন নাকি জন্ম থেকেই আমেরিকায় থাকে৷ ও মশলা খেতে পারে না৷ ইন্ডিয়ান বা দেশী ফুড ওর পছন্দ না৷ ওর জন্য আলাদা করে এসব করছে৷ মিরাও হাত লাগালো কাজে৷

দুপুরে মেহমানরা আসল। মাত্র দুজন। সাদের খালা আর ওর কাজিন৷ ওর কাজিনের চেহারায় বিদেশি বিদেশি ভাব আছে। দুপুর থেকে মিরার মধ্যে চাঞ্চল্য ভাব ফুটে উঠে। অস্থিরতা বিরাজমান মনের মধ্যিখানে। সবাই সঙ্গে লাঞ্চ করল। কিন্তু সে ঠিকমতো কিছু খেতে পারল না৷

একসময় আন্টি বলে উঠে, ” তোমার কী রান্না পছন্দ হয়নি?”

মিরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, ” খুব মজা হয়েছে তো আন্টি।

–” ঠিকমতো খাচ্ছো না কেন তাহলে? আরো একটু রাইস নাও?”

— “না৷ না আন্টি পেট ভরে গেছে”

— “কিছুই তো খেলে না! ”

সে দ্রুত খাবার শেষ করে উঠে পরে৷ এরপর আন্টি তার বোনকে নিয়ে নিজের রুমে গেল। এবং হলরুমে তারা তিনজন বসল। হলরুম থেকে মিরা বহুবার সদর দরজার দিকে তাকিয়েছে। আনমনে, মনের অজান্তেই কারো অপেক্ষায় আছে সে। সাদ আর ওর কাজিন লিমন একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। বেশ জমেছে তাদের গসিপ। সাদ ওর ব্রেক আপের গল্প শুনালো৷ তবে মিরা খেয়াল করে লিমন কিছুক্ষণ পর পর তাকে দেখছে৷ বিষয়টা অস্বস্তিকর৷ বিকেল পাঁচটায় কফি খেতে খেতে সাদ মুভি ছাড়ল একটা৷ হলিউড একশন মুভি৷ আধঘন্টা মুভি দেখল মিরা। এরপর টিভির স্ক্রিনে রোমান্টিক সীন আসল। এতে আরেকদফা লজ্জা পায় সে। এখান থেকে উঠে চলে যেতে ইচ্ছা করছে৷ এমন সময় মেইন গেইট খুলে গেল। মিরার চোখ সবার আগে সেদিকে গেল। কালো শার্ট ইন করা কাউকে ঢুকতে দেখল। তার অবয়ব দেখে সে মুহুর্তের মধ্যে চিনে ফেলে৷ কাঙ্ক্ষিত চেহারাটা দেখলেই তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।

ইমান দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই সবার আগে মিরাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল। এই সামান্য কারণে তার মন ভালো হয়ে গেল। জার্নি করে আসা ক্লান্তিরা ঘরছাড়া হলো। সে ভাব নিল যেন মিরাকে দেখেনি৷ মিরা উঠে দাঁড়ালো৷ নিশ্চয়ই তার কাছে আসবে৷ কথা বলবে৷ এক সপ্তাহ ছিল না সে৷ তাদের মধ্যে একটা কথা অব্দি হয়নি৷ আসুক। কথা বলুক তার সঙ্গে। কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে সরাসরি বলবে মাথা ব্যথা৷ মাথা টিপে দাও৷

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মিরা কিচেনে গিয়ে সাদকে জিজ্ঞেস করে, “পপকর্ণ খাবে?”

সাদ বলে, “ইয়েস, ইয়েস।”

ইমানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। পপকর্ণ খাবে তারা! বাহ! ভালোই।

সাদ তাকে দেখে উল্লাসের সঙ্গে বলে, ” ব্রাদার নাইস টু মিট ইউ।”

ইমান কথা না বাড়িয়ে দোতলায় উঠে যায়৷ অসহ্য! সবকিছুই অসহ্য লাগছে তার৷

মিরা পপকর্ণ ভেযে আনে। লিমন আর তার মা একটু পর বিদায় নেয়৷

মিরা সাদকে বলে, ” আরো একটা মুভি দেখি সাদ৷ ”

–” আরেকটা?”

–” হ্যাঁ। কোন সমস্যা? ”

–” মুভি না দেখে চল ফ্রেন্ডস দেখি৷ মাই ফেভারিট। ”

–” ফ্রেন্ডস? আমি দেখিনি এটা।”

–” একবার দেখো ফ্যান হয়ে যাবে৷ আমি তো র‍্যাচেলের মতো গার্লফ্রেন্ড আর মনিকার মতো ওয়াইফ চাই৷”

মিরা শব্দ করে হাসল। এরপর টিভি দেখায় মনোযোগ দিল। ঘন্টা খানেক অতিক্রম হওয়ার পর ইমান নিচে নেমে এসে সাদকে ধমকে বলে, “পড়াশোনা নাই তোর? কখন থেকে টিভি দেখছিস? এগুলো স্টুডেন্টের নমুনা?”

সাদ হা হয়ে যায়। ভাইয়ার আবার কী হলো?

ইমান বলে, ” তোর চার্জারটা এনে দে৷ আমারটা কাজ করছে না৷”

সাদ উঠে তার রুমে গেলে ইমান দ্রুত হাসনাহেনার রুমের দরজা লক করে দিল৷ এরপর এক সেকেন্ডের মধ্যে মিরাকে সোফা থেকে কোলে তুলে দোতলায় উঠতে লাগে৷ মিরা হতভম্ব হয়ে চিৎকার করতে ভুলে গেল৷

দোতলায় আসতেই মিরা বলে, ” আপনি কী পাগল? আমাকে এভাবে কি*ডন্যা*প করে আনলেন কেন?”

ইমান তাকে বেডে বসিয়ে বলে, ” ফর ইউর কাইড ইনফরমেশন আমি তোমাকে কি*ডন্যা*প না৷ মহিলান্যাপ করেছি। ইউ আর নট এ কিড এনিমোর।”

মিরা চোখ ছোট করে বলে, “ইগনোর সহ্য হয় না?”

— “না হয় না। যাও আমার জন্য পপকর্ণ ভেজে আনো। গো।”

–” পারব না।”

ইমান মুখ ভোতা করে। মিরা কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলে, “আপনার জন্য গিফট এনেছি।”

–” গিফট? ফর এনি ওকেশন?”

–” না। এমনি।”

–” মিস করছিলে নাকি?”

–” মিস না ছাই করছিলাম। সবার জন্য এনেছি।”

বলে গিফট বক্স এনে তার সামনে রাখতেই ইমান খুশিমনে বক্স খুলে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার হাসির অস্তিত্ব নাই হয়ে গেল৷ গিফট বক্সে একটা খেলনা সবুজ রঙের ব্যাঙ। সে নেড়েচেড়ে দেখল। ব্যাঙের গায়ে চাপ লাগায় হুট করে ওটার পেট থেকে লাল বাতি জ্বলে উঠে এবং গায়েবী আওয়াজে বলে উঠে, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং এ বি সি ডি ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং।

ইমান হচকচিয়ে যায়। তার ফেস রিয়্যাকশন দেখে মিরা হাসতে হাসতে শেষ।

–” গিফট পছন্দ হলো?”

স্পষ্ট মজা নেওয়া হচ্ছে। ইমান দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “খুব্বব। তুমি অনেক দূর অব্দি ভাবো৷ এখনই বাবুর জন্য খেলনা এনে রেখেছো। আমি যত্ন করে রাখছি। ফার্স্ট টয় ফর মাই বেবি আফটার ওল।”

মিরার মনে আচমকা এক দলা লজ্জা এসে হানা দিল। এই ছেলেটা এতো ইতর কেন? কাউকে লজ্জা দিতে তার জুড়ে নেই৷

ইমান বিজয়ে হাসি হেসে আবারো ব্যাটারি অন করে। ব্যাঙটা পুনরায় বলে উঠে,

ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং এ বি সি ডি ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং।

চলবে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here