#অব্যক্ত ভালোবাসা
#পর্ব :৩০
#সুমাইয়া ইসলাম নিশা
-”অভিমান ভেঙেছে নাকি আরো কিছু করতে হবে?
মায়ানের কথায় লজ্জা যেনো আরো পেয়ে বসে মেহবিনকে।মেহবিন সেই তখন থেকে চোখ বন্ধ করে নিচে তাকিয়ে আছে।মায়ানের করা একটু আগের কাজটা যেনো মেহবিনের বিশ্বাস হতে চাইছেনা।মেহবিন কোনোভাবে ঠোট নাড়িয়ে বলে-
-”ছা-ছাড়ুন,কেউ দেখলে-
মায়ান হাতের বাধন শক্ত করল।মেহবিনের নিঃশ্বাস আটকে আসছে।মায়ান মেহবিনের হাত দুটো বুকের সাথে চেপে ধরে।তারপর বলে-
-”কিছু ফিল করছো?
মেহবিন মাথা নাড়ে।যার অর্থ না।মায়ান মৃদু হাসে।কোমর থেকে হাত সরিয়ে মাথাটা চেপে ধরে নিজের হৃদয় বরাবর।মেহবিন থম মেরে যায়।হ্যা,সে এখন ফিল করতে পারছে কিছু।মায়ানের হার্ট বিট যেন মেহবিন গুনতে পারবে।মেহবিন আবেশে চোখ বুজে নেয়।মায়ান ফের ফিসফিস করে বলে-
-”এখন ফিল করতে পারছো?
মেহবিন চোখ বন্ধ রেখেই বলে-
-”হুম।
মায়ান নিঃশব্দে হাসে।তারপর বলে-
-”অভিমান ভেঙেছে?
-”আপনার সাথে অভিমান করে থাকাটা যে বড্ড দায় মায়ান ভাই।
মায়ান দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে নেয় মেহবিনকে।সময়টা আরো একটু ব্যাক্তিগত হয়।কতক্ষন যে তারা এভাবে ছিলো জানা নেই।হঠাৎ বিকট একটা শব্দে দুইজনেই বাস্তবে ফিরে আসে।মেহবিন চমকে তাকায়।আকস্মিক শব্দে মেহবিন ভয় পেয়ে গেছে।তারপর ভয়ে ভয়েই বলে-
-”’কিসের শব্দ হলো মায়ান ভাই?
মায়ান সচেতন চোখে আশেপাশে তাকিয়ে ছাদের ঐ ভাঙা অংশটার দিকে নজর দিতেই শব্দের উৎস খুজে পায়।মায়ান মেহবিনের হাত ধরে সামনে দাড় করিয়ে বলে-
-”ঐ ভাঙা অংশ টাই নিচে পড়েছে।
মেহবিন তাকিয়ে দেখে সত্যিই একটা অংশ ভেঙে নিচে পড়ে গেছে।মেহবিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।মায়ান আরো কিছু বলবে তখন মায়ানের ফোন বেজে উঠে-
-”দাড়াও পিচ্চি,আমি আসছি।
আসছি শুনে মেহবীনের বুকের ভেতর ধক করে উঠে।কেনো এমন হলো সে নিজেও জানে না।মেহবিন মায়ানের হাত শক্ত করে ধরে বলে-
-”যাবেননা।
মায়ান মেহবিনের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলে-
-”কল টা এটেন্ড করেই আসছি।গিভ মি ফাইব মিনিট মেহু।
মেহবিনের বুক ধরফরানি থামল না।মায়ান যেতে নিলে মেহবিন ফের ওর হাত ধরে থামিয়ে বলে-
-”সত্যি আসবেন তো ?
মায়ান মেহবিনের গালে হাত দিয়ে বলে-
-”আমাকে তো আসতেই হবে আমার পিচ্চির কাছে।
মেহবিনের মন মানল না।তবুও হেসে ছেড়ে দিলো মায়ানের হাত।মায়ান মেহবিনের কপালে সময় নিয়ে চুমু খেলো।তারপর নিচে চলে গেলো।মায়ান যত নিচে নামছে তত মেহবিনের অন্তস্থল কেপে উঠছে।মায়ান কে আর দেখতে পেলো না।সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেছে সে।মেহবিনের এতক্ষণে চকলেটের ডালার কথা মনে পড়ল।সে টেবিল থেকে আরেকটা ডালা নিয়ে সিড়ির দিকে তাকাতেই মাইজাকে দেখতে পেলো।মাইজা বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মাইজাকে দেখে চমকে উঠে মেহবিন।রক্তশূন্য চোখে তাকিয়ে আছে মাইজা।মেহবিন মাইজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো-
-”কি হয়েছে মাজা।এমন লাগছে কেনো তোকে?
মাইজা উত্তর দিলো না।পাল্টা প্রশ্ন করল-
-”কেনো এমন করলি মেহবিন?
মেহবিন থমকালো।ভীষণ ভাবে চমকালো।মাইজা ওর পুরো নাম ধরে ডাকছে। কখনো কেউ যদি মাইজাকে জিজ্ঞেস করতো তোমার ফ্রেন্ডের নাম কি তাহলেও ও কখনো পুরো নাম বলত না।সবসময় মেহু বলত।আজ কি এমন হলো যে সে ওর পুরো নাম ধরে ডাকছে।মেহবিন বিষ্ময়ে হাত পা অবশ করে দাঁড়িয়ে আছে।মেহবিন মাইজার কাধে হাত রাখবে তার আগেই মাইজা জোরে চিৎকার করে বলে-
-”ছুবিনা তুই আমায়।
মেহবিন কেপে উঠে মাইজার চিৎকারে।চিৎকার টা অনেক জোরেই ছিলো।বাইরে মিউজিকের জন্য সেই চিৎকার বাসার সবার কান পর্যন্ত পৌছায় নেই।মেহবিন কাপা কাপা কন্ঠে বললো-
-”কি হয়েছে তোর, এমন করছিস কেনো?
মাইজা মেহবিনকে ধাক্কা দিলো।মেহবিন তাল সামলাতে না পেরে পিছনের দিকে পিছিয়ে যায়।মাইজার কাজে মেহবিন অবাক হয়ে যাচ্ছে।মাইজা আবারো কন্ঠে তেজ ভরে বললো-
-”তুই কেড়ে নিতে চাইলি আমার থেকে মায়ান ভাইকে?তুই?তুই জানতি না আমি মায়ান ভাইকে ভালোবাসি।তবুও তুই এটা কিভাবে করতে পারলি?বল।
মাইজা এক শ্বাসে কথাগুলো বললো।মেহবিন অবাকের শেষ সীমানায় গিয়ে ঠেকলো।এসব কি বলছে মাইজা।মাইজা মায়ানকে ভালোবাসে।এটা সে কোনোদিনই জানত না।মেহবিন অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললো-
-”এসব কি বলছিস।তুই মায়ান ভাইকে ভালোবাসিস।আমি এটা কখনোই জানতামনা এসব।হ্যা মায়ান ভাই তোর ক্রাস ছিল তা-
-”মায়ান ভাই আমার ক্রাশ ছিলো না।সে আমার প্রথম ভালোবাসা,আমার ফেইরিটেলের রাজপুত্র।তুই কেড়ে নিয়েছিস।কিন্তু এটা আমি হতে দিবোনা।দেখ মায়ান ভাইয়ের দেয়া শাড়ি এখন আমি পড়ে আছি।
মেহবিন বুঝতে না পেরে বলে-
-”মানে?
মাইজা বলে-
-”তোকে যেই শাড়িটা মায়ান ভাই দিয়েছেন সেটা আমি পড়েছি।তখন ইলফার ঘরে আলমারি খুলতেই ঐ প্যাকেট টা পাই।চিঠি পড়ে বুঝতে পারি এটা মায়ান ভাই তোকে দিয়েছে।ব্যস ঐ শাড়িটা আমি নিয়ে কায়াপুর একটা শাড়ি রেখে দেই।এভাবে করেই একদিন আমি মায়ানকেও নিজের করে নিবো বুঝেছিস?
মেহবিনের কান্না পেয়ে যায়।মাইজা যে মায়ানকে নিয়ে এতো সিরিয়াস সেটা সে বুঝেনি।বিষয়টা মাথা চাড়া দিতেই মেহবিনের রাগ চড়ে যায়।মায়ান কে তো সেও ভালোবাসে আর মায়ান তাকে।তাহলে এখানে কেড়ে নেওয়ার কথা উঠলে সেটা মাইজা কেড়ে নিচ্ছে।মেহবিন এবার জোর গলায় বলে-
-”ভুল করছিস।মায়ান ভাই তোর না।সে আমাকে ভালোবাসে।আর আমি তাকে।তুই কেড়ে নিচ্ছিস আমার থেকে মায়ান ভাইকে।
মাইজা মেহবিনের কথা শুনে গর্জে ওঠে বলে-
-”তোকে মায়ান ভাই কখনোই ভালোবাসতে পারেনা।তোর কি আছে?না আছে রূপ না আছে গুন।কি দিয়ে তুই মায়ান ভাইয়ের ভালোবাসা পাবি?
মেহবিনের কথাটা বোধগম্য হতেই হাত ফসকে ডালাটা নিচে পড়ে গেলো।মাইজা ওর রূপ নিয়ে খোটা দিচ্ছে।যেই মেয়ে কিনা কখনো ওর গায়ের রঙ নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে প্রতিবাদে নেমে যেতো সেই মেয়ে আজ নিজেই এসব বলছে।মেহবিন অস্ফুট স্বরে বলে-
-”মাইজা।
মাইজা তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে-
-”তোর তো নিজের রূপ দেখিয়ে ও কাউকে বশ করার ক্ষমতা নেই।
মেহবিন কানে হাত দিয়ে বলে-
-”মায়ান ভাই আমার আমার আমার।
মেহবিন দৌড়ে নিচে চলে যায়।মাইজা সেখানেই দাঁড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বলে-
-”তোকে আমি ঘৃণা করি মেহবিন,ঘৃণা করি।
———
২ মাস পর
বদ্ধ ঘরে বসে আছে মেহবিন।ঘরে পিনপন নিরবতা।বিন্দু পরিমান আলোও ঘরে নেই।মেহবিন ঘরের মাঝখানটায় হাটুভেঙে বসে আছে।চোখের নিচে কালচে দাগ।চুলগুলো উসখোখুসকো।মুখে বিভিন্ন জায়গায় দাগ হয়ে আছে।মেহবিনের ভিতর এখন কোনো প্রাণ নেই।শুধু তার অচল দেহটাই পরে আছে।দুইমাস আগে কায়ার গায়ে হলুদের পরে মায়ানকে সে আর খুজে পেলো না।বিয়ের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কত খুজেছে।কোথাও পায়নি।পরে রাতে বিয়ের ঝামেলা শেষ হতে জানতে পারে মায়ান নাকি আজই লন্ডনে চলে গিয়েছে।তার নাকি কি কাজ।মেহবিনের পুরো পৃথিবি সেখানেই থমকে গিয়েছিল।মায়ান তাকে ছেড়ে না জানিয়ে লন্ডনে চলে যেতে পারেনা।মেহবিন সেখানেই জ্ঞান হারিয়েছিল।জ্ঞান ফিরার পর মেহবিন রাফিজকে কত আকুতি মিনতি করেছিলো একটাবার তার সাথে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য।কিন্তু রাফিজ সবসময় মাথা নিচু করে জানিয়েছে যে মায়ানের ফোন অফ।সেদিন থেকে মায়ানের সাথে আর দেখা হয়নি।আর নাইবা কথা হয়েছে।
সপ্তাহ খানেক পর রাফিজ এলো মেহবিনের বাসায়।মিসেস রুকাইয়াকে সালাম জানিয়ে মেহবিনকে ডাকতে বললো।মেহবিন রাফিজ এসেছে শুনেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরুলো।মেহবিন উত্তেজিত হয়ে বললো-
-”মায়ান ভাই এসেছে।মায়ান ভাইকে এনেছেন আমার কাছে?কোথায় ওনি?
রাফিজের বুকে চিনচিন ব্যাথা করছে।নিজের বোনের ও যে মেহবিনের মতোই অবস্থা।রাফিজ মাথা নিচু করে পকেট থেকে একটা খাম বের করে মেহবিনের দিকে দিলো।মেহবিন খামটা নিয়ে প্রশ্ন করে-
-”এটা কি?
-”নিজেই দেখিস।
-”মায়ান ভাই?
-”মায়ান আসেনি।
মেহবিন নিশ্চল হয়ে ঘরে যাবে তখনই রাফিজ বললো-
-”নিজেকে সামলে নে মেহু।
মেহবিন কথাটা শুনলো না।ঘরে চলে গেলো।ঘরে গিয়ে খাটে বসে খামটা বের করে সেই পরিচিত হাতের লিখা দেখতেই মেহবিনের হৃদয়ের গহীনে আশার আলো জেগে উঠল।মেহবিন দ্রুত খামটা খুলে কাগজটা মেলতেই দেখল-
-প্রিয়,
তোমাকে সম্বোধন করার অধিকার আমার নেই।তাই আজ আর কোনো সম্বোধন করলাম না।শুধু প্রিয় বলেই ডাকলাম।অভিমান করেছো?নাকি রাগ করেছো?আমার না খুব ইচ্ছে করছে তোমার রাগ ভাঙাতে।তোমার কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে অভিমান ভাঙিয়ে লজ্জায় ফেলতে।তোমার লজ্জায় ঘেরা মুখটা দেখতে।কিন্তু আমি নিরুপায়।এসবের কিছুই আমি করতে পারবোনা।আমি কখনোই পারবনা ফুলের মতো পবিত্র একটা সম্পর্ক ভাঙতে।আমার জন্য আমি তোমাদের বন্ধুত্ব শেষ হতে দেখতে পারবোনা।সেদিন ছাদে দাঁড়িয়ে তোমাদের সব কথাই আমি শুনেছিলাম।তোমাদের কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল।তাই আমি সেদিন রাতেই কাউকে না জানিয়ে ঢাকা চলে যাই।এই দুইমাস আমি বিডিতেই ছিলাম।কিন্তু রাফিজকে বলেছিলাম সবাইকে বলতে যে আমি লন্ডন চলে গিয়েছি।তবে এখন আর আমি বিডিতে নেই।যখন তুমি আমার চিঠি পড়ছো ততক্ষনে আমি লন্ডনে পৌছে গিয়েছি।আমায় ক্ষমা করো মেহু।তোমারছোট্ট হৃদয়ে আমার জন্য অনুভূতি জাগিয়ে চলে আসার জন্য দুঃখিত।মাইজার সাথে নিজের সমস্যা দূর করো।আমি কখনোই তোমাদের মাঝে বাধা হয়ে আসবোনা।
এইটুকুই লিখা শুভ্র কাগজটায়।মেহবিন কাগজটা হাতে নিয়ে উন্মাদের মতো এদিক সেদিক ঘুরাতে লাগল।হয়ত ভাবছে যদি মায়ান আরো কিছু লিখে।তবে না।আর কিছুই নেই।মেহবিন কাগজটা দুমড়েমুচড়ে জোরে জোরে বলে-
-”তোর জন্য মায়ান ভাই আমায় ছেড়ে গেলো মাইজা।তোর জন্য।
*( আমি অতীতের সমাপ্তি টা অন্য ভাবে করতে চেয়েছিলাম।বাট তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাই অগোছালো হয়ে গিয়েছে।আপনাদের কথামতো অতীতের সমাপ্তি টানলাম আজকে।কালকে থেকে বর্তমানের কাহিনী দেওয়া হবে।সবাই সাথে থাকবেন❤)