এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১৪

0
1273

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akther

১৪.

মেরুনরঙা শাড়ি, সাথে ম্যাচিং কিছু জুয়েলারী সহ যাবতীয় সবকিছু কেনাকাটা শেষ করে মিলিদের বাড়ির পথে রওনা হয় শোয়েব আর রাসেল।

বাড়িতে পৌঁছানোর পর শোয়েব দেখতে পায় বাড়িতে অচেনা কিছু মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। শপিংব্যাগ গুলো রাসেলের হাতে দিয়ে শোয়েব বাড়ির বাইরে চলে যায়। নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে থাকে।

কপালে তিন আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে শোয়েবের মনে হলো একটিবার মিলির সঙ্গে কথা বলার দরকার। যেহেতু আগে থেকেই ওর সাথে বনিবনা কম। অন্তত বিয়ে হওয়ার আগে সামনাসামনি মিলির সাথে আরও একবার কথা বলতেই হবে।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে মিলির নাম্বারে কল ডায়াল করলো শোয়েব। কল রিসিভ হলে ওপাশ থেকে কিছু মেয়ে মানুষের হাসির শব্দ শুনতে পায় শোয়েব। এরইমাঝে মিলির কন্ঠে হ্যালো শুনতে পায় শোয়েব। শোয়েব এক নিশ্বাসে বললো,

— মিলি তোমার সাথে দেখা করা যাবে? খুবই আর্জেন্ট। এখন তোমার সাথে আমার দেখা করা খুবই জরুরি। তুমি জলদি করে নীচে আমার গাড়ির কাছে এসো।

— সন্ধ্যার পরও কিন্তু কথা বলা যাবে। এখন কেউ যদি আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেখে তবে বিষয়টা অন্তত দৃষ্টিকটু দেখাবে।

মিলি বিরক্তিকর সুরে কথাটি বলে। শোয়েব তবুও অস্থির চিত্তে বলল,

— তোমার সাথে আমার দেখা করতেই হবে তাও আমাদের বিয়ের আগেই। তুমি না হয় বাড়ির বাইরে আসতে পারবে না। কিন্তু, আমি তো পারব। তোমাদের ছাঁদে চলে যাও পাঁচ মিনিটের মধ্যে। আমি আসছি।

কথাটি বলে কল কেটে দেয় শোয়েব। মিলি দুশ্চিন্তায় পরে যায়। কি এমন কথা যে বিয়ের আগেই বলতে হবে?

মিলি নিঝুমকে ইশারায় কাছে ডেকে কানে কানে কিছু বলতেই নিঝুম ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয়।

সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মিলি ওদের দোতলা বাড়ির ছাঁদে চলে যায়। ছাঁদের দরজা খুলে ভেতরে যেতেই শোয়েবের মুখটা দেখতে পায় মিলি।

মিলির উপস্থিতি টের পেয়ে যায় শোয়েব। মাথা উঁচু করে শোয়েব খুব ভালো করে তাকায় মিলির দিকে।

বিয়ের জন্য কিনে আনা মেরুন রঙের শাড়িটা এখন মিলির গায়ে জরিয়ে আছে। কানে একজোড়া স্বর্ণের দুল, গলায় নেকলস, নাকে ছোট্ট স্বর্নের নাকফুল।আর দুই হাতে দুইটা স্বর্ণের চিকন চুড়ি। একদম বৌ বৌ দেখাচ্ছে মিলিকে।

শোয়েব মিলিকে ডেকে এনে যা জিজ্ঞেস করবে বলে ভেবেছিল তা ভুলেই গেছে। এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় মিলির দিকে। শোয়েবের এভাবে হুট করে মিলির কাছে আসা দেখে মিলি ঘাবড়ে যায়। শাড়ির আঁচলের কোণা ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।

শোয়েব মিলির অনেকটা কাছে চলে যায়। যতটা কাছে এলে একে অপরের গায়ের মিষ্টি সুগন্ধি অনুভব করা যায়। শোয়েবের নেশাক্ত চাহনি দেখে মিলি ভয়ে ভয়ে ঢক গিলে বলে ফেললো,

— কিছু বলবেন, আপনি? নিঝুম অপেক্ষা করছে আমার জন্য। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হচ্ছে। সেদিকে খেয়াল আছে আপনার?

— তুমি আমার চোখের সামনে থাকলে আর কোনো কিছুতে খেয়াল রাখার প্রয়োজন নেই আমার। তুমি এতটা মোহনীয় কেন, মিলি?

শোয়েবের শেষের কথাটি শুনে মিলির পুরো শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যায়। চোখ তুলে তাকায় শোয়েবের দিকে। শোয়েব তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে।

মিলি এক পা পিছিয়ে নেয়। এখান থেকে চলে যাবে ভেবে মনস্থির করে। আরও এক কদম পা ফেলার আগে শোয়েব মিলিকে একটানে নিজের বুকে এনে বন্দি করে নেয়। ঠিক সেদিনের মতো যেদিন প্রথমবারের মতো মিলিকে শোয়েব দেখেছিল এবং নিজের এই বুকে ভয়ার্ত মিলি আশ্রয় নিয়েছিল।

মিলির বুক হৃদপিণ্ডের গতি অস্বাভাবিক গতিতে চলছে। প্রথমবার যদিও ভুল করে শোয়েবের বুকে আশ্রয় নিয়েছিল মিলি। কিন্তু, আজ স্বজ্ঞানে শোয়েবের এতটা কাছে এসে মিলির মনে হচ্ছে আজই বোধহয় এই পৃথিবীতে তার অন্তিম মূহুর্ত।

— আমার এই বুকে আমার প্রেয়শী হয়ে শুধু তুমি মাথা রাখতে পেরেছো মিলি। আমৃত্যু পর্যন্ত আমার এই বুকে যেন তোমারই বসবাস হয়। অন্য কেউ আসার আগেই যেন আমার এই দেহের মরণ হয়।

কথাটি বলে মিলির কপালে চুমু দিতে গিয়েও শোয়েব নিজেকে সামলে নেয়। এই যে মিলির অনুমতি বিহীন ওকে জড়িয়ে রেখেছে নিজের হৃদয়মাঝে। এটাই তো ভারি অন্যায় হয়েছে। সন্ধ্যার পর ওদের বিয়েটা একবার হোক। তখন মিলির ইচ্ছা থাকুক না আর না থাকুক গুনে গুনে ওর কপালে পনেরোটা চুমু খাবে বলে মনস্থির করেছে শোয়েব।

শোয়েবের হাতের বাঁধন হালকা হতেই মিলি শোয়েবের বুক থেকে সরে এসে এক দৌঁড়ে ছাঁদ থেকে নেমে চলে যায়। আর শোয়েব নিজের চুলে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে শেষ বিকেলের সিঁদুররঙা সূর্যের দিকে।

সন্ধ্যার পর যথাসময়ে শোয়েব আর মিলির আকদ সম্পন্ন হয়। মিলির বাবা আর শোয়েবের বাবা খুশি হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সমর্বধনা জানায়। শোয়েবের এই মূহুর্তটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে ও ঘুমিয়ে আছে। কেউ ডাক দিলে বুঝি এত মধুর ক্ষণ হারিয়ে যাবে শোয়েবের জীবন থেকে। মনে মনে অসংখ্য বার নিজের সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছে শোয়েব।

যেহেতু রাতেই শোয়েবের পরিবার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্য রওনা হবে। তাই খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর শোয়েবের সাথে মিলির দেখা করার জন্য আলাদা একটি রুমে দুজনকে নিয়ে যায় ইরাবতী আর নিঝুম মিলে।

শোয়েব আর মিলিকে খাটের ওপর পাশাপাশি বসিয়ে ইরাবতী আর নিঝুম রুম থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু, ওরা দুজন বাঁদরামি করে রুম বাইরে থেকে লক করে দেয়।

মিলি চুপ করে বসে আছে। একদম নববধূর মতো। দেখতেও মোমের পুতুলের মতো লাগছে মিলিকে। শোয়েব কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এতক্ষণ ধরে কতশত কথা মাথায় সাজিয়ে রেখেছিল। চলে যাওয়ার আগে মিলিকে এটা ওটা বলবে। কিন্তু, এখন সব ভুলে গিয়ে শুধু মিলিকে দেখতেই ভালো লাগছে শোয়েবের কাছে।

কিন্তু, কিছু তো বলতে হবেই। নিজের বিয়ে করা বৌকে আজ রেখে যেতে হবে। তাও আবার পনেরো দিনের জন্য। পৃথিবীর কোনো ছেলেকে এই দুঃখে জর্জরিত হতে হয়নি বোধহয় । যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পেয়েও এভাবে বিয়ের রাতে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যেতে হয়েছে। শোয়েবের তো এই দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, মিলি সামনে বলে কাঁদতে পারছে না।

— মিলি???

—হুম??

— আগামী পনেরো দিন আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো তুমি?

শোয়েবের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে মিলি কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারছে না। লোকটা বিয়ের খুশিতে আধ-পাগল হয়ে গেল কি না কে জানে?

— আমি এখন আপনার স্ত্রী। পনেরো দিন কেন পনেরো বছর পেরিয়ে গেলেও আমার আপনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

মিলির মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে আনন্দে মন ভরে ওঠে শোয়েবের। মিলি তবে ওদের বিয়েটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছে।

শোয়েবের বুক ভারি হয়ে আসছে কারণ বিদায়ের ঘন্টার বাজতে শুরু করেছে। শোয়েব মিলির হাত ধরে নিজের উরুর ওপর রাখলো। পকেট থেকে কিছু একটা বের করে মিলির অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দেয়। শোয়েব মিলির হাতটি নিজের ঠোঁটের কাছে এনে চুমু খায়।

কোনো পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া ঠোঁটের স্পর্শ এই প্রথমবারের মতো অনুভব করে মিলি। লজ্জা হোক বা সংকোচ শোয়েবের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে মিলি। শোয়েব মিলির ঘাড়ে হাত দিয়ে টেনে এনে ওর কপালে গুনে গুনে পনেরোটা চুমু দেয়।

চুমু দেয়া শেষ হলে শোয়েব মিলির কানে কানে বললো,

— পনেরো দিন পর তোমার আমার দেখা হবে। তাই পনেরো দিনের আমার কাছে থেকে তোমার পাওয়া হক গুলো আজই নগদে ফেরত দিলাম। যদি মরে টরে যাই তবুও তো বলতে পারবে, আমার কাছ থেকে পাওয়া এই পনেরোটা চুমু তুমি পেয়েছো।

মিলির বুকটায় কাঁটার মতো করে বিঁধে যখন শোয়েব ওর মৃত্যুর কথা বললো। লোকটা এমন কেন হুটহাট মুখে যা আসে তাই বলে! আজ এমন দিনেই কেন তার এই কথাটি বলতে হবে?

শোয়েব এই কথাটি বলে মিলির কানে স্ব-শব্দে চুমু খায়। আর এমন সময় দরজা ক্যাচ করে খুলে ভেতরে প্রবেশ করে নিঝুম আর ইরাবতী।

শোয়েব সেই আগের মতো বসে থাকলেও মিলি দূরে সরে বসে। ইরাবতী আর নিঝুম নতুন বর-কনের কান্ড দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here