এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-২১

0
1280

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

২১.

সে রাতে শোয়েব মিলির একে অপরের সঙ্গে দেখা হয়নি। বলতে গেলে একে অপরকে এড়িয়ে গেছে দুজনেই।

শোয়েবের ঘুম ভাঙে মসজিদের আযান শুনে। ফজর ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে। চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। ওযু সেড়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে দরজা লক করে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় পাঁচ মিনিট দূরত্বে থাকা মসজিদে। নামাজ শেষ করে আবারও ফ্ল্যাটে ফিরে যায় শোয়েব।

কি মনে করে শোয়েব নিজের ঘরে না যেয়ে মিলি যেই ঘরে আছে সে ঘরের দরজা বিনাশব্দে খুলে ভেতরে চলে যায়।

ভেতরে যেতেই দেখতে পেলো মিলি অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। দুচোখের কার্নিশে কান্নার ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। শোয়েব মিলির মুখের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায়।

শোয়েব আর না ঘুমিয়ে দুজনের জন্য নাশতা বানানো শুরু করে। মিলির জন্য এক্সট্রাভাবে তরমুজের জুস বানিয়ে রেখে দেয়। নাশতা বানানো শেষ হলে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালে দেখতে পায় তখন সময় সকাল সাতটা। সব খাবার এনে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখে নিজের ঘরে চলে যায় শোয়েব। একেবারে গোসল সেরে বের হতে হবে। আজ হসপিটালে যেতেই হবে।

গোসল শেষ করে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চমকে যায় শোয়েব। কারণ, মিলি ওর ঘরে ওরই খাটে এসে শুয়ে আছে। শোয়েব হাতের ভেজা টাওয়াল ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মিলির সামনে গিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,

— আমার ঘরে কেন এসেছো?

মিলি ক্লান্ত চোখে শোয়েবের দিকে তাকিয়ে বললো,

— হুট করে মাথা ঘুরছে। ঘর থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু, চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছিল। কোনোভাবে দেয়ালে হাতের ভর রেখে আপনার রুমে এসেছি।

মিলির কাছ থেকে সম্পূর্ণ কথা শুনে শোয়েব চুপসে যায়। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সোজা রান্নাঘর চলে যায়। আগে থেকে বানিয়ে রাখা তরমুজের জুস গ্লাসে ঢেলে মিলির জন্য নিয়ে আসে।

জুসের গ্লাসটি এনে মিলির সামনে বাড়িয়ে দিলে মিলি শোয়েবের দিকে তাকায় প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে। শোয়েব মিলির চাহনি দেখে উত্তর দেয়।

— তোমার জন্য বানিয়েছি। খেয়ে নাও ভালো লাগবে। ফ্রেশ না হয়ে থাকলে আমার সাথে ওয়াশরুমে চলো। আমি তোমাকে হ্যাল্প করব।

শেষের কথাটি মিনমিনে গলায় বলে শোয়েব। মিলি একবার ভাবছে শোয়েবের সাহায্য নিবে কিনা। আবার ভাবছে যদি শোয়েবের হ্যাল্প না নেয় আর মিলি দূঘর্টনা বসত পরে গিয়ে কোনো প্রবলেম হয়? তখন শোয়েব মিলিকে শ্যুট করে জানে মেরে ফেলবে। শেষমেষ মিলি শোয়েবের সাহায্য নিয়ে ওয়াশরুমে যায়।

শোয়েব মিলির হাত ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। তারপর, ঘরে থাকা নতুন ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে মিলিট দিকে বাড়িয়ে দেয়। মিলি শোয়েবের হাত থেকে ব্রাশ নিয়ে ধীরে ধীরে ব্রাশ করে হাত-মুখ ধুয়ে ফেলে। মিলি ফ্রেশ হলে শোয়েব মিলির হাত ধরে বের হয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে।

ঘরে আর না বসে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিংরুমে চলে যায়। টেবিলের সামনে এসে মিলির হাত ছেড়ে দেয় শোয়েব। মিলি একটি চেয়ার টেনে বসে পরে। শোয়েব মিলির মুখোমুখি চেয়ারে বসে একটি প্লেটে একটি ডিম সিদ্ধ, এক গ্লাস দুধ, দুটো রুটি, এবং কুমড়ো ভাজি দিয়ে এগিয়ে দেয় মিলির সামনে। মিলি এতকিছু খেতে হবে ভেবে মনে মনে ঢোক গিলছে। কিন্তু, কিছু বলতেও তো পারবে না।।

আস্তে আস্তে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে মিলি। শোয়েব দুটো রুটি খেয়ে এক গ্লাস দুধ পান করে চেয়ারে বসে বসে মোবাইল টিপছে। উদ্দেশ্য মিলির পাশে বসে থাকা। শোয়েব উঠে গেলে হয়তো মিলি সম্পুর্ন খাবার খেতে চাইবে না।

এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে।

শোয়েব ওঠে এসে দরজা খুলে দিতেই আনুমানিক চল্লিশ বছর বয়সী একজন মহিলা দেখতে পায়। শোয়েব মহিলাকে দেখার পর মুখে ভদ্রতার হাসি বজায় রেখে কি যেন আলাপ করে। মহিলাটি হাসিমুখে শোয়েবের প্রত্যেক কথায় সায় জানাচ্ছে।

মহিলাকে সাথে নিয়ে শোয়েব মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিলি একবার শোয়েবের দিকে আর একবার সেই মহিলার দিকে তাকায়। মিলিকে কোনো প্রশ্ন করতে হয়নি। তারআগে, শোয়েব মিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— উনি নাজমা মাহমুদ। উনি বাচ্চাদের এবং গর্ভবতী নারীর খেয়াল রাখেন। যেহেতু আমি সারাদিন বাসায় থাকতে পারব না। তাই নাজমা খালা তোমার খেয়াল রাখবেন যতক্ষণ পর্যন্ত আমি হসপিটাল থেকে ফিরে আসব।

— এত ঝামেলা করার কি আছে? আমাকে নারায়ণগঞ্জ দিয়ে আসুন না। আপনার মা আর ইরাবতী আছে না। উনাদের সাথে থাকলে বরং ভালো হতো।

কথাটি মিলি আনমনে বললো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাজমা খালা মুখটা কালো করে ফেলে। আর শোয়েব মিলির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মিলি শোয়েবের তাকানোর স্টাইল দেখে খাবারে মনোনিবেশ করে।

— খালা, আপনি মিলির খেয়াল রাখবেন। আমি আসছি। মিলি আমার বেবিদের খেয়াল রাখবে।

কথাটি বলে শোয়েব বের হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য।

শোয়েব চলে যাওয়ার পর মিলি খাবারের প্লেট ছেড়ে ওঠে দাঁড়াবে তারআগে নাজমা খালা দিল এক রামধমক। ব্যস, মিলি ফের খেতে বসলো।

বহু কষ্টে আধঘন্টা লাগিয়ে খাবার শেষ করে মিলি। নাজমা খালা মিলির মাথায় হাত রেখে বললেন,

— কষ্ট পেয়েছো? আমি কিন্তু তোমার আর তোমার বাচ্চাদের জন্য তোমাকে একটু ধমক দিয়েছি।

নাজমা খালার মুখ থেকে এমন আদুরে কথা শুনে মিলির মন ভরে ওঠে।

— কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু, এখন আর সেই কষ্টের লেশমাত্র নেই।

মিলির উত্তর শুনে নাজমা খালা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,

— শোয়েব, তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?

মিলি চুপ হয়ে যায়। কি উত্তর দেবে সে? আগে শোয়েব মিলিকে চোখে হারাতো, সবসময় আগলে রাখার কত আয়োজন ছিল তার। আর এখন নাকি বাচ্চাদের জন্য তাকে আগলে রাখছে। মিলি সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খালাকে বললো,

— হুম। অনেক ভালোবাসে আমাকে।

__________________

সময় যেতে থাকে। তখন মিলি আটমাসের অন্তঃসত্তা। মিলির আর শোয়েবের সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয় না। মিলির খাবার, কাপড়-চোপড় ধোয়া সহ সব কাজ শোয়েব করে। নাজমা খালা রোজ সকাল সাড়ে সাতটায় এসে ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়। খালা এলেই শোয়েব চলে যায়।

এমনই একদিন মিলি বারান্দায় বসে রাতের আকাশে মিটমিটিয়ে জ্বলতে থাকা তারাদের দিকে তাকিয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলছিল।

ঘরে বসে থাকা শোয়েব মিলির কান্ড দেখছে। মিলি আগের থেকে কতটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। মা হলে বুঝি একটি মেয়ের শরীরের সঙ্গে সঙ্গে, আচরণও বদলে যায়।

এমনসময় শোয়েব শুনতে পায় মিলি ওকে ডাকছে। প্রথমে মনের ভুল ভেবে কাজে মনোনিবেশ করে। কিন্তু, দ্বিতীয় বার ডাক শুনে শোয়েব চকিত নজরে তাকায় বারান্দায় থাকা মিলির দিকে। মিলি তাকে হাতের ইশারায় ডাকছে। শোয়েব মিলির এই আচরণের সঙ্গে একটুও পরিচিত নয়। কারণ, আজ চারমাস ধরে একই বাড়িতে, একই ছাঁদের নীচে থাকছে দু’জনে। শোয়েব যখন কথা বলে মিলি চুপটি করে শুনে। পাল্টা প্রশ্ন করে না। কিন্তু, আজ নিজ থেকে ডাকছে ব্যাপারটা কি?

শোয়েব বারান্দায় চলে যায়। মিলি শোয়েবকে দেখে হাসি দিয়ে বললো,

— ডক্টর সাহেবের সময় হবে আজ? গল্প করতে ইচ্ছে করছে।

এমন আবদার শুনে শোয়েব অবাক হয় ভীষন। শোয়েবকে আরও একধাপ অবাক করে দিয়ে মিলি শোয়েবের বামহাত ধরে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তারপর, আকাশের দিকে তাকিয়ে শোয়েবকে বললো,

— হয়তো, আর একমাস। তারপর আপনি আমাদের বেবিদের একজনকে নিয়ে যাবেন না। তাই না?

— হুম।

— কানাডায় চলে যাবেন?

মিলির মুখ থেকে “কানাডা” নামটি শুনে বিস্মিত হয়ে যায় শোয়েব। ও কানাডা চলে যাবে মিলি কি করে জানল?

— আমি জানি আপনি কানাডায় চলে যাবেন। গতকাল আপনার ড্রয়ার থেকে পরাসিটামল ট্যাবলেট আনতে যেয়ে পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজ দেখেছি আমি।

— কারো পারসোনাল কিছু দেখা বেয়াদবির উর্ধ্বে সেটা জানো তুমি?

— আমি চরিত্রহীনা সেটা তো জানেন। আর একটু না হয় বেয়াদব হলাম। শোয়েব, খুব কি জরুরি কানাডায় চলে যাওয়াটা ?

মিলির কথা শুনে শোয়েব চুপ হয়ে যায়। কি জবাব দেবে? লোক দেখানো সংসার নামক কারাগারে থাকতে শোয়েবের কোনো ইচ্ছে নেই।

— দেশে থাকলে তুমি মরিয়া হয়ে যাবে তোমার সন্তানকে দেখার জন্য। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি দেশের বাইরে চলে যাব।

— মানলাম আমি আমার সন্তানকে দেখতে মরিয়া হয়ে যাব। কিন্তু, আমার কাছে যেই সন্তান থাকবে তাকে দেখতে আপনার চোখ একবারও কি তৃষ্ণার্ত হবে না?

মিলির কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শোনার পর শোয়েবের পুরো দুনিয়া থমকে যায়। সত্যিই তো এক সন্তানকে নিয়ে না হয় সে ভিনদেশে থাকবে। কিন্তু, অন্য সন্তান যে তার মায়ের কাছে থাকবে। তাকে কি করে দেখবে শোয়েব?

মিলির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বারান্দা থেকে ঘরে চলে আসে শোয়েব। চোখ বুজে শুয়ে পরে থাকে বিছানায়। মাথায় হাজারো যন্ত্রণার কাঁটা এসে হানা দিচ্ছে।

মিলি মেকি হাসি দিয়ে আসমানের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমাকে আপনি সন্তান হারানোর কষ্টে জর্জরিত করতে চান। কিন্তু, একবারও ভাবেননি এই কষ্টে আপনাকেও ভুগতে হবে। আমাকে আপনি যতটা কষ্ট দিবেন তারচেয়ে বেশী কষ্ট পাবেন আপনি। কারণ, আমি জানি শোয়েবের জীবনে এখন তার সন্তানদের গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে বেশি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here