#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_১৯
হোসেন বাড়ী নেই জেনেই নিরার স্বামী আসতে সাহস পেয়েছে। হোসেন বোনকে সান্ত্বনা দিলো। বোনকে বলল,সে যেই খামারে কাজ করে সেখানে নিয়ে যেতে এসেছে তাকে। সেখানে রান্নার কাজ করবে নিরা তাহলে ভাই-বোন এক জায়গাতেই থাকতে পারবে।একা একা এই বাড়ীতে নিরাকে থাকতে হবে না।এর মাঝেই অনেক শকুনের চোখ এই বাড়ীর উপর পড়েছে ,যারা নিরাকে খুবলে খেতে চায়।
এক অজানার পথে যাত্রা করলো নিরা।তবে তার ভাই সাথে আছে তাই বিন্দুমাত্র ভয় লাগছে না তার। খামারে ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেল নিরার।অনেক জাতের,অনেক রঙের গোলাপ ফুলের গাছ আর প্রতিটা গাছেই ফুল ফুটে আছে।
কি অপূর্ব লাগছে দেখতে,চোখ জুড়িয়ে যায়। জীবনে কোন দিন এত গোলাপ ফুলের গাছ সে দেখেনি।এই সুন্দর্য তার চোখ আটকে দিলো। হোসেন পেছনে তাকিয়ে দেখে নিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুল দেখছে,সে কাছে এসে বলল,’এখন প্রত্যেক দিনই দেখতে পারবি, এইবার চল।’
এই খামারের মালিক তোফাজ্জল হোসেনের সামনে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল নিরা। হোসেন নিরার প্রশংসা করে যাচ্ছে,ওর রান্নার হাত কতটা ভালো খাওয়ার পরই বুঝতে পারবেন , আরো কত কি। তোফাজ্জল একবার মাথা তুলে বললেন,’ঠিক আছে কাজে লেগে যাও।’
রান্না আসলেই ভালো হয়েছে,এত এত টাকা ইনকাম করে লাভ কি যদি তৃপ্তি করে খেতেই না পারেন।হোসেনকে ডেকে বললেন,’তোমার বোনের চাকরি পাকা। ডাক তোমার বোনকে । খুব ভালো রান্না করে।নিরা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরে ঢুকলো মাথা নিচু করে। তোফাজ্জল বললেন,’এখানে আমাকে প্রায়ই আসতেন হয়। আমি আবার রান্না ভালো না হলে খেতে পারি না।
ভালোই হলো তোমাকে নিয়ে এসেছে হোসেন,নাম কি তোমার?,’নিরা’।
‘শোন নিরা রান্নার আগে আমার কাছে জেনে নিবে কি রান্না করবে,ঠিক আছে?’
‘জী ঠিক আছে।’
খামারের কাজের জন্য অনেক কাজের লোক আছে,যাদেরকে স্থানিয় ভাষায় কামলা বলা হয়। এদের মধ্যে যাদের বাড়ী কাছে তারা বাড়ীতে গিয়েই খায় আর যারা এখানে থাকে তারা নিজেরাই রান্না করে খায়।ওদের থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা উত্তর পাশে।আর তোফাজ্জল হোসেনের বাংলো দক্ষিণ পাশে।এখানেই রান্না ঘরে নিরার থাকার ব্যবস্থা।হোসেন থাকে রান্না ঘর লাগোয়া একটা চিলতে ঘরে।তার কাজ হলো তোফাজ্জল হোসেনের তদারকি করা , কাজের হিসাব রাখা এক কথায় সেক্রেটারি। তাই তার জায়গা কামলাদের চাইতে একটু উঁচুতে। এখানে ম্যানেজার ও আছে তবে সে রাতে থাকে না।তার বাড়ী কাছেই।
তোফাজ্জল যখন থাকেন তখন নিরার কাজ খুব বেশি থাকে।প্রতিবেলায় রান্না করতে হয়। ঘরদোর ঝকঝকে রাখা ইত্যাদি।তোফাজ্জল কি মোলায়েম করে কথা বলেন,নিরা এমনটা কখনো দেখেনি। সব পুরুষ প্রথমে তার শরীরের দিকেই নজর দেয় কিন্তু তোফাজ্জল খুব ভালো। কিছু ভুল হলে বুঝিয়ে বলেন।নিরার চোখে অমায়িক, ভদ্র একজন মানুষ।তবে মানুষটার একটা দোষ আছে,মাঝে মধ্যে মদ খায়। তখন মানুষটা বদলে যায়।এই ব্যপারে একদিন সাহস করে বলেছেও নিরা,’স্যার এই সব না খাইলে হয় না?’ তোফাজ্জল হেসে বলেছিলেন, ‘অভ্যাস হয়ে গেছে, বুঝলে অভ্যাস খুব খারাপ জিনিস।’ তোফাজ্জল এই কম বয়সী মেয়েটাকে পছন্দ করেন।অনেক ভালো মেয়ে। কপাল গুনে এখানে কাজ করতে এসেছে, ভালো ঘরে থাকলে রাজকন্যার মতো থাকতো। তোফাজ্জল চলে গেলে নিরার কেমন খালি খালি লাগে।মনে হয় কোন কাজই নেই। এখানে আসার পর নিরা আর হোসেনের আর কোন চিন্তা নেই।ভালো খাওয়া দাওয়ায় শরীর স্বাস্থ্যও ভালো হয়েছে।তবে কিছু কিছু রাত নির্ঘুম কাটে নিরার। তখন সে লম্বা মেঘের মতো কালো চুল মেলে বারান্দায় বসে আকাশ দেখে আর চুলে হাত বুলিয়ে উকুন আনে। দুঃখ বেশি ভর করলে চোখের পানি ফেলে। অন্ধকারে কেউ দেখলে নিশ্চিত ভুত ভেবে ভুল করবে।
এক রাতে এমনি করে চুল মেলে বসেছিল নিরা। তার চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিলো।আকাশটা ছিল গভীর রহস্যময়,মেঘ ছিল না, চাঁদ ও ছিল না আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার ও ছিল না, খুব বেশি বাতাস ছিল না, খুব বেশি গরম বা ঠান্ডা ও ছিল না। তোফাজ্জল ওয়াক ওয়াক করে বমি করছিলেন । রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই শব্দ এত দুরে বসেও নিরা শুনতে পেয়ে দৌড়ে গেল। দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।হয়তো দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। তারাতাড়ি তোফাজ্জলকে ধরলো নিরা।বমি শেষ হলে খাটে শুইয়ে ঘরের বমি পরিষ্কার করলো। এরপর তোফাজ্জল পানি খেতে চাইলে দিল। নিজেই বলতে লাগলেন ,’এত বেশি ড্রিংস করা ঠিক হয়নি,একটু লেবু পানি এনে দাও তো।’ নিরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেবু পানি নিয়ে এলো।
তোফাজ্জল ঢক ঢক করে লেবু পানি শেষ করলো। এতক্ষণে এই দুই নরনারীর খেয়াল হলো এই নিশুতি রাতে এই ঘরে আর কেউ নেই , দুজন একেবারে কাছাকাছি। বয়ষ্ক মানুষ সব সময় বলেন,’আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখতে নেই।’ একটা হাত আলতো করে যখন নিরার কাঁধ স্পর্শ করলো নিরা কোন বাঁধা দিলো না। বাইরে তখন হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল।এই ঝর যেন সব কিছু উপরে ফেলবে এমন ভয়ানক ঝড়।এর পর শুরু হলো বৃষ্টি। প্রকৃতির নিয়মে একটা অবৈধ সম্পর্ক ঘটে গেল।যে সম্পর্কের জন্য কেউ দায়ী ছিল না। না তোফাজ্জল হোসেন, না নিরা। চরম ভাবে দায়ী ছিল সেই মুহূর্তটা।
খুব সকালেই নিরা তার ভাই হোসেনকে ডেকে তুললো।ভাইকে বলল, বাড়ি দিয়ে আসতে তার পেটের খুব সমস্যা, শরীর খুব খারাপ লাগছে।
হোসেন তাদের স্যারকে জানাতে চাইলে,নিরা বলল,সে বলে এসেছে। হোসেন, নিরাকে বাড়ীতে নিয়ে গেল।নিরা একা থাকতে পারবে কিনা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে লাগল।নিরা ভাইকে আশ্বস্ত করলো কোন সমস্যা হবে না একটু সুস্থ হলে সে আবার খামার বাড়ি চলে যাবে।
নিরা আর খামার বাড়ীতে যাবে না এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ছিল তার নিজেকেই অপরাধী লাগছে গত কালকের ঘটনার জন্য। একটা চিরকুট রেখে এসেছে তোফাজ্জলের মাথার কাছে।তাতে লিখা আছে-
“আপনাকে কোন দোষ দিচ্ছি না।তবে আমি আর এখানে থাকতে পারবো না।ক্ষমা করবেন।”
নিরা
নিরা কেন এভাবে চলে এলো সেটা তার নিজের কাছে স্পষ্ট না।হয়তো অনুতাপ কিংবা পাপকে না বাড়ানোর দৃঢ় সংকল্প।এর পরের দিন সে গেলো তার শ্বশুর বাড়ি।তাকে দেখে তার শাশুড়ি ঝাঁজালো কন্ঠে তেড়ে আসলো। পোড়ামুখী অপয়া আরো অসংখ্য বিশেষণ যুক্ত করে নিরাকে সম্ভাষণ জানালো।জানতে পারলো তার স্বামী ঢাকায় চলে গেছে,কেউ তার ঠিকানা জানে না। শ্বশুরবাড়িতে এক গ্লাস পানিও খেতে পারলো না। এতটা পথ এই রোদের মাঝে হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। তবুও আবার হাঁটা শুরু করলো। মনে পরল রোজিনার কথা। সেখানে উপস্থিত হল নিরা। রোজিনার বাড়ি জুড়ে মহিলারা নকশি কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত। নিরাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো রোজিনা। কোন কিছু বলার আগে এক গ্লাস পানি খেতে চাইলো।
গ্লাসের পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল নিরা।
—এই সময় কই থাইকা আসলি?
নিরা জানালো শ্বশুরবাড়ি থেকে। রোজিনা, নিরাদের গ্রামের ই মেয়ে।এক গ্রাম পড়ে এখানে বিয়ে হয়ে এসেছে রোজিনা। এখন এই সেলাইয়ের কাজ করিয়ে মোটামুটি ভালই ইনকাম হচ্ছে তার, স্বামীর উপর নির্ভর করতে হয় না। বরং দুজনের ইনকামে অনেক ভালো চলছে তারা। নীরা রোজিনা বু বলে ডাকে। তাকে একটা কাজ দিতে বলল নিরা। সমস্যা একটাই এতটা পথ প্রতিদিন হেঁটে এসে তাকে কাজ করতে হবে। তবুও নিরা বলল,সে এই সেলাই কাজ করবে।
তোফাজ্জল হোসেন আর আগের মতো খামার বাড়ীতে যান না,ভালো লাগে না কেমন একটা বিষন্নতা ভর করে। জরুরি কাজ থাকলে সকালে এসে বিকেলে চলে যান।আর কয়েক মাস থেকেই এই খামারের লস গুনছেন তাই সিদ্ধান্ত নিলেন খামারটা বিক্রি করে দেওয়ার।
হোসেন একটা মুদির দোকান দিল।এর সাথে সে প্রাইভেটে বি এ ভর্তি হয়ে রইল।এর মধ্যে একটা গোপন বিষয় ঘটেছিল। তোফাজ্জল একেবারে চলে যাওয়ার আগে হোসেনকে বেশকিছু টাকা দিয়ে যান। হোসেনের কাজে তোফাজ্জল খুব খুশি হয়েছেন আর হোসেন যেন বোনকে নিয়ে কিছু করে খেতে পারে এটাই বলেছিলেন।
এক সময় যখন আর নিরা কাপড়ের ডাবল ভাঁজ দিয়েও পেট লুকাতে পারছিলো না তখনই হোসেনের নজরে এলো।নিরাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,’আমি যখন খামারে ছিলাম তখনও কি তোর জামাই এইখানে আসতো?’
‘আসতো।’
হোসেন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।’হায় হায় করতে লাগলো।’আমারে আগে বলস নাই কেন?এখন তোর পেটের এই আপদ কেমনে মানুষ করবি?’ঐ শয়তান ও তো কই না কই পলাইছে?’
শেষ বার যখন নিরার স্বামী এখানে এসেছিল আশপাশের মানুষরাও দেখেছে। তাই নিরার গর্ভবতী হওয়া নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলল না।
কিন্তু আসল ব্যপার জানে একমাত্র নিরা।ওর স্বামী এসেছিল ঠিকই , নিরার কাছে টাকা চাইতে এত দিন কাজ করে এসেছে বেতন কই? নিরা সাফ জানিয়ে দিয়েছিল ,টাকা ওর ভাইয়ের কাছে আর নিজের কাছে থাকলেও এক টাকাও দিতো না।এই নিয়ে ঝগড়া করে নিরার গায়ে হাত তোলে ওর স্বামী এবং রেগেমেগে চলে যায়।
ঠিক সময়েই একটা চাঁদের মতো ফুটফুটে একটা মেয়ের জন্ম দেয় নিরা। হোসেন ভাগ্নির নাম রাখে নওমি,নিরার সাথে মিলিয়ে।হোসেন যখন মিষ্টি নিয়ে নিরার শ্বশুর বাড়ি যায় সুসংবাদ জানাতে, তখন নিরার শাশুড়ি বলে দেয় আর কখনো যেন ওরা কেউ ওই বাড়িতে না আসে। যেখানে ছেলের সাথেই সম্পর্ক নেই সেখানে ছেলের বৌ আর তার মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার কোনো মানেই হয় না।
হোসেনের দোকানটা আরো বড় হলো। হোসেন ভাবলো তার ভাগ্নি অনেক ভাল ভাগ্য করে এসেছে তাই তো নিজের ভাগ্যের এত উন্নতি হচ্ছে। ভাগ্নি নওমি হলো তার জান। হোসেনের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো। হোসেনের এক কথা ভাগ্নিটা আরেকটু বড় হোক তারপর নিজের বিয়ের কথা ভাবা যাবে। এর মাঝে হোসেন নিরার বিয়ের কথাও চিন্তা করেছে কিন্তু নিরা এই প্রসঙ্গে কোন কথাই শুনতে চায় না।
যখন নওমির পাঁচ বছর তখন হোসেন বিয়ে করল আর তাদের ভাই বোনের সুখের সংসারে অশান্তি শুরু হলো।
মেয়ে শাপলার ডাকে যেন হোসেনের ঘোর কাটলো।-
—আব্বা এত রাইতে এইখানে বইসা কি কর, ঘুমাও না ক্যান?কিছু সমস্যা হইছে?
—আরে মা, না কোন সমস্যা হয় নাই। এমনেই ঘুম আসতেছিল না।
—তুই ঘুমাস নাই ক্যান শাপলা।
—আমি তো পানি খাইতে উঠছিলাম , দেখলাম দরজা খোলা।পরে দেখি তুমি এইখানে বইসা আছ।
—আচ্ছা চল ঘুমাই গিয়া।
সকালে বের হওয়ার আগে জালেরা বেগম, তোফাজ্জল হোসেনকে বললেন-
—তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।যদি পার রাইতে একটু তাড়াতাড়ি আইসো।
তোফাজ্জল বুঝতে পারছেন নওমির ব্যপারেই হয়তো কিছু বলবেন আম্মা।
—ঠিক আছে আম্মা তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করব।
তোফাজ্জল ভাবছেন মানুষের জীবনের একটা ভুল কখন যে সামনে এসে সবচেয়ে শক্ত প্রাচীরের মতো দাঁড়াবে তা কেউ জানে না। নওমির জন্ম না হলে তার হয়তো নিরার কথা মনেই থাকতো না।
যেদিন হোসেন তাঁর অফিসে এসে দেখা করলো,প্রথমে হোসেনকে চিনতেই পারেননি তোফাজ্জল।নিরার কথা তোলাতে সাধারণ ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছে নিরা?
‘নিরা তো মইরা গেছে।তবে আপনাদের মেয়ে নওমি ভালো আছে।’
এই কথা শুনে তোফাজ্জল বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরেছিলেন।রাগে তাঁর গা কাঁপছিল।
তাঁর মনে হচ্ছিল হোসেনকে এখনই গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন।
কিন্তু হোসেনের আর একটা কথায় তোফাজ্জল দমে গেলেন।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু