কৌমুদিনী পর্ব-২৬

0
1623

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া_মেঘলা
#পর্ব ২৬

প্রিয়ম বাড়িতে গিয়েও খোঁজ নিয়েছে মেহনুবার নাম করে চন্দ্রিকা সকাল থেকেই নেই৷ প্রিয়ম কে বিশ্রাম নিতে বলে গটগট পায়ে নিজের কক্ষে এলো শ্রেয়াস৷ শ্রেয়াসের এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে, সাথে চন্দ্রিকার উপর ও মেয়েটা ওকে বড্ড জ্বালাচ্ছে৷ ও তো সবসময় শ্রেয়াস কে উল্টো পাল্টা কথা শুনায় আজ না হয় ও দু চারটে শুনিয়েছে তাই বলে কিছু না বলেই ওমন উধাও হয়ে গেলো? ও মেয়ে কে কড়ায় গন্ডায় একদিন সব ফেরত দিবে শুধু সময়ের অপেক্ষা৷

৪৯
অন্তরিক্ষ ফের গুড়ুম গুড়ুম করে ডেকে উঠছে বারংবার তার সাথে বিদ্যুৎ টা ও হুট করে চলে গেলো৷ ঝড়ো হাওয়া বইছে বাহিরে প্রকৃতি ফের আজ ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে৷ চারোপাশ সাঁঝ বেলার মত আঁধার আচ্ছন্ন হয়ে আছে৷ কিছুক্ষণ পর পর বড় বড় আলোক রেখা তৈরি হয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে৷ মধ্যাহ্ন পেরিয়েছে সবে অপরাহ্নের শুরু৷ সেই সকালে বের হওয়ার পর সবে ফিরলো চন্দ্রিকা৷ শ্রেয়াস তখন নিজের অলিন্দে বসে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছিলো চন্দ্রিকার জন্য৷ মেয়েটা কোথায় গিয়েছিলো? এখন যে ফিরলো? কি চলছে ওর মস্তিষ্কে? কোথায় ছিলো সারা দিন?

চন্দ্রিকা চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়ির অন্দরে ঢুকতেই হঠাৎ একটা স্টিলের পানি খাওয়ার পাত্র এসে ললাটে লাগে নিচে কৃত্রিম মেঝেতে পরলো ঝংকার দিয়ে ‘টং টং’ আওয়াজ তৈরি করে৷ হঠাৎ এসে ললাটে লাগায় সাথে সাথেই চন্দ্রিকা ‘আহহ’ করে আর্তনাদ করে উঠলো৷
বেখেয়ালিতে তরকারিতে বেশি লবন হওয়ায় মারজিয়া বেগম চন্দ্রিকার মা কে ছুড়ে মেরেছিলো পানি খাওয়ার পাত্র টা চন্দ্রিকার মা সরে যাওয়ায় চন্দ্রিকার ললাটে এসে লাগলো৷

চন্দ্রিকার আর্তনাদ শুনে দুজনেই এদিকে তাকায়৷ মেয়ের কপালে লাগায় চমকে উঠে চন্দ্রিকার মা৷ মারজিয়া চন্দ্রিকাকে দেখে আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে রুষ্ট কন্ঠে বলে,
“এসেছে নবাবজাদি, তা সারা দিন কোন ছেলের সাথে ঘুরে আসলি? তোর তো কাজ ছেলেদের ফাসানো৷ ”
চাচির কথায় রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মারজিয়ার দিকে চন্দ্রিকা৷ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
“মুখ সামলে কথা বলো চাচি৷ বাড়াবাড়ি করছো তুমি৷ ”
মারজিয়া বেগম আরো চটে গেলো এগিয়ে এসে চন্দ্রিকার লম্বা কৃষ্ণ কালো কেশ গুলো শক্ত করে হাতের মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরলো৷ চন্দ্রিকা ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করলো৷ চুলে হাত দেওয়ায় রাগ বাড়লো রি রি করে উঠলো শরীর৷ চন্দ্রিকার মা এগিয়ে এলো মেয়েকে বাঁ’চাতে তখনই চন্দ্রিকা মারজিয়ার হস্ত চেপে সরাবে এর আগেই এসে কেউ টেনে সরালো মারজিয়াকে৷ চন্দ্রিকা সামনে তাকাতেই ফারহানকে দেখতে পেলো৷ ফারহান মা কে সরিয়ে দাতেদাত চেপে শান্ত কন্ঠে বলে,
“মা তোমাকে না করেছিলাম আমার চন্দ্রের গায়ে হাত দিতে?”
মারজিয়া বেগম কাচুমাচু খেয়ে দাঁড়ালো৷ ছেলেটা তার মত হলো না এটাই তার কষ্ট৷ উহু ভুল তার মতই ছিলো আগে মেয়েটা মাথা নষ্ট করে দিয়েছে ছেলেটার ছেলে এখন তাকেই শাসায়, আগে এমন ছিলো না চন্দ্রিকাকে তো সহ্যই করতে পারতো না৷

ফারহান এবার রে’গে উচ্চ কন্ঠে বলে,
” মা উত্তর দাও, ওর গায়ে হাত তুলেছো কেন?”
এবারো মারজিয়া উত্তর দিলো না ফারহান এবার চন্দ্রিকার কাছে এসে ওর হাত চেপে ধরে কিছু বলবে এর আগেই ফারহান থেকে চন্দ্রিকাকে কেউ ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
” দূরে থাকুন চন্দ্রাবতী থেকে ফারহান৷ আপনারা মা ছেলেতে মিলে এসব শুরু করেছেন? এর পরিনাম ভালো হবে না বলে দিলাম৷ ”
মারজিয়া বেগম এবার ভয়ে চুপসে গেলো, কি হবে এবার? শ্রেয়াস দেখে ফেললো? না জানি এবার ঘর ছাড়া হতে হয়৷ কিন্তু ফারহানের কোন ব্রুক্ষেপ নেই৷
ফারহান একবার চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে আরেকবার শ্রেয়াসের ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে উম্মাদের মত বলেন,
“স্পর্শ করছেন কেন আমার চন্দ্রকে? ছাড়ুন রাজকুমার চন্দ্রের হাত হাত ছাড়ুন৷ ”
শ্রেয়াস হাত ছাড়লো না৷ এদের কান্ডে বিরক্ত হলো চন্দ্রিকা দুজনে ন্যাকামি ছাড়া আর কিছু পারে না নাকি?
শ্রেয়াস ফাতহান কে উপেক্ষা করে চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি কোথায় ছিলেন সারা দিন?”
চন্দ্রিকার হঠাৎই সকালের কথা মনে পরে গেলো অভিমান আর রাগ দুটোই হলো৷ থমথমে কন্ঠে উত্তর দিলো,
” আপনি কে? কেন আপনাকে এর কৈফিয়ত দিবো? আপনি তো এ রাজ্যের শাসক প্রজাদের ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করার আপনার কোন অধিকার নেই৷ বেরিয়ে জান এখান থেকে৷ ”
চন্দ্রিকার ‘বেরিয়ে জান’ এ কথা শুনে সবাই বিস্মিত হলো, ফারহান খুশি হলো৷ মারজিয়া বেগম থতমত খেলো আজ বুঝি সত্যি রক্ষে নেই৷ চন্দ্রিকার মা এগিয়ে এসে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে,
” চন্দ্র এসব কেমন কথা?”
শ্রেয়াস কোনো মত রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে৷ যেহেতু নিজেরো দোষ আছে যার দরুন কিছু বলছে না শুধু শান্ত কন্ঠে বললো,
” মহলে আসুন চন্দ্রিকা মা আপনাকে ডাকছে৷ ”
শ্রেয়াস জানে মেহনুবার কথা ছাড়া এ মেয়ে এখান থেকে যাবেনা৷ কিন্তু শ্রেয়াসের ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত হলো শ্রেয়াস কে আশাহত করে চন্দ্রিকা বললো,
” আম্মার সাথে কথা হয়েছে আমার৷ ”
শ্রেয়াস এবারো হার মানলো না কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
” চন্দ্রাবতী আপনার সাথে আমার কথা আছে আপনি এখন আমার সাথে আসবেন৷ ”
“আমি যাবোনা, আপনি যান এখান থেকে৷ ”
চন্দ্রিকার স্পষ্ট উত্তর৷ সে উত্তর দিয়ে আর দাঁড়ায়নি বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে যায়৷ চন্দ্রিকার মা আর মারজিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ফারহানের ওষ্ঠ জুরে বিশ্ব জয়ের হাসি৷ যা শ্রেয়াসে নেত্র এড়ালো না৷ শ্রেয়াসো রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো, তার শরীর রাগে রি রি করছে মেয়েটা অবাধ্য৷ এ অবাধ্য মেয়ে কে সে দেখে নিবে সব কিছুর হিসেব চুকাবে তাকে উপেক্ষা তাকে অপমান? ফারহানের হাসি তার সহ্য হচ্ছে না কাউকে ছাড়বে না কাউকে না৷ আজই কিছু করবে৷ চন্দ্রিকার এমন কাজে শ্রেয়াসের মানে লেগেছে অদ্ভুত এক ইচ্ছা অন্তরকরণে ঝেকে বসেছে৷

৫০
সন্ধ্যা হয়ে আসতেই মুষলধারে বৃষ্টি এলো ফের৷ এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেই তমা নামক মেয়েটি মহল ছেড়ে বের হলো মুঠোফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে যা প্রিয়মের চোখ এড়ালো না৷
আর মুঠো ফোনেই বা কার সাথে কথা বলছিলো? মতলব কি এই মেয়ের? খারাপ মতলবে মহলে প্রবেশ করেছে কি? মেয়েটা কি চলে গেলো? নাকি আসবে আবার?
তমা যে মহল ছেড়ে বেড়িয়েছে তা কি মেহনুবা জানে? প্রিয়ম মেয়েটির পিছু নেওয়ার আগেই মেয়েটি চলে গেলো কোথাও মহল থেকে বেড়িয়ে দেখতে পেলো না প্রিয়ম৷ এতো তাড়াতাড়ি কোথায় গেলো? জাদুটোনা জানে নাকি?
মেয়েটাকে তো পেলোই না আরো চুপচুপে ভিজে গেলো৷ তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো যাওয়ার সময় ধরতে পারেনি আসবে নিশ্চয়ই? বলা তো যায় না আসতেও পারে? যখন তখন হাতে নাতে ধরবে আর দেখবে কোথ্যেকে এলো৷

বেশ ক্ষানিক্ষণ পর মেয়েটা এলো প্রিয়ম ততক্ষণে এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো মেয়েটার হাতে কিছু আছে জিনিসটা কেমন আবছা কি ওটা? মেয়েটা হাতের জিনিসটা নিজের হাতের থলে টায় ঢুকিয়ে এগিয়ে এলো এবারো কিছু না বলে অন্দরে ঢুকবে তার আগেই প্রিয়ম প্রশ্ন ছুড়লো,
“কে আপনি? মহলে কি জন্য এসেছেন?আর যাবেন কবে?”
মেয়েটি তপ্ত শ্বাস ফেলে নিম্ন কন্ঠে বলে,
” রানী মেহনুবার খাস দাসী আমি৷ এখন থেকে এখানেই থাকবো৷ শুনেছেন? এবার যাই?”
মেয়ের এক রুখে উত্তরে অসন্তুষ্ট হলো প্রিয়ম এ মেয়ে নাকি মেহনুবার খাস দাসী৷ কোনো দিক দিয়েই তো দাসী হলে মনে হচ্ছে না৷ মেহনুবা বললো না তো? এ মেয়ে নাকি তার খাস দাসী কিন্তু ভাব ভঙ্গি দেখে মোটেও তা মনে হচ্ছে না কেমন ভাবভঙ্গি ভিন্ন৷
দাসী হয়ে খারাপ মতলবে মহলে ঢুকলো নাকি? প্রিয়ম আবার প্রশ্ন ছুড়লেন,
” থলিতে কি আছে? তখন কি ঢুকালেন? আর এমন কি জরুরি কাজ ছিলো এমন বৃষ্টির মধ্যে বের হতে হলো?”
তমা এবার ক্ষানিকটা বিরক্ত হলো বিরক্ত নিয়ে বললো,
“এত কথার জবাব আপনাকে দিবো কেন? আমার যা ইচ্ছা করবো আমার জিনিসের কথা আপনাকে বলবো কেন?”
প্রিয়ম তমার হাবভাবে এবারো অবাক না হয়ে পারলো না৷ একজন দাসীর ব্যাবহার এমন? মহলে শ খানেক দাসী আছে তারাতো চোখ তুলেও তাকায় না এই মেয়ে এত কথা বলছে? প্রিয়ম ব্রু কুচকে প্রশ্ন ছুড়লো ,
” একটা দাসী হয়ে আমার সাথে তর্ক করছেন আপনি?”
তমা বিরক্ত সুরেই উত্তর দিলো,
” আমি রানী মেহনুবার দাসী, খাস দাসী৷ আপনার নই তাই চোখ নিচে নামিয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না৷ আসছি আমি৷ ”
বলে অন্দরে প্রবেশ করলো তমা৷ প্রিয়ম হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো, ধানি লংকা মেয়ে একটা কি বড় বড় কথা শুনিয়ে গেলো? দাসী থেকে বেশি মালকিন লাগছে৷ জামা কাপর ও দাসীর মত না কে এই মেয়ে? মতলব কি? এ মেয়েকে তো দেখে নিবে প্রিয়ম৷ হাবভাবে দাসি নয় রাজকুমারী বলেই মনে হলো, মহলে প্রবেশ করতে না করতেই চন্দ্রিকার বাতাস পেয়ে গেলো নাকি? কি অদ্ভুত মেয়ে বাবা৷

৫১
চন্দ্রিকার বাড়ি থেকে এসে নিজের কক্ষে পায়চারি করছে শ্রেয়াস৷ রাগে তার শরীর এখনো কম্পন দিয়ে উঠছে না চন্দ্রিকার উপর নয় ফারহানের মায়ের উপর৷ আর অই অবাধ্য মেয়েই বা চুপ করে মার খেলো কেন? ও সকালে কয়েকটা কথা শুনিয়েছে তাই বলে আজ এমন অপমান করলো সবার সামনে ওই ফারহানের সামনে৷ ছাড়বে না শ্রেয়াস কাউকে ছাড়বে না, আর ওই অবাধ্য মেয়ে? তার তো কিছু একটা করতেই হবে ওই পাত্তাই দিচ্ছে না কি করে ওই মেয়ে কে ঠিক করতে হয় তা শ্রেয়াস ভালো করেই জানে৷

হঠাৎ শ্রেয়াস কিছু ভেবেই ওষ্ট কোণে কুটিল হাসি ফুটে উঠলো৷ নিজের কক্ষ ছেড়ে বড় বড় পা ফেলে মেহনুবার কক্ষের সামনে এসে দরজায় কড়া নাড়লো দু’বার কড়া নাড়তেই কক্ষে ঢূকার অনুমতি দিলো মেহনুবা৷
মেহনুবা তখন তমার সাথে কথা বলছিলো শ্রেয়াস কে দেখে দু জনেই ব্রু কুচকে তাকায় শ্রেয়াসের দিকে তার আগেই তাদের বিস্মিত করে দিয়ে শ্রেয়াস কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,
” মা আমি চন্দ্রাবতীকে বিয়ে করতে চাই৷”

চলবে,

[গল্প প্রায় শেষ পর্যায় প্লিজ একটু রেসপন্স বাড়ান এবং কমেন্টের মাধ্যমে উৎসাহিত করুন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here