#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_১০
সিমি মেহমানদের সামনে এসে একেবারে স্ট্যাচু হয়ে গেলো।শফিক বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন, আর পারু একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন সিমিকে এই বাড়িতে দেখে।
শফিক আর পারুকে আনতে গাড়ি পাঠানো হয়েছিলো। সুন্দর,মনোরম সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে ঢুকে তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন।অনেক বড় লিভিং রুমে তাঁদের বসানো হলো।
পরশের বড় মামা হায়দার, হায়দার গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান। সিমির বাবা এতদিন এই ইন্ডাস্ট্রিতে সেকেন্ড একাউন্টেন্ট পদে চাকরি করলেও হায়দাররের সাথে সরাসরি পরিচয় ছিল না।এত এত এম্প্লয়ির ভেতরে শফিককে আলাদা ভাবে চেনার প্রয়োজন পড়ে নি।তাই যখন হায়দার সব কিছু শুনলেন রোকেয়ার কাছে, তিনি খুব আশাহত হলেন।ভাগ্নেকে নিয়ে তাঁর অন্যরকম স্বপ্ন ছিল। তার কোম্পানির একজন সামান্য কর্মচারীর মেয়ের সাথে পরশের বিয়ের কথা শুনে খুবই দুঃখ পেলেন।
বোন রোকেয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য হায়দারের ছিল না তাই অফিসে শফিককে তলব করলেন তাঁর রুমে।শফিক এই সংবাদে অসম্ভব ভয় পেয়ে গেলেন,ভাবতে বসলেন নিজের অজান্তেই কোন ভুল হয়ে গেলো না তো।তা না হলে এত দিনের চাকরি জীবনে কখনো যার সঙ্গে সরাসরি কথা হয়নি সেই চেয়ারম্যান স্যার তাঁকে কেন ডাকবেন?
ভয় আর সঙ্কা নিয়ে উপস্থিত হলেন হায়দারের সামনে। হায়দার তাঁকে খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।আগেই সব খবর নিয়েছেন শফিক সম্পর্কে। চাকরি জীবনে সৎ একজন মানুষ এই ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই।শফিকের পরিবারে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ কেউ নেই। একমাত্র শফিক সবার মধ্যে একটু ভালো অবস্থানে আছেন।মাথার চুল অনেক কমে এসেছে গায়ের শার্ট-প্যান্ট পুরনো হলেও পরিপাটি, জুতাজোড়া ও অনেক পুরনো ,এর উপরেই জুতার কালি মেখে চকচকে করা হয়েছে। মোটামুটি নিম্ন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির বাস্তব চিত্র।
হায়দার অভয় দিয়ে শফিককে বসতে বললেন। শফিক কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বসলেন।
—শফিক সাহেব কেমন আছেন?
—জি স্যার ভালো।
এসির মধ্যে বসেও শফিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো।রুমাল বের করে ঘাম মুছতে ও ভয় লাগছে।
—আপনাকে একটা অ্যাড্রেস দিচ্ছি,আপনি আগামীকাল লাঞ্চ আওয়ারে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে ওখানে যাবেন। আমিও জুম্মার নামাজ আদায় করে ওখানে উপস্থিত হবো।এই সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করবেন না, ওখানে গেলেই সব কিছু জানতে পারবেন।তবে আশ্বস্ত করছি ভয়ের কোনো কারণ নেই। ঠিক আছে এবার আপনি আসুন তাহলে।
এই ব্যাপারে অফিসে কারো সঙ্গে আলোচনা করার দরকার নেই সেটাও জানিয়ে দিলেন।
শফিক কোনমতে চেয়ারে এসে বসলে।অন্য কলিগরা এসে জড়ো হলো। কি কারনে চেয়ারম্যান স্যার হঠাৎ ডেকেছেন সেই কৌতূহলে। শফিক জানালেন তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি।
গত রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি।একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে।কি কারণ হতে পারে।
সিমিকে এখানে দেখে তাই শফিক আর পারু বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। হায়দার আসতেই শফিক যেন চেতনায় ফিরলেন।
হায়দার ,শফিককে বসতে বললেন।
শফিক বললেন-
—স্যার আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।
—আমার ভাগ্নে পরশ আর আপনার মেয়ে সিমি বিয়ে করেছে।
এর পর সব কিছু খুলে বললেন। সবার পরিচয়, যোগ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।
সব শেষে বললেন-এটা ওরা খুব অন্যায় একটা কাজ করেছে।
—জি স্যার একশবার,এটা খুবই জঘন্য কাজ করেছে।আমি সিমিকে কখনো ক্ষমা করবো না।
সিমি দাঁড়িয়ে সবই দেখছে,সে বুঝতে পারছে না,পরশের মামাকে তার বাবা স্যার স্যার করছে কেন?এটাও বোঝা যাচ্ছে উনাকে তার বাবা খুব ভয়ও পাচ্ছে।তার মানে তার বাবা কাউকে অন্তত ভয় পায়!
কথা নেই বার্তা নেই পারু নিরবে কাঁদতে শুরু করলেন।
হায়দার ,সবাইকে আসতে বললেন।সবার সাথে পরিচয় হয়ে যাওয়ার পরে হায়দার বললেন-
আমার বোনের পরিবারের সবাই অনেক চেষ্টা করেছে সিমিকে আপন করে নিতে। কিন্তু সিমি আলাদা বাসায় থাকতে চায়,পরশের পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি তাই ওর পক্ষে সংসারের দায়িত্ব নেয়া কোন ভাবেই সম্ভব না।অনেক বুঝিয়ে ও কোন লাভ হয়নি আপনার মেয়েকে।আর ও যথেষ্ট বেয়াদব একটা মেয়ে। এখন আপনি বলেন আমাদের কি করা উচিৎ।উভয় পরিবারের মতামতের ভিত্তিতে এর একটা ফয়সালা দরকার।
—স্যার থাপ্পর দিয়ে দাঁত ফেলে দেন।মাইর পরলেই ঠিক হয়ে যাবে।
এবার নাঈম হেসে বললেন-
—সব কিছু মেরে ঠিক করা সম্ভব না।আর এটা কোন সমাধান না।
দাদু বললেন-
—সিমিরে আপনেরা সাথে কইরা নিয়া যান।ওর সমস্ত খরচপাতি আমরাই দিমু।পরশের পড়া শেষ হইলে তখন আলাদা সংসার পাতবোনে দুইজন। এখন এই মাইয়া এই সংসারে থাকলে এই সংসারে প্রতিদিন অশান্তি হইবো।
শফিক কটমট করে তাকালেন সিমির দিকে।সিমি বুঝতে পারছে না এই সব কি হচ্ছে।
শফিক বললেন-
—আমাকে ক্ষমা করবেন আপনারা,সিমিকে আমি নিয়ে যেতে পারবো না।ওর জন্য আত্নীয় স্বজন , প্রতিবেশী সবার কাছে ছোট হয়েছি।এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে ,ওকে নিয়ে গেলে আর আবার নতুন করে ঝামেলার সৃষ্টি হবে আর মুখ দেখাতে পারবো না। আমি আবারো ক্ষমা চাইছি।
—আপনার মেয়েরে স্বাভাবিক মনে হয় না। আমার মনে হয় ও নিজেই জানে না কি চায়। সবার সাথে মিইলা মিইশা থাকলে তো কোন সমস্যাই ছিল না।
সিমির নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে।কেউ তাকে রাখতে চায় না।তাহলে কি তার নিজের মধ্যেই সমস্যা?আগে পান থেকে চুন খসলেই বাবা মারতো, তাঁর কথা শোনানোর মাধ্যমই ছিল মাইর দেয়া।কখনো নরম করে কথা বলেছে বাবা?রাগে দুঃখে তার গা কাঁপতে লাগলো। নিজের চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করলো। তার বাবা, দাদি, ফুফুরা,চাচারা সবাই মিলে কি অমানবিক আচরণ করেছে তার মায়ের সাথে সেই সব কিছু তো সিমি চোখের সামনে দেখেছে।মাঝে মাঝে তার মা নাখেয়ে থেকেছে কারণ ভাত শেষ।পরের বেলা পেট ভরতো কিনা সেটা মাই ভালো জানে।পরশের পরিবারের সব উল্টো চিত্র দেখে সিমির বিশ্বাস হলো না।সে ভাবলো এদের উপরে উপরে ভালো রুপ, কিছুদিন গেলেই তার ভাগ্যও তার মায়ের মত হবে।
তবে এর মাঝেও একটা ভালো চিন্তা এলো সিমির মনে তা হলো, এই মুহূর্তে তাকে চুপ করে থাকতে হবে।দেখা যাক কি হয়।সে কিছুতেই আবার বাবার বাসায় ফিরে যেতে চায় না।
শফিক বললেন-
—স্যার আশা করি ব্যক্তিগত বিষয় আমার চাকরির ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না।এই বয়সে চাকরি হারালে ছেলে,মেয়ে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে আমাকে।
শফিকের কথায় অনুনয় নিবেদন ঝরে পড়ছে।
হায়দার বললেন-
—এই ব্যপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
—আরেকটা অনুরোধ, সিমিকে তাড়িয়ে দিবেন না দয়া করে।একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে আপনারা ওকে আপন করে নিন।
যেই বাবার উপর এতটা রাগ আর ক্ষোভ জমা ছিল সিমির মনে আজ সেই বাবাকে ওদের সামনে এতটা ছোট হতে দেখে খুব খারাপ লাগছে। দৌড়ে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এভাবে বলো না বাবা, তোমাকে এত অনুনয় করতে হবে না,আমি ওদের কথা শুনে চলবো।সিমি যেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল,দ্রুত পায়ে তার বাবার কাছে গিয়ে, বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
পারুর চোখে যে পাথর হৃদয় মানুষ শফিক, তার চোখে ও পানি দেখে পারু বর্তমান পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে শফিকের চোখে থেকে কিভাবে পানি ঝরে তা দেখতে লাগলেন।
একটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলো।
হায়দারের কথায় সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিরে এলেন।
—রোকেয়া আমার একটা মিটিং আছে , কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হতে হবে।
—আচ্ছা তাহলে খাবারের পর্বটা সেরে ফেলি?সবাই চলুন প্লিজ।
টেবিলে বিরাট আয়োজন।সিমি সকাল থেকে একবার ও রান্না ঘরে উঁকি দেয়নি। তার খুব খারাপ লাগতে লাগলো। তার বাবা-মায়ের জন্য এত আয়োজন করেছে তার শাশুড়ি খুব অবাক লাগছে।ওরা মানুষ হিসেবে ভালো ও হতে পারে!
তাঁরা তো তার বাবা-মাকে ইচ্ছা করলে অনেক অপমান ও করতে পারতো।মামা তার বাবার মতো একজন সামান্য কর্মচারীকে চাকুরীচুত্য করলে কিছুই করার ছিল না।অবস্থার দিকে থেকে তাদের আর পরশদের মধ্যে এত পার্থক্য তার পরেও তারা কোন অহংকার দেখাচ্ছে না।
সবাই সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর খাচ্ছে।মনে হচ্ছে বহুদিনের চেনা তারা। শফিক সবাইকে দাওয়াত করলেন।
আলোচনা করে ঠিক হলো কিছু দিন পর রিসেপশনের ব্যবস্থা করা হবে।আর সব কিছু নির্ভর করছে সিমির উপর।
অনেক দিন পর টেক্সট করলো তাশফি। নওমি ভাবলো সিন করবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের কাছে যুক্তি হার মানলো।ফুচকা খাওয়ার সময় তোলা সেলফিগুলো পাঠালো।তাশফি লিখেছে,”ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছে।
এখনো ঘুমাওনি কেন?”
“ঘুম আসছে না।আপনি কেন ঘুমাননি?”
“কি কর?”
“জানালার পাশে বসে আছি, চাঁদের আলো এসে পড়েছে রুমের ভেতর।আপনি কি করছেন?”
“ছাদে দোলনায় বসে আছি আর তোমার ছবি দেখছি।আমরা দুজনেই চাঁদের আলো উপভোগ করছি, দারুন না ব্যপারটা? তোমার আর আমার পছন্দ মিলে গেলো।”
“চাঁদের আলো কে না পছন্দ করে?তবে এই মুহূর্তে আমি শুধু চাঁদের আলোর রুপ দেখছি আর আপনি সেটা গায়ে মাখছেন।”
“দারুন বললে তো।”
“হু,এটাই তো আপনার আর আমার মাঝে পার্থক্য।যোজন যোজন দূরত্ব।”
“তুমি চাইলে সেই দূরত্ব ঘুচে যেতে পারে এক মুহূর্তে।”
“এই পৃথিবীতে সব কিছু চাইলেই সম্ভব হয় না।”
“শুধু একবার চেয়ে দেখ।”
“এবার ঘুমান, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
“আমার উত্তর পেলাম না তো।”
“সব কিছুর উত্তর সবাই কি দিতে পারে?”
“পারে, ইচ্ছে করলেই পারে?”
“ভালো থেকবেন।”
“তুমিও।”
ঘর অন্ধকার হলেও মোবাইলের আলো জ্বলছে তাই পম্পি বুঝতে পারলো নওমি ঘুমায়নি।কাছে আসতেই নওমি ভয় পেয়ে গেলো।
—কি রে কিসের মধ্যে এত ডুবে আছিস?আমাকে দেখে ভয় পাস?
—এভাবে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে আসলে ভয় পাবো না?
—মোটেও নিঃশব্দে আসিনি।আমি ওয়াসরুমে গেলাম,পানি খেলাম তবুও বলিস নিঃশব্দে এসেছি? কি রে আসলেই কি প্রেমে মজেছিস?
—ফালতু কথা বলবি না তো।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু