এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১৬

0
1258

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

১৬.

ফুল দিয়ে সাজানো খাটের মধ্যখানে বসে আছে মিলি। ওফ ওয়াইট রঙের লেহেঙ্গা, মাথায় ভারি কারুকাজের ওড়না। দুই হাতে ওয়াইট স্টোনের চুড়ি। মিলির কানে এবং গলায় শ্বাশুড়ির বিয়ের সময়কার গহনা পরনে। মরিয়ম খুশি হয়ে নিজের একমাত্র ছেলের বৌকে নিজের বিয়ের সমস্ত গহনা দিয়ে দিয়েছেন।

মিলি প্রায় আধঘন্টা যাবত বাসরঘরে বসে আছে। মনটা ভীষণ খারাপ। কারণ, আজ বাবা এবং ভাইদের ছেড়ে চলে এসেছে পরের বাড়িতে। মিলির মনে পরছে ফিরে আসার সময়ের কথা। ওর বাবা শোয়েবের হাত ধরে কিভাবে অঝোরে কাঁদছিল! বাকি দুইভাই মিলিকে যেতে দিতে চাচ্ছিল না। তারপর, মিলির চাচারা ওদের বুঝিয়ে শুনিয়ে মিলিকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মিলি নতুন সম্পর্ক এবং বরকে নিয়ে রওনা হয় নারায়ণগঞ্জের পথে। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছেতে পৌঁছেতে রাত প্রায় দশটা বেজে যায়।

নতুন বৌকে বরণ করে ঘরে তোলে মরিয়ম। ইরাবতী এগিয়ে এসে মিলিকে সাথে করে নিয়ে যায় ড্রইংরুমে। মিলিকে সোফায় বসিয়ে দেয়ার পর যেন ওকে দেখার জন্য মানুষের ঢল নামে। একের পর একজন আসছে মিলিকে একপলক দেখে যাচ্ছে। বেশিরভাগই এই বিল্ডিংয়ের ভাড়াটিয়ারা। কেউ কেউ তো বলেছে একমাত্র ছেলে, ডক্টর, নারায়ণগঞ্জে ফ্যাক্টরি আছে। সেই হিসেবে ছেলে আরও ভালো জায়গায় বিয়ে করতে পারত।

প্রতিউত্তরে শোয়েবের মা মরিয়ম মুচকি হেসে উত্তর দেয়।

— ছেলে সংসার করবে তার স্ত্রীর সঙ্গে। ছেলের পছন্দ মানে আমাদের পছন্দ। তাছাড়া, টাকা-পয়সা থাকলে কি হবে যদি আপনাদের মতো আমার ছেলের বৌয়ের মাথায় হিংসায় ভরপুর থাকে? যেই মেয়ে এনেছি না! আমার শোয়েবের উপযুক্ত বৌ হচ্ছে মিলি। এরচেয়ে বেটার ছেলের বৌ আমার বা আমার পরিবারের দরকার নেই। বৌ দেখতে এসেছেন, দেখে চলে যান।

শ্বাশুড়ির উত্তর শুনে মিলির আনন্দে মন ভরে ওঠে।

দরজার খটাখট শব্দ শুনে মিলির ধ্যানভঙ্গ হয়। ওড়নার ফাঁকে দেখতে পায় শোয়েব সবে রুমে ঢুকে দরজা লক করছে। ভেতরে ভেতরে মিলির কাঁপন ধরে যাচ্ছে। স্বামী নামক শোয়েব মানুষটা মানুষের মাঝে থেকে কত বেপরোয়া আচরণ করে। আর আজ তো সেখানে একই ছাঁদের নীচে দু’জনেই একা থাকবে।

শোয়েব রুমে ঢুকে সর্বপ্রথম কার্বাডের কাছ যায়। তারপর, কাবার্ড থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসে পাঁচ মিনিট বাদে।

ঘোমটার আড়ালে থাকা মিলি সবটাই দেখছে। ভয় এবং অস্বস্তি দুটোই আঁকড়ে ধরেছে।

হাতের ভেজা টাওয়াল ডিভানের ওপর রেখে শোয়েব ফের এগিয়ে যায় কার্বাডের দিকে। সেখান থেকে একটি নীল শাড়ি বের করে এনে মিলির দিকে বাড়িয়ে দেয়। মিলি ঘোমটার আড়ালে তাকিয়ে রইলো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে।

—ভারি ড্রেসে থাকলে অস্বস্তি লাগবে। ওই যে ডানপাশের দরজাটা দেখছো ওটাই ওয়াশরুম। ওয়াশরুমে যেয়ে এই শাড়িটা পরে এসো।

মিলি কাঁপাকাঁপা শোয়েবের হাত থেকে নীল শাড়ি হাতে নিয়ে খাট থেকে ধীর পায়ে নেমে যায়। মিলি যখন খাট থেকে নীচে দাঁড়ায় ঠিক তখনি শোয়েবের কান্ড দেখে মিলি ফ্রিজড হয়ে যায়।

শোয়েব মিলিকে কোলে তুলে নেয়। মিলি আকস্মিক ঘটনায় আহত দৃষ্টিতে তাকায় শোয়েবের দিকে। শোয়েব মিলির চোখের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। মিলি লজ্জা পেয়ে চোখ বুঁজে নেয়।

ওয়াশরুমের সামনে এসে মিলিকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় শোয়েব। তারপর,মিলির নাকে হালকা করে একটা টোকা দিয়ে বললো,

— আমি যদি পারতাম সারাদিন সারাক্ষণ তোমায় কোলে নিয়ে এখানে থেকে সেখানে নিয়ে যেতাম। কিন্তু, সবসময় তো আর পারব না। তাই আমি ঠিক করেছি যখনি আমি ঘরে থাকব। ঠিক তখন তোমাকে মাটিতে আর পা রাখতে দেব না। তুমি আমার কোলে থাকবে। যেখানে যাবে আমাকে বলবে আমি তোমাকে নিয়ে যাব। কথাটা যেন মনে থাকে, মন। এখন যাও ভেতরে। আমি অপেক্ষা করছি।

শোয়েবের পুরো কথা শুনে মিলির লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। লেহেঙ্গা দু-হাত দিয়ে আলগোছে ধরে ওয়াশরুমের ভেতরে যেয়ে দরজা লক করে দেয়।

এদিকে ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে মিলির জন্য অপেক্ষা করছে শোয়েব।

দশমিনিট পর মিলি বের হয়ে আসে একেবারে গোসল করে। দরজা খোলার শব্দ শুনে পেছনে ঘুরে তাকায় শোয়েব। ওমনি প্রতিদিনের মতো আজ মিলিকে দেখে প্রেমে পড়ে যায়। নীল শাড়ি, ভেজা চুলে আজই প্রথমবারের মতো দেখেছে মিলিকে। নীল শাড়ি পরনে এতটা সুন্দরও কি হুমায়ুন আহমেদের রচিত রুপাকে দেখা যেত?

এই একটা মানুষ যাকে যতবার শোয়েব দেখে ঠিক ততবার প্রেমে। একটা মানুষের প্রেমে কতভাবে প্রেমে পরা যায় তা সঠিকভাবে জানে না শোয়েব। জানতেও চায় না। শোয়েব শুধু জানে মিলি শুধুমাত্র তার।

মিলি ওয়াশরুমের বাইরে পা রাখতেই শোয়েব এগিয়ে এসে ধীরপায়ে মিলিকে পাজকোলে তুলে নেয়। মিলি শোয়েবের গলা জড়িয়ে ধরে দুই হাত দিয়ে।

মিলিকে খাটের ওপর বসিয়ে শোয়েব মিলির পাশে বসে পরে। মিলি সেই আগের মতো মাথা নিচু করে আছে। শোয়েব মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় অতিবাহিত হবার ওর শোয়েব গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আমার সাথে রাগ করে আছো নাকি লজ্জা পাচ্ছো?

মিলি মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। শোয়েব মিলির উত্তর বুঝতে পারেনি। তাই আবারও জিজ্ঞেস করে,

— রাগ করে আছো নাকি লজ্জা পাচ্ছো? এটাই জিজ্ঞেস করছি। তুমি মাথা নাড়িয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছো, মন?

— আমি আপনার ওপর রেগে আছি।

এতক্ষণ মিলির গলা শুনতে পায় শোয়েব। মুচকি হেসে শোয়েব বললো,

— রেগে থাকার কারণটা কি পনেরো দিন তোমার সাথে কথা বলিনি তার জন্য ?

— কথা বলেননি সমস্যা নেই। কিন্তু, টেক্সট তো করতে পারতেন। আমি আপনাকে গত পনেরো দিনে গুনে গুনে পনেরোটা ছবি দিয়েছি আপনার কথা অনুযায়ী। আপনি কি করেছেন! সিন করে রেখে দিয়েছেন।

মিলির কথায় রাগের আভাস পাচ্ছে শোয়েব। তাই আর কথা না বাড়িয়ে শোয়েব মিলির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

— ডক্টরদের ছুটি বলতে কোনো শব্দ আছে বলো তো, মন? বিয়ে করব আমি এবং আমারই ছুটির দরকার। তাই, কিছুদিন হসপিটালে রাতেও সময় দিয়েছি। যেন ছুটি কিছুদিন বাড়ানো যায়। বাট আমার কপাল খারাপ মাত্র তিনদিনের ছুটি পেয়েছি।

শোয়েব কথাগুলো বলে মিলির দিকে তাকায়. কিন্তু, মিলি সেই আগের মতো মুখ করে বসে আছে। শোয়েব দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলতে শুরু করে।

— তোমার দেয়া প্রত্যেকটা ছবি আমি সময় পেলে খুঁটিখুঁটিয়ে দেখেছি। যেমন ধরো তোমার ডান চোখের কোণায় একটা ছোট্ট লাল তিল আছে। এটাও আমি দেখেছি। শুধু তোমার কাছে কল করে এটাই বলতে পারিনি যে, মন তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল।

শোয়েবের কথায় মিলির মনের অন্তরালে জমানো অভিমান নিমিষেই হারিয়ে যায়। আর শোয়েবকে দেখানো রাগ টুকু ধীরে ধীরে কেটে যায়।

শোয়েব বুঝতে পেরেছে মিলির মন ভালো হয়ে গিয়েছে। সেই রাতটুকু কেটে যায় অজস্র গল্প শুনতে শুনতে। গল্পের শ্রোতা হিসেবে ছিল মিলি।

পরদিন সকালে দরজার খটাখট শব্দে শোয়েবের ঘুম ভেঙে যায়। শোয়েব পাশ ফিরে তাকাতেই ভয়ে আঁতকে ওঠে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মানে এটা কি করে সম্ভব!

মিলি ওর ঘরে এলো কি করে! মিলির তো ওদের বাড়িতে থাকার কথা। শোয়েব ভাবছে হয়তো সে ঘুমের ঘোরে মিলিকে দেখছে। তাই, খাট থেকে নেমে সোজা দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই হুরমুড় করে ইরাবতী আর নূরী ঘরে ঢুকে পরে। শোয়েব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর বোনদের দিকে। কারন, ওর বোনেরা কখনোই ওর ঘরে আসে না।কিন্তু, আজ কি হলো? যে সাতসকালে এই ঘরে চলে এলো!

শোয়েব চোখ ডলতে ডলতে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময়, নূরীর ডাক শুনে থেমে যায় শোয়েব।

—কি রে তোর বৌকে ডাক দে? পার্লারে যেতে হবে নয়টা বাজে।

শোয়েব অবাক হয়ে ওর আপাকে বললো,

— আপা তুমি কি আমার মতো পাগল হলে নাকি ? মিলি এখানে আসবে কোত্থেকে?

শোয়েবের কথা শুনে ইরাবতী আর নূরী একে অপরের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ওদের হাসির শব্দ শুনে মিলি ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আর শোয়েব বিরক্তিকর সুরে বললো,

— এখানে হাসির মতো কথা কি বললাম? যাও নিজেদের ঘরে যাও।

— কি হয়েছে? আপনারা সবাই হাসছেন কেন, আপা?

মিলির কন্ঠ পেয়ে নূরী আর ইরাবতী মিলির দিকে তাকায়। আর শোয়েব সে তো মনে হচ্ছে আজ সাত আসমান থেকে টুপ করে মাটিতে এসে পরেছে।

— মিলি, তুমি কি সত্যিই আমার ঘরে আছো?

সকাল সকাল শোয়েবের কাছ থেকে এমন উদ্ভট কথা শুনে মিলি বোকার মতো তাকিয়ে আছে। ইরবাতী আর নূরী হাসতে হাসতে দম আটকে মরে যাওয়ার উপক্রম।

ইরাবতী বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে মিলিকে সব কথা খুলে বলতেই মিলি ফিক করে হেসে দেয়।

এবার তিনজন একসাথে মিলে হাসতে থাকে। আর, শোয়েব লজ্জা পেয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।

ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শোয়েব নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে আনমনে বললো,

— এতদিন নিজের মনের গোড়া কল্পনায় তোমাকে নিয়ে ভেবেছি। তুমি আমার ঘরের কোথায় কিভাবে থাকবে। আর আজ যখন তুমি সত্যি এলে তখন আমি মনের ভ্রম ভেবে বসে আছি! কিছু মূহুর্ত এত ভালোলাগার মূহুর্ত হয় কেন? এই যে আজকের সকালের মতো এতদিন ভালো একটা সকাল আমার জীবনে এসেছিল কি? হয়তো, না। মন তুমি আমার জীবনে এসেই আমার প্রতিটি ক্ষণকে নিজ হাতে মধূর মতো মিষ্টতায় ভরে দিলে। আজকের সকালের মতোই যেন প্রতিটা সকাল হয় আমাদের।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here