এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-২৩

0
1606

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

২৩.

শোয়েবের জ্ঞান ফিরে আসে। নিজের বেডের পাশে মা-বাবা এব বোনদের দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যায় শোয়েব। হটাৎ করেই মা মরিয়মের কান্না দেখতে পেয়ে শোয়েবের মনে পরে যায় তার মনের কথা।

তড়িঘড়ি করে বেড থেকে নামার চেষ্টা করলে শোয়েবের হাতে সূচালো ব্যাথা অনুভব করে। আহ্ বলে বাম হাতটি চেপে ধরে বেডে বসে পরে। উপস্থিত সবাই বিচলিত হয়ে পরে। মরিয়ম এগিয়ে এসে ছেলেকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে শোয়েব ক্ষীপ্ত হয়ে বললো,

— আমার মন কোথায় আছে, বলছো না কেন? আমাকে ছেড়ে দাও না মা। আমার মন আর আমার বেবিরা কেমন আছে?

শেষের কথাগুলো ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললো শোয়েব। মরিয়ম ছেলের এমন অবস্থা দেখে আরও ভেঙে পরেন। শাফায়াত আহমেদ এগিয়ে এলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,

— তোর দুটো মেয়ে হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।

শোয়েবে কিছুটা শান্ত হয়। তবুও মনের কোণায় খচখচানিটা বেড়েই চলেছে। শোয়েব এমন একটি ভাব করলো যেন মেয়েদের কথা সে শুনেনি। অবিরত ভাবে বারবার মিলির অবস্থান জানতে চাচ্ছে শোয়েব। শোয়েবের একগুয়েমির কারণে শাফায়াত আহমেদ একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মরিয়মকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— নিয়ে যাও ওকে।

মরিয়ম নার্সকে ডেকে এনে ছেলের হাতের স্যালাইন খুলে নেয়। তারপর, ছেলের একহাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন আইসিইউ পনেরো নাম্বার রুমে। শোয়েব আইসিইউর দরজার সামনে এসে ওর মায়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

— মা, আমার মন ঠিক আছে তো?

মরিয়ম আত্মবিশ্বাসী হয়ে শোয়েবের চোখে চোখ রেখে বললেন,

— তোর মন ভীষণ ভালো আছে। এই ধরণীতে নিশ্চিন্তে শ্বাস নিচ্ছে। ভেতরে চল।

এমনসময় ভেতরে থাকা একজন নার্স বাইরে বেরিয়ে এসে শোয়েবকে একটি ড্রেস পরিয়ে। যা শুধুমাত্র আইসিইউ এর ভেতরে গেলে পরিধান করতে হাইজিনিক ব্যাপারটা মেইনটেইন করার জন্য।

মরিয়ম বাইরে থেকে গেলেন। শোয়েব নার্সের সাথে চলে যায়। ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো চিকিৎসা ক্ষেত্রের অসংখ্য মেশিন। কোনোটায় হার্টবিট তো কোনোটায় ব্লাড প্রেশার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হসপিটালের বেডে সাদা চাদরে ফাঁকে একটি হাত বের হয়ে আছে।

ধীর পায়ে এগিয়ে যায় শোয়েব। যতই নিকটে যাচ্ছে ঠিক ততটাই ঘাবড়ে যাচ্ছে শোয়েব। বেডের অতি নিকটে পৌঁছানোর পর অক্সিজেন মাস্ক পরে থাকা মিলিকে দেখতে পেলো শোয়েব। হৃদয়ে যেন হটাৎ করে শান্তির জোয়ার বয়ে যায়।

শোয়েব মিলির শিয়রের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে মিলির কপালে হাত রেখে তিনবার মিলির নাম ধরে ডাকে। কিন্তু, মিলির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া আসে না।

এমনসময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটি শোয়েবকে জানালো,

— আপনার ওয়াইফ কোমায় চলে গিয়েছে।

শোয়েব যেন সাত আসমান থেকে এসে পৃথিবীতে আছড়ে পরেছে। নিজের কানদুটোকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না শোয়েবের। মিলির মুখের দিকে তাকায় শোয়েব। চোখদুটো দেবে গেছে। গাল শুকিয়ে হাড় বোঝা যাচ্ছে। শোয়েবের চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে।

— মিলি, এ কেমন প্রতিশোধের খেলায় তুমি মেতে ওঠেছো আমার সঙ্গে? যতবারই তোমাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে চেয়েছি। ঠিক ততবারই তুমি আমায় ফাঁকি দিয়েছো। আমাদের দুই মেয়ে কার দিকে তাকিয়ে বাঁচবে বলো? তুমি আমাকে শত কষ্ট দিয়ে গেলে কিছুই বলিনি। কিন্তু, আমার মেয়েদের এভাবে একলা রেখে কোথায় যাওয়ার পাঁয়তারা করছো তুমি? মন, মন রে তোমাকে ছাড়া আমি কি করে বাঁচব? আমি মরে যাব। মরে যাব আমি।

হাঁটু গেড়ে বসে চিৎকার দিয়ে বিলাপ করে কথাগুলো বলছিল শোয়েব। নার্স আরও একজন ডক্টর এসে শোয়েবকে জোর করে আইসিইউর বাইরে নিয়ে আসে। কিন্তু, শোয়েব বারবার জোর করে মিলির কাছে যেতে চাচ্ছিল।

এমনসময় একটি বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে থমকে যায় শোয়েব। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে ইরাবতীর কোলে দুটি বাচ্চা। শোয়েবের চাহনি বুঝতে পারে ইরাবতী। তাই ইরাবতী কান্নারত কন্ঠে তার ভাইকে বললো,

— ভাই তোমার মেয়েরা।

শোয়েব ডক্টরের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ইরাবতীর কাছে এগিয়ে যায়। সামনে যেতেই দেখলো, ফর্সা গায়ের রঙ, গাল দুটো লাল হয়ে আছে। কান্নায় ভেজা দুটো চোখ। মাঝে মাঝে ঠোঁট দুটো চোখা করে উপরের দিকে তাকায়।

শোয়েব হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় নিজের অংশদের। বুকের মাঝে চেপে ধরে জোরে শ্বাস নেয়। হয়তো বাবার গায়ের গন্ধ বুঝতে পারে তাই তো চুপটি করে বাবার বুকের সাথে মিশে আছে ওরা । শোয়েব নিজের মেয়েদের বুকে জরিয়ে বললো,

— আমার মেয়েরা কি কখনো ওদের মায়ের ছায়াতলে বড়ো হতে পারবো না? কি এমন অপরাধ করেছিলাম আমি, আল্লাহ? যে কারণে আমার এই দুটো নিষ্পাপ বাচ্চাদের কাছ থেকে ওদের মাকে কেড়ে নিতে চাই..ছো?

শোয়েব সেন্সলেস হয়ে পরে যাচ্ছিল। তার আগে নূরী এসে শোয়েবকে আগলে ধরে। আর, ইরাবতী নিজের ভাতিজিদের।

শোয়েবকে আবারও ডক্টরের আওতায় রাখা হয়।

—————

সেদিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন ধরাধরি করে মিলি এবং শোয়েবকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। শোয়েবের মোবাইল এক্সিডেন্ট এরিয়ায় পাওয়া যায় বলে শোয়েবের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সফল হয় ডক্টররা। কল করে শোয়েবের পরিবারকে জানানো হলে উনা আতংকগ্রস্থ হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়।

শোয়েবের পরিবার হসপিটালে এসে পৌঁছানোর পর দেখতে পেলেন শোয়েবকে একটি কেবিনে অবর্জারভেশনে রাখা হয়েছে। শাফায়াত আহমেদ ডক্টরের কাছ থেকে মিলির ব্যাপারে জানতে চাইলে উনারা জানান মিলির অবস্থা আশংকাজনক। ইমিডিয়েটলি সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে। নয়তো, বাচ্চাদের ক্ষতি হবে বলে জানায়। শাফায়াত আহমেদ অনুমতি দিয়ে বন্ড পেপারে সাইন করে দেন। এর পরপরই ডক্টররা মিলির সিজারিয়ান অপারেশন শুরু করে।

মিলির দুই মেয়ে সন্তান এলো পৃথিবীর মুখ আলো করে। বাচ্চারা দুজনই সুস্থ আছে। কিন্তু, ডক্টররা এরইমাঝে একটি দুঃসংবাদ জানালেন। মিলির মাথায় এক্সিডেন্টের কারণ ইন্টারনাল ব্লিডিং হয় যার দরুন ইমিডিয়েট আরও একটি জটিল অপারেশন করতে হবে তাও রাত বারোটার মধ্যে। ডক্টরের কাছ থেকে এমন দুঃসংবাদ জানার পর শোয়েবের পরিবারের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। একদিকে নিজের ছেলে অন্যদিকে পুত্রবধুর এমন পরিণতিতে সবাই যেন বাকহারা হয়ে যায়।

অপারেশন করার আগে ডক্টর সুনীল শাফায়ত আহমেদকে নিজের কেবিনে ডেকে এনে জানালেন,

— আপনার বৌমার অপারেশন কতটা সাকসেসফুল হবে আমরা জানি না। কিন্তু, শেষ অব্দি আমরা চেষ্টা করব যেন মিলি সুস্থ হয়ে আমাদের সকলের মাঝে ফিরে আসে।

— যদি অপারেশন সাকসেস না হয়?

— তবে মিলি কোমায় চলে যেতে পারে।

এমন কথা শুনে শাফায়াত আহমেদ আরও ভেঙে পরলেন। কি করবেন তিনি? ছেলের জ্ঞান আসার পর যদি মিলিকে দেখতে না পায় তবে ছেলে পাগল হয়ে যাবে।

মনের শত বাধা, কল্পনা এবং ভয়কে জয় করে শাফায়াত আহমেদ আবারও বন্ড পেপারে সাইন করে দিলেন।

দীর্ঘ সময় নিয়ে অপারেশন শেষ হলো শেষ রাতের দিকে। ডক্টররা বের হয়ে এলে শাফায়াত আহমেদকে জানায় যে অপারেশন সাকসেসফুল হয়নি। মিলি কোমায় চলে গিয়েছে। যদি ভাগ্যের জোরে কখনো সে এই পৃথিবীতে আবারও সেই আগের মতো বাঁচতে পারবে। নয়তো, একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে যাবে অসীম যাত্রায়।

পরদিন বিকেলে শোয়েবের জ্ঞান ফিরে আসে এবং জানতে পারে তার মন এখন কি অবস্থায় আছে?

একজন ভালোবাসার মানুষ যদি জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটি বেঁচে আছে। কিন্তু, কখনোই তার পাশে বসে গল্প করবে না। কিংবা তার হাতে হাত রেখে অজানা পথে পাড়ি দিবে না। কিংবা কখনো মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে প্রশংসার বাক্য ছুঁড়ে দেবে না।

তখন সেই মানুষটির কেমন অনুভূতি হয় আমরা কেউই তা উপলব্ধি করতে পারব না। যার চলে গেছে সে জানে হারানোর লাল নীল বেদনায় মানুষ কতটা ভেঙে পরে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here