#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_৩১
নওমি দোতলায় ঢুকতেই তোফাজ্জলকে সোফায় বসা দেখে তার পা আটকে গেল।জালেরা বেগমের সাথে দেখা করতেই এসেছিল নওমি। তিনিও ছেলের সামনেই বসে আছেন।তোফাজ্জলের নিজের বাসায় তিনি থাকতেই পারেন কিন্তু নওমির মনে হতে লাগলো তিনি এখানে কেন?
জালেরা বেগম অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন ‘নওমি’ ।
নওমিকে দেখে তোফাজ্জল যেন কাঠ হয়ে গেলেন। নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ফাঁসির আসামি মনে হতে লাগলো।জীবনে কোন দিন এতটা অপরাধ বোধে ভোগেননি তিনি।চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বসে রইলেন।শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতেই হলো তাকে।পালিয়ে যাবনই বা কোথায়? পালিয়ে গেলে মানুষের চেহারার আড়াল টুকুই শুধু হওয়া যায় কিন্তু মনের দিক থেকে তো আড়াল হওয়া যায়না। সব সময় দুঃখগুলো নড়াচড়া করে মনের ভেতর। তোফাজ্জল শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছেই ফেরত এলেন। দুনিয়ার সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখলেও তার মা তাকে সেই পরম মমতায় আগলে রাখবেন।মা হলেন পরম শান্তির আশ্রয়স্থল।
যন্ত্রচালিত মেশিনের মত এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো নওমি।কি বলবে বা কি করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ সময় যেন মনে হতে লাগলো কয়েক ঘণ্টা। কখনো তোফাজ্জলের মুখোমুখি হলে যেসব প্রশ্ন করবে ভেবেছিল নওমি, সেগুলো তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে কিন্তু এখন কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। তোফাজ্জলকে দেখে তার রাগ বা ঘৃণা কিছুই হচ্ছে না বরং অজানা ভালোবাসার অনুভূতি হচ্ছে মনে।বাবাদের প্রতি কি মেয়েরা এমনই ভালোবাসার টান অনুভব করে? তোফাজ্জলের দিকে তাকিয়ে তার খুব কষ্ট লাগছে। কি অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছেন। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।আর বসে থাকতে পারলো না খুব ধীরগতিতে উঠে নওমি বের হয়ে গেলো।
জালেরা বেগমও কিছু বললেন না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নওমি ভাবতে লাগলো। কোন নির্দৃষ্ট ভাবনা না,এলোমেলো ভাবনা সব। দরজার সামনে এসে আশ্চর্য হয়ে গেলো সে,স্বর্ণা তার মা তাবাসসুমকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নওমির মনে হচ্ছে এই সব কিছুই সে স্বপ্নে দেখছে।একটু আগে তোফাজ্জল কে দেখা এখন আবার ওরা।এই সব নিশ্চয়ই স্বপ্ন। আজ এইসব কি হচ্ছে তার সাথে?
স্বর্ণা বলল-
—এই মাত্রই এসেছি।নক করে দেখলাম খুলছিস না। ভাবলাম ঘুমাচ্ছিস।
স্বর্ণার মুখে হাসি নেই।সে কথা বলছে মুখ গম্ভীর করে।ভেতরে ওর একটা গুমোট ভাব,একটা কষ্ট যেন ওকে খোঁচা দিচ্ছে।
নওমি যেন বাস্তবতায় ফিরে এলো।এসব কিছু স্বপ্ন ভাবার তো কোন কারণ নেই।সে এমনই এক জন, তার সাথে সব কিছু ঘটাই স্বাভাবিক। খুব ভালো করে বুঝতে পারলো আন্টি খুব জরুরি কিছু বলতে এসেছে।
দরজার লক খুলে ভেতরে ঢুকলো তারা। কোন ভনিতা না করেই তাবাসসুম বললেন-
—নওমি বসো। খুব জরুরি কিছু কথা বলতে এসেছি তোমাকে।
নওমি বসলো।সে বুঝতে পারছে কি বলবেন তিনি।নিশ্চয়ই বলবেন, তাশফির সাথে সম্পর্ক না রাখতে।তাকে দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। ছেলের ভবিষ্যত সম্মানিত করতে এসেছেন ।
—আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার আর তাশফির বিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবো।এতে করে মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। দেশের বাইরে এইসব নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করেনা। তোমার আঙ্কেল রাজি ছিলেন না,অনেক বুঝানোর পর রাজি হয়েছে। আর তাশফিকে আমরা কষ্ট দিতে চাই না। মূলত তাশফির কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া। সমাজে আমাদের একটা মান সম্মান আছে। তোমার ব্যাপারে সবকিছু জানাজানি হয়ে গেলে আমরা আর মুখ দেখাতে পারবো না।তাই বিয়েতে কোন আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে আসতে বলা হবে না। এইজন্য তাড়াতাড়ি তোমাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
নওমি ভাবতেও পারেনি তাবাসসুম তাকে এই সব কথা বলবে। তাঁর কথায় এমন মনে হচ্ছে, নওমিকে বিরাট দয়া করছেন তাঁরা। তাঁরা যদি মেনে না নেন রাস্তার কুকুর নওমিকে কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলবে।নওমি অবৈধ সন্তান বলে এই সমাজে তার থাকার অধিকার নেই, তার জন্য অন্যদের মাথা নিচু হয়ে যাবে। এত শিক্ষিত , এত জ্ঞানী, মানবতার সেবায় নিয়োজিত একটা পেশায় থাকা,সমাজের উপরের তলার মানুষদের মনোভাব দেখে নওমি দুঃখ পাচ্ছে না। শুধু অবাক হয়ে যাচ্ছে আগের চেনা জানা মানুষগুলো এভাবে হঠাৎ করে কিভাবে অচেনা হয়ে গেল! দূর থেকে সান্তনা দেওয়া যায় কিন্তু যখন নিজেদের স্বার্থ সামনে আসে তখনই মানুষের মুখোশ খুলে আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।আসলে মানুষের মন মানসিকতা শিক্ষা,অশিক্ষা, সমাজের উঁচু নিচু দেখে যাচাই করা যায়না।
—নওমি কিছু বলছ না যে! তোমার মামাকে জানাও। কথা বার্তা বলে সবকিছু ঠিক করতে হবে। বিয়ে হয়ে গেলে সব ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু রেডি করে ফেলতে হবে।
নওমি হাসলো।নিজের মনকে বলল,কিছুতেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না।প্লিজ শান্ত থাকো।
তাবাসসুম ভাবলেন ,নওমি খুশিতে আটখানা হয়ে হাসছে। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করবে নাকি। নওমি খুব চালাক মেয়ে। বেছে বেছে তার বোকা ছেলেটাকে ফাঁসিয়েছে।
খুব মোলায়েম ভাবে নওমি বলল-
—আন্টি আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঠিক আছে কিন্তু আমি তো কোন সিদ্ধান্ত নেইনি ।
—মানে কি?তুমি তাশফিকে ভালোবাস না,বিয়ে করতে চাও না?
—ভালোবাসি। কিন্তু এভাবে বিয়ে করতে চাই না।
—কিভাবে?
—আসলে বলতে চাইছি আমি আপনাদের ফ্যামিলির জন্য কোনোভাবেই যোগ্য না। চোরের মতো বিয়ে আবার দেশের বাইরেও চলে যেতে হবে, আমার জন্মের বৈধতা নেই বলে শুধু মাত্র এই জন্য! আমার জন্ম হওয়ার পেছনে আমার তো কোন অন্যায় ছিল না তাহলে আমি কেন মুখ লুকাবো,চোরের মতো থাকবো। তাশফির সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আপনাদের মান সম্মান ধুলায় মিশে যাবে এটা তো আমি হতে দিতে পারি না।এত দিন আপনাদের মেয়ের বান্ধবী হিসেবে আমাকে অনেক আদর করেছেন এর বিনিময়ে এত টুকু তো করতে পারি?
তাবাসসুম খুব আশ্চর্য হলেন নওমির কথা শুনে। তাঁর ধারণার বাইরে এই মেয়ে,ওকে দেখে পড়ে ফেলা সহজ না।মনে মনে একটু খুশিও হলেন, এখন তাশফিকে বলা যাবে নওমি নিজেই রাজি না।
স্বর্ণা টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,মাথা নিচু করে।নওমির দিকে তাকাতে পারছে না। এখানে তার মায়ের সাথে কিছুতেই আসতে চায়নি।তার বাবা-মা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এই বিয়ে না হোক।
সে এত দিন যেই নওমিকে দেখেছে আজ তাকে সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে। পরিস্থিতি মানুষকে কত কিছু শেখায়।তবে খুব খুশি লাগছে নওমির কথা শুনে।ওর আত্মসম্মানবোধ আছে, শুধু আছেই না প্রখর আত্মসম্মানবোধ ওর।
স্বর্ণা তার ভাই তাশফিকে বলেছিল, তোমারা লুকিয়ে বিয়ে করে ফেল। কিন্তু তাশফি রাজি হয়নি।’যা কিছু করবো আব্বু আম্মুর সম্মতি নিয়েই করবো’ এই বলেছিল তাশফি।
—তুমি তাহলে এই বিয়েতে রাজি না?
—না।
—তাহলে এই কথা তাশফিককে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিও।
—ঠিক আছে আন্টি জানিয়ে দেবো।
—তাহলে আমরা আসি এখন।
তাঁরা চলে যাওয়ার পর নওমি ঐ জায়গাতেই বসে রইলো,উঠে দরজাও লাগালো না।উঠে যাওয়ার শক্তি টাও যেন পাচ্ছে না। মনটা যেন একেবারে চুরমার হয়ে শরীরটাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। কতখানি শক্ত হয়ে এই কথাগুলো তাকে বলতে হয়েছে এটা শুধু সেই জানে। তাশফিকে সে কিভাবে ভুলে থাকবে এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। তবে তাকে ভুলে থাকতে হবে যে কোন উপায়েই হোক। তার নিজের যেটা অভাব ছিল সারা জীবন সেটা হলো একটা পরিবার। এই পরিবারের অভাব কারো যেন না হয় জীবনে। তার কারণে তাশফি যেন কখনো তার পরিবার থেকে আলাদা না হয় সেই চেষ্টা সব সময় করে যাবে সে।
মোবাইল স্ক্রিনে তাশফির নাম ভেসে উঠলো। আগে থেকেই সাইলেন্ট করা মোবাইলটা উল্টে রাখল নওমি। কি কথা বলবে সে তাশফির সাথে? সে বলল-
“তাশফি তুমি ভালো থেকো।”
তার কথার যেন প্রতিধ্বনি হলো ফাঁকা ঘরে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে তাশফিকে মেসেজ পাঠালো,”তোমাকে কিছুতেই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি ভালো থেকো।”এর পরে তাশফির নাম্বার ব্লক করে দিলো।
স্বর্ণা রাগ হয়ে বলল-
—আম্মু আমরা এসেছিলাম সবকিছু ঠিক করার জন্য। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ উল্টো পরিস্থিতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। ভাইয়াকে কি বলবে?
—কি বলবো মানে? তুমি তো নিজেই শুনলে নওমি নিজেই তাশফিকে বিয়ে করতে চাইছে না।
—তুমি যেভাবে কথা বললে, এরকম ভাবে কথা শুনলে নওমি রাজি হবে ভাবলে কী করে তুমি?
—এই ব্যাপারে তুমি কিছুই আলাপ করবে না তাশফির সাথে।
—বাহ্ তোমাদের মন মানসিকতা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। স্ট্যাটাসের চিন্তা করতে করতে লাইফটাই শেষ হয়ে গেল। কি হবে এই সব করে? শুধু শুধু দুইটা মানুষকে কষ্ট দেয়া।
—অনেক বেশি কথা বলছো স্বর্ণা। আমি কখনোই তোমাদের কোন কিছুতে জোর করিনি। কখনো তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বলিনি। তোমার বাবার সঙ্গে আমার মতের কখনো মিল ছিল না কিন্তু এই ব্যাপারটাতে আমি একমত। সমাজ নিয়ে আমাদের চলতে হয়।
—কি তোমাদের শুধু সমাজ সমাজ সমাজ! ভাইয়া ঠিকই এক সময় নওমিকে নিয়ে দূর-দূরান্তে পালিয়ে যাবে তখন কি করবে? এখন তো সে ভালো মনে চাচ্ছে তোমাদের মতে, তোমাদের রাজি করিয়ে সবকিছু করতে। যখন তোমাদের এই নোংরা মানসিকতা সম্পর্কে জানতে পারবে তখন দেখো কি হয়!
—যা বোঝনা তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।
স্বর্ণার কথায় তাবাসসুমের ভাবনার উদয় হল মনে। আসলেই তো সবকিছু যদি ওলটপালট হয়ে যায়। ছেলে যদি তাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়। তাহলে কিভাবে থাকবেন? নিজের ছেলে নিজের সন্তান দুনিয়াতে এত এত মেয়ে থাকতে এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করলো কেন?
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু