#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter
৪.
তখন ভোর ছয়টা বাজে ।
মিলি ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তারপর, ফজরের কাজা নামাজ আদায় করে ছাঁদে যাওয়ার জন্য ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রওনা হয়। একটিবারের জন্য মিলির শোয়েব নামক মানুষটার কথা মনে পরেনি।যদি মনে থাকত তবে সে বোধহয় ঘর থেকে বের হতো না।
মিলি যখন ছাঁদে গিয়ে পৌঁছায় তখনও চারদিকে আবছা আলো বিরাজ করছে। ভোরের এই সময়টা মিলির কাছে একান্তই ভালো লাগে। পরিবেশের শীতল আবহাওয়া যেন সে একাই উপভোগ করতে পারে।
ছাঁদের রেলিং ধারে গিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলো। রাস্তায় দু’একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে হয়তো তারা এতক্ষণ মসজিদে নামাজ আদায় করছিল।
মিলি যখন নীচের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক তখনি কে যেন মিলির হাত ধরে টেনে নিজের শরীরে সঙ্গে আবদ্ধ করে ফেলেছে। আকস্মিক ঘটনায়, মিলির অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে।
মিলির নাকে হটাৎ করে একটি মিষ্টি গন্ধ নাসরন্ধে অনুভব হয়। এই গন্ধটা মিলি এর আগেও পেয়েছে। মিলি যার কথা সে নয়তো। মিলি জোর করে সেই বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়।
মিলি অত্যন্ত রাগান্বিত সুরে কিছু একটা বলতে যাবে। তার আগে শোয়েব বলে উঠে,
— তুমি যে চূড়ান্ত পর্যায়ের বেয়াদব। এটা তুমি জানো?
নিজের সম্পর্কে এহেন কথা শুনে মিলির মাথায় যেন আগুন ধরে গিয়েছে। নিজের রাগটুকু চেপে রাখতে না পেরে মিলি চেচিয়ে উঠলো,
—হ্যা. আমি চূড়ান্ত পর্যায়ের বেয়াদব। আর আপনি কি?হুটহাট, আমাকে জরিয়ে ধরেন কেন? নাকি মেয়ে মানুষ দেখলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেন না?
মিলির মুখ থেকে এমন কথা আশা করেনি শোয়েব। আসলে ছাঁদ আসার পর সে দেখেছিল মিলি উপুড় হয়ে আছে যদি পরে টরে যায়। সেই ভয়ে মিলিকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসে। কিন্তু, মিলি যে ওকে আগের থেকে আরও বেশি ভুল বুঝেছে।
— দেখো মিলি। তুমি আমাকে যেমন ভাবছো আমি আসলে সেরকম ছেলে না। তোমাকে ছাঁদের রেলিংয়ের কাছে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।
মিলি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে ওর পুরো শরীর কাঁপছে। মন চাইছে শোয়েবকে আরও জঘন্য কিছু কথা বলতে। কিন্তু, মিলি চায় না। কারণ, দুদিন পর সে কুমিল্লায় চলে যাবে। আর কখনো এখানে আসবে না। তাহলে, বেশি কিছু বলে বাড়াবাড়ি করায় কোনো মানে হয় না।
মিলি শোয়েবের কথার প্রেক্ষিতে জবাব না দিয়ে ছাঁদ থেকে নেমে আসার জন্য পা বাড়ায়। শোয়েব সেটা দেখতে পেয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর পথ আঁটকে ধরে। মিলি থমকে দাঁড়ায়। শোয়েব নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে মিলিকে জিজ্ঞেস করে,
—রাতে প্যাকেটটা নিলে না কেন?জানো আমি সারারাত সিঁড়িতে বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি।
—আমার কি কোনো কিছুর কমতি আছে? যে আপনার কাছ থেকে আমার কাপড়-চোপড় নিয়ে পরতে হবে?
—কার কিসের কমতি আছে বলো,মিলি? কারো জীবনে কোনো কিছুর কমতি থাকে না। কিন্তু, হুট করে এমন এক কিছুর কমতি জীবনে এসে ধরা দেবে। যা চাইলে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ করা যায় না।
শোয়েবের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে মিলি কিছুটা শান্ত হয়ে যায়। সত্যিই তো! মানুষের জীবনে এমন অনেক কিছুর কমতি আছে। যেমন: মিলির জীবনের একটাই কমতি। ওর জীবনে মা নামক ছায়াটি নেই। আর চাইলেও এই কমতি কোনোদিনও পূরণ করা সম্ভব নয়।
—আপনার আর কিছু বলার আছে? আমি বাসায় যাব। খালা ঘুম থেকে জেগে উঠার পর আমাকে না দেখতে পেলে অস্থির হয়ে পরবেন।
মিলির মুখ থেকে এমন শক্ত কথা শুনে শোয়েবের পুরো কানে যেন কেউ তিতা করলার পানি ঢেলে দিয়েছে। এই মেয়েটা এমন কেমন?মিষ্টি করে দুটো কথা বললে কি হয়?
শোয়েব সেই আগের মতো মুডি এবং রাগী ভাব নিয়ে মিলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
— যা বলার মেসেজে বলেছি। বাকিটা তোমাকে অনুষ্ঠানে দেখার পর বলব। আল্লাহ হাফেজ।
শোয়েব শিষ বাজাতে বাজাতে ছাঁদ থেকে নেমে নীচে চলে যায়। আর মিলি সেই একইরকম ভাবে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মিলি আনমনা হয়ে ছাঁদ থেকে নেমে ফ্ল্যাটে চলে আসে। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ড্রইংরুম থেকে পুরুষ কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ায় মিলি।
গুটি গুটি পায়ে ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে। ওর খালা আর আরও একজন মহিলা এবং শোয়েব সোফায় বসে কি বিষয় নিয়ে আলাপ করছে।
মিলির উপস্থিতি টের পেয়ে তিনজনই মিলির দিকে তাকায়। মিলি জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে সেই অচেনা মহিলার দিকে তাকিয়ে সালাম জানায়। মহিলাটি মিলির দেয়া সালামের উত্তর দিয়ে বলে,
—এদিকে এসো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলি।
মিলি অবাক হয়ে যায় কারণ উনার সঙ্গে মিলির কি কথা থাকতে পারে? না চাওয়া সত্ত্বে মিলি গিয়ে ওর খালার পাশে গিয়ে বসে পরে।
তখনি, মহিলাটি মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—তুমি হয়তো আমাকে চিনতে পারছো না।
কিন্তু,আমি তোমাকে অনেক আগে থেকে চিনি।কারণ, তোমার খালা প্রতিনিয়ত তোমার কথা আমাকে বলে। আর আজ সামনাসামনি তোমাকে দেখেও নিলাম।
মিলি মহিলাটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি বিনিময় করে। এমন সময় মিলির নজর পরে শোয়েবের দিকে। শোয়েব মিলির দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে। মিলি চোখ নামিয়ে ফেললো।
—ও হচ্ছে আমার একমাত্র ছেলে সরফরাজ আহমেদ শোয়েব।
—ও ইনি তাহলে জল্লাদের মা। মা এত চমৎকারভাবে কথা বলে। আর ছেলে কিনা ছিনতাইকারীর মতো ব্যবহার করে!
মনে মনে কথাগুলো বলে মিলি। এমনসময় শোয়েব মিলির খালা জেসমিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—আন্টি, নূরী আপার রিসিপশনের ড্রেস কোড হচ্ছে। ব্ল্যাক এন্ড ওয়াইট। ছেলেদের কালো এবং মেয়েদের সাদা। তাই আব্বা সবার জন্য একই রঙের এবং ডিজাইনের ড্রেস চয়েজ করে এনেছেন। বয়সভেদে ডিজাইন আলাদা। আপনি এবং আপনার বোনের মেয়ে যদি এই ড্রেসগুলো একসেপ্ট করেন। তবে,আমরা সবাই অনেক খুশি হবো।
—কি যে বলো না শোয়েব? অবশ্যই একসেপ্ট করব। তোমরা ছাড়া আমার আর কেই বা আছে এই শহরে? জেসমিন বলে উঠলো।
—তাহলে, আমরা চলি দুপুর বারোটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকবেন। আমাদের গাড়িতে করে যাবেন আপনারা।
—ঠিক আছে, শোয়েব।
শোয়েবের মা এবং খালা আগে উঠে চলে গেলেন দরজার কাছে। এদিকে আমি আর শোয়েব একা। আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। কারণ, এই লোক কখন কি করে ঠিক নেই? ওমা উনি আবার দিকে আসছে কেন?
শোয়েব মিলির সামনে দাঁড়িয়ে খুবই কম আওয়াজে বললো,
— এবার তো তুমি আমার দেয়া ড্রেস না পরে থাকতে পারবে না, মিলি। কারণ, তুমি না পরতে চাইলেও তোমার খালা তোমাকে জোর করে পরিয়ে দিবে। বেস্ট অফ লাক। ওহ্, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। যেভাবে সেজে এসো না কেন? তোমার সাজ যেন তোমার খালার পরে আমি দেখতে পাই। সেজেগুজে সারা বিল্ডিংয়ে ঘুরে ছেলেদের দেখাতে যেও না আবার।
—শোয়েব??
শোয়েবের মা শোয়েবকে ডাক দিলে শোয়েব ড্রইংরুম ছেড়ে বের হয় যায়। আর মিলি সেখানে বসে দাঁত দিয়ে ওর নখ কাটতে থাকে।
এগারোটা বাজে গোসল শেষ করে ফেলে মিলি। তারপর, রুমে গিয়ে হেয়ার ডায়ার দিয়ে নিজের ভেজা চুল শুকিয়ে নেয়। কিছু সময় পর মিলির খালা এসে শোয়েবদের দেয়া মিলির ড্রেসটা এনে মিলির কাছে দিয়ে চলে যায়।মিলি দরজা লক করে এসে প্যাকেট হাতে নিয়ে খাটের ওপর বসে। তারপর,প্যাকেট খুলতেই বের হয়ে আসে একটি ঢাকাইয়া জামদানী সাদা শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউজ এবং পেটিকোট। সাদা পাথরের কানের ঝুমকো।সাদা স্টোনের দুই জোড়া হাতের চুড়ি।
—বাব্বাহ, এতগুলো জিনিস তাও আবার আমার জন্য! কিন্তু, কেন? গেস্টদের যদি দেয়ার কিছু থাকে তবে এতকিছু কেন দিতে হবে? থাক এই ব্যাপার নিয়ে পরে ভাববো আগে তৈরি হয়ে নেই। তারপর, চিন্তা করা যাবে।
মিলি সব চিন্তা একপাশে রেখে তৈরি হতে শুরু করে।
মিলির তৈরি হতে প্রায় একঘন্টা সময় লেগেছে। সাজ সম্পূর্ণ কমপ্লিট হবার পর মিলি ওর ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর, ওর খালার ঘরে গিয়ে দেখে ওর খালা সাদা এবং কালো মিশেলের শাড়ি এবং হিজাব পরে তৈরি।
—খালা, দেখো তো আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
মিলির কন্ঠ পেয়ে জেসমিন পেছনে ঘুরে দেখে মিলি দরজার সামনের দাঁড়িয়ে আছে। সাদা জামদানী, কানের ঝুমকো, হাতের চুড়িতে, চোখের কাজল এবং ঠোঁটের লিপস্টিকে এবং এলোমেলো চুলের হাত খোপায় মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। মুচকি হেসে মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় জেসমিন। তারপর, নিজের চোখের নীচ থেকে কিছুটা কাজল নিয়ে মিলির কানের পেছনে টিকা লাগিয়ে বললো,
—মাশাল্লাহ, কারো নজর যেন না লাগে!খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে।
— কম করে এপ্রিশিয়েট করো, খালা। আমার লজ্জা লাগছে।
মিলির লজ্জাসুরে বলা কথাগুলো শুনে জেসমিন হেসে ফেললো। তারপর, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
—চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ফ্ল্যাটের দরজা লক করে মিলির হাত ধরে এগিয়ে যায় জেসমিন। বিল্ডিংয়ের পার্কিং এরিয়ায় যেতেই সবাট সঙ্গে দেখা হয়। বিল্ডিংয়ের হাতেগোনা কয়েকজন যাচ্ছে নূরীর রিসিপশনে। মিলির খালা এগিয়ে গেলেন শোয়েবের মা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
এমন সময় মিলিকে দেখে ইরাবতী হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো,
— ও মাই গড। তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে মিলি!
—আউচ। দেখ ভাই শুধু শুধু মারবি না। আমার চুলের সেটিংটা তো দিলি নষ্ট করে।
ইরাবতী অভিমানী কন্ঠে শোয়েবের দিকে কথাটি ছুঁড়ে দেয়। শোয়েব বোনের অভিমান বুঝতে পেরে বলে,
—কারো সৌন্দর্য বা তার কাজের প্রশংসা করতে হলে মাশাআল্লাহ বলতে হয়।
—হুম। বুঝতে পেরেছি। তোমরা থাকো আমি যাই।
ইরাবতী চলে যেতেই শোয়েব মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—আমি তোমাকে দেখার আগে এই বিল্ডিংয়ের সবাই তোমাকে দেখে ফেলেছে! এখন, আমার তোমাকে কি করা দরকার বলো তো, মিলি???
মিলি শোয়েবের কথায় ভেতরে ভেতরে ভয় পায় কিন্তু প্রকাশ করে না। শোয়েব মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ভয়টুকু বুঝতে পারে। তাই আর কিছু না বলে এগিয়ে যায় ওদের ফ্ল্যাটের দিকে।
মিলি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে কারণ তখন গাড়ি আসেনি। কিছুসময় পর শোয়েব ফিরে আসে একটি কালো হিজাব নিয়ে। হিজাবটা এনে মিলির হাতে দিয়ে বললো,
— এই দিকটায় গিয়ে ডানপাশে ঘুরলে দেখবে ওয়াশরুম আছে। সেখানে গিয়ে সুন্দর করে হিজাব বেঁধে এসো। হিজাবের সঙ্গে পিন আছে। দেখে নিও।
মিলি শোয়েবের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মানে কি এই লোক তো একপ্রকার ওর ওপর নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিচ্ছে।
—কি হলো নিচ্ছো না কেন?নাকি কেউ এসে দেখুক আমি তোমার জন্য এখানে হিজাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
—আমি হিজাব পরব না। এত সুন্দর করে চুল বেঁধেছি কি হিজাব পরে ঢেকে রাখার জন্য?
— তাহলে কি নিজের সাদা পিঠ দেখিয়ে ছেলেদের নিজের দিকে আর্কষণ করার জন্য এভাবে চুলে খোঁপা করেছো? আমি যা বলেছি তাই করো। এখানে যারা আছে সবাই হিজাব বেঁধেছে শুধুমাত্র তুমি আর ইরাবতী বাদে। ইরাবতীকে হিজাব দিয়ে এসেছি। এবার তুমি পড়ে নেও। আমি অপেক্ষা করছি যাও।
শোয়েব শেষের কথাটুকু কিছুটা ধমক দিয়ে বলতেই মিলি শোয়েবের হাত থেকে হিজাব এবং পিন নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।
কিছু সময় পর মিলি ফিরে এসে দেখে কেউ নেই শুধুমাত্র শোয়েব ছাড়া। মিলি ভয়ে ঢোক গিলতে শুরু করে এবার কি করবে লোকটা?
—কি হয়েছে ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?সবাই চলে গেছে আমি আর তুমি বাদে। এতসময় লাগে একটা হিজাব বাঁধতে? এখন বাইক দিয়ে যেতে হবে।
মিলি শোয়েবের কথায় আরও বেশি চমকে যায়। মানে একি বাইকে খুব কাছাকাছি বসে লোকটার সঙ্গে যেতে হবে মিলির?
#চলবে