#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Last Part (শেষ অংশ)
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা মেঘলা ছিল। আকাশের বজ্রপাতে হঠাৎ করে হাসপাতালের গুমোট রুমটা বিদ্যুৎ গতিতে আলোকিত হয়ে উঠে মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল৷ কারেন্ট চলে গেল। এরপর এক-দুই সেকেন্ডের মধ্যে জেনারেটর অন হলো। জেনারেটরের ভট ভট আওয়াজে মিরার মাথা ধরে যায়। তার কানে ভোভো শব্দ হচ্ছে। সৃজার আম্মু ডাক্তার লুবনা তাকে কিছু বলছে যার একটা শব্দও মিরা কর্ণপাত করল না৷ সে নিষ্পলক চাউনি মেলে বেডে ঘুমন্ত ইমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ নিষ্পাপ, আদুরে, ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে এক মিনিটের মাথায় সে মুখে ওড়না চেপে কাঁদা শুরু করল৷ ইমাদ এখন জেগে থাকলে, নিশ্চয়ই লাফ দিয়ে তার বুকে এসে তাকে ঝাপ্টে ধরে জিজ্ঞাসা করত, ” আম্মু তুমি কাঁদছো কেন?” তার ছেলে কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। শুনলেই মন ভরে যায়। কেন আজ তবে বাবু কথা বলছে না?
ডক্টর লুবনা বলে উঠে, ” দুপুরে ওরা সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করে খেলা-ধুলায় ব্যস্ত ছিল। হুট করে ইমাদের কি হলো! সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল৷ আমি দেরি না করে সাথে সাথে আমাদের ক্লিনিকে এনেছি৷ কিছু টেস্ট করতে দিয়েছি। রিপোর্ট এখনো আসেনি। ”
–” আপনি কেন এসব হাবি-জাবি টেস্ট করলেন? আমার ছেলে সুস্থ আছে। শুধু শুধু টেস্ট কেন করাচ্ছেন?”
লুবনা নরম সুরে বলে, ” আমি জানি ইমাদ সুস্থ আছে। কিন্তু….. ”
মিরা কঠিন চোখে তাকালো তার দিকে। তিনি অসহায় গলায় বলে, ” আমার কিছু ডাউট হচ্ছে। রিপোর্ট আসলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে৷ ইমাদের আব্বুকে কল করেছেন? আমি জানাচ্ছি ভাইকে৷”
ডক্টর লুবনা এরপর কি করলেন মিরা দেখেনি। সে বাবুর পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন সে৷ মিরা তার কপালে অসংখ্য চুমু খেল৷ এই মূহুর্তে তার মাথা ফাঁকা। কোনকিছু করার ক্ষমতা নেই৷ ইমানকে যে ফোন করবে সে শক্তি বা সেন্স কোনটাই নেই তার। শুধু না চাইতেও চোখের জল ফেলছে সে।
ইমান এলো আরো আধা ঘন্টা পর। ইমান আসতেই মিরা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ল। তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। ইমান নিজেই হতবিহ্বল। কোন কিছু ঠাওর করতে পারছে না সে। সে নিজেই শক্ত থাকতে পারছে না৷ ইমাদের সামান্য সর্দি-কাশি জানলেই খাওয়া হারাম হয়ে যায়, সেখানে তার বাচ্চা নাকি এতো গুরুত্বর অসুস্থ হলো যে হসপিটালে ভর্তি। বিকেলের আগেই পরিবারের বাকি সদস্যরা এসে পৌঁছে হাসপাতালে। প্রত্যকেই ভেতরে ভেতরে চিন্তিত এবং কষ্টে আছে৷
বিকেলের পর ডক্টর লুবনা ইমাদের পেরেন্টসকে স্পেশালি তার কেবিনে ডাকল৷ তারা দু’জন কেবিনে প্রবেশ করল। এসির বাতাসে হীম শীতল কেবিনের পরিবেশ।
সৃজার আম্মু চোখের চশমা খুলে বলল, ” ভাবী, ইমাদ একদম আমার ছেলের মতো৷ আমার মেয়ে যেমন আমার কাছে আমার জীবন, তেমনই ইমাদও আপনাদের প্রাণশক্তি। আসলে একটা ব্যাড নিউজ আছে।”
ইমানের বুক ধক করে উঠল। মিরা হয়তোবা ওনার কথা কানে তুলছে না। সে মাথা নিচু করে অনড়ভাবে বসে আছে৷
লুবনা বলে উঠে, ” ইমাদের কিছু টেস্টের সঙ্গে সিটি স্ক্যান করলাম। বলতে গেলে আমি নিজের ডাউট ক্লিয়ার করার জন্য ফুল বডি একবার চেক আপ করিয়েছি। এন্ড হিজ মেডিকেল রিপোর্ট ইজ শোয়িং…….. ”
ইমান নিস্তেজ গলায় বলে, ” প্লিজ এমন কিছু বলবেন না যেটা আমাদের সহ্য সীমার বাইরে।”
লুবনা মুখ কালো করে বলে, ” আই এম সর্যি। আমি নিজেই মানতে পারছি না৷ আপনাদের কীভাবে বলব!”
মিরা কেঁদে উঠে বললো, ” আমি কিছু শুনতে চাই না। আমি জানি আমার বাবু সুস্থ আছে। ”
লুবনা ইমানের দিকে তাকিয়ে রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে বলে, ” ইমাদের ব্রেইন টিউমার।
সেইদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হলো মিরার নতুন যুদ্ধ। ছোট্ট ইমাদের সঙ্গে হওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি নিজের ভাগ্যের পরিহাস ভাবতে শুরু করল৷ ইমাদ কিছু-ই বুঝল না। সে ব্রেইন টিউমার মানে কী তাই জানে না। শুধু এতোটুকু জানল, সে সামান্য অসুস্থ। আম্মুর কথামতো চললে একদম সুস্থ হয়ে যাবে সে। বরং ও আরোও খুশি হয়, স্কুল মিস দিতে পারবে বলে!
তাকে রাতের মধ্যে রিলিজ দেওয়া হলো৷ ডক্টর লুবনা জানালেন, রেগুলার চেক আপে রাখতে আর ভয় না পেতে৷ আজকাল চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব উন্নত। ইমাদ ইনশাআল্লাহ রিকোভার করবে৷
মিরা শতভাগ নিশ্চিত তার ছেলে সুস্থ আছে৷ ভবিষ্যতেও সুস্থ থাকবে৷ সৃষ্টিকর্তা তার পরীক্ষা নিচ্ছে। তাকে মেয়ে হিসেবে সহনশক্তির পরীক্ষা দিতে হয়েছে৷ স্ত্রী হিসেবে ধৈর্য্যশক্তির পরীক্ষা দিতে হয়েছে৷ এখন মা হয়ে পরীক্ষা দিবে সে। পরের দিন থেকে শুরু হলো নতুন সংগ্রামী জীবন। এবারের সংগ্রামের দিনে সে ইমানকে সর্বদা পাশে পেয়েছে৷ মিরা তার চাকরিটা ছেড়ে দিল৷ আপাতত এই মূহুর্তে তাকে খুব কেয়ারফুলি ইমাদের যত্ন নিতে হবে৷ মেডিসিনের এক ডোজও এক মিনিট পরে খাওয়াবে না৷ বাসার হাসি-খুশি পরিবেশ যেন মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে যাওয়া ছাই হয়ে গেল। মিরার বাবা পরেরদিনই ইমাদকে দেখতে আসলেন। আজ কেউ কোনধরনের তর্কে জড়ালো না। কিন্তু মিরা তার সাথে কোন কথা বলেনি। এরপর দেখা গেল প্রতিদিনই কোন না কোন আত্মীয় আসছে দেখা করতে। সবাই দুঃখ প্রকাশ করছে৷ সান্ত্বনাবাণী দিচ্ছে৷ ওই সব সান্ত্বনাবাণী ইমান আর মিরার জন্য ছিল বিষভরা কাঁটা। দুর্বিষহ রাত গুলোতে অজস্র চোখের পানি ফেলতে লাগলো মিরা৷ দু’জনেরই রাতের ঘুম হারিয়ে যায় কোন এক চোরাবালির কবলে পরে৷
___________________
জহির সাহেব ও হাসনাহেনা যেদিন বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে পৌঁছে, ঠিক তার আগেরদিন হুট করে ইমাদ গুরুতর অসুস্থ হলো। হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আবারও। এয়ারপোর্টে তাদের সাদ একা আনতে গিয়েছিল। ইমাদের হাসপাতালে ভর্তির কথা শুনে হাসনাহেনা তার বাড়িতে যেতে চাইল না৷ বরং সরাসরি হাসপাতালের দিকে যায় তারা৷ জহির খান আর হাসনাহেনা হাসপাতালে যেতেই ইমানের সঙ্গে দেখা হলো। ইমান তাদের দেখে এগিয়ে এসে বলে, ” কেমন আছো বাবা?”
জহির খান ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে। কতদিন পর বাবা বলে ডাকলো ছেলে! ছেলেটার চেহারার দিকে তাকালো যাচ্ছে না। চোখের নিচে কালি জমে গেছে৷ নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারে না। তারা দু’জন প্রথমবার সরাসরি নিজের নাতিকে হাসপাতাল বেডে দেখল৷ হাসনাহেনা মুখ চেপে কেঁদে অনেকক্ষণ ইমাদের হাত ধরে বসে থাকলেন। এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার চেহারায় এতো মায়া! আসামাত্র কতো কিছু জিজ্ঞাসা করলো দাদা-দাদীকে। সে নাকি ফেসবুকে তাদের ছবি দেখে প্রায়। ইমাদ জেগে থাকতে থাকতে দাদা-দাদীর সঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলত। ভাসা ভাসা চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সে আরোও অনেক গল্প করতে চাচ্ছিল অসুস্থ জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও সে জানায় তার ফেসবুক একাউন্ট খোলার খুব ইচ্ছা৷ কিন্তু আম্মু তাকে ফেসবুক খুলে দিবে না। এটাও জানালো তার ভীষণ মাথাব্যথা করছে। চোখ খুলে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। তার কিছুক্ষণ পর নার্স এসে ইঞ্জেকশন পুশ করল। হাসনাহেনা অবাক হয়ে দেখল এইটুকু একটা বাচ্চা অথচ ইঞ্জেকশন পুশ করার সময় একবিন্দু ভয় পেল না৷ একটু পর সে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থেকে সে চোখ দিয়ে পানি ফেলে। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন বুকে?
সন্ধ্যার পর জহির খান আর হাসনাহেনাকে জোর করে সুপ্তি বেগম বাসায় আনলেন৷ সঙ্গে ইমানও আসলো৷ মানুষ গুলো এতো দূর জার্নি করে এসে সোজা হাসপাতাল গিয়েছে৷ খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, ফ্রেস হওয়া নেই ওভাবেই পরে ছিল নাতির সঙ্গে। জহির সাহেব তো আসতেই চাচ্ছিলেন না। ইমান জোরাজোরি করে আনলো। গাড়িতে তারা খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলল যেন তাদের মধ্যে কখনোই কোনদিন কোন ঝগড়া, ঝামেলা ছিল না৷
জহির সাহেব থমথমে গলায় বলে, ” ডাক্তার কী বলছে? ”
ইমান ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়ে বলে, ” ডাক্তার তো তেমন কিছু পজিটিভ কথা বলছে না। টেস্টের ওপর টেস্ট দিয়েই চলেছেন।”
জহির খান উত্তেজিত হয়ে গেল এবং বলল, ” তুমি ওকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ট্রাই করছো না কেন? আমেরিকা নিয়ে আসো। আমাদের কী টাকার অভাব আছে? এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আমার আস্থা নাই।”
ইমান বলে উঠে, ” বিগত পনের দিন তো ভালোই চলছিল সবকিছু। আমি চেষ্টা করছি। খুব শ্রীঘ্রই ওকে নিউইয়র্ক নিয়ে যাব৷”
বাসায় এসে গোসল সেড়ে হাসনাহেনা ভাত খেলেন। যদিও গলা দিয়ে ভাত নামছিল না। তাও জোর করে খেয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলেন৷ বারান্দায় ঢুকতেই তার বুক মুচড়ে উঠে। বারান্দায় একপাশে খেলনা দু’টো গাড়ি পরে আছে। তার আরেক পাশে খেলনা সুপারম্যান পুতুল৷ নিশ্চয়ই এগুলো দিয়ে তার নাতি খেলা-ধুলা করে৷ একটু পর ইমান নিজে চা নিয়ে আসলো। তার হাতে চা দিয়ে বারান্দার ফ্লোরে বসে ধপ করে ইমান। হাসনাহেনা মোড়ায় বসে ছিলেন৷ ইমান খেলনা গুলোর দিকে তাকিয়ে বেদনাভরা কণ্ঠে বলে,” পড়শু দিনও ইমাদ সুস্থ ছিল৷ মেডিসিন চলছিল৷ আর আজকে…….. ”
তার গলা ধরে আসলো। সে হাসনাহেনার চোখে চোখ রেখে কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না৷ ক্ষণেই সে হাসনাহেনার হাঁটুতে মাথা রেখে প্রায় কেঁদে উঠে বললো, ” মা, আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আর পারছি না, মা। কেন বারবার আমার সাথেই এমন হয়? কেন? আচ্ছা আমি কী খুব খারাপ একটা মানুষ? সৃষ্টিকর্তা কী আমায় পাপের শাস্তি দিচ্ছে? মা, আমার আদরের ছেলেটার সঙ্গে কেন এমন হলো? সবই তো ঠিক চলছিল। কেন? কেন সৃষ্টিকর্তা আমার সঙ্গে এমন করলো?”
হাসনাহেনা থমকে যায় ইমানের মুখে “মা” ডাক শুনে। সে কম্পনরত হাতে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” ধৈর্য্য ধরো বাবা। সব ঠিক করে দিবে সৃষ্টিকর্তা।”
–” আর কী-ই বা ঠিক হবে? ”
বলেই ইমান থামলো এরপর করুণ গলায় বলে, ” ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে তাদের পক্ষে কিছু করা পসিবেল না৷”
হাসনাহেনার বুক ধুক করে উঠলেও সে শক্ত হয়ে বলে, ” এক ডাক্তার পারবে না বললেই কী হলো নাকি? পৃথিবীতে আরোও অনেক ডাক্তার আছে৷ আমরা বেস্ট ডাক্তার দেখাবো। সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। তুমি শক্ত হও। তাহলে মিরা আর ইমাদকে কে সামলাবে? ”
ইমান হাসনাহেনার হাঁটুতে মাথা লুকিয়ে চোখের পানি ফেললো৷ এই কান্নাটা তার জন্য খুব দরকার ছিল৷ মন হাল্কা করার প্রয়োজন ছিল৷ মন হাল্কা নাহলে নিজেকে পাথরের মতো মজবুত রাখা সম্ভব হচ্ছিল না৷
জহির খান আড়াল থেকে সবটা শুনল। সে দ্রুত রুমে ফিরে এলো এবং ওযু করে জায়নামাজ বের করে। জায়নামাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক দূরের আত্মীয়ের মতো। বাংলাদেশে থাকতে তাও যা জায়নামাজের ভাঁজ খোলা হত৷ কিন্তু নিউইয়র্ক গিয়ে তা একদমই হত না৷ কিন্তু আজ সে হাজার পাপিষ্ঠ হলেও সৃষ্টিকর্তার করুণা চায়। তার দরবারে কাঁদতে চান তিনি৷ জীবনে এখন একটাই চাওয়া তার — তার নাতি ইমাদ যেন পুরাপুরি সুস্থ হয়ে যায়৷
বিশ দিনের মাথায় ইমাদকে নিউইয়র্ক নিয়ে যাওয়ার সকল অফিশিয়াল কাজ সম্পন্ন হয়৷ এই বিশদিনে ওর হেলথ কন্ডিশনের উন্নতি হয়নি। বিশ দিনের মধ্যে পনের দিনই সে হাসপাতালে ভর্তি ছিল৷ ইমান খুব দ্রুত টিকিটও কেটে ফেলল। একটা মিনিটও তারা অপচয় করতে চায় না। হাসনাহেনা-জহির খান, সাদ তারাও ইমাদকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছে৷ তাদের সঙ্গে ইমান-মিরাও যাচ্ছে। আবারও নিউইয়র্কে। একটা নতুন আশা বুকে চেপে নিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধানে সমুদ্র তের নদী অতিক্রম করতে যাচ্ছে।
যাওয়ার দিন সুপ্তি বেগম খুব কাঁদছিলেন৷ ইমাদের শরীর তখন খুব একটা ভালো না। নাদুসনুদুস শরীরটা শুকিয়ে গেছে৷ ইমাদ খুব অবাক হয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে সি অফ করতে অনেকেই এসেছে। তাদের স্কুলের সবচেয়ে রাগী ম্যাথ মিস সহ আরো চারজন স্যার-ম্যাডাম৷ তার কয়েকজন ক্লাসমেট এসেছে৷ প্রত্যকেই তাকে “গেট ওয়েল সুন” কার্ড দিয়েছে৷ কিন্তু সৃজা আসেনি৷ ইমাদ বার কয়েক খুঁজলো তাকে। পেল না। নানাভাই ও এসেছে এবং বাবার হাত ধরে খুব আকুতিভরা কণ্ঠে কিছু বলছে৷ নানাভাই হাত দুটো এক করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করলে বাবা সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে ধরে কিসব বলল। ইমাদ দূর থেকে শুনতে পায়নি৷ অপরদিকে তিনজন বিদেশী মানুষও এসেছে৷ ওনাদের মধ্যে মাঝেরজন তার খালামনি হয়৷ যদিও বা ইমাদ সোনালী খালামনি ছাড়া আর কাউকেই খালা হিসেবে ডাকে না কিন্তু এই মানুষটাকে তার পছন্দ হয়েছে৷ একবার হাসপাতালে তাকে দেখতে এসে বলেছিল, ” আমি যদি আগে তোমার সাথে মিট করতাম তাইলে তোমাকেই বিয়ে করে নিতাম৷ এই যে মিষ্টার তুমি এতো হ্যান্ডসাম কেন শুনি? ”
ইমাদের খুব লজ্জা লেগেছিল আবার আনন্দও হচ্ছিল। ওর বহুদিনের শখ ছিল হ্যান্ডসাম হওয়ার। ইমাদ নানির কাছে ছুটে গিয়ে টুপ করে চুমু খেল এরপর গম্ভীর মুখ করে বলে, ” নানিমনি তুমি নিজের খেয়াল রাখবে। মিমোকে বলবে আমার খেলনায় যেন হাত না দেয়৷”
সুপ্তি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ” আচ্ছা আমার সোনাপাখি।”
ইরা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। ইমাদ বুঝতে পারছে তার বড় ধরনের কোন অসুখ করেছে কিন্তু আম্মু তাকে এসব জানাচ্ছে না৷ তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য আরোও হাজির হয়েছিল । তার বড় নানুও এসেছে। সবার কাছ থেকে বিদাই নিয়ে সে বাবা-মায়ের হাত ধরে এয়ারপোর্টের ভেতর দিকে হাঁটা ধরে। সে তবুও পেছনে ফিরে সবাইকে দেখে নিল। সৃজা শেষ সময়ে তাকে সি অফ করতে এলো কীনা এটাও একবার চেক করে নিল । কিন্তু সৃজার দেখা মিলল না।
সুপ্তি বেগম দাঁড়িয়ে রইলেন মূর্তির মতো শক্ত হয়ে৷ ইমাদকে তার দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে প্রবেশ করেছে তারা৷ ইরা তাকিয়ে থেকে বলে, ” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা। বুক ফেটে যাচ্ছে৷”
তখনই সৃজা এবং তার মা ডক্টর লুবনা এসে উপস্থিত হলো। ইরা জানালো ইমাদরা ভেতরে প্রবেশ করেছে৷ সম্ভবত তার সঙ্গে দেখা হবে না। সৃজা মন খারাপ করে তার মায়ের দিকে তাকালো। লুবনা অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকালো।
ইরা সৃজার গালে হাত রেখে বলে, ” মন খারাপ করো না। ইমাদ যখন ফিরে আসবে তখন আবার দেখা করো৷”
ডক্টর লুবনা আকাশের দিকে তাকালো। সে নিজে একজন ডক্টর। ইমাদের রিপোর্ট খুটিনাটি সব মুখস্থ করেছে৷ সবসময়ই নেগেটিভ কিছুরই আভাস পেয়ে আসছে৷ তবুও করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করে, যেন অসম্ভব কিছু ঘটে৷ মিরাকেল কিছু হোক।
আকাশভর্তি ঘন কালো মেঘ। বিজলি চমকাচ্ছিল। ধুলো বাতাসের তোড়ে চোখে ধুলো ঢুকে জ্বালা করা শুরু করল৷ ডক্টর লুবনার চোখ দিয়ে মেয়ের ক্লাসমেটের জন্য চোখের জল গড়িয়ে পরে৷
__________________________
পরিশিষ্টঃ
সেদিন ওয়েদার খুব খারাপ ছিল। যেকোন সময় স্নোফল শুরু হবে। সাদ ফোন করে জানালো আজকে আসতে পারবে না। চেম্বারেই থেকে যাবে৷ রুগীর সিরিয়াল প্রচুর৷ কাল সকাল সকাল ওয়েদার ভালো থাকলে রওনা দিবে।
ইরা ফোনের মধ্যেই তাকে ঝাড়তে লাগলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” আসছে আমার সাইকোলজিস্ট রে! তুই ছাড়া এই নিউইয়র্কে আর বুঝি কোন সাইকোলজিস্ট নাই? কালকেও তুই লেইটে বাসায় আসছিলি। পড়শু ফ্রেন্ডের সঙ্গে পার্টি করে রাত একটায় আসলি।”
সাদ আর শুনে নি। ফোন কেটে দিয়েছে৷ ইরা এবং তার দম্পত্য জীবন ভালোই কাটছে। শুধু ইরা রেগে গেলে তাকে তুই বলে ডাকে। এছাড়া তাদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই। তারা হ্যাপিলি ম্যারিড কাপল৷ সাদ ফোন রেখে এসিস্ট্যান্টকে পরবর্তী রোগীর হিস্ট্রি ফাইল দিয়ে যেতে বললো৷
ইমান গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় ফিরল সন্ধ্যা সাতটায়৷ মিরাকে প্রমিজ করেছিল আজ জলদি ফিরবে৷ মিরা তাকে কী যেন বলবে তাই ইমানের মূল্যবান সময় চাই তার। এজন্য সে প্রমিজ করেছিল পাঁচটার আগেই আসবে৷ কিন্তু অফিসে চাপ ছিল৷ জুই আর রবার্ট দশমবারের মতো হানিমুনে গেছে৷ পিটার আর জুই তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর অনুরোধ করে পুনরায় অফিসে জয়েন্ট করতে। ইমান আর না করেনি৷ ওদের দু’জনের অবর্তমানে সব কাজের চাপ তার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ সে বাড়ি ফিরতেই হাসনাহেনা গেইট খুলে দিয়ে বলে, ” বাবা রে আজকে তোমার কপালে শনি আছে৷”
–” মিরা আবার রেগে গেছে মা?”
–” তা নয়তো কী? তুমি পাঁচটায় আসবে বলে আসো নি জন্য ও নাক ফুলিয়ে স্নোবুট পরে তোমার বাবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে৷”
–” বাবা ওকে কেন গাড়ির চাবি দিল?”
হাসনাহেনা বলে উঠে, ” তুমি তো জানোই, তোমার বাবা তার বড় পুত্রবধূকে কতোটা স্নেহ করে৷ মিরাকে সে কোনদিন না করবে না।”
ইমান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে৷ হাসনাহেনা এক গ্লাস জুস এগিয়ে দিল। সে জুস খেয়েই বললো, ” যাই শেহজাদীর রাগ ভাঙ্গিয়ে আনি৷”
হাসনাহেনা হাসলেন৷ ইমান জানে মিরা কোথায় কোথায় যেতে পারে৷ সে গাড়ি বের করল। বরফ পরতে শুরু করেছে। পেঁচা তুলোর মতো নরম বরফ হাওয়ায় ভাসছে। পাশের বাসার ইটালিয়ান ফ্যামিলির কর্তা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার ওয়াইফ আবারোও রাগ করে বেরিয়ে গেছে? ”
–” ইয়েস৷”
ইমান যখন ব্রুকলিন ব্রীজের সামনে এসে থামে তখন রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে৷ তবে এখনো সেইভাবে তুষারপাত শুরু হয়নি।ওয়েদার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে গভীর রাতে তুষার ঝড় বইবে৷ ইমান মিরার নির্দিষ্ট প্রিয় জায়গাটায় এসে দাঁড়াতেই দেখল হার হাইনেস পেছনে ঘুরে বসে আছে। সে পিছনে থেকেই ওর চোখ তার হাত দিয়ে বন্ধ করে বলে, ” আমি যা দেখি তুমি কী তা দেখো?”
–” চোখ বন্ধ করে রাখলে কেউ কীভাবে দেখবে? ”
— হৃদয়ের আঁখি মেলে দেখবে৷ এবার বল আমি যা দেখি তুমি তা দেখো?”
— ” আপনি কী দেখছেন? ”
–” আমি দেখতে পাচ্ছি খুব চমৎকার একটা রাজপ্রাসাদ, যেখানে চারিদিকে ফুল আর ফুল। পাখি গান গায়। প্রজাপতি নেচে বেড়ায়। সেই রাজ্যের শেহজাদী সাদা একটা শাড়ি পড়ে রাজপ্রাসাদের পালিত পায়রা দিয়ে খেলছে এবং তার প্রহরী লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখছে। এবার বলো তো, তুমি কী সেই রাজকন্যাটাকে দেখতে পাও?”
–” না, পাই না।”
ইমান চোখ খুলে দিয়ে তার কপালে চুমু দিয়ে বলে, ” সর্যি ডিয়ার৷ আর লেইট করব না৷”
–” আচ্ছা ঠিক আছে৷”
— চল ফিরে যাই।”
–” কোথায়?”
–” ফেইরিটেলে যেখানে কোন দুঃখ, কষ্ট নেই।”
মিরা হাসল। দুজন গাড়ির সামনে হেঁটে আসল৷ ইমান বলে, ” তুমি আমাকে ফোনে বলেছিলে একটা গুড নিউজ দিবে৷ কী সেটা?”
মিরা সরাসরি তার চোখের দিকে তাকায়৷ ইমান বুঝল মেয়েটা নীরবে কাঁদছে। মেয়েটা এক জীবনে আর কত কাঁদবে?
মিরা বলে উঠে, ” ইমাদের আব্বু?”
ইমান যেন চমকে উঠে। একটা সময় “ইমাদের আব্বু” নাম ধরে ডাকলেই তার মুখে হাসি ফুটত। কিন্তু আজ দু’টো বছর পর এই সময়ে, বর্তমানে দাঁড়িয়ে এই নামটা তার বুকে খালি ব্যথা দেয়। জীবনটা অসার্থক লাগে। নিজেকে বড় অসহায় লাগে৷
তবুও সে হাসিমুখে বলে, ” বল?”
–” আজ একটা স্বপ্ন দেখলাম। খুব সুন্দর একটা বাগানে অনেকগুলো ছোট বাচ্চা ফুটবল খেলছে। আমাদের ইমাদও ছিল সেখানে। সে খেলায় এতো ব্যস্ত যে মায়ের দিকে তাকানোর সময় নেই তার। কী হাসছিল সে খেলার সময়। যেন আজ ঈদ লেগেছে তার মনে।”
এরপর নিজ থেকে সে কেঁদে উঠে বললো, ” ইমান আমি আর কাঁদতে চাই না। সুখে থাকতে চাই৷ আপনি প্লিজ আমার সব দুঃখ ঘুঁচিয়ে দিন। আপনার কল্পনা করা ওই ফেইরিটেলে নিয়ে যান যেখানে কোন দুঃখ-যন্ত্রণার অস্তিত্ব নেই।”
ইমান নীরবে তার গালে চিকচিক করা অশ্রু মুছে দিল। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মেয়েটার সঙ্গে সেও কাঁদছে৷ দু’বছর আগে, মৃত্যু নামক ভয়ানক এক দানব তাদের ছোট্ট বাবুটাকে মায়ের বুক থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে৷ ইমানের মনে হয়, মৃত্যুর কোন বিবেক নেই। মৃত্যুর উচিত ইমাদকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেওয়া। “সন্তান ” হারানোর মতো যন্ত্রণা এই দুনিয়ায় আর একটাও নেই৷ মানুষ বলে সবকিছুর রিপ্লেসমেট হয়৷ কিন্তু ইমান জানে দুনিয়াতে মা-বাবা আর সন্তানের কোন রিপ্লেসমেন্ট হয় না৷ তাদের মধ্যে কেউ একজন হারিয়ে গেলে আজীবন তাদের জায়গাটা শূন্য রয়ে যায়। তার শূন্যস্থানটা কারো সাধ্য নেই পূরণ করার! নিউইয়র্কে ইমাদের অপারেশন করানো হয়৷ সেই অপারেশনের পর বাহাত্তর ঘন্টা লাইফ সাপোর্টে থেকে ও হারিয়ে যায়। নিজে চলে যাওয়ার সঙ্গে মা-বাবার সব সুখ নিজের সাথে নিয়ে গেল৷
–” ইমাদের আব্বু?”
ইমান চমকে উঠে। প্রতিবার এই নামটা কানে আসলে সে ঠিক প্রথম দিনের ন্যায়ই কষ্ট পায়৷
মিরা তার বুকে মাথা রেখে আস্তে আস্তে বললো, ” ইমাদের ছোট্ট বোন আসতে চলেছে৷”
মিরার দেওয়া সুসংবাদটা শুনে ইমান বিষ্মিত হয়ে পরে। মুখে কিছু বলতে পারল না। কেবল প্রেয়সীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অনেক অনেক চাপা বেদনাভরা দীর্ঘ রজনীর পর বুঝি এতোদিনে সৃষ্টিকর্তা তাদের উপর করুণা করলো। তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের কালো ভয়ংকর আধার বুঝি ফুরিয়ে গেল। কাল নিশ্চয়ই তাদের জীবনে একটা নতুন সূর্যোদয় আসবে৷ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হবে তাদের জীবন। মিরা আবারও হাসবে মন থেকে। ছোট শিশুর হাসি-কান্নায় মৃত দেয়ালগুলোও মরে যেতে চাওয়া গাছে পানি দিয়ে সতেজ হওয়ার মতো সজীব হবে। তার খুব ইচ্ছা করছে এই চমৎকার মেয়েটাকে নিয়ে ভীনদেশে পাড়ি দিতে৷ অজানা কোন গন্তব্যে। কিংবা কোন ফেইরিটেলে? পৃথিবীতে আদৌ কোন ফেইরিটেলের অস্তিত্ব আছে? অস্তিত্ব থাকলে ইমান সেই ফেইরিটেলের ঠিকানা চায়।
বাসায় আসার পর হৈচৈ শুরু হয়ে গেল৷ ইরা সঙ্গে সঙ্গে পায়েস বানাতে শুরু করল৷ গুড নিউজ শোনার পর মিষ্টিমুখ করা দরকার। বাসার মানুষগুলো অনেকদিন পর আজ হাসলো। ইমান তার পরিবারের দিকে চেয়ে থাকল। সবাই মিরাকে ঘিরে রেখেছে৷ হাসনাহেনা নিজ হাতে জুস খাইয়ে দিচ্ছে। এতো এতো সুখের মধ্যেও ইমান অনুভব করে বুকের কোন এক কোণে শূন্যতা বিরাজ করছে৷
ঘন্টা তিনেকের মধ্যে নিউইয়র্কের বুকে তুষারপাত তাণ্ডব চালাতে শুরু করল৷ নিস্তব্ধ রাত৷ আপাতত এই নিশিরাতে নিউইয়র্ক নামক টুয়েন্টি ফোর আওয়ার জেগে থাকা সিটিটাকে গহীন কোন জঙ্গল ভেবে যে’কারো ভুল হতে পারে। নিউইয়র্কের মতো হাস্যজ্বল শহরের মন খারাপ হয়।
জীবন অদ্ভুত সুন্দর। হাজারও দুঃখ বুকে পুষে আমরা আগামীকালের আশায় থাকি। ভালো কিছু ঘটার আশায় আড়ি পেতে রই৷
~The End~
[ আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। দীর্ঘ এই যাত্রায় আমার পাশে থাকার জন্য অনেক ভালোবাসা সবাইকে। সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী৷ শেষবারের মতো, সবাইকে ভালোবাসা অবিরাম। ]