এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-২৪

0
1800

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

২৪.

— কেমন আছো, মন? আমার ডাক শুনে তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না? আমার তো বড্ড ইচ্ছে করছে তোমার সাথে কথা বলতে। তোমার হাতে হাত রেখে দূর অজানায় পাড়ি দিতে। আগের মতো করে তোমার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “মন, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি”।

মিলির কপালে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো খুব যত্ন সহকারে কানের পিছে গুঁজে দেয় শোয়েব। উপুড় হয়ে মিলির কপালে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু একে দেয়।

–উূউূ আ.আ.আ

শব্দ শুনে শোয়েব সোজা হয়ে বসে। মেয়েদের একজন ঘুম থেকে জেগে ওঠেছে। তাই তো মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করছে। শোয়েব হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয় মেয়ে মেহনুবাকে। মেহনুবা দীর্ঘ সময় পর বাবার কোলে উঠতে পেরে খুশিতে দন্তবিহীন হাসি ফুটে ওঠেছে ওর মুখশ্রীতে।

শোয়েব মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বললো,

— বাবাকে মিস করছে??

— উু..উু।

— এত মিস করেছো আমায়! মায়ের সঙ্গে কথা বলেছো?

মেয়ে আর কোনো কথারই জবাব দেয় না। শোয়েব নিশ্চুপ হয়ে যায়। এমন সময় দ্বিতীয় কন্যার কান্নার শব্দ শোনা যায়। শোয়েব মেহনুবাকে কোলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয় চলে যায় ওর মায়ের ঘরে।

দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো মরিয়ম নাতনি মাহিকে কোলে নিয়ে কান্নার থামানোর চেষ্টা করে। শোয়েবকে দেখে মরিয়ম মুচকি হেসে বলল,

— তোর মাহি একেবারে তোর মতো একরোখা হয়েছে। মেহনুবা তো আমাদের মিলির মতো।

শেষেট কথাটি বলতে গিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ছেলের সামনে এসে মেহনুবাকে কোলে তুলে একহাতে মাহিকে শোয়েবের কোলে তুলে দেয়।

শোয়েব মাহিকে কোলে তুলে নিতেই একেবারে শান্ত মেয়ের মতো চুপ হয়ে যায়। শোয়েব মেয়েকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে মেয়েকে নিয়ে মিলির পাশে শুইয়ে দেয়। মাহি শুয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খেলছে। মাঝে মাঝে মিলির গায়ের মেক্সিটা টেনে এনে মুখে দেয়ার চেষ্টা করছে। শোয়েব এই দৃশ্য দেখে ভীষণ কষ্ট পায়। মেয়ে দুটোর মধ্যে মেহেনুবা শোয়েবের কোলে উঠলে কান্না থামিয়ে দেয়। আর মাহিকে মিলির পাশে এনে শুইয়ে দিলে পেটে অনেক ক্ষুদা থাকলেও চুপটি করে মায়ের পাশে শুয়ে খেলা করে।

ইরাবতী মাহির জন্য ফিডার ভরে দুধ নিয়ে আসে। দরজার কাছে এসে চিরচেনা সেই দৃশ্য দেখে ইরাবতীর মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপকে একপাশে রেখে ঘরের ভেতরে এসে মাহির পাশে বসে ওকে কোলে তুলে ফিডারটি মুখে তুলে দিতেই চুকচুক করে খেতে শুরু করে মাহি।

ইরবতী ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ভাই???

— হুম?

— মাহিকে আজ আমার সাথে রাখব?

— আমি কি মানা করেছি তোমায়?

শোয়েবের কাছ উত্তর পেয়ে ইরাবতী মাহিকে কোলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

পুরো ঘর জুড়ে পিনপতন নীরবতা। দুটো মানুষ একই ঘরের ছাঁদের নীচে অবস্থান করছে। কেউ স্বজ্ঞানে আর কেউ অজ্ঞানে। জানালা দিয়ে শীতল বাতাস ঘরে আসছে। পর্দাগুলো উড়ছে। রাতের আকাশে আজ কোথাও তারা নেই। হয়তো, মেঘের আড়ালে ঢাকা পরেছে। কখন যেন বৃষ্টি এসে পুরো শহরকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়?

শোয়েব বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আলমারীর দিকে। আলমারী খুলে ড্রয়ার থেকে একটি নীল ডায়েরি বের করে। ডায়েরি উপরে বড়ো করে লেখা “শরৎ আপনার জন্য “।

ডায়েরিটা হাতে নিয়ে জানালার দ্বারে চেয়ার টেনে বসে পরে শোয়েব। এই নিয়ে এই ডায়েরীটা সে পাঁচ বার পড়ে ফেলেছে। কিন্তু, যতবারই পড়ার জন্য হাতে নেয় ঠিক ততবারই মনে হয় যেন আজই প্রথমবারের মতো পড়ছে সে।

শোয়েব ডায়েরীর প্রথম পাতা উল্টে চোখ রাখলো। সেখানে লেখা আছে এই দুটো লাইন।

” দিনের আলোতে যদি আমি আপনার খোঁজ না পাই।
তবে, যেন আঁধার রাতের বেঘোর ঘুমে আমি যেন আপনারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই ”

দ্বিতীয় পাতায় উল্টিয়ে চোখ রাখলো শোয়েব।

************

অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। মাঝে মাঝে আকাশের বুকে বজ্রপাত হচ্ছে। বজ্রপাতের শব্দে যেন পুরো শহরকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কোথাও বিদুৎ নেই। মোম কিংবা চার্জার লাইট এখন একমাত্র আলোর যোগানদারী।

উপরতলা থেকে প্রায় দুই জন মানুষের হাসিঠাট্টা চলছে প্রায় আধঘন্টা হলো। অষ্টাদশী এক কন্যা নিজের ঘরে বসে কোমড় অব্দি ছাড়িয়ে যাওয়া কেশরাশিতে চিরুনি চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করে আনমনে বলছে,

— বৃষ্টি হচ্ছিল এক ভালো ছিলো। বৃষ্টি চলে গিয়ে আমাকে মুসিবতে রেখে গেল। এই যে উপরতলায় ভাইয়ার ঘর থেকে এমন হইহট্টগোল শোনা যাচ্ছে এতেই ভীষণ বিরক্তি হচ্ছে আমার।

এমন সময় ঘরের দরজা খুলে আমার ঘরে এলো আমার বড়ো ভাই রাসেল। এসেই আমাকে বললো,

— মিলু, যা তো দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয় তো।

আমার হাতে থাকা চিরুনিটা ড্রেসিংটেবিলের ওপরে রেখে ভাইয়াকে বললাম,

— তোমার বন্ধু এসেছে তুমি তাকে চা বানিয়ে দাও। আমাকে বলছো কেন?

— বানাতে পারলে নিশ্চয়ই তোকে বলতাম না। আর জানিস তুই কে এসেছে?

— তোমার বন্ধু বাদে আর কে আসবে?

— আমার বন্ধু ঠিক আছে। কিন্তু, তার অন্য একটা পরিচয় আছে। ইউটিউবে যার গান শুনিস তুই। কি যেন নাম? ওহ হ্যা “শরৎ”।

নিজের ভাইয়ের মুখ থেকে “শরৎ” নামটি শুনে অন্যমনস্ক হয়ে যায় মিলি। মিলির একমাত্র ক্রাশ কিনা তার ভাইয়ের বন্ধু! আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে তার ভাইয়া শুধুমাত্র মজা করে “শরৎ” এর নাম মিলির সামনে বলছে।

— তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তাই না?

— বিশ্বাস করলে কর না করলে নাই। কিন্তু, মিলি তোকে যে শরৎের কথা বলছি এটা আবার শরৎের সামনে গিয়ে বলিস না। এমনকি কারো সঙ্গেই না। বুঝতেই পারছিস ও কিন্তু ওর পরিচয় এবং ফেইস হাইড রেখে মনের সুখে গান গায়।

কথাগুলো বলে রাসেল উপরের ঘরে চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে অনুরোধ করে যেন খুবই দ্রুত চা বানিয়ে মাহিমকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।

মিলি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারমানে ওর স্বপ্নের মানুষ সত্যি সত্যি ওর বাড়িতেই আছে! আচ্ছা, উনি দেখতে কেমন? থাক দেখা লাগবে না। আমার মনের আয়নায় উনাকে রাজপুত্রের চেয়েও কম সুন্দর দেখায় না।

মিলি মাথায় খুব ভালো ওড়না দিয়ে খুবই সাবধানে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে যেয়ে চা বানিয়ে কাপে ঢেলে ট্রেতে সাজিয়ে রাখে। তারপর,মাহিমকে ডাক দিলে মাহিম এসে ট্রেটা নিয়ে উপরের ঘরে চলে যায়।

তারপর, রাতের কি রান্না করবে তা নিয়ে আয়োজন করছে। যেহেতু বৃষ্টির দিন তাই খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করে ফেললো মিলি। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে শহরের বুকে। মিলির বাবা মাগরিবের নামাজ আদায় করে বাড়িতে ফিরে আসেন। মিলি ওর বাবার সঙ্গে দেখা করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল এটে বসে আছে।
শুনেছে কাল সকালেই নাকি ভাইয়ার বন্ধুটা চলে যাবে। মিলি যে করেই হোক ওই লোকের সামনে যাবে না। নামটা শোনার পর থেকে বুকটা ধুকপুক শুরু করেছে। এখন যদি সামনাসামনি দেখা হয় তবে মিলি বুঝি সোজা হার্ট অ্যাটাক করবে।

রাতের খাবারের সময় বেশ কয়েকবার মিলিকে ডাকতে আসে রাসেল। কিন্তু, মিলি দরজা খুলতে নারাজ। আজ নাকি রাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। রাসেল হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।

সেই রাতটা মিলির নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়। সকালে মিলি যখন বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে ঠিক সেসময় এই বাড়ি থেকে “শরৎ” নামক মিলির স্বপ্ন পুরুষটি চলে যায়।

মিলি ঘুম থেকে জাগার পর মাহিমের কাছ থেকে জানতে পারে সেই কথা।

সেদিনের পর থেকে মিলি অনেকটাই গম্ভীর হয়ে যায়। কারো সাথে তেমন মিশে না। মিশুক প্রকৃতির মেয়েটা হুট করে নেতিয়ে পরে।

আষাড়ের তৃতীয় দিবসে “শরৎ” এরে চ্যানেলে নতুন একটি গান রিলিজ হলো। মিলি একপ্রকার হুমড়ি খেয়ে পরলো। গানটি প্লে করে চোখ বুঁজে শুয়ে রইলো। এইদিকে গান বাজছে,

তোর বর্ষা চোখে,
ঝরতে দেবনা বৃষ্টি
তুই জগবি সারারাত,
আমি আসবো হঠাৎ

তোর শুকনো ঠোঁটে,
ফোটাবো প্রেমের হাসি
তোকে প্রানের চেয়ে
বড় বেশি ভালোবাসি

তোকে প্রানের চেয়ে বড
বেশি ভালোবাসি

গানটি শুনতে শুনতে মিলি মুগ্ধ হয়ে যায়। এত সুন্দর গলা যার। যার এত ফ্যান-ফলোয়ার আছে। সে কি করে আড়ালে থাকতে পারে! হয়তো, সে আড়ালে থাকে বলেই সকলেই তার অন্ধ ভক্ত।

মিলি একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিলো। সারারাত ভেবে “শরৎ” এর ইউটিউব চ্যানেল থেকে ওর ফেইসবুক এক্যাউন্টের লিংক অপশনে ঢুকে পরে। তারপর, নিজের “হৃদয়েশ্বরী” একাউন্ট থেকে “শরৎ” এর মেসেঞ্জারে গিয়ে একটি ভার্চুয়াল চিঠি লিখলো।

“প্রিয়”

বলতে গিয়েও কন্ঠে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কেমন আছেন? এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করব না। কারণ, আপনি অনেক ভালো আছেন এবং অনেক সুখে আছেন।
যার এত এত ভক্ত থাকে সে কি করে খারাপ থাকবে বলুন তো?

আমি কে আপনি জানতে চাইবেন না। শুধুমাত্র এটা জেনে রাখুন আপনি আপনার আসল পরিচয় লুকিয়ে যেমন “শরৎ” হতে ভালোবেসেছেন। ঠিক তেমনি আমি আপনাকে ভেবে আপনার হৃদয়ের “হৃদয়েশ্বরী” হতে চাচ্ছি।

আমি অষ্টাদশীতে এসে যে কারো প্রেমে এভাবে পরে যাব জানা ছিল না। নয়তো, প্রেমে পরে যাওয়ার আগে নিজেকে সাবধানে রাখতাম। যেহেতু আপনার কারণে আমার এই অবস্থা তাহলে আপনি জানিয়ে দিন আমার কি করণীয় আছে?

অচেনা একজনের কাছ থেকে এমন চিঠি পেয়ে আবার হকচকিয়ে যাবেন না।

ইতি,
হৃদয়েশরী।

মেসেজটি সেন্ড হলো। মিলি সারারাত মোবাইলের স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু, মেসেজ সিন হলো না।

সেই থেকে মিলির অপেক্ষার দিন শুরু হলো। মিলি প্রতিদিন নিজের মেসেঞ্জার চেক করে। তিনদিন হয়ে গেছে কিন্তু, না শরৎের কাছ থেকে কোনো জবাব আসে না। মিলির মন ভীষণ খারাপ হলো। জীবনের প্রথম প্রেমের পত্র কি তবে বিফলে যাবে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here