এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১৫

0
1228

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

১৫.

নববধূকে রেখে রওনা হয় শোয়েবসহ ওর পরিবার। গাড়িতে বসে সেই মূহুর্তকে বারবার স্মরণ করছে শোয়েব। মিলি এখন আমার স্ত্রী এই কথাটি মনে পড়লেই আনন্দে বিমোহিত হয় শোয়েব।

শোয়েব চলে যাবার পর মিলি ওর ঘরে যেয়ে বসে আছে। খাটের ওপরে থাকা গিফট বক্সের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে ভাবে শোয়েব নামক ব্যক্তিটার কথা। কিভাবে হুট করে ওর জীবনে এসে ওর একজীবনের পুরো অর্ধেক অংশের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে সে।

এই যে চলে যাওয়ার সময় শোয়েব একবারও ওর দিকে তাকায়নি এই ব্যাপারটা কিন্তু মিলি ধরতে পেরেছে। কিছুটা অভিমান জমেছিল শোয়েব প্রতি কিন্তু গিফট বক্সের সাথে আসা চিরকুটটা পড়ার পর মিলির জমে থাকা সেই অভিমানটুকু আর অবশিষ্ট নেই।

মিলি আবারও চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে,

” এই যে শোয়েবের প্রেয়শী তুমি শুনছো?”

মিলি মাথা কাত করে সায় জানায়। মনে হচ্ছে
যেন শোয়েব ওর পাশে বসে ওকে প্রশ্ন করছে। আর মিলি ওর বলা প্রত্যেকটা কথা শুনছে।

“তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় নূরী আপার হলুদ সন্ধ্যায়। হলুদ শাড়ি পরে তুমি যখন তোমার কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলোকে বিরক্তি নিয়ে সামলাতে ব্যস্ত। ঠিক তখনি আমার চোখে তোমাকে দেখতে পাই। আপার বিয়ে এবং আমি একমাত্র ভাই বলে যেন আমার কাঁধে কাজের ভাগটা বেশি পরে। ডেকরেশনের জন্য আনা ফুল হাতে নিয়ে আমি শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার এটা অব্দি খেয়াল ছিল না যে আমার অতিদ্রুত কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। পরে ইরাবতী এসে আমাকে ডাক দিলে আমি তুমি নামক মন্ত্রের জাদু থেকে বের হয়ে আসি। সেদিন বলা চলে একেবারে ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু, কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার চোখের আয়নায় একটি মেয়ের মুখ ভেসে ওঠে। আর সেটাই হচ্ছো তুমি। মিলি আপার বিয়ের দিন তুমি আমাকে প্রথমাবরের মতো দেখেছো। কিন্তু, সেই সময়ে যা কিছু হয়েছে তার জন্য আমি কাউকে সরি বলব না। কারণ, আমি যা করেছি বেশ করেছি। তুমি শুধু শোয়েবের। তাই তোমাকে যদি আদর দিতে হয় তাও আমি দিব। আর যদি তোমার গায়ে একটু কাঁটার আঘাত লাগে তবে তাও যেন আমার হাতেই লাগে। অন্য কেউ এসে তোমাকে স্পর্শ করবে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। তুমি এমনিতেই আমাকে আড়ালে বা সবার সামনে সাইকো বলে ডাকো। তোমার মুখে এই ডাক শুনে আমার মাঝল কোনো পরিবর্তন হয় না। পুরনো কথা বাদ। এখন নতুন কথা বলি। আগামী পনেরো দিন পর তুমি যখন আমার কাছে চলে আসবে তখনই আমি পুরোপুরি শান্তি পাব। তাই বলছি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবে। অসুস্থ হওয়া চলবে না। কলেজে যাওয়ার সময় অবশ্যই তোমার বাবা মানে আমার শ্বশুরকে নয়তো মাহিমকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ছেলেদের কাছ থেকে চার ফুট দূরত্বে থাকবে। সর্বশেষ, বক্সে যা কিছু আছে। একেকদিন একেকটা ড্রেস পরে ছবি তুলে আমার মোবাইলে সেন্ড করবে। ঠিক আছে?

ইতি
তোমার শোয়েব ”

মিলি চিরকুটটা ভাজ করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে। “তোমার শোয়েব” শব্দটা যেন কোনোভাবেই মাথা থেকে সরতে চাইছে না।

চোখ বন্ধ করে মিলি একজনের কথা ভাবছে। তার বলা কথা, প্রতিশ্রুতি আজ সব নিজ হাতে ভঙ্গ করে মিলি শোয়েবের হাতে হাত রেখে বাকিটা পথ চলতে চায়। কি দরকার তাকে এবং তার কথাকে নিজের মাঝে আগলে রেখে ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়ার?

বক্সটা নিজের কাছে এনে একে একে ভেতরে থাকা সব প্যাকেট বের করে খাটের ওপর সাজিয়ে রাখে মিলি। তারপর, একটা একটা করে প্যাকেট খুলতে শুরু করে। এবং, প্রত্যেকটা প্যাকেট খুললেই শাড়ি বের হয়ে আসছে। বারোটি রঙের বারোটি শাড়ি। তারমধ্য দুইটা থ্রিপিছ আর অন্যটা লং কূর্তি। মিলি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকে। এমনও কেউ আছে কি? প্রত্যেকটা ড্রেসের কি বারে পরতে হবে তাও ছোট্ট কাগজে লিখে দিয়েছে শোয়েব ।

এমন সময় মিলির মোবাইলে মেসেজ আসে শোয়েবের মোবাইল থেকে।

” ঘুমিয়ে পরো। আমার কাছে এলে কিন্তু ঘুমাতে দিব না। কতশত জায়গায় তোমায় নিয়ে আমি ঘুরতে যাব। কতশত কথা সব তোমার কাছে জমা রাখব। একটু আগে বাসায় পৌঁছালাম চিন্তা করো না। আমি শ্বশুর মশাইকে বলে দিয়েছি। যে আমরা নারায়নগঞ্জ পৌঁছে গেছি। ”

মিলি মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রেখে মুচকি হেসে ওদের আকদের সময় তোলা ছবিগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

রাসেল চলে যায় এর পরদিন। ছোট দুই ভাই এবং একমাত্র বোন এবং বাবাকে রেখে যাওয়ার সময় রাসেলের মনে কি যে এক কাঁটা্যুক্ত অনুভব হয় তা একমাত্র প্রবাসীরা বলতে পারবে। যারা তাদের পরিবার, এবং ভালোবাসার মানুষকে রেখে ভিনদেশে পাড়ি জমায়।

নিঝুমের জন্য রাসেলের মন যে ভালোবাসাটুকু ছিল তা কখনোই নিঝুম উপলব্ধি করতে চায়নি কিংবা দেখেও না দেখার ভান করেছে।

প্রতিদিন রোজ বিকেলের সময়টাতে মিলি শোয়েবের কাছে ছবি পাঠায়। শোয়েব তখনও হসপিটালে রোগী দেখে। কাজের ফাঁকে যখন টুংটুং শব্দে মেসেজ আসে তখন শোয়েব সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে আড়ালে এসে তার প্রেয়সীকে দেখে। একেক শাড়িতে তার প্রেয়সীকে একেক রুপে দেখা যায়। এই যেমন আজ তার প্রেয়সীকে টিয়াপাখির মতো দেখাচ্ছে। কলাপাতা রঙা থ্রীপিছ পরনে, ঠোঁটে বোধহয় গাড় করে লাল লিপস্টিক দেয়া। শোয়েবকে ঘায়েল করার জন্য মিলির এতটুকু সাজই যথেষ্ট।

ওইদিকে ছাঁদে মোবাইল হাতে নিয়ে অপেক্ষারত মিলি জানেই না শোয়েব ওর রুপের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। কারণ, আজ সাতদিন ধরে রোজ এইসময়টাতে মিলি শোয়েবের মোবাইলে ছবি পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু, শোয়েব না কোনো রিপ্লাই দেয় না কোনো কল। এই ব্যাপারটা নিয়ে মিলির কেন যেন প্রচন্ড মন খারাপ হয়। কিন্তু, মিলি চায় না ওর মন খারাপ হোক। কিন্তু, বেহায়া মনটা যেন বিয়ের পর থেকে শোয়েবের দলে নিজের নাম লিখিয়েছে। থাকবে আমার দেহে কিন্তু শোয়েবের কথা ভাববে দিনরাত ।

ধীরে ধীরে সময় মিলির চলে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। শোয়েবের ব্যস্ততা আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে। মিলি ব্যস্ত না হলেও ওর ভীষণ মন খারাপ। কারণ, প্রত্যেকটা মেয়েরই এসময়টায় এসে বাঁধ ভাঙা কান্নারা এসে বুকে জমাট বেঁধে থাকে। যাদের কাছে জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠেছে সেই বাবা-মাকে, নিজের ভাই-বোনদের ছেড়ে একদিন চলে যেতে হয় অচেনা মানুষটার কাছে। সেই মানুষটা কেমন হবে? তার পরিবার কেমন হবে? এই বিষয়েগুলো ভাবতে ভাবতে মেয়েরা যেন আরও ভেঙে পরে।

হলুদের দিন সকালে সবাই একসাথে বসে রাসেলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। হয়তো, আজকের পর থেকে সবাই এভাবে একসাথে বসে কথা বলতে পারবে না।

কথা বলার ফাঁকে সবার চোখে জল চলে আসে। বিশেষ করে মাহতাব সাহেব এবং মাহিমের। কারণ, তাদের কাছে মিলি অনেক দামী। মিলি তো ওর ভাইদের চোখের পানি দেখল হিঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে। মিলির বাবা বা ভাইয়েরা কেউ ওর কান্না থামতে পারছিল না। ঠিক তখনি মাহিম কল দেয় শোয়েবের কাছে। শোয়েব ভিডিও কল রিসিভ করতেই দেখতে পায় তার হলুদিয়া বউটা কাঁদছে।

মিলির কান্না দেখল শোয়েবের মন খারাপ হয়ে যায়। তাই শোয়েব মিলিকে প্রশ্ন করে,

— কি হয়েছে কাঁদছো, কেন?

শোয়েবের কন্ঠ শুনে মিলির কান্না থেমে যায়। এদিকসেদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। শোয়েব আবার ওদের বাড়িতে চলে এলো কি-না এটা দেখার জন্য। মাহিম ওর বোনের কান্ড দেখে উচ্চ স্বরে হেসে হেসে বলছে,

— তোর জামাই আপাতত মোবাইল স্ক্রীনের ভেতরে। এদিকে তাকিয়ে দেখ।

মিলি মাহিমের মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখক সত্যি সত্যি শোয়েব লাইনে আছে। মিলি অস্বস্তিে পরে যায়। তবুও, শোয়েবকে বুঝতে না দিয়ে ওঠে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

শোয়েব মিলির রাগ বুঝতে পারে। মাহিমের কাছ থেকে জেনে নেয় মিলির কান্না করার কারন।

— কি দরকার এখন কথা বলার? কই এতদিন তো ঢের কথা বলা ছাড়াই থাকতে পেরেছে? আবার চিঠিতে উল্টাপাল্টা কথা লিখে আমাকে পটানোর ধান্দায় থাকে।

কথাগুলো নিজে নিজে বলে দরজায় খিল এঁটে বসে থাকে মিলি।

এমন সময় মিলির কাছে শোয়েবের ভয়েস রেকর্ডিং আসে। মিলি ফুল সাউন্ড দিয়ে শুনছে কই বলছে সাইকো সাহেব।

” আজ রাগ করে উল্টো দিকে ঘুরে চলে গিয়েছো। কিন্তু, আগামীকাল কি করবে? তখন, কিন্তু এভাবে রাগ করে এদিক সেদিকে যেতে পারবে না। আমি তোমাকে কোলে নিয়ে সারা ঘরে জুড়ে ঘুরে বেড়াব। তখন আমি দেখব তোমার রাগ কোথায় থাকে?”

মিলি চুপ হয়ে যায়। এ তো দেখছি রাগ দেখাতে যেয়ে উল্টো বলির পথে হাঁটতে শুরু করেছে সে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here