#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া_মেঘলা
#পর্ব ২৪
৪৬
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চন্দ্রিকার শরীরের তাপমাত্রাও৷ হঠাৎ এই জ্বরের কারণ বুঝলো না মেহনুবা৷ রাত বাড়ছে শ্রেয়াস নেই আহসান মীর ও নেই বাড়িতে শুধু দেহরক্ষী আর দাসী গুলোই রয়েছে৷
মেহনুবার চিন্তিত হয়ে বার বার নাড়ি পরিক্ষা করছে চন্দ্রিকার নাড়ির স্পন্দন ও বাড়ছে৷ কি হয়ে গেলো মেয়েটার? কি সুন্দর সেজে ছিলো আজ মেয়েটা৷ চোখ সরাতে পারছিলো না৷ তাহলে কি তার নজর লেগে গেলো?
নিজের ভাবনায় নিজেই হাসলো মেহনুবা কি ভাবছে এসব? এমন হয় নাকি?
সাদা রোমালটা ফের ভিজিয়ে কপালে দিয়ে দিলো৷ টুক টুক করে তাকিয়ে আছে৷ এ মেয়েটাকে দেখে সর্বদা অবাক হয় মেহনুবা মেয়েটা এমন শক্ত পোক্ত কেন? কেমন কঠিন কিছু তাকে কাবু করে না৷ মিফতা যখন হয়নি এর আগে মেহনুবা চন্দ্রিকার মায়ের কাছে কত কাকুতি মিনতি করে চন্দ্রিকাকে চেয়েছিলো৷ দেয়নি সে চন্দ্রিকার মা চন্দ্রিকাকে৷ মিফতা হওয়ার পরেও মিফতার সাথে নিজ হাতে বড় করেছে চন্দ্রিকাকে সে এই মেয়েকে তার মহলের রানী করে আনবে বলে পন করেছে৷ তার শ্রেয়াসের রানী৷ এ মেয়েটাও তার প্রাণ৷
হঠাৎ মিফতার মুখখানা চোখে ভাসলো৷ অজানা ভয়ে বুক টা কে’পে উঠলো তার৷ হঠাৎই বুকের মাঝে ঝাপটে ধরলো চন্দ্রিকা কে যেন এখনই তার থেকে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে চন্দ্রিকা কে৷ মিফতাকে হারিয়ে নিজেকে সামলেছে আর কাউকে হারাতে পারবে না সে৷
ভালো মেয়েটা ছাদ থেকে নেমে এসেছিলো৷ এখন কেমন জ্বরে ভুগছে৷
মেহনুবা এমন ঝাপটে ধরায় হাসলো চন্দ্রিকা, সাথে এমন ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ ও হলো৷ মানুষ টা ওকে এতো ভালোবাসে কেন? মিফতাও এতটা ভালোবাসতো আর এখন তো আরেক পাগল এসেছে সে তো একেবারেই পাগল৷ মেহনুবা শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছে ভাবলো চন্দ্রিকা৷ এই জ্বর বুঝি তাকে কাবু করতে পারবে ওকে? কখনোই না এতোটাও দূর্বল নয় চন্দ্রিকা৷
চন্দ্রিকা মেহনুবাকে ঝাপটে ধরে বুকে মাথা রেখে জরানো কন্ঠে বলে,
“ভয় পাচ্ছো কেন আম্মা? ”
চন্দ্রিকার এমন জরানো কন্ঠে আরো কে’পে উঠলো মেহনুবা৷ মেয়েটা কতটা দূর্বল ভিতর দিয়ে কথার কন্ঠে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷
মেহনুবা কথার উত্তর দিলো না চুপ করেই রইলো৷ চন্দ্রিকা হাসলো নিঃশব্দে অতঃপর ফের বললো,
” এ জ্বর আমায় কিছু করতে পারবে না রানী মা৷ অকারণে ভয় পাচ্ছেন আপনি৷ ”
‘রানীমা’ ডাক শুনে এবার মেহনুবার রাগ হলো৷ কত বার বলে এই মেয়ে কে রানী মা বলবি না তবুও বলে৷ মেহনুবা এবার ছেড়ে উঠে বসলো ঠিক হয়ে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো চন্দ্রিকার পানে অতঃপর বললো,
” কথা বলবি না আমার সাথে৷ ”
বলেই চন্দ্রিকার কপাল থেকে রোমালটা নিয়ে ভেজালো আবার৷ জ্বর ছাড়ছেই না ওষুধ খাইয়ে দিলো তবুও কেন জ্বর টা বাড়ছে বুঝতেই পারছে না মেহনুবা৷ রোমালটা কপালে জরাতেই চন্দ্রিকা আবার ঝাপটে ধরলো মেহনুবার কোমর৷ মেহনুবা কিছু বলবে এর আগেই ভেজা অনুভব করলো৷ চন্দ্রিকা কাঁদছে? এ মেয়েকে সে কখনো কাঁদতে দেখেনি মেহনুবা, বড় হওয়ার পর এক বারই কাঁদতে দেখেছে চন্দ্রিকাকে৷ সে বার সেই বড় ঘটনার পর মেয়েটা কেমন পাষাণ হয়ে গিয়েছিলো৷ মিফতা মারা যাওয়ার সময় একবার শুধু কাঁদতে দেখেছিলো কিন্তু আজ কি হলো মেয়েটা? মেহনুবা মাথায় হাত দিয়ে কিছু বলবে এর আগেই চন্দ্রিকা জরানো কন্ঠে বললো,
” আম্মা মিফতাকে এনে দাও না আম্মা৷ ”
চন্দ্রিকার এহেন কথায় নিজেও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো মেহনুবা৷ ফের ক্ষতটা নাড়া দিয়ে উঠলো৷ তার রাজকন্যা আর নেই৷ মিফতা নেই৷ মেয়েটাকে সে ছুঁতে পারছে না৷
মিফতা জন্ম নেওয়ার পর আহসান মীর বলেছিলো, “দেখো মেহনুবা এটা আমাদের পুতুল৷ ”
সেই পুতুলটা আর নেই৷ মা বাবা হয়ে সন্তানের মৃত দেহ দেখা কতটা কষ্ট দায়ক এটা নিশ্চই সত্নান হারা মা বাবাই বুঝতে পারে?
” আম্মা এনে দাও না মিফতাকে? আম্মা মিফতা আর আমাকে ডাকে না চন্দ্রাবতী বলে, হুট করে এসে জড়িয়ে ধরে না৷ আমার মন খারাপ আর কেউ বুঝে না আম্মা৷ আমি একলা হয়ে গেলাম৷ বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলে আমি তো কিছু বলিনি এখন তো একেবারেই মিফতা নেই আম্মা এনে দাও না মিফতাকে৷ আমি ছুঁতে পারি না, নাগাল পাই না আমি মিফতার৷ আমাকে দিয়ে আসোনা মিফতার কাছে আম্মা? তোমার মেয়ে পাষাণ আম্মা সে তার চন্দ্রাবতীর সাথে কথা না বলে থাকছে কি করে?”
বলেই ঢুকরে কেঁদে উঠলো চন্দ্রিকা৷ শক্ত থাকতে পারছে না সে আর৷ সে ঘটনার পর নিজেকে সামলে নিয়েছিলো তো শক্ত হয়েছিলো তো এবার কেন পারছে না? চন্দ্রিকা তো চায় না তার দূর্বলতা কেউ হোক৷ শ্রেয়াসের থেকে তার অনেক কথা জানার আছে কিন্তু শ্রেয়াস কোথায়? উত্তর না দিয়ে কোথায় গেছে?
চন্দ্রিকা এবার আর শুয়ে থাকলো না৷ শান্ত হলো ধাতস্থ হলো অতঃপর কপাল থেকে রোমাল সরিয়ে মেহনুবা কে ছেড়ে উঠলো৷ মেহনুবার ধ্যান ভাঙলো৷ চন্দ্রিকাকে উঠতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কোথায় যাচ্ছিস উঠছিস কেন?”
চমদ্রিকা চোখ মুখ মুছে বাইরে যেতে যেতে বললো,
” ঘুমিয়ে পরো আম্মা আমি বের হবো৷ ”
মেহনুবা চমকে উঠে উত্তর দিলো,
“হায় আল্লাহ তাপমাত্রা বাড়ছে চন্দ্র তুই ঠিক নেই৷ কোথায় যাবি এতো রাতে এই ঝড় বৃষ্টির মাঝে? ”
চন্দ্রিকা ধাতস্ত কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আমি ঠিক আছি আম্মা৷ এই ঝড় বৃষ্টি তোমার চন্দ্রের কিছু করতে পারবে না৷ ”
বলে ক্ষানিকটা ঠোঁট এলিয়ে রহস্যময় হেসে মাথায় ঘোমটা টেনে বের হলো চন্দ্রিকা৷
মেহনুবা ডেকেও আটকাতে পারলো না৷ দেহরক্ষী গুলো বাধা দিলো তাদের উপেক্ষা করেই বেরিয়ে গেলো চন্দ্রিকা৷
বৃষ্টির মাত্রা বাড়লো, এই ঝড়ের মাঝেই মহল ছেড়ে বের হলো চন্দ্রিকা৷ কিন্তু ঘটলো আরেক বিপত্তি মহল থেকে বের হতেই চন্দ্রিকার মা ভিজে চুপচুপে হয়ে এক প্রকার দৌড়ে এলো৷ অতঃপর মেয়েকে দেখে হাপাতে হাপাতে বলে,
” বাড়ি চল চন্দ্র৷ ফারহান ভালো নেই ওকে বাঁ’চা মা৷ ”
মায়ের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকালো চন্দ্রিকা৷ ওই আপদ টার আবার কি হয়েছে? আর ও কি করে বাঁ’চাবে?
চন্দ্রিকা কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বলে,
“আমার কাজ আছে৷ আমি এখন বাড়ি যাবো না তুমি যাও৷ ”
চন্দ্রিকার মা খপ করে চন্দ্রিকার হাত ধরে বলে,
“মা আজ কোথাও যাস না৷ ছেলেটা এমন হলে ম’রেই যাবে হাত থেকে র’ক্ত ঝরছে কাউকে কাছে ঘেষতে দিচ্ছে না সারা দিন তোর নাম জপ করছে৷ ”
চন্দ্রিকার এবার রাগ হলো৷ মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না এটা ওর মা নাকি ফারহানের৷ রাগ নিয়ে মায়ের আগেই হাটা দিলো চন্দ্রিকা৷ কাজের কাজ কিছুই হলো না শ্রেয়াস কোথায় গেছে এ ও জানে না৷ শ্রেয়াসের সাথে কথা বলতেই হবে৷ লোকটা অসময় আসে পাশে ঘুরঘুর করে কাজের সময় পাওয়া যায় না৷
চন্দ্রিকা বাড়িতে ঢুকলো৷ নিজের শরীর ও আর সায় দিচ্ছে না দূর্বল পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে আগে জামা পালটে নিলো অতঃপর ফারহানের ঘরের দিকে গেলো৷ দরজার কড়া নাড়বে এর আগেই ঠাস করে থা’প্পড় পরলো গালে৷ বিস্মিত হয়ে গাল ধরে সামনের দিকে তাকালো৷ মারজিয়া আরেকটা থা’প্পড় দিবে এর আগেই চন্দ্রিকার রাগ উঠে গেলো হাত মুচড়ে ধরলো৷ এই মা ছেলেতে মিলে কি পেয়েছে কে জানে?
মারজিয়া বেগম অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বললো,
“আমার ছেল্টার মাথা একেবারে খেয়ে ফেলেছিশ তোকে আজ আমি মে’রেই ফেলবো৷ ”
বলে আরেকবার হাত উঠাবে চন্দ্রিকা ঝটকা দিয়ে দূরে সরিয়ে শাসিয়ে বলে,
“চাচি আমায় আমায় রাগীও না তোমার জন্য ভালো হবে না৷ ”
এইটুকু বলে ফের কিছু বলবে এর আগেই চমদ্রিকার মা থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ছেলেটাকে আগে দেখ মা৷ ”
চন্দ্রিকা রাগ নিয়েই কড়া নাড়লো ওপাশ থেকে শব্দ এলো না৷ চন্দ্রিকা ফের কড়া নেড়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে,
“দরজা খুলুন ফারহান ভাই৷ এমন অভিনয় করছেন কেন? কি চাইছেন কি বলুন তো?”
চিরচেনা কন্ঠ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে কপাট খুললো ফারহান৷ চন্দ্রিকাকে দেখে মন শান্ত হলো৷ হঠাৎই হ্যাচকা টানে নিজের ঘরে আনলো অতঃপর দরজা বন্ধ করে দিলো৷ তা দেলহে চন্দ্রিকার মার অন্তর আত্মা কে’পে উঠলো৷ হায় আল্লাহ মেয়েটাকে কিছু করে দিবে না তো? মারবে না তো? সে কি ভুল করলো?
ফারহান কপাট আটকে বিছানায় ছু’ড়ে মে’রে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো অতঃপর রাগ নিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
” কি করছিলি ওই শ্রেয়াসের সাথে? ওই ছেলে কেন তোর আশেপাশে থাকে? ছাড়বোনা আমি ওই শ্রেয়াস কে মে’রে দিবো৷ ”
চন্দ্রিকা ও রাগ দেখিয়ে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে বলে,
” মা ছেলেতে বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন ফারহান ভাই আপনাদের ভালো থাকার দিন শেষ হয়ে আসছে৷”
ফারহান এবার শান্ত হয়ে গেলো ফের চন্দ্রিকার কাছে এসে গালে হাত দিয়ে বলে,
” মা তোকে মে’রেছে চন্দ্র?”
চন্দ্রিকা হাত ঝাড়ি দিয়ে ফেলে বলে,
” নাটক বন্ধ করুন৷ গু’লিটা আপনি করেছেন তাই না ফারহান ভাই? মা’রতেও চাইছেন ভালো বাসি বলছেন কি চাইছেন বলুন তো আপনি”
ফারহান এবার চুপসে গেলো কথা বললো না৷ চন্দ্রিকার রাগ হচ্ছে নিজেকে কিছুটা সামলে প্রাথমিক চিকিৎসার বক্সটা নিয়ে নিজের সামনে বসালো ফারহান কে৷ এসব করার তার কোন ইচ্ছা নেই মায়ের কথায় করছে শুধু৷ ফারহান যেন ঝটকা খেলো৷ আকাশের চাঁদ পেলো৷ তার চন্দ্র তার খেয়াল রাখছে?
কিন্তু চন্দ্রিকা তার ভাবনায় পানি ঢেলে থমথমে কন্ঠে বলে,
” নাটক করার মানে কি?”
ফারহান এবারো উত্তর দিলো না৷ চন্দ্রিকা ব্যান্ডেজ করে উঠে চলে যেতে নিলেই ফারহান হাত ধরে থামালো৷ চন্দ্রিকা প্রশ্নবোধক চাওনি দিয়ে তাকালো৷ কিছু বলবে তার আগেই ফারহান ফের টেনে বসিয়ে চন্দ্রিকার পায়ে মাথা রেখে শুয়ে পরলো৷ চন্দ্রিকা এবারো কিছু বলবে এর আগে ফারহান মুখ খুললো,
” আমায় কেন কষ্ট দিচ্ছিস চন্দ্র? আমাকে কেন উপেক্ষা করছিস? আমি তোকে চাই চন্দ্র তোর আলোতে সিক্ত হতে চাই৷ আমাকে তোর জ্যোৎস্নার আলোতে আলোকিত করে দে না চন্দ্র? আমি তোকে কারো সাথে সহ্য করতে পারবোনা চন্দ্র৷ কারো সাথে না৷ ”
চলবে,
[নোটঃ ১৩৭৫ শব্দ
খাপছাড়া হয়ে গেছে কাজের চাপে লিখেছি ভুল ত্রুটি বুঝে নিবেন]