#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অপ্রতিভ দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা আহনাফের দিকে। অর্ষা দুর্বোধ্য হাসে। হুটহাট এই লোকটার হয় কী? বিড়বিড় করে সে কী-ই বা বলছে?
ড্রয়িংরুমে গিয়ে হাত ছাড়ে আহনাফ। সোফার ওপর বসে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। না তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারছে চার জোড়া বিস্ময় করা দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু বাইরে সে চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর। পায়ের ওপর পা তুলে বসে, পা নাড়াতে নাড়াতে নার্ভাসনেস দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। লজ্জায়, সংকোচে পাশে উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে তাকাতেও পারছে না। হঠাৎ করে যে তার কী হলো! কোন ভূতে ধরেছিল? ভূত নাকি পেত্নী? শেওড়া গাছের পেত্নী নিশ্চয়ই তার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। নতুবা সে এমন হাস্যকর একটা কাণ্ড কেন ঘটাতে যাবে? বিরক্তিকর!
আহনাফ অনেকটা সাহস নিয়ে পাশে ওদের দিকে তাকাল। এবার আরো বেশি নার্ভাস হয়ে গেল সে। সবাই চোখদুটো গোল গোল করে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কেন? কী এমন অসম্ভব, অদ্ভুত কাজটা সে করে ফেলেছে হু?
আহনাফ হাসার চেষ্টা করে বলল,’কী…কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে কেন? বসো তোমরা।’
হেলেন আর গ্লোরিয়া পাশের ডাবল সোফায় বসল। অর্ষা নিজেও কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। তাই সে বসল না। স্মিথকে নিয়ে কিচেনে যেতে যেতে বলল,
‘আমি কফি নিয়ে আসছি।’
‘ভেতরে কেন আসতে বললে?’ প্রশ্ন করল গ্লোরিয়া।
আহনাফ থমকায়। মুখে বিব্রতকর হাসির ছটা। কেন ভেতরে আসতে বলেছে, তা তো সে নিজেও জানে না। সব দোষ ঐ অদৃশ্য শ্যাওড়া গাছের পেত্নীর।
সে বিব্রতকর হাসিটা হেসেই বলল,’আসার পর থেকেই তো বাইরে দাঁড়িয়ে আছো। খাবে না নাকি?’
‘বাহিরেও খেতে পারতাম। ওখানেই তো বেশ ভালো লাগছিল।’
‘খাওয়ার পর না হয় আবার যাওয়া যাবে।’
অর্ষা কফি নিয়ে আসে তখন। সবার হাতে কফি দিয়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তে হেলেন পিছু ডাকে।
অর্ষা ঘুরে দাঁড়ানোর পর হেলেন বলল,’তুমি খাবে না?’
অর্ষা একবার আহনাফের দিকে তাকাল। আহনাফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। একবার চোখাচোখিও হয়ে গেল দুজনের।
দৃষ্টি সরিয়ে অর্ষা হেলেনের দিকে তাকাল। স্মিত হেসে বলল,’আপাতত ইচ্ছে করছে না।’
‘কফি খেতে আবার ইচ্ছেও লাগে নাকি? যাও কফি নিয়ে এসো। এক সাথে খেতে খেতে আড্ডা দিই।’ বলল হেলেন।
এভাবে বলার পরও মুখের ওপর না করাটা অভদ্রতা। তাছাড়া হেলেন আহনাফের বন্ধু। বাড়িতে এসেছে গেস্ট হয়ে। তাকে তো আর অপমান করা যায় না। তাই সে হেসে বলল,
‘আচ্ছা।’
অর্ষা কিচেন থেকে নিজের জন্য কফি এনে হেলেনের পাশের সিঙ্গেল সোফাটিতে বসল। কফির মগে চুমুক দিয়ে একবার সেদিকে সরু দৃষ্টিতে চাইল আহনাফ।
হেলেন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,’আজ নাকি তোমার রেজাল্ট দেবে?’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ।’
‘কখন?’
‘বাংলাদেশের সময়ে দুপুর বারোটার মধ্যেই বা তার কিছুক্ষণ বাদেই রেজাল্ট পাবে সবাই।’
‘তারমানে সুইজারল্যান্ডের সময়ে আটটার পরেই পেয়ে যাবে?’
‘হুম।’
হেলেন ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’তাহলে আর বেশিক্ষণ নেই। এখন ৭:৫০ বাজে।’
অর্ষা নিরুত্তর থেকে মৃদু হাসল শুধু। হেলেন বলল,’জানো আজ সকাল সকাল আমরা এখানে কেন এসেছি?’
অর্ষা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’না তো!’
‘তোমার রেজাল্ট দেবে আজ তাই আহনাফ আমাদের ট্রিট দেবে। আজ আমরা সবাই একসাথে ঘুরব। তাই তো আহনাফও আজ অফিসে যাবে না বলে ছুটি নিয়েছে।’
হেলেনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই বিষম খায় আহনাফ। এদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা। সে তো এসবের কিছুই জানত না। এখন তার ভয় লাগছে। পরীক্ষা সে ভালো দিয়েছে। কিন্তু আহনাফের এত পসেসিভ ভাবনা দেখে ভয় লাগছে, যদি রেজাল্ট ভালো না আসে? সে কেন আগেই তার বন্ধুদের ট্রিট দেওয়ার কথা বলল? এটলিস্ট রেজাল্ট জানার পর তাদের ট্রিটের কথা বলতে পারত! এতক্ষণ রেজাল্ট নিয়ে তার মাঝে কোনো উত্তেজনাই ছিল না। কিন্তু এখন ভয়ে, উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে।
এদিকে বেফাঁসে কথাগুলো বলে ফেলা হেলেনের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রয়েছে আহনাফ। এসব অর্ষার সামনে বলাটা কি খুব বেশি জরুরী ছিল? আহম্মক একটা!
পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করবে আহনাফ কিংবা অর্ষা কেউ-ই বুঝতে পারছে না। হেলেন হয়তো নিজের ভুলটা বুঝতে পারল তাই প্রসঙ্গ পালটিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি কোন সাবজেক্ট থেকে পরীক্ষা দিয়েছ?’
অর্ষা মিহিকণ্ঠে বলল,’আর্টস।’
‘এরপর কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে?’
‘ইকোনোমিকস্।’
‘দ্যাট’স গুড।’
আহনাফ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’তোরা কথা বল। আমি রেডি হয়ে আসছি।’
লিলিয়া তখন নাস্তা নিয়ে এসেছে। আহনাফকে যেতে দেখে বলল,’সকালেও তো নাস্তা করোনি। এখনো করবে না?’
‘রেখে দাও। পরে খাব।’ যেতে যেতে বলল আহনাফ।
অর্ষা কিছুক্ষণ বসে ওদের সাথে গল্প করতে করতে নাস্তাও করে নিল। এরপর সে রুমে চলে গেল রেডি হওয়ার কথা বলে। দরজায় ক্যাথিওন দাঁড়িয়ে ছিল। ও’কে পাশ কাটিয়ে অর্ষা ভেতরে ঢুকল।
আহনাফ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। অর্ষাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘গল্প করা শেষ?’
‘মানে?’
‘জিজ্ঞেস করলাম গল্প করা শেষ কিনা।’
‘কী এমন গল্প করলাম?’
‘আমি কি জানি?’
অর্ষা অযথা আর কথা বাড়াল না। এতদিন তো ঠিকমতো কথাই বলেনি। আর আজ যা একটু কথা বলছে তাও আবার ঠেস মেরে বলতেছে। এই লোকের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শুধু সমস্যা আর সমস্যা।
আলমারি থেকে নিজের জামা-কাপড় বের করে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল, আহনাফ তখন পিছু ডাকল।
বলল,’আজ কোন ড্রেস পরছ?’
অর্ষা হাতের জামা-কাপড় দেখিয়ে বলল,’টপস্।’
‘এসব পরার দরকার নাই। জিন্স পরো সমস্যা নেই। বাট সাথে লং গাউন নয়তো কামিজ পরো।’
‘এটায় কী সমস্যা?’
‘এত প্রশ্ন করছ কেন? এটায় তোমায় ভালো লাগবে না তাই বললাম। তোমার ইচ্ছে হলে পরতে পারো।’
অর্ষা বিড়বিড় করে বলল,’ঘাড়ত্যাড়া!’
আবার আলমারির কাছে ফিরে গিয়ে মেরুন রঙের একটা কামিজ বের করে বলল,’এটা পরি?’
আহনাফ জামাটা দেখে বলল,’পরো।’
অর্ষা রেডি হতে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখে আহনাফ এখনো রুমেই আছে।
অর্ষা তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,’আপনি এখানে বসে আছেন কেন? উনারা বোরিং ফিল করছে না একা একা?’
‘না। গ্লোরিয়া চলে গেছে। হেলেন আর স্মিথ টিভি দেখতেছে।’
গ্লোরিয়া চলে গেছে শুনে মনে মনে ভীষণ খুশি হলো অর্ষা। তবে খুশিটা প্রকাশ না করে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,
‘ওমা! কেন? আজ না আমাদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার কথা?’
‘হু। কথা তো এমনই ছিল। কিন্তু ওর বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। জরুরী দরকার। তাই চলে গেল।’
অর্ষা মনে মনে বলল,’বেশ হয়েছে।’
এরপর সে সাজগোজ করার জন্য আয়নার সামনে বসল।
‘হেলেনকে তোমার কেমন লাগে?’
আহনাফের প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ষা।
আহনাফ জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বলল,’বলছ না যে?’
হুঁশে এসে অর্ষা বলল,’কেমন লাগবে আবার?’
‘সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি।’
‘এই প্রশ্ন কেন করছেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’
‘এমনিই।’
‘সে আপনার ফ্রেন্ড। ছেলে হিসেবে খারাপ নয়।’
‘তাই?’
‘জি।’
‘এজন্যই বুঝি এত হেসে হেসে কথা বলো?’
‘কী?’
‘কিছু না।’ বলে আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
অর্ষা কিছুক্ষণ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে বলে,’নিজে যখন গ্লোরিয়ার সাথে দাঁত কেলিয়ে কথা বলে তখন কিছু না! আর আমি হেসে কথা বললেই দোষ!’
এই মুহূর্তে সালমান খানের একটা গান মনে পড়ছে প্লাস মনেও ধরছে,’মে কারু তো শালা, ক্যারেক্টার ঢিলা হে!’
_______
আহনাফ, অর্ষা, হেলেন আর স্মিথ এই চারজনে মিলে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বের হলো। গাড়ি ড্রাইভ করছে আহনাফ। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে হেলেন। আর পেছনে বসেছে অর্ষা, স্মিথ।
খাঁজবিহীন সরু রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলছে। গন্তব্য আজ উদ্দেশ্যহীন। যেহেতু ঘুরতে বের হওয়া হয়েছে তাহলে সেটা একেবারেই গন্তব্যহীন হয় কীভাবে?
অর্ষা গাড়ির কাচ নামিয়ে দিতে বলল। আহনাফ বিনাবাক্যে কাচ নামিয়ে দিল।
‘আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অর্ষা। ঠিক কার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করা হয়েছে, তা ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না। তবে উত্তরটা হেলেনই দিল,
‘লং ড্রাইভে।’
লং ড্রাইভ শুনে অর্ষার মুখটা হা হয়ে গেল। লং ড্রাইভে যাবে তাও কিনা আবার ফ্রেন্ড আর আণ্ডাবাচ্চাকে সাথে নিয়ে। অর্ষার ভীষণ আফসোস হলো। সে নিজে এক নিরামিষ, তার কপালে জুটেছেও এক নিরামিষ। কী আর করার! সবই হচ্ছে কপাল।
গাড়ি প্রথমে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। আহনাফ আগে নেমে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
‘নামো।’
অর্ষার জানতে ইচ্ছে করল, লং ড্রাইভের কথা বলে এখানে কেন! তবে আহনাফের গম্ভীর মুখ দেখে প্রশ্নটি আর করা হয়নি। শেষে রাগে যদি হেলেনের সামনেও ধমক দেয় তখন? তারচেয়ে শ্রেয় চুপ করে থাকা।
আহনাফ রেস্টুরেন্টে আগে ঢুকল। স্মিথ অর্ষার ডান হাত ধরে হাঁটছে। বামপাশে রয়েছে হেলেন। সে ফিসফিস করে বলল,
‘সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’
অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হেলেনের দিকে তাকাল। তবে হেলেনের থেকে তার সুন্দর হাসিটা ব্যতীত কোনো উত্তর পেল না।
ভেতরে যাওয়ার পর সবাই মিলে একটা টেবিল দখল করে বসে। কিছুক্ষণ বাদে একজন ওয়েটার এসে সুন্দর একটি কেক দিয়ে যায়।
অর্ষা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানতে চায়,’আজ জন্মদিন নাকি কারও?’
প্রশ্নটা ইংরেজিতে করায় হেলেন আর স্মিথও বুঝতে পারল। হেলেন হেসে বলল,’নাহ্। কেকের ওপর লেখাটা দেখো।’
অর্ষা মাথাটা একটু উঁচু করে লেখাগুলোর দিকে তাকাল। সেখানে লেখা,’কংরাচুলেশন ফর ইউর ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট অর্ষা।’
বিস্ময়ে হতবাক অর্ষা। সে তো এখনো তার রেজাল্টই জানে না। বাইরে ঘুরতে আসার চক্করে গ্যাঞ্জাম পার্টির সাথে কথাও হয়নি। কী এসেছে তার রেজাল্ট?
এবার আহনাফ, হেলেন আর স্মিথ সমস্বরে বলল,’কংরাচুলেশন।’
‘আপনি জানেন আমার রেজাল্ট?’ প্রশ্নটি অর্ষা আহনাফের উদ্দেশ্যে করেছে।
আহনাফ মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ। আহিল জানিয়েছে। গোল্ডেন এ প্লাস!
খুশিতে চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে অর্ষার। আনন্দে এবার কান্না পাচ্ছে।
আহনাফ তখন শীতলকণ্ঠে বলল,’তুমি অনেক ভালো স্টুডেন্ট, আহিল এটা বলেছিল। আজ প্রমাণও পেলাম। সত্যি বলতে ভীষণ খুশিও হয়েছি।’
এ কথার পরে আর অশ্রু আটকে রাখা গেল না। দু’ফোটা অশ্রুকণা চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
একসাথে কেক কেটে, অল্পকিছু খাওয়া-দাওয়া করে আবার চারজনে মিলে ঘুরতে বের হয়। রেস্টুরেন্টে থাকতে আমেনা বেগম আর জহির চৌধুরীর সাথেও কথা হয়েছে। তারা অর্ষার রেজাল্ট শুনে ভীষণ খুশি হয়েছে। বন্ধুদের সাথে বাড়িতে ফিরে জমিয়ে আড্ডা দেবে বলে এখন খুব একটা কথা হয়নি। অর্ষা, আহিল, জুঁইয়ের গোল্ডেন এ প্লাস এসেছে, রেশমি আর দিদার এ প্লাস পেয়েছে আর লামিয়া আশিকের এ গ্রেড এসেছে। একটুর জন্য প্লাস মিস! শুধু এটুকুই কথা হয়েছে সকলের।
.
.
ঘুরাঘুরি শেষ করে রাতে বাঙালি রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে এসেছে সবাই। হেলেন ঝাল একদম খেতে পারে না। তবুও জেদ ধরে ঝাল খেয়েছে। এখন তার করুণ অবস্থা। অর্ষা পানির বোতল, জুসের বোতল এগিয়ে দিল। এসব কিছুই আহনাফ দেখল সরু দৃষ্টিতে।
ঝালে হা-হুতাশ করতে করতে হেলেন বলল,’আর জীবনেও বাঙালি রেস্টুরেন্টে খাব না।’
‘বাঙালি রেস্টুরেন্টের দোষ নেই। ঝাল ছাড়া খাবার, কম ঝাল দেওয়া খাবারও ছিল। আপনি তো ইচ্ছে করেই এই ডিশ নিলেন।’ বলল অর্ষা।
‘আমি কি জানতাম নাকি তোমরা এত ঝাল খাও?’ ঝালে চোখ-মুখ লাল করে বলল হেলেন।
আহনাফ মিষ্টি জাতীয় খাবার এগিয়ে দিল। সেখান থেকে অল্পকিছু খেয়ে কিছুটা ঝাল কমার পর সবাই এবার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। হেলেনকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে ওরা নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যায়।
স্মিথ অর্ষার গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ষা স্মিথের মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে পিঠে হালকা চাপড় দিতে লাগল, যাতে ঘুমটা ভালো হয়। আহনাফ ভিউ মিররে তাকিয়ে এসব দেখছিল।
অর্ষাও যে আহনাফকে খেয়াল করেনি, বিষয়টা এমনও নয়। কিন্তু আবার গম্ভীর আহনাফকে দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এতক্ষণ তো বেশ ভালোই ছিল। হঠাৎ করে তাহলে আবার কী হলো?
অর্ষার ভাবনার মাঝেই আহনাফ গাড়ি ব্রেক করে। ভিউ মিররে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,’নামো। আমি গাড়ি গ্যারেজে রেখে আসছি।’
স্মিথকে কোলে তুলে নিল অর্ষা। আহনাফ নেমে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। অভিমানী দৃষ্টিতে তার দিকে অর্ষা তাকালেও, আহনাফের দৃষ্টি ছিল ভাবলেশহীন। অর্ষা মনমরা হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। আহনাফ ওর যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসে।
স্মিথকে লিলিয়ার কাছে দিয়ে অর্ষা নিজের রুমে গেল। লিলিয়া পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘আজ কেমন ঘুরলে?’
অর্ষা ফিরে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,’খুব ভালো।’
‘স্মিথের জন্য তোমায় কষ্ট করতে হলো।’
‘না, আন্টি! বরং ওর সঙ্গ আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।’
লিলিয়া হাসল। বলল,’যাও ফ্রেশ হয়ে নাও আগে।’
অর্ষা মুচকি হেসে রুমের দিকে পা বাড়ায়। তিয়াসের কথা বড্ড মনে পড়ছে। কেমন আছে সোনা বাবাইটা! কতদিন দেখা হয় না, কোলে নিয়ে আদর করা হয় না। এসব ভেবে মনটা তার আরো খারাপ হয়ে যায়।
ক্যাথিওন আর অ্যানিওন-ও এসেছে অর্ষার পিছু পিছু। আগে অ্যানিওন পালিয়ে বেড়ালেও এখন আর পালায় না। সেও এখন ক্যাথিওনের দেখাদেখি অর্ষার পিছু পিছু ঘোরে। কথায় আছে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ওদের ব্যাপারটাও এখন এমন।
মন খারাপের পরিমাণ একটু বেশি থাকায় ওদের উপস্থিতি আজ খুব বেশি ভয় পাওয়াল না। এছাড়া শরীরও ভীষণ ক্লান্ত। ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়বে সেই সময়ে তার ফোনটা বেজে ওঠে।
হোয়াটসএপে আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। অর্ষা ফোন রিসিভ করে ক্লান্তস্বরে বলে,’হ্যালো।’
ঐপাশে নিরবতা। অর্ষা আবার বলল,’হ্যালো! কে বলছেন?’
‘কেমন আছিস?’
ম্রিয়মাণ কণ্ঠে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে যায় অর্ষা। অস্পষ্টস্বরে বলল,
‘কেয়া আপু!’
ঐপাশ থেকে কেয়া বলল,’হ্যাঁ। কেমন আছিস বললি না তো?’
কেয়ার ওপর এতদিনে জমে থাকা সকল রাগ-অভিমান গলে পানি হয়ে গেছে। সে কান্না করে ফেলে। ফোঁপানোর শব্দ শুনে কেয়া বলে,
‘অর্ষা? কাঁদছিস কেন তুই? আজকের দিনেও কেউ কাঁদে? কত ভালো রেজাল্ট করেছিস তুই!’
অর্ষা কান্না থামিয়ে কোনো রকমে বলল,’কেয়া আপু! তুমি কোথায় চলে গেছ বলো? কেন এভাবে চলে গেলে সেদিন? কোথায় আছো তুমি? এই নাম্বার কোথায় পেলে? এতদিন পর মনে পড়েছে? আমাদের সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কারণটা কী?’
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে। এরপর কেয়ার মৃদু শব্দের হাসি। হেসে কেয়া বলল,’তোর রেজাল্টের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল। ভালো থাকিস।’
কথা শেষ করার সাথে সাথে ফোন কেটে দিল কেয়া। অর্ষাও সাথে সাথে আবার ফোন দিল। রিং হওয়ার পরও ফোন রিসিভ করছে না। অর্ষা আবার ট্রাই করে। বেশ কয়েকবার ট্রাই করার পর এখন আর কল যাচ্ছে না। কেয়া ব্লক করে দিয়েছে!
অর্ষাকে নিরব, নিস্তব্ধ ও অস্থির দেখে শব্দহীনভাবে রুমে প্রবেশ করে আহনাফ। ক্যাথি আর অ্যানি ও’কে দেখে ম্যাউ ম্যাউ শুরু করে। একবার অর্ষার দিকে তাকায়, আর একবার আহনাফের দিকে। হয়তো বোবা প্রাণী দুটো আহনাফকে বলতে চাচ্ছে, অর্ষা কেঁদেছে।
আহনাফ কিছু বলল না। অর্ষার পাশে বসে জুতা খুলতে খুলতে বলল,’কী হলো হঠাৎ? মন খারাপ কেন?’
আটকে রাখা কান্নাগুলো বারবার যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অর্ষা ফুঁপিয়ে ওঠে। আঁৎকে ওঠে আহনাফ।
মৃদুস্বরে ডাকে,’অর্ষা!’
অর্ষা এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলে। আহনাফ অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে তোমার?’
উত্তর না পেয়ে অর্ষার দু’বাহু ধরে নিজের দিকে সোজা করে বসায়। হাত দুটো চেক করতে করতে জিজ্ঞেস করে,’ক্যাথি কি আবার খাঁমচি দিয়েছে? নাকি অ্যানি?’
অর্ষা কথা বলতে পারল না। ঠাই হিসেবে আহনাফের বিশ্বস্ত বুকটাকে বেছে নিল। যেখানে এখন সে ভরসা পায়, স্বস্তি পায়, শান্তি অনুভ করে। দু’হাতে সে শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে।
আহনাফ অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরেকণ্ঠে বলল,’প্লিজ ডোন্ট ক্রাই! আই অলওয়েজ ওয়ান্ট টু সী স্মাইল ইন ইউ ফেস। এই? অর্ষা আমায় বলো কী হয়েছে?’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]