আলোছায়া পর্ব-১৫

0
1891

আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৫

মনের মধ্যে হাজারো চিন্তা ভাবনা নিয়ে জুনায়েদ কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। অনিক বারবার ফোন করছে। বেচারা সেখানে একা পড়ে গেছে। অনেক রাতের জন্য রাস্তায় গাড়ি পাচ্ছে না। তাছাড়া বন্ধুদের গন্তব্যস্থলের বিপরীতে ওদের বাসা। যাবার সময় জুনায়েদ ওকে গাড়ি নিতে মানা করেছিল বলে ছেলেটা নাইট ক্লাবে ফেঁসে আছে। জুনায়েদ বিরক্তি নিয়ে ফোন কানে ধরতেই অনিক একগাদা কথা শুনিয়ে দিলো। ছেলেটা চরম খেঁপেছে যা ইচ্ছে ভুলভাল বকছে।। ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হলে জুনায়েদকে আবারও সেখানে যাওয়া দরকার কিন্তু সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব‍্যস্ত থাকাই খাওয়া হয়নি শরীর ভয়ানক দুর্বল। কথাটা ভেবে ও অরিফকে ফোন দিয়ে বলে দিলো অনিককে নিয়ে আসার জন্য। ফোন রেখে জুনায়েদ বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। আজ ঘরে খাবার দিয়ে যাওয়া হয়নি। হয়তো ভেবেছে বাইরে থেকে খেয়ে আসবে। পেটে ইদুর দৌড়াতে শুরু করেছে। এখুনি খাবার চাই, চাই মানে চাই। ভয়ানক ক্ষুধা পেয়েছে। জুনায়েদ বসে থাকতে পারলো না। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাইনিং রুম লাল নীল ড্রিম লাইটের আলোতে ঝলমল করছে। জুনায়েদ সিঁড়িতে দুপা ফেলেই পড়লো চরম বিপত্তিতে। সামনে কেউ আছে ও খেয়াল না করে ধাক্কা দিয়ে বসেছে। সামনে একজন মেয়ের অবয়ব বসে আছে। জুনায়েদ শব্দ করে কে বলতে গিয়ে থমকে গেলো কারণ সামনে থেকে নীলুর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। জুনায়েদ অপেক্ষা করলো না দ্রুত নিচে বসে ওর কন্ঠ অনুসরণ করে ফিসফিস করে বলল,

> বাইরে কি করছো? এই তুমি রাতের আধারে নাইট ক্লাবে যাও? মারামারি করো তাই না?

> আপনার মুণ্ডু। বুদ্ধিজীবীদের মতো আচরণ করেন কিন্তু মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই। সেখানে গেলে আমি এখানে কি উড়ে এলাম?

জুনায়েদ ওর কথায় বেশ চটে গেলো। এই মেয়েটা কথা বলে না বলে না কিন্তু এমন কথা বলে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা কষ্টের। জুনায়েদ ভাবলো একে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার আছে তাই জোরে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে আনার পরিকল্পনা করলো কিন্তু নীলু ওর পরিকল্পনা ব‍্যর্থ করে হাতের সামনে নুডুলসের থালা তুলে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

> আপনার জন‍্য খাবার নিতে রান্নাঘরে গিয়েছিলাম। তেমন কিছুই ছিল না তাই নুডুলস খেয়েই রাত পার করতে হবে। চিৎকার করে সবাইকে ডাকলে আপনি নিজেই বকা শুনবেন।

জুনায়েদ হতভম্ব হয়ে প্লেট নিয়ে বলল,

> অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। ঠিক বুঝতে পারছি না আমি তোমার সঙ্গে এতো কিছু করলাম তবুও তুমি আমার সঙ্গে স্বাভাবিক কিভাবে আছো?

> হিটলারের বুদ্ধি আপনার আপনিই খুজে নিন।

নীলু তার দীর্ঘ চুলের গোছা পিঠের উপরে ছুড়ে দিয়ে হেলতে দুলতে চলে গেলো। জুনায়েদ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রুমের ফিরে এসে খাবার মুখে দিলো। খাবার থেকে ধোয়া উড়ছে মানে নীলু রান্না করেছে কিন্তু ওর তো আগুনে ফোবিয়া আছে। নিজে রান্না করেছে নাকি কেউ করে দিয়েছে? জুনায়েদ মেলানোর চেষ্টা করেও ব‍্যর্থ হলো। আপাতত সেসব নিয়ে মাথা নষ্ট করে লাভ হবে বলে মনে হলো না।

সকাল আটটা কাজের মেয়ে ডলির ডাকে জুনায়েদের ঘুম ভাঙলো। গতকাল ভালো ঘুম হয়নি। সারারাত কেমন অস্বস্তি নিয়ে কেটেছে। বারবার মনে হয়েছে এক জোড়া চোখ ওকে দেখছে। লাইট জ্বালিয়ে ঘুমানোর অভ‍্যাস নেই। তাই সেই অস্বস্তি নিয়েই রাত কেটেছে। ঠকঠক আওয়াজে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। জুনায়েদ বিরক্তি নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে দরজা খুলতেই ডলি মুখ বাকিয়ে বলল,

> আপনের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে আফা আপ্নেরে নিচে ডাকে।

জুনায়েদ চোখ বড়বড় করে ফেলল। একবার বিয়ে দিয়ে শান্তি হয়নি আবারও বিয়ে দিবে?বিষয়টা ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সবাই মিলে কি খিচুরি পাকিয়েছে কে জানে। নিজের মাকে ওর একটুও বিশ্বাস নেই। দেখা গেলো আবারও কাকে উঠিয়ে এনে ওর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে মেয়ের আসনটা ছেড়ে দিয়েছে। খুব আফসোস হচ্ছে দু চারটা বোন কেনো হলো না! কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতে ও ডাইনিং রুমের দিকে ছুটলো। ফ্রেস হবার কথার বেমালুম ভূলেগেছে। আগে জীবন তারপর অন‍্যসব। জুনায়েদ হাপাতে হাপাতে সোফার দিকে তাকিয়ে অবাক। পিউ ওর পরিবার নিয়ে বসে আছে। জুনায়েদকে দেখে মেয়েটা লজ্জায় লাল নীল বেগুন হচ্ছে। জুনায়েদের এবার ইচ্ছা হলো সোজা গিয়ে ওর গলা টিপে দিতে কিন্তু পারলো না। এমনিতেই বাড়িতে অশান্তি। জুনায়েদকে দেখে সৈয়দ সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

> আমি ওদেরকে ডেকে এনেছি। যার জন্য ছেলে এতোটা বেপরোয়া তার সঙ্গে থাকলেই ভালো হবে। যাইহোক বিয়ের কথাবার্তার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যাবে। আশাকরি তুমি এবার খুশী হবে।

জুনায়েদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেটা এতোদিন মনে প্রাণে চেয়ে এসেছে আজ তা সহজে পাচ্ছে কিন্তু ওর ইচ্ছা নেই। জুনায়েদের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ও কড়া ভাষায় বলল,

> বারবার বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না। আমাকে দিয়ে কি বিশ্ব রেকর্ড গড়তে চাইছো যে তখন ইচ্ছা হবে বিয়ে করবো। আমাদের বংশের ছেলেদের ডিভোর্স হয়না।

জুনায়েদের কথায় পিউ কাঁদতে শুরু করলো। উপস্থিত সকলে বিরক্ত। বিশেষ করে জুনায়েদের উপরে। নীলু মাথায় ঘোমটা টেনে বাড়ির বউয়ের দায়িত্ব পালন করছে। ডলির সঙ্গে সে নাস্তা রেবি করতে ব‍্যস্ত। মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে যা হচ্ছে তাতে ওর কিছু যায় আসে না। জুনায়েদ ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আনতেই পারভীন বেগম গম্ভীর মুখে বললেন,

> বিয়েটা লোকজন জানিয়ে দিতে চাইছি। পরে আবার বলা হবে বউকে মানছি না খুন করবো সে আর হচ্ছে না। সারাজীবন কি আমরা তোমাকে নিয়েই পড়ে থাকবো।

জুনায়েদ ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু শরবতের ট্রে নিয়ে ওর সামনে দিয়ে মেহমানের জন্য নিয়ে আসছিল জুনায়েদ হনহন করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। নীলু সরল মুখে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু জুনায়েদ ওকে বুঝতে না দিয়ে হুট করে নীলুর হাত থেকে ট্রে নিয়ে সামনে ধপাস করে ফেলে দিলো। ঝনঝন করে কাচের গ্লাস গুলো মেঝেতে পড়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেলো। জুনায়েদের হঠাৎ এ ধরণের আচরণের জন্য সবাই বিরক্ত। নীলু ভয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে ধরে রেখেছে। পারভীন বেগম উঠে এসে জুনায়েদের গালে জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। উনি রাগে ফুলছেন। জুনায়েদ মুখ ফুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উপরে যেতে গিয়ে সিঁড়ির মাঝামাঝি গিয়ে ফিরে এসে নীলুর হাতধরে টানতে টানতে উপরে গিয়ে ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পারভীন বেগম হতাশ হয়ে সোফায় গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। এই ছেলেকে নিয়ে কি করবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। মেজাজ হুড়হুড় করে খারাপ হচ্ছে। পিউ অনবরত কান্না করছে। ওর বাবা ওকে কোলের মধ্যে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সবাই যেখানে রাজি সেখানে জুনায়েদ বেঁকে বসেছে। শুভ্র আয়েশি ভঙ্গিতে কফি খাচ্ছে। মনে হচ্ছে লাইভ সিনেমার সুটিং চলছে,দেখতে বেশ মজা পাচ্ছে। সৈয়দ সাহেব পিউয়ের বাবার সামনে অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন,

> প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমরা ওকে বুঝিয়ে বলবো। আপনারা এখন আসুন।

ভদ্রলোক বেশ চটেছেন। উনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বের হলেন। ডলি ভাঙা কাচের টুকরো গুলো গুছিয়ে রাখছে। শুভ্র কফির কাপটা ঠক করে টেবিলের উপরে রেখে নিজের রুমের দিকে হাটা ধরলো। গতকাল বিশাল একটা প্রজেক্টের কাজ শেষ করেছে মন বেশ ফুরফুরে।

নীলু মুখে হাত দিয়ে সোফায় বসে আছে। জুনায়েদ ওর সামনে দিয়ে হাটাহাটি করছে আর বিড়বিড় করছে। ওকে এভাবে হাটতে দেখে পিউ করুন মুখে বলল,

> খুব ক্ষুধা পেয়েছে।

জুনায়েদ হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লো ওর কথা শুনে। এই মেয়েটা এই জটিল ঝামেলার মধ্যে খেতে চাইবে ভাবতে ওর কষ্ট হচ্ছে। ও ভ্রু কুচকে বলল,

> টেনশনে আমার খাওয়া বন্ধ আর তোমার ক্ষুধা পেয়েছে? স্বামীর বিয়ের কথা শুনেও তোমার হেলদোল নেই। এই তুমি সত্যিই মেয়েতো?

জুনায়েদর ঝাড়ি শুনে নীলু পা দুটো সোফায় গুছিয়ে নিয়ে বসে বলল,

> আপনি খিচুরি পাকিয়েছেন আপনি খাবেন না তো কি আমি খাবো? প্রেম করার আর লোক ছিল না দেশে? আর আপনি তো আমাকে তাড়িয়ে দিবেন দুদিন পরেই।তাহলে আপনাকে নিয়ে কেনো মাথাব্যথা হবে আমার?

জুনায়েদ ওর কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না। বিড়বিড় করে বলল,”ফালতু বউ জুটেছে কপালে। বলেছি বলেই কি চলে যেতে হবে”।

নীলু ওর কথা শুনেও না শোনার ভান ধরে বলল,

> আমার ক্লাস আছে নয়টা বাঁজতে চলেছে।

জুনায়েদ ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। নীলু সেদিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। ছেলেটাকে রাগানো খুব সহজ। ও ভাবতে ভাবতে ক্লাসের জন্য তৈরী হতে গেলো।

জুনায়েদ ক্লাসে এসেছে। এখান থেকে ফিরে অফিসে যাবে। নীলুও এসেছে তবে ও জুনায়েদের সঙ্গে না শুভ্রর সঙ্গে।ও একটানা দুটো ক্লাস করার পরে আর কিছুতেই ক্লাসে বসতে পারছে না। নিশ্বাস নিয়ে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ও কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সূর্যের আলোতে শরীর পুড়ে যাচ্ছে কিছুতেই সহ‍্য হচ্ছে না। ও হেলতে দুলতে কোনক্রমে বকুল গাছের কাছাকাছি আসলো। জুনায়েদ দূর থেকে নীলুকে দেখছে। মেয়েটার এমন এলোমেলো হাটা দেখে ও হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছে তাই দৌড়ে গিয়ে ওর হাতটা ধরে জিঙ্গাসা করলো, নীলু ঠিক আছো?
নীলু উত্তর করতে পারলো না। ওর দিকে একবার তাকিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি এনে চোখ বন্ধ করলো। জুনায়েদ আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত ওকে কোলে তুলে গাড়ির দিকে দৌড় দিলো।

চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here