#ইসলামিক_গল্প #ISLAMIC_STORY
===========================
❝ ফিরে_আসা ❞
———————-
লেখিকা– Umma Hurayra Jahan
শেষ পর্ব–
ফাতেমা –সেটা ভালো করে ভেবে তারপর ঠিক করতে হবে।কারন বাবা মা হিসেবে সন্তানের সু,ন্দর অর্থপূর্ণ নাম রাখা অনেক গুরুত্বপুর্ন, মাহিন- হুম ।ঠিক বলেছো।
ফাতেমা –আরেকটা কথা বলার ছিলো তোমার সাথে।
মাহিন– হুম বলো।
ফাতেমা — আমাদের সন্তান হওয়ার পর তার যখন জ্ঞান অর্জনের সময় হবে তখন তাকে আমরা স্কুলে না দিয়ে মাদরাসায় ভর্তি করবো আল্লাহ যদি চাহে তো।
মাহিন– আলহামদুলিল্লাহ।উত্তম সিদ্ধান্ত।
ফাতেমা — জানি না আল্লাহ ভবিৎষতে কপালে কি রেখেছেন আমাদের।তবুও আমার খুব ইচ্ছা আল্লাহ যদি তৌফিক দেন তো তাকে আমি হাফেজি লাইনে পড়ানোর চেষ্টা করবো।কারন একজন হাফেজ বা হাফেজার বাবা মা হওয়া যে কতটা সৌভাগ্যের তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
মাহিন– হুম ঠিক বলেছো।আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া তিনি যেন আমাদের সন্তানকে সহি সালামতে পৃথীবিতে পাঠান।আর আমরা যাতে তাকে ছোট থেকে দ্বীনের শিক্ষা দিতে পারি ইনশাআল্লাহ।
কিছুক্ষন পর ফাতেমার ফোন বেজে উঠলো ।হেন্সি ফাতেমাকে ফোন করেছে।
হেন্সি মেডিকেলে চান্স না পেলেও ভাগ্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান এ বিষয়ে চান্স পেয়েছে।
ফাতেমা সালাম দিয়ে হেন্সির ফোন ধরলো।
হেন্সি– ওয়া আলাইকুমুস সালাম।কেমন আছিস ফাতেমা??
ফাতেমা –আলহামদুলিল্লাহ ।তুই কেমন আছিস?
হেন্সি– আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তোকে একটা সুখবর দিতে ফোন দিলাম।
ফাতেমা– বল বল তাড়াতাড়ি বল কি সুখবর??
হেন্সি– ইয়ে. .না. .মানে তুইও আন্টি হতে চলেছিস।
ফাতেমা — আলহামদুলিল্লাহ।এ তো মহা সুখবর!!!!!তাহলে আরেকজন নতুন সদস্য আসতে চলেছে আমাদের মাঝে।
দোয়া করি আল্লাহর কাছে আল্লাহ তোকে আর তোর সন্তানকে যেন নেক হায়াত দান করেন।
এ খুশির খবরটা তো সবাইকে জানাতে হবে এখুনি।
হেন্স–ঠিক আছে।ফোন রাখছি এখন।হিহিহি
সালাম বিনিময় করে হেন্সি ফোন রেখে দিলো।
ফাতেমা সবাইকে খুশির সংবাদটা জানালো।
সত্যিই চারিদিকে এখন খুশির মহল।
এভাবেই খুশিতে আনন্দে সবার দিন কাটতে লাগলো।
ফাতেমার যখন প্রেগ্নেন্সির ৭ মাস হলো তখন মাহিন ফাতেমাকে নিয়ে একজন মহিলা গাইনি ডাক্তারের কাছে গেলো।এখানেই ফাতেমা রেগুলার চেকাপের জন্য আসে।কিন্তু কোনদিন আল্ট্রাসনোগ্রাফি করায় নি।আজ এটা করার আগে ব্লাড টেস্ট করতে হবে।
ফাতেমা বরাবরের মতো সুই দেখে নাজেহাল অবস্থা।
যতবার রক্ত পরীক্ষা করতে এসেছে বেচারি ফাতেমা ততবার বেহাল দশায় পড়েছে।
এবারো একি অবস্থা।যিনি রক্ত পরীক্ষা করবেন তিনি একজন মহিলা।
–আপু আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন না হলে ইনজেকশন দিয়ে বেশি ব্যাথা পাবেন।
মাহিন– আরে ফাতেমা ভয় পাচ্ছো কেন??আমি তো আছি সাথে।কিচ্ছু হবে না।চোখ বন্ধ করো।
ফাতেমা — এসব বললেও লাভ নেই।আমার যে প্রত্যেকবার ভয় করে।আমি কি করবো??
মাহিন– তুমি আমাকে ধরো তাহলেই ব্যাথা লাগবে না।
ফাতেমা প্রতিবারের মতো ইনজেকশন দেওয়ার সময় মানে রক্ত নেওয়ার সময় এমনভাবে মাহিনের হাত চেপে ধরলো বেচারা মাহিনের হাতে ফাতেমার নখ বিধে গেছে।
তবুও মাহিন টু করে পর্যন্ত শব্দ করে না।কারন নিজের থেকে বেশি ফাতেমাকে ভালোবাসে।
কোন অযত্ন হতে দেয় না ফাতেমার।
রক্ত পরিক্ষা করতে দিয়ে ফাতেমার আল্ট্রাসনোগ্রাফির জন্য ডাক্তারের কাছে গেলো।
ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখে ফাতেমার পেটে জময মেয়ে বাচ্চা।
ডাক্তার রিপোর্ট তৈরি করার পর ফাতেমা আর মাহিনকে খবরটা জানালো।
এটা শুনার পর থেকে তো ফাতেমা আর মাহিন আনন্দে আত্মহারা।কারন ধীরে ধীরে আল্লাহ ফাতেমার সব ইচ্ছা পূরন করে দিচ্ছেন।
ডাক্তার জানালেন ফাতেমার সব রিপোর্ট ঠিকঠাক আছে আলহামদুলিল্লাহ।ডাক্তার ফাতেমার ডেলিভারির ডেটও দিয়ে দিলো।
ফাতেমা যেহেতু পর্দা করে সেহেতু ফাতেমার ডেলিভারি যাতে মহিলা ডাক্তাররা করেন সে ব্যবস্থাও মাহিন করে রেখেছে।
মাহিন ডাক্তারকে ফাতেমার পর্দার ব্যাপারে বুঝিয়ে বলেছেন।অনেক বুঝিয়ে বলার পর এই মহিলা ডাক্তার রাজি হয়েছেন ফাতেমার ডেলিভারি সব মহিলা ডাক্তার দিয়ে করানোর জন্য।
কারন মহিন ফাতেমার পর্দার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।
তাই সে ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলেছে যাতে কোন পুরুষ ডাক্তার ফাতেমার ডেলিভারি না করেন।
মাহিন আর ফাতেমা সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিলো।
মাহিন গাড়ি ড্রাইভ করেছে আর আনন্দর সারা রাস্তা কেদেছে।
ফাতেমাও কেদেছে ।কারন এতো ধৈর্য ধরার ফল আল্লাহ তাকে দিচ্ছেন আস্তে আস্তে।
মাহিন বাড়ি এসে সবাইকে সুখবরটা জানালো।
সবাই তো আনন্দে আনন্দে আত্মহারা।
সবাই খুব খুশি।
ফাতেমা এখন নিজের অনেক কাজ করতে পারে না।মাহিন সব করে দেয়।মাহিন ফাতেমার চুল আচড়ে দেয় ,বিলি কেটে দেয় ,মাথায় তেল দিয়ে দেয়,ধরে ধরে হাটায়।আরো বাকি সব কাজ করে দেয়।
ফাতেমা যদি খেতে না চায় মাহিন নিজ হাতে জোর করে খাইয়ে দেয়।
ঠিক সময় ওষুধ খাইয়ে দেয়।
বাড়ির বাকিরাও,ফাতেমার খুব খেয়াল রাখে।মেহেঘ বেগম, নুরি ,মহিমা ফাতেমার খুব খেয়াল রাখে।তারা সবাই ফাতেমাকে সময় দেয়।ফাতেমার সাথে গল্প করে ।সবসময় ফাতেমার সাথে কেউ না কেউ একজন থাকেই।সবাই চেষ্টা করে এ সময় ফাতেমা যাতে হাসি খুশি থাকে।যাতে তার মন সবসময় ভালো থাকে।
ফাতেমার বাবার বাড়ির সবাই একটু পর পর ফোন দিয়ে ফাতেমার খোজ খবর নেয়।
সবার এমন ভালোবাসা দেখে ফাতেমার চোখে পানি চলে আসে ।ফাতেমা কোন দিন ভাবতেও পারে নি তার জীবনটা এমন হবে।
তাই ফাতেমা আল্লাহর কাছে বার বার শুকরিয়া আদায় করে।
এ সময় ফাতেমার শরীরটা একটু খারাপ লাগে বলে ফাতেমা কলেজে ক্লাস করে কম। কলেজে কম যায়।কারন এ সময় জার্নি করা ঠিক না।
ফাতেমার কলেজের স্যার ম্যাডামরা অনেক সাপোর্টিব।তারা ফাতেমার এ অবস্থায় ক্লাস করতে বারন করেছে।কিন্তু লেখাপড়ার তো একটু ক্ষতি হচ্ছেই।
কিন্তু হাজার কষ্ট লাগলেও ফাতেমা তার আমল করা ছাড়ে নি।
এখন ফাতেমার পেট বেশি বড় হয়ে গেছে তাই সে দাড়িয়ে নামায পড়তে পারে না।
গর্ভাবস্থায় দাড়িয়ে নামায পড়তে অসুবিধা হলে বসে নামায আদায় করা যায়েজ আছে।
ফাতেমা প্রতিদিন কুরআন পাঠ করে।যা যা আমল করার দরকার তাই তাই করে।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে।
ফাতেমার যত্নের কোন অভাব হয় না।
ফাতেমা মাহিনকে বলছে “জানো আমার না খুব ভয় করে।
মাহিন– আরে পাগলি ভয় কিসের ??আমি আছি না??আল্লাহর রহমতে কিছুই হবে না।আর যা হবে ভালোই হবে ।
তুমি না সাহসী মেয়ে তাহলে ভয় পাও কেন??
ফাতেমা– না মানে….যদি কিছু হয়ে যায় আমার??আচ্ছা আমি যদি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে ,সবাইকে ছেড়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাই তখন কি তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে??
মাহিন ফাতেমার মুখে হাত দিয়ে বললো “আর কোন দিন যদি এমন কথা বলো তাহলে গালে ঠাস করে একটা চড় মারবো।এমন কথা কোন দিন মুখে আনবে না বলে দিলাম।কি সব উল্টা পাল্টা কথা বলো তুমি??কয়েকদিন ধরেই দেখছি খালি এসব উল্টা পাল্টা কথা বলো।
এসব কথা আর একদম মুখে আনবে না বলে রাখলাম।
ফাতেমা — তুমি আমাকে মারবে??
মাহিন– আরে আরে পাগলি মেয়ের কথা শুনো।তুমি এসব আযব কথা কেন বলো হুম।জানো না তোমাকে ছাড়া আমি এ মুহুর্ত থাকতে পারি না।আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভুলেও মুখে আনবে না।
এই বলে মাহিন ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো।
ফাতেমা– হিহিহি।দেখো আমার রাগি মশাইটা ছোটদের মতো কিভাবে কান্না করছে।আরে বোকা আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।আর আমরা আমাদের আমল দিয়ে একসাথে জান্নাতে যাওয়ার চেষ্টা করবো।তুমি ,আমি,আমাদের সন্তান,মা, বাবা,মহিমা,আমার পরিবারের সবাই।আমরা সবাই আমদের আমল দিয়ে জান্নাতে যাওয়ার চেষ্টা করবো।
মাহিন– তাহলে বলো আর কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে না।
ফাতেমা — আচ্ছা ঠিক আছে মশাই আর বলবো না।কিন্তু আল্লাহ যেদিন ডাক দিবেন সেদিন তো এই পৃথীবির মায়া ত্যাগ করে যেতেই হবে।
মাহিন— তখনেরটা তখন দেখা যাবে।কিন্তু এর আগে এমন কথা যেন আমি আর না শুনি।
ফাতেমা — ঠিক আছে মশাই।আচ্ছা নামাযের সময় হয়ে গেছে যাও মসজিদে যাও।
মাহিন– হুম যাচ্ছি।কিন্তু তার আগে তোমার নামাযের ব্যবস্থাটা করে দিয়ে যাই।
মাহিন ফাতেমার নামাযের ব্যবস্থা করে দিয়ে মসজিদে চলে গেলো।
নামায পড়ে ফাতেমা বসে আছে।
মাহিন মসজিদ থেকে ফিরলে তারপর তাকে খাইয়ে দিবে।
মেহেঘ বেগম ফাতেমার রুমে এলো।
মেহেঘ– কিরে মা শরীরের অবস্থা এখন কেমন তোর??
ফাতেমা– ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু মাঝে কোমর,পিঠ ,ঘাড় এগুলো ব্যাথা করে।
মেহেঘ– জানি রে মা।এ সময় এরকম ব্যাথা হয়।কিন্তু এর থেকে হাজার গুণ ব্যাথা সহ্য করতে হয় বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে।
পুরুষেরা যদি সেই ব্যাথা একবার অনুভব করতে পারতো তাহলে কোনদিন তাদের মা আর স্ত্রীদের সাথে খারাপ আচরন তো দূরে থাক টু শব্দটা পর্যন্ত করতো না।
কিন্তু আমাদের পৃথীবির সব পুরুষেরা সেটা বুঝে না।তাই তারা নারীজাতির সাথে রূঢ় আচরন করে।
ফাতেমা — ঠিক বলেছো মা।আল্লাহ যদি এটা বুঝার ক্ষমতা তাদেরকে দিতো তাহলে সমাজ থেকে নারী নির্যানত নামক ভয়ংকর ব্যাধি উঠে যেতো।
মেহেঘ– মা রে আমার তো তোর জন্য ভয় হয়।যেহেতু তোর পেটে যমজ বাচ্চা সেহেতু তোর ডেলিভারিস সময় সমস্যা হতে পারে।তাই সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করি যাতে আল্লাহ তোকে আর তোর সন্তানদের সুস্থ রাখে।
মেহেঘ– আচ্ছা যেহেতু তোর দুটি মেয়ে হবে তাদের তো নাম ঠিক করতে হবে।তাই না??
ফাতেমা– তা তো করতেই হবে।আজ বাবা আর ও নামায থেকে আসলে রাতের খাবারের পর সবাই মিলে নাম ঠিক করবো।
মেহেঘ– ঠিক আছে তাহলে।
আমি এখন যাই।রাতের খাবার বাড়তে হবে।
একটু পরে মহিমা এসে ফাতেমার সাথে আলাপ করে গেলো।
মাহিন আর আরমান সাহেব মসজিদ থেকে ফিরে এলো।
মাহিন ফাতেমাকে এসে নিজ হাতে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো।
নিজেও খাবার খেয়ে নিলো।
তারপর বাচ্চাদের নাম ঠিক করার জন্য সবাই একসাথে বসলো।
মাহিন ফাতেমাকে ধরে ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলো।
সবাই একসাথে বসেছে বাচ্চার নাম ঠিক করার জন্য।
একেক জন একেক নাম বলছে কিন্তু কারোরই কোন নাম ভালো লাগছে না।
অবশেষে ফাতেমার ঠিক করা নামগুলো সবার পছন্দ হলো।
ফাতেমা — আমি যে নাম গুলো ঠিক করেছি একবার সেগুলো তো শুনো তোমরা।
আরমান– হে মা তুই বল।
ফাতেমা– যে বড় হবে তার নাম হবে জান্নাতুল ফেরদৌস হুরাইরা ,আর যে ছোট হবে তার নাম হবে জান্নাতুল ফেরদৌস হাবিবা।
মেহেঘ– মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর নাম।আমার তো পছন্দ হয়েছে।
বাকিরাও সহমত জানালো।
মহিমা– তাহলে এই দুটো নামি সিলেক্ট করা হলো।
মাহিন– হুম ঠিক আছে।
সবাই একসাথে বসে অনেক আলাপ ,হাসি ,মজা করলো।
এভাবেই দিন দিন ফাতেমার ডেলিভাবির ডেট এগিয়ে আসলো।
একদিন সকাল বেলা মাহিন কি যেন একটা কাজে বাইরে গেলো।
ফাতেমা নিজের ঘরেই ছিলো।
মেহেঘ বেগম আর নুরি রান্নাঘরে ছিলেন।
আর মহিমা কলেজে আছে।
আর আরমান সাহেব অফিসে গেছেন।
ফাতেমা একা একা বসে কুরআন পড়ছিলো।
হঠাৎ হালকা ব্যাথা উঠলো ফাতেমার।ব্যাথাটা সহ্য করার মতো ছিলো বলে তেমন পাত্তা দেয় নি ফাতেমা।
কিন্তু আস্তে আস্তে ব্যাথা বাড়তে শুরু করলো।
ফাতেমা — হে আল্লাহ এমন ব্যাথা করছে কেন??
ব্যাথার মাত্রা বেড়েই চলেছে।
হে আল্লাহ…..
ফাতেমা আর সহ্য করতে না পেরে তার শ্বাশুড়ি মাকে ডাক দিলো।
—মা….ও. মা…….
ফাতেমার চিৎকার শুনে মেহেঘ বেগম আর নুরি দৌড়ে এলো।
মেহেঘ বেগম এসে দেখে ফাতেমা ব্যাথায় কাতারাচ্ছে।
মেহেঘ বেগম ফাতেমার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।
–ফাতেমা তোর কি হলো রে মা??হে আল্লাহ..মনে হয় ডেলিভারির টাইম হয়ে গেছে।কিন্তু ডেট তো তিন দি পরে ছিলো।
ফাতেমা —মা তাড়াতাড়ি সূরা ইনশিকাক পড়ে পানিতে ফু দিয়ে আমাকে দাও।
মেহেঘ– মা রে আমি তো এ সূরা পারি না।এখন কি করি??মাহিনটা গেলো কোথায়??
মেহেঘ বেগম মাহিনকে তাড়াতাড়ি ফোন দিলো।
মাহিন– মা কি হয়েছে হাপাচ্ছো কেন???
মেহেঘ— মাহিন তাড়াতাড়ি বাসায় আয় ফাতেমাকে হসপিটালে নিতে হবে।
এই বলে মেহেঘ বেগম ফোন কেটে দিলো।মাহিন বাসার কাছেই ছিলো।
মাহিন তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বাসায় গেলো।
মাহিন– কি হয়েছে ফাতেমার??
মেহেঘ– লেভার পেইন উঠেছে ।তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে চল।
ফাতেমার মরার মতো অবস্থা কিন্তু ঠিকি সে পর্দার কথা মাথায় রেখেছে।
ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আর বলছে –মা ..মাগো তুমি আমাকে আগে বোরকাটা পড়িয়ে দাও।আমার হিজাব আর যা আছে পড়িয়ে দাও।
মেহেঘ– আরে শুনো পাগল মেয়ের কথা।এ অবস্থাতেও পর্দার নাম ভুলে নি।মা রে এখন এসব পড়তে হবে না।তোকে এভাবেই নিয়ে যাবো।তুই চিন্তা করিস না ।তোর গুনাহ হবে না।
ফাতেমা — না মা ।আমাকে এগুলো পড়িয়ে দাও।আর আমার একটা কথা রেখো ,আমি যদি মরেও যাই আমার পর্দার লঙ্ঘন যাতে না হয়।আমাকে যেন কোন পরপুরুষ না দেখতে পারে।
মাহিন— তুমি শান্ত হও।আমি কথা দিচ্ছি কোন অবস্থাতেই তোমার পর্দার লঙ্ঘন আমি হতে দিবো না।দাড়াও আমি পড়িয়ে দিচ্ছি এসব।
মাহিন তাড়াতাড়ি ফাতেমাকে বেরকা ,হিজাব ,আর বাকি জিনিস পড়িয়ে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে সোজা হাসপাতালে চলে গেলো।
বাড়ির অন্য গাড়ি দিয়ে মেহেঘ বেগম আর নুরি হাসপাতালে গেলো।
মাহিন তাড়াতাড়ি ফাতেমাকে ওটিতে নিয়ে গেলো।
যে ডাক্তার ফাতেমার ডেলিভারি করানোর কথা তিনি তাড়াতাড়ি বাকি মহিলা ডাক্তারদের নিয়ে এলেন।
ডাক্তার ফাতেমাকে দেখে বললেন–Oh my god. রোগির অবস্থা ভালো না।ওর নরমাল ডেলিভারি করানো সম্ভব না।তাহলে মা আর সন্তান সবার বিপদ হতে পারে।তাই ইমিডিয়েটলি অপারেশন করতে হবে।
ফাতেমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে।OT তে নিয়ে সিস্টাররা ফাতেমাকে অক্সিজেন দিচ্ছে।
ডাক্তার মাহিনকে বললো –দেখুন রোগির অবস্থা ভালো না যেকোন কিছু ঘটতে পারে।তাই বন্ড পেপারে আপনাকে সই দিতে হবে।
একথা শুনে মাহিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
মাহিন— কী??যে কোন কি..কি ..কিছু হতে পারে মানে???কি বলছেন এসব? ?না আমার ফাতেমার কিছু হতে পারে না।
–দেখুন তাড়িতাড়ি এটাতে সই করুন না হলে রোগিকে ICU তে নিতে পারবো না আমরা।যা করার তাড়াতাড়ি করুন।
মাহিনের হাতে ডাক্তার একটা কলম দিয়ে বললো –এই কাগজটাতে সই করুন।
মাহিনের সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।হাত কাপছে মাহিনের।কাপাকাপা হাত নিয়ে মাহিন সই করে দিলো।
মাহিন আল্লাহকে ডাকছে আর চিৎকার করে কাদছে।
মেহেঘ বেগম তাড়াতাড়ি আরমান সাহেবকে ফোন দিলো আর ফাতেমার বাড়ির সবাইকে ফোন দিলো।
এ সংবাদ শুনে ফাতেমার বাড়ির সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
তারা তাড়াতাড়ি রওনা দিলো।
এদিকে ICUতে ফাতেমার অবস্থা খারাপ।
ডাক্তারাও ঘাবড়ে গেছে।
এদিকে মাহিন তো আল্লাহকে ডেকেই চলেছে আর কেদেই চলেছে।
মেহেঘ বেগম ICU এর সামনে পায়চারি করছে টেনশনে।নুরিও এখানে।
আর মাহিন আধমরা হয়ে বসে আল্লাহকে ডাকছে।
এই মুহুর্তে মহিমা আর আরমান সাহেব এলো।
৩ ঘন্টা হয়ে গেছে এখনো কোন খবর নেই।
৫ ঘন্টার মাথায় ICU থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনা গেলো।
একজন নার্স এসে বললো –রোগির বাড়ির লোক কে আছেন??
মাহিন দৌড়ে গেলো।-জ্বি বলুন আমার স্ত্রী কেমন আছে।???
–আপনার দুটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছে।
মাহিন– আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু ফাতেমা কেমন আছে??
সিস্টার– I am sorry. .
মাহিন — সরি মানে????সরি মানে কি বলছেন???
মাহিন চিৎকার করে বললো–Answer me dam why do you say sorry.???why why why????
সিস্টার– দেখুন চিন্তা করবেন না।আপনার স্ত্রী মারা যান নি।কিন্তু ২৪ ঘন্টা না গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
কারন প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।তাই রক্ত লাগবে।আর উনার গ্রুপের রক্ত আমাদের ব্লাড ব্যাংকে আছে।আমরা যথা সম্ভব চেষ্টা করছি।আপনি আল্লাহকে ডাকুন।
ফাতেমার বেচে থাকার কথা শুনে মাহিনের প্রাণ যেন ফিরে এলো।
বেচারা খাড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেলো।
ফাতেমার বাড়ির লোকেরা সবাই এসে হাজির।
খাদিজা বেগম আর আবিদা তো কান্না শুরু করে দিয়েছে।
সবার প্রাণ যেন ধক ধক ধক ধক. করছে।
বাচ্চাদেরকে ICU তেই রাখা হয়েছে।
এখনো কেউ তাদের মুুখ পর্যন্ত দেখে নি।
কিছুক্ষন পর ২ জন নার্স এসে ফাতেমার ২ মেয়েকে বাইরে নিয়ে এলো।
মাহিন ওখানেই দাড়িয়ে ছিলো।
এক বাচ্চাকে মাহিন কোলে নিয়েছে আরেক বাচ্চাকে হাসান কোলে নিয়েছে।
কি ফুটফুটে হয়েছে দুটো বাচ্চা।একদম পরীর বাচ্চার মতো।
একে একে সবাই এসে বাচ্চাদেরকে দেখছে।
হাসান –ভাই মাহিন তোমার মেয়ে দুটোর কানে তো আজান দিতে হবে।জানি তোমার মনের অবস্থা ভালো নেই।তবুও ভাই বাবা হিসেবে এই দায়িত্বটা তো তোমাকে পালন করতে হবে।
মাহিন দুই বাচ্চার কানের কাছে আস্তে করে আজান দিলো।
ও মা কি অবাক কান্ড আজান দেওয়ার সময় বাচ্চা দুটো কি সুন্দর চুপচাপ আজান শুনছিলো ।মনে হচ্ছিলো যে তারা এই আজানের অর্থ বুজতে পারছে।
মুখে হাসি ফুটে উঠেছিলো দুই নবজাতকের।
আযান দেওয়ার পর মাহিন আর হাসান দুই মেয়েকে মেহেঘ ও খাদিজা বেগমের কোলে দিলো।
মাহিন ICU এর বার বার দাড়িয়ে ফাতেমাকে দেখার চেষ্টা করছে। ICU এর কাচ দিয়ে শুধু অক্সিজেন মাস্ক লাগালো ফাতেমার নিশ্পাপ মুখটা দেখা যাচ্ছে।
মাহিনের চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে।
সারাদিন কোন খাওয়া নেই কারো।
শুধু নামাযের সময়টা সবাই এক এক করে নামায পড়ে নিয়েছে।
হাসপাতালে মহিলাদের নামাযের জায়গা আছে সেখানে মহিলারা নামায পড়ে নিয়েছে।
মাহিন– সন্ধ্যা হয়ে গেছে।মা উনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন।উনাদের বাসায় নিয়ে যাও।আমি আছি এখানে।
প্রথমে কেউ যেতে রাজি হচ্ছিলো না।তারপর মাহিন জোর করে রাজি করিয়েছে।
সবাই বাড়ি চলে গেলো।কিন্তু মাহিনের সাথে হাসান রয়ে গেলো।
সারা রাত মাহিন না ঘুমিয়ে মসজিদে কিটিয়েছে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে।আল্লাহ যাতে ফাতেমাকে ঠিক করে দেন।
বাচ্চাদেরকে ডাক্তারেরা হাসপাতালেই রেখে দিয়েছিলেন।
২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেলো।
আল্লাহ মাহিনের দোয়া কবুল করেছেন।
ফাতেমার জ্ঞান ফিরেছে।
এক নার্স এসে মাহিনকে খবর দিলো।
মাহিন দৌড়ে ফাতেমার কাছে গেলো।
মেয়ে দুটোকে ডাক্তারেরা ফাতেমার কাছে দিয়েছেন।
মাহিন ফাতেমার কাছে গিয়ে হাত ধরে কান্না শুরু করে দিলো।
ফাতেমা দূর্বল শরীর নিয়ে বললো–আরে ও আমার রাগি মশাই কাদছো কেন??কি ভেবেছিলে তোমাকে ছেড়ে আমি চলে যাবো??হুম???এই যে মশাই এই দুনিয়াতে তো না বংর আখিরাতেও আমি আপনার পিছু ছাড়বো না।ইহকাল পরকাল দুজন একসাথে থাকবো।
মাহিন– জানো কত ভয় পেয়ে গেছিলাম।অাল্লাহর কাছে কোটি শুকরিয়া আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দিয়েছেন।আলহামদুলিল্লাহ।
ফাতেমা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বললো–দেখেছো মামনিরা তোমাদের আব্বুজি কত ভিতু আর বোকা।ছোটদের মতো কান্না করছে।হিহিহি
এ যে মশাই দেখো তুমি কাদছো বলে তোমার মেয়েরা হাসছে।
মাহিনের মুখে এতোক্ষন পর হাসি ফুটলো।
মাহিন বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বললো –না মানমিরা তোমাদের আব্বুজি একদম ভিতু না।অনেক সাহসি।তোমাদের আম্মুজি খালি আমাকে কাদায়।তোমাদের আম্মুজিকে একটু শাসন করে দাও তো।
দুই মেয়েকে নিয়ে ফাতেমা আর মাহিন বেশ মজা করছে।ওদেরকে দেখলে কে বলবে একটু আগে কত ভয়ংকর পরিস্থির মধ্যে ছিলো।
মাহিন ফাতেমার সুস্থ হয়ে ওঠার কথা বাড়ির সবাইকে জানালো।
ফাতেমা ৭ দিন হাসপাতালে ছিলো।৭ দিন পর ডাক্তার তাকে ডিসচার্জ করে দিলো।
আজ ফাতেমা তার দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।আর আজ দুই মেয়ের আকিকাও।
তাই সব সুন্নতি আয়োজনের মধ্য দিয়ে আকিকা হলো।
এভাবেই হেসে খেলে দুই মেয়ে হুরাইরা আর হাবিবাকে নিয়ে দিন কাটছে ফাতেমা আর মাহিনের।
ফাতেমার প্রতি ভালোবাসা দিন দিন আরো বেড়ে গেলো মাহিনের।
বাচ্চাদের সব খেয়াল রাখে দুজনে মিলে।
আর হুরাইরা আর হাবিবার নানা নানু ,দাদা দাদুর চোখের মনি তারা দুই বোন।
দুই বোন যেন পরীর বাচ্চা।ফাতেমার মতো সুন্দরি হয়েছে দুই মেয়ে।
মহিমার চোখের মনি দুই ভাতিজি।
এভাবে কেটে গেলো ১০ টা বছর।
আজ ফাতেমা আর মাহিনের দুই মেয়ে হুরাইরা আর হাবিবা দুইবোন হাফেজা হয়েছে।
দুই বোন তুখর মেধাবি ছাত্রী।
আর ছোট থেকেই মাহিন আর ফাতেমা দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে তুলেছে তাদেরকে।দুই বোনের ব্যবহার এতো ভালো।দুটা জান্নাতের টুকরা ।
১০ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে।
মহিমার বিয়ে হয়ে গেছে আরো ৮ বছর আগে।একজন হাফেজের সাথে।সে শুধু হাফেজ না ।একজন বড় মাপের ডাক্তারও।মহিমারও ১ মেয়ে।
হেন্সির ও ১ মেয়ে এক ছেলে।
আবিদারও ২ মেয়ে।
সবাই তাদের ছেলে মেয়েদেরকে মাদরাসায় ভর্তি করেছে।
ছোট থেকেই দ্বীনের শিক্ষা দিচ্ছে তারা।
ফাতেমা এখন শুধু একজন মা, একজন স্ত্রী বা বৌমাই না।সে এখন এ শহরের নামকরা গাইনি বিভাগের ডাক্তার।সে আরো বিখ্যাত গরিবদেরকে বিনা টাকায় চিকিৎসা দেওয়ার জন্য।
শুধু এই সেবামূলক কাজেই থেমে নেই সে।
মাহিন আর ফাতেমা মিলে এক সেচাছা সেবা মূলক সংগঠন তৈরী করেছে।
সেটার মূল কাজ হচ্ছে যারা অত্যাচারিত নওমুসলিম তাদের সংস্থা এটা।
যারা অন্য ধর্ম থেকে মুসলিম ধর্ম গ্রহন করে তাদেরকে নানা ভাবে সাহায্য করে এই সংস্থা।
অত্যাচের স্বিকার নওমুসলিমদের তারা নানা ভাবে সাহায্য করে আর ভালো কাজও দিয়ে থাকে।
ফাতেমা আর মাহিন এমন মহান উদ্দোগ দেখে সবাই তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।খুব বিখ্যাত তাদের এই সংস্থা।
তাদের এই বিখ্যাত সংস্থার নাম **#ফিরে_আসা**
হুরাইরা– আম্মুজি আর আব্বুজি তোমাদের কাছে আমার প্রশ্ন তোমরা এই সংস্থার নাম ফিরে আসা কেন দিলে??
হাবিবা– হে আম্মুজি আর আব্বুজি আমারো একি প্রশ্ন এই নাম দিলে কেন????
ফাতেমা আর মাহিন তাদের মেয়েদের কথা শুনে হাসলো।
হুরাইরা– হাসছো কেন তোমরা??
হাবিবা– হুম হাসছো কেন???
মাহিন ফাতেমা হাত ধরে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বললো““““কারন আমার হুর পরীর কারনেই যে রবের কাছে আমার #ফিরে_আসা””””””
সমাপ্ত
গল্প এই পর্যন্তই শেষ।শেষটা এভাবে শেষ করবো ভাবতেই পারি নি।আরো অনেক কিছু লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু লেখা হলো না।আরো অনেক ইনফরমেশন গল্পে দেওয়ার ছিলো দেওয়া হলো না।
সময়ের সল্পতার কারনে পাড়লাম না শেষ পর্বটা ভালো করে লিখতে।আমি দুঃখিত।শেষ পর্বটা আমার মন মতো হয় নি।।
কিন্তু শেষ করতে পেরেছি এতেই শুকরিয়া।আলহামদুলিল্লাহ।
কিন্ত গল্পের পাঠকের উদ্দেশ্যে আমার একটাই কথা গল্পটা শুধু বিনোদোন হিসেবে নিলে হবে না।।গল্পে যে শিক্ষনিয় দিকগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো যদি আপনারা আপনাদের জীবনে প্রয়োগ করেন তাহলেই আমার লিখা স্বার্থক হবে।
আর গল্পটা শেষ ।হয়তো সবাই আমাকে ভুলে যাবে।কিন্তু আমার প্রত্যেকটা পাঠককে খুব মিস করবো।
!! লেখিকার জন্য সবাই দোয়া করবেন যাতে ভবিৎষতে আরো ভালো গল্প লিখতে পারে।
আরঃ আমার জন্য ও দোয়া করবেন সবাই।
আস সালামু আলাইকুম।
আল্লাহ হাফেজ।