৫ম তলার মেয়েটা পর্ব-৩৮

0
668

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৩৮

অবশেষে রজনীর খবর পাওয়া গেলো। একটুও সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লেন পম্পির বাবা পম্পিকে সাথে নিয়ে ।
পম্পির বাবা ভাবছেন রজনী হয়তো কাউকে খুঁজে পেয়েছে কিংবা আগেই কেউ ছিল তার জীবনে যার সম্পর্কে তিনি জানেন না।এই জন্যই রজনী এতটা সাহস পেয়েছে।সে বাসা থেকে কোন গহনা,টাকা কিছুই নিয়ে যায়নি আর তার সামনে দিয়েই তো বেরিয়ে গেলো।তিনি একটা বারও আটকানোর চেষ্টা করেননি।
রজনীর কাবিনের টাকাটা ব্যাংকে রাখা ছিলো রজনীর নামেই। গতকাল ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে সেখান থেকে টাকা উঠিয়েছে রজনী আর এই সূত্র ধরেই পম্পির বাবার লম্বা হাত রজনীর খোঁজ পেয়ে গেলো। তাঁর ইনফর্মার ফলো করে রজনী যেখানে থাকে সেই জায়গাটা পর্যন্ত দেখে এসেছে। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন নিশ্চয় কোন হাভাতের সঙ্গে আছে,তা না হলে রজনীর টাকার দরকার পড়লো কেন?

পম্পি তার বাবার মনের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। পম্পি ভাবছে তাঁর বাবা অনুতপ্ত, রজনীর সাথে খারাপ আচরণের জন্য। রজনী অভিমান করেই চলে গেছে। সিরাতকে, রজনী পছন্দ করলে তাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলে সে নিজেও খুব খুশি হতো। কিন্তু রজনী সিরাতকে ফিরিয়ে দিয়েছে,এখন সে তাহলে কিভাবে কার কাছে আছে?এই সব প্রশ্নের উত্তর ওখানে গেলেই পাওয়া যাবে।

গাড়ি ছুটে চলেছে সব কিছু পেছনে ফেলে। সারি সারি গাছ, কোথাও বা ধান ক্ষেত সবুজে ঢাকা দুই পাশের রাস্তা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাজধানী থেকে বের হয়ে যত দূরে যাওয়া যায়, যেদিকেই যাওয়া যায় চোখে পড়বে শুধু সবুজ আর সবুজ, সীমান্ত পর্যন্ত সবুজের খেলা। আস্তে আস্তে এই সবুজ অবশ্য কমে যাচ্ছে।এই জন্যই ঢাকার বাইরে বের হলেই খুব ভালো লাগে। পম্পি নিজের অজান্তেই তার বাবার একেবারে কোল ঘেঁষে বসলো সেই ছোট বেলার মতো।কত দিন এভাবে বাবার কোল ঘেঁষে বসে না। যত কিছুই হোক বাবার উপর অভিমান করে আর কত দিন থাকা যায়? স্ত্রীর কাছে ভালো স্বামী হতে না পারলেও বেশীরভাগ বাবারা সন্তানের অসম্ভব ভালো বাবা হয়ে উঠে।তাই তো কখনো কখনো বাবা আর মায়ের সম্পর্ক নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে নিজেদের মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কখনো মা জিতে যায় কখনো বা বাবা জিতে যায়।

গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তায় আসতেই ড্রাইভার বলে উঠলো-
—এই ফ্লাইওভারের জন্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ মনে হয় ঢাকাই পইরা যাইবো।
এই শুনে পম্পি কোথায় কোথায় বলে দেখতে চাইলো-
ড্রাইভার একটু স্লো করে এগুতে লাগলো-
—ছোট ম্যাডাম এই যে দেখেন।

—কখনো সরাসরি ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ দেখা হয় নি। অসাধারণ সুন্দর স্বাধীনতার প্রথম স্মারক এই ভাস্কর্য ।
ভাইয়া জানেন তো ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো জয়দেবপুরের অধিবাসীরাই।সেই সময়‌ শহীদ হন হুরমত আলী,কালু মিয়া ও মনু খলিফা। সেই স্মৃতি এবং শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নির্মাণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম এই ভাস্কর্য ১৯৭৩ সালে।এক হাতে রাইফেল অন্যহাতে গ্রেনেড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো।

—জ্বী ম্যাডাম জানি এই ইতিহাস।আগে অনেকদূর থাইকাই দেখা যাইতো এই ভাস্কর্য। এইটা দেখলেই মনে হইতো গাজীপুর চৌরাস্তায় আইসা পড়ছি। কিন্তু আফসোস এখন আর দেখা যায় না।

—এই ভাস্কর্য অক্ষত রাখতে নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করবে সরকার।এত সুন্দর,তাও আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম স্মৃতি এই ভাস্কর্য নিশ্চয়ই অবহেলায় পতিত হবে না।
আব্বু তুমি কি বলো?

—নিশ্চয়ই একটা কিছু ব্যবস্থা করবেই। অবশ্যই করা উচিত। হেলাফেলায় এই ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের স্বাধীনতাকেই অপমান করা হবে।

—সুন্দর একটা ভাস্কর্য আগে দেখলাম না। এখন আফসোস লাগছে দূর থেকে দেখলে কেমন দেখা যেত, দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।এই দিকে আমার কখনো আসাই হয় নি। দাদা,নানা সবার বাড়িই সিলেটে।তেমন কোন আত্নীয়ও নেই।
নওমিদের বাড়ি ময়মনসিংহের কোথায় যেন বলেছিল মনে পড়ছে না।

—এত খারাপ রাস্তা আর হয় না। গাড়ির জান থাকে না।
—ভাইয়া গাড়ির কি জান থাকে?

— মাইনষের যে অবস্থা হয় এই প্রাণহীন গাড়ি গুলোর অবস্থা আরো বেহাল । এই রাস্তা দিয়া একমাস চলাচল করলে এই গাড়ি ভাঙ্গারির দোকানেও কিনব না এমনই লক্কর-ঝক্কর হইয়া যাইবো।

পম্পির বাবা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন আর কতক্ষণ লাগতে পারে।সে বলল-
—রাস্তা ভালো না, কতক্ষণ যে লাগে নির্দিষ্ট করে বলা যাইতেছে না।তবে আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ময়মনসিং শহরে পৌঁছতে পারবো ইনশাল্লাহ।

—ময়মনসিংহ পৌঁছে আমরা লাঞ্চ করে নেব।
আমরা যেখানে যাচ্ছি প্রত্যন্ত গ্রাম। হয়তো তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না। প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা ও করতে হবে কি বল মামনি?

—ঠিক আছে আব্বু।

ময়মনসিংহ শহরে ঢোকার আগেই পম্পির বাবা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় লাঞ্চ করলে ভালো হবে কারণ ড্রাইভার ছেলেটা ময়মনসিংহের। স্বাভাবিক ভাবেই ওর সব কিছু চেনাজানা।
সে বলল —
—সারিন্দায় লাঞ্চ করলে ভালো হইবো। এটা গাঙ্গিনাপাড়ে।এই গাঙ্গিনারপাড়ই সবকিছু,বলতে গেলে ময়মনসিংহ শহরের প্রাণ।এর পর কেনাকাটা করা যাবে এখানেই।এছাড়াও এখানে সেখানে রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন শোরুম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শহরের সর্বত্র।

খেয়েদেয়ে, কেনাকাটা করে একটু বেশিই সময় গেলো।পম্পি খাওয়ার জন্য অনেক কিছু কিনলো ফ্রুট,ড্রাই ফ্রুট, মিষ্টি নাস্তার আইটেম,আরো অনেক কিছু কিনলো। পম্পির বাবা মানা করলেন না বা তাড়া দিলেন না,এটা সেটা নিয়ে দেখাচ্ছে আব্বু এটা নিচ্ছি।সেই ছোট বেলায় এভাবে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যেতেন কেনাকাটা করতে,সেই স্মৃতিগুলো মনে হচ্ছে। আবার যদি যেতে পারতেন জীবনের ঐ সময় টাতে!

পম্পির মা ঘরকোনো মহিলা ছিলেন,ঘরটাই তার সব কিছু। ঘর কুনো হয়েছিলেন পম্পির বাবার জন্যই। একবার শপিং এ গিয়ে দেরি হচ্ছিল দেখে পম্পির বাবা পম্পির মাকে রেখেই চলে আসেন। সেদিন পম্পির মা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি ঢাকার কিছুই চিনেন না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন।এক রিকশাওয়ালা এটা দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? শুধু জায়গার নাম আর বাসার নাম্বার বলতে পেরেছিলেন।সেই রিকশাওয়ালা তাঁকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলো। রিকশা থেকে নেমে পার্শে যত টাকা ছিল সব দিয়ে দিয়েছিলেন রিকশাওয়ালাকে।
এটা শুনে পম্পির বাবা নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হবেন তা না উল্টো এত টাকা রিকশা ওয়ালা কে দিয়েছেন দেখে রাগে গজ গজ করছিলেন।
সেই দিনই পম্পির মা নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন
নিজের কাছে,আর কোন দিন শপিং এ যাবেন না, আর তাঁর প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছিলেন আমৃত্যু।
পম্পির মাকে আবার ফিরে পেলে জীবনে করে আসা ভুলগুলো শুধরে নিতেন। আফসোস সেটা সম্ভব না।সময় চলে গেলে আফসোস করেই বা কি হয়? আবার রজনীর কথা মনে হতেই তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বিশ্বাস ঘাতক ।

পম্পি সবুজ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেল তার বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে। পাম্পির বাবার খুব শান্তি লাগছে মেয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তাঁর ও মনে হয় তন্দ্রার মতো এসেছিল, ড্রাইভার এর কথায় ঘুম ভাঙলো।
—স্যার একজন লোক হাত ইশারা করতেছে। গাড়ি কি থামাবো?
পাম্পির বাবা চিনতে পারলেন।ফুলপুর চলে এসেছেন।এখানে থাকার কথাই ছিল ওর। এটাই তাঁর ইনফর্মারদের একজন। গাড়ি থামিয়ে তুলে নেওয়া হল তাকে।সেই বাকি রাস্তাটা সেই চিনিয়ে নিয়ে যাবে।

—আর কত দূর?
—স্যার আরো সাত কিলোমিটার ভিতরে।আধা কিলো আগেই গাড়ি রেখে যেতে হবে। ওখান থেকে রাস্তা এত সরু যে, সহজে গাড়ি যেতে পারবে না। রিক্সা ভ্যান চলে সেটাও খুব কম। হয়তো হেঁটেই যেতে হবে।

অবশেষে পৌঁছানো গেলো পদ্মপুর গ্রামে।এত দিন পর এতটা রাস্তা হেঁটে এসে পম্পির বাবার ক্লান্তি একমুহূর্তেই উবে গেল রজনীকে দোলনায় বসে দোল খেতে দেখে। একটা বড় গাছের ডালে পাটের মোটা রশি ঝুলিয়ে দোলনা বানানো হয়েছে। এটাতে বসেই রজনী মনের সুখে দোল খাচ্ছে। পায়ের আওয়াজ হতেই পেছন ফিরে ওদেরকে দেখে রজনীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো।
সকালের সূর্য টা তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে, লাল আভা ছড়িয়ে সে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছে । পম্পি দৌড়ে গিয়ে রজনীকে জড়িয়ে ধরল। রজনী যেন একেবারে জমে গেছে। বাস্তবে এমন হচ্ছে এটা বুঝতে তার অনেকক্ষণ সময় লাগলো।
বাড়িটার খুব কাছাকাছি অন্য লাগোয়া বাড়িঘর নেই। দূরে দূরে আছে তিন পাশে বাড়ি। এই বাড়িটাতে ঘর সংখ্যা মোটে দুইটা, শূন্য গোয়াল ঘর, বিভিন্ন গাছ দিয়ে বাড়িটা ঘেরাও করা। ঘরের চাল, বেড়া সবকিছুই খড় দিয়ে তৈরি,চালের উপরে লাতানো গাছ,লাউ বা সিমের মাচা ছোট্ট উঠানের একপাশে, একটা পাশে একটা টিউব ওয়েল – দারিদ্র্য যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা যুগ যুগ ধরে।
পম্পির বাবার হঠাৎ করে মনে এলো, ঘরে নিশ্চয় ঐ শয়তান ঘরে শুয়ে আছে। তিনি জোরে ডাকতে লাগলেন-
—ঘরে কে আছ বের হও?

কথা শুনে একজন বয়স্ক বৃদ্ধ মহিলা বেরিয়ে এলেন-তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এর পরে প্রায় চিৎকার করে বললেন-
—কেডা তুমি,বাড়ির ভিতরে ঢুইক্কা চিল্লাচিল্লি করতাছ?কত বড় সাহস?

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here