স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। পর্ব-১১

0
2014

#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-১১)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

রূপের মোহে, আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ হুট করেই কাউকে মন দিয়ে বসে। তার সবটা জুটেই সেই মানুষটার বাস থাকে। কল্পনায় তাকে নিয়ে হাজার স্বপ্ন বুনে। মন মাঝে ভাবনা আসে, এই মানুষটাকে ছাড়া তার চলবে না। সব সুখ বুঝি এর মাঝেই নিহিত। কল্পনায় বোনা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হাজার চেষ্টার পর তাকে জীবনে নিয়ে আসে। সেইক্ষণে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। সময় গড়ার সাথে সাথে যখন সে দেখে সঙ্গীর সাথে তার মনের অমিল, তখন সুখভাবটা ফিকে হয়ে যায়। প্রথমে মনের দূরত্ব এসে যায়, অনুভূতি কাজ করা বন্ধ করে দেয়, বিরক্তি লাগতে শুরু করে। মনে হয় রূপে মত্ত হওয়া উচিত হয়নি। মতের মিল, চলনের মিল আছে কি-না যাচাই করা উচিত ছিল। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। মানুষটা তার জন্য ঠিক নয়, সে এমন কাউকে চায়নি। অথচ একটা সময় মনে হয়েছে এই সেই মানুষ, যাকে সে হন্য হয়ে খুঁজেছে।

মুশরাফার পোশাক দেখে ঠিক এই অনুভূতিগুলো হচ্ছে জাওয়াদের। যাবারকালে যখন পাশাপাশি হাঁটছিল, তখন নিজের পাশে মুশরাফাকে বড্ডো বেমানান লাগছিল। মানাচ্ছে না তাদের, একটু ও না।
কপালে বিরক্তির ভাজ জাওয়াদের। সেই বিরক্তির মাত্রা গাঢ় হলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে। টেবিলে টেবিলে মানুষ বসা, জাওয়াদ একটা টেবিল বুক করল। বার্গার অর্ডার করল। বড়ো সাইজের বার্গার। খেতে গিয়ে জাওয়াদের ও কিছুটা ধাক্কা লাগল, এক কামড় দুইটা বান অবধি পৌঁছাচ্ছে না।
মুশরাফা নিকাব করা। নোজ নিকাবটা ঘোমটা থেকে আলাদা। নাকের উপর ঘোমটার ভেতর পেছনে বাধা। নাক থেকে বুকে ঝুলে পড়েছে। মুশরাফা এর আগেও রেস্টুরেন্টে এসে খেয়েছে। কায়দা তার জানা। সেই কায়দা মাফিক মুখ খুলল না সে। একহাতে বার্গার নিল, অন্যহাতে নিকাবটা একটু বাকিয়ে ফাঁক করে বার্গারে কামড় দিল। বার্গার দু’হাতে নিয়ে খেলে বিপত্তি হয়না, এক হাতে বড়ো সাইজের বার্গার খেতে গিয়ে নিকাবে লেগে গেল। একটু সস বোরকায় ও পড়ল। মুশরাফা ভড়কাল না। বার্গারে কামড় দিয়ে বার্গার রেখে দিল প্লেটে। তারপর স্বাভাবিকভাবে টিস্যু নিয়ে সস মুখে ফেলল। তাকে একটু ও বিচলিত দেখাল না।

কিন্তু জাওয়াদকে বিচলিত দেখাল। সে খাওয়া থামিয়ে তীক্ষ্ম চোখে পরখ করল ব্যাপারটা। চোখ মুখ কুঁচকে এলো। ওর খাওয়ার ধরণ একবারেই পছন্দ হলো না জাওয়াদের। নিকাবের ভেতর বার্গার নিয়ে কিভাবে খাচ্ছে! আবার ফেলে টেলে একাকার। পাশের টেবিলের একটা মহিলা এদিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হাসছে। লজ্জায় মাথা কা/টা যাচ্ছিল জাওয়াদের। তখনই শপথ নিয়েছে দ্বিতীয়বার মুশরাফাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসবে না। তার বন্ধুরা দেখলে হাসবে, টিপটপ চলা ছেলেটা শেষে কিংবা এমন গেঁয়ো মেয়েকে বিয়ে করেছে! টিটকারি দিবে।

বিয়ের আগে ওর পর্দার কথা শুনে মনে হয়েছিল, পছন্দের মানুষটা যেমনই হোক, মানিয়ে নিতে পারবে। তার কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে পারবে না মানিয়ে নিতে । এই চালচুলোহীন মেয়েটার সাথে সারাজীবনে কাটানো সম্ভব নয় তার পক্ষে। মেয়েটা তার মতো নয়, তার স্ট্যাটাসের সাথে যাচ্ছে না। শার্টের সাথে বোরকার মিশ্রণ হচ্ছে না।
একদিনেই মন বেঁকে গেছে। সকাল অবধি মনের ভেতর যে ভালোবাসা, সুখের উপস্থিতি ছিল তা যেন এক নিমিষেই উবে গেল। বাস্তবতার ধাক্কা বোধহয় একেই বলে। কল্পনার জীবন সুন্দর, বাস্তবতার নয়। বিরক্তিতে জাওয়াদের মুখ কালো হয়ে গেল। মুশরাফা তখনো আগের ভঙ্গিমায় খাচ্ছে। জাওয়াদের দেখতে ভালো লাগছিল না দৃশ্যটা। সে উঠে দাঁড়াল। অনেক কষ্টে নিজের স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
‘তুমি খাও, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।’

মুশরাফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। মুশরাফা ওর এহেন আচরণের অবাক হলো না, কারণটা রুমেই আন্দাজ করেছে সে। ব্যাপারটাকে সে স্বাভাবিকভাবেই নিল। খাওয়া থামিয়ে মনে মনে বলল,
‘আল্লাহ, তুমি মানুষটাকে সঠিক বুঝ দাও।’

আবার খাওয়ায় মন দিল। জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ ফিরল না। মিনিট দশেক বাদে ফিরল। মুখে মাস্ক। ততক্ষণে মুশরাফার খাওয়া শেষ। এসে চেয়ারে বসল। বার্গারের দিকে চেয়ে ও দেখল না। মুশরাফার উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোমার খাওয়া শেষ?’
‘হ্যাঁ।’ ছোটো করে উত্তর দিল মুশরাফা। জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। মানিব্যাগ বের করে বলল,
‘তুমি হাঁটো, আমি বিল দিয়ে আসছি।’

মুশরাফা জাওয়াদের আধখাওয়া বার্গারের দিকে চাইল এক পলক। কিছুই বলল না। জাওয়াদ যে আর খাবে না সে জানে। উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ হাতে দিয়ে বলল,
‘আমি বিল দিয়ে দিয়েছি।’

মুশরাফা হাঁটা ধরল। জাওয়াদ বিল কার্ড চেক করল। সত্যি বিল দেয়া। সে ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফার কাছে এসে বলল,
‘তুমি বিল দিলে কেন? আমি বিল দিতাম।’

মুশরাফা হাসল। নিকাবের ফাঁকে ওর চোখকে ও হাসতে দেখা গেল। হেসেই বলল,
‘ আমি আপনি একইতো। একজন দিলেই হলো।

জাওয়াদ বলল,
‘ কিন্তু মুশরাফা, ট্রিটটা তো আমার পক্ষ থেকে দেয়ার কথা ছিল।’

লোকটা সকাল অবধি ‘রাফা’ ডেকেছে। এখন ‘মুশরাফা’ ডাকছে। সম্পর্কের অবনতি টের পেল মুশরাফা। আলতো স্বরে বলল,
‘একদিন মন থেকে ট্রিট দিয়েন। ‘

‘আজ মন থেকে দিই নি?’
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল জাওয়াদ। রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুশরাফা গাড়ির খোঁজে এদিক ওদিক তাকাল। সুকৌশলে উত্তর এড়িয়ে বলল,
‘ এবার বাসায় ফিরি? ‘

থাকার ইচ্ছে জাওয়াদের নেই। তবুও সৌজন্যবোধে জিজ্ঞেস করল, ‘আর কোথাও যাবে না? চলো পার্ক টার্ক থেকে ঘুরে আসি?’

মুশরাফা কিছুটা দূরে ছিল। কদম বাড়িয়ে কাছে এলো। হাতের মুঠোয় হাত রেখে আলতো স্বরে বলল,
‘ আমি আপনার জীবনে বিরক্তি হতে আসিনি। বিরক্তির ভাজে আমায় আটকাবেন না। বাসায় চলুন।’

বলে হাত ছেড়ে দিল। সরে গেল দূরে। জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। মেয়েটা তার বিরক্তিভাব টের পেয়ে গেছে! কিভাবে? সে তো তেমন আচরণ করেনি। তবে? এই মেয়ে তো দেখি বেজায় চালাক। জাওয়াদ বিব্রতবোধ করল, অস্বস্তি হলো তার। হতভম্ব চোখে এক পলক চাইল মুশরাফার পানে। পরপরই দৃষ্টি ঘুরাল। গাড়ি ঠিক করে উঠে বসল। মুশরাফাকে বলা লাগল না, নিজেই উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

মাঝপথে মুশরাফা শান্ত স্বরে বলল,
‘ আমার জানামতে, মামা আপনাকে আমার জীবনধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। আপনি সবটা জেনে, সায় জানিয়েই বিয়ের ব্যাপারে এগিয়েছেন। তবে এখন আপনার কপালে বিরক্তির ভাজ কেন?’

জাওয়াদ ভাবেনি, মুশরাফা ওকে সরাসরি প্রশ্নবাণে ফেলবে। মেয়েটার বোল্ড পার্সোনালিটি যেন পদে পদে প্রকাশ পায়। জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারল না। খানিক বাদে ধীর স্বরে বলল,
‘আমি পর্দার মানে জানতাম না।’

মুশরাফা অবাক হলেও প্রকাশ করল না। কোমল স্বরে বলল,
“বিয়ের আগে অন্তত একবার হলে গুগলে গিয়ে ‘পরিপূর্ণ পর্দার ধরণ’ লিখে সার্চ দেয়া উচিত ছিল আপনার। তাহলে বোধহয় মিসম্যাচ হতো না। ”

কথাটা যুক্তিযুক্ত। আসোলেই উচিত ছিল, পর্দা সম্পর্কে জানা। ভুল হয়ে গেছে। এখন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। জাওয়াদ পাশ ফিরে চাইল এক পলক। তড়িৎ চোখ সরাল। এই পোশাক ওর মোটেই পছন্দ নয়। তাকাতে ইচ্ছে করছে না।

বাকি পথ আর কথা হলো না। চারতলায় উঠে মুশরাফা বাসায় গেলেও জাওয়াদ গেল না। ছাদে উঠে গেল। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এখন একটা সিগারেট না গেলেই নয়।

বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে দু’দিন ছুটি নিয়ে অনিক। আজ সে বাসাতেই আছে। অনিক ল্যাপটপে খেলা দেখছিল। জাওয়াদকে দেখে প্রফুল্ল মনে বলল,
‘কিরে নববর, কী অবস্থা? জীবনের প্রথম বিয়ের অনুভূতি কেমন?’

জাওয়াদ হতাশ চোখে তাকাল এক পলক। তারপর চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল। উদ্ভান্তের মতো কয়েক টান দিল। উদাস গলায় বলল,
‘হুটহাট বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হয়নি।’

অনিককে চিন্তিত দেখাল। ল্যাপটপ রেখে নড়েচড়ে বসল। বলল,
‘কাহিনি কী?’
‘কাহিনি হইতাছে, সি ইজ নট মাই টাইপ। কী সব আলখাল্লা পরে থাকে। বাইরে গিয়ে লজ্জায় পড়েছি। আমার সাথে যাচ্ছে না ওকে। বন্ধুবান্ধব কেউ দেখলে মান ইজ্জত থাকবে না। ‘ বিরস মুখে বলল জাওয়াদ।

অনিক কটু চোখে তাকাল। এমন মহীয়সী নারী কজনার ভাগ্যে থাকে? জাওয়াদ ভাগ্যজোরে পেয়েছে, তাও মূল্য দিচ্ছে না। অনায়েসে পেয়ে গেছে তো তাই, মূল্য বুঝে সাধনা করে পেলে মাথায় তুলে নাচতো। বন্ধুটি হীরে চিনছে না, আফসোস হলো অনিকের। প্রার্থনা করল, বন্ধুটি যাতে শীঘ্রই বুঝে, কত মূল্যবান রত্ন পেয়েছে জীবনে। চাপা শ্বাস ফেলল অনিক। তারপর কৌতুকের সুরে বলল,
‘ শালা তুই হলি লোকাল মানুষ, তাই রিজার্ভ ভালো লাগে না। সারাজীবন তো লোকাল ছিলি, এবার একটু রিজার্ভ হ। ‘

রাত ন’টা নাগাদ জাওয়াদ বাসায় ফিরল। মেহমানরা সবাই বিকেলে চলে গিয়েছে। শুধু লায়লা আর জায়ফা আছে। তারা কাল মুশরাফাকে বিদায় দিয়ে যাবে। বসার ঘরে সবাই মিলে কথা বলছে। জাওয়াদ সবার সাথে কুশল বিনিময় করে রুমে এলো। মুশরাফার উপর ক্ষীণ বিরক্তভাব তখনো অবিচল। মেয়েটাকে যথাসাধ্য এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস তার মনের। অনিকের জোরাজোরিতে এসেছে, নয়তো আসার ইচ্ছে ছিল না তার। গম্ভীর মুখভঙ্গিমায় রুমের দিকে এগুলো। দরজা ভেজানো। ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।
মুশরাফা কাপড় গুছাচ্ছিল। ওকে দেখে কাপড় রেখে কাছে এলো। প্রসন্ন হেসে কোমল স্বরে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম। ‘

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি। অথচ বিকেলে তাদের নিরব বোঝাপড়া হয়ে গেছে এক চোট। জাওয়াদ সালামের উত্তর নিল না। পাশ কাটিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। ফোন হাতে নিয়ে ফোনে চোখ ডুবাল। বাইরে থেকে এসেছে বোধহয়। ঘেমে-নেয়ে একাকার। মুশরাফা বরফ কিউব দিয়ে লেবুর শরবত করে আনল। জাওয়াদের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এটা নিন। ফ্রেশ লাগবে।’

জাওয়াদ মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল এক পলক। আবার নিবদ্ধ করল ফোনে। বলল,
‘আমি এমনিই ফ্রেশ আছি।’

‘কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনার চেহারায় ফরমালিন আছে।’ মুখ টিপে হাসল মুশরাফা।

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘ কীসব বলছো? মুখে কীসের ফরমালিন?’

খাটের পাশে সাইট টেবিল, তাতে গ্লাসটা রাখল মুশরাফা। তারপর জাওয়াদের কাছে বসল। মুখের কিছুটা উপর আঙুল ঘুরিয়ে বলল,
‘রাগ আর গম্ভীরতা নামক ফরমালিন দেখা যাচ্ছে আপনার মুখে। চোখে রাগ রাগ ভাব, নাকের ডগা ফুলে আছে। লক্ষণ ভালো নয়। আয়নায় দেখুন, নিজেই টের পাবেন। ‘

জাওয়াদ চোখ রাঙালো, ‘মজা করছো আমার সাথে?’

মুশরাফা উত্তর দিল না। চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে রইল। কেমন গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব ওর দৃষ্টিতে । চোখের পলক পড়ছে না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

মুশরাফা উত্তর দিল না। তাকিয়ে রইল অনিমেষ। জাওয়াদ কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর যখন চোখ তুলল তখনও মুশরাফাকে একইভাবে তাকানো দেখল। জাওয়াদ আবার বলল,
‘ কী দেখছো এভাবে? চোখ নামাও, আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’

মুশরাফা ঠোঁট চেপে হাসল। লোকটাকে বিরক্ত করতে ভালো লাগছে ওর। পলক ফেলল না। জাওয়াদ আবার কপাল কুঁচকাল। মেয়েটার হলো কী হঠাৎ? বুঝতে পারল না ও। দুজনার দৃষ্টিমিলনের মাঝে একবার পলক সরাল মুশরাফা। শরবতের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফেলল জাওয়াদের পানে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে গ্লাসে তাকাল জাওয়াদ। শরবত খায়নি বলে এমন করছে? জাওয়াদ গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল। এক টানে অর্ধেকটা করল। শরবতটা ভালো হয়েছে। আসোলেই ফ্রেশ লাগছে। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু ধন্যবাদ দিলে আবার পেয়ে বসবে, এই ভেবে চেপে গেল। আবার চুমুক দেয়ার পরপরই মুশরাফা বলল,
“আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন? মাকে না কি বলেছিলেন, বিয়ে করলে ‘রাফা ‘কেউ করব। অন্যকাউকে না।”

বিষম খেল জাওয়াদ। মেয়েটা তার ভাণ্ডারের সব কথা কিভাবে জেনে যায়? কে বলে? মা বলেছে নিশ্চয়ই! কাশতে কাশতে কেমন চোরা চোখে তাকাল মুশরাফার দিকে। মুশরাফা ওর পিঠ ঢলতে ঢলতে মুখ চেপে হাসল। পানি দিল। পানি খেয়ে স্বাভাবিক হলো জাওয়াদ। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল,
‘মোটেও না। মা তোমাকে বাড়িয়ে বলেছে।’

মুশরাফা আগের জায়গায় গিয়ে বসল, ‘আমি কিন্তু একবারও বলিনি মা বলেছে।’

‘মা বলেনি! তবে কে বলেছে? মাকে বলা কথাটা মা ছাড়া তো কেউ জানে না।’ অবিশ্বাস্য সুরে সত্য ফাঁস করে দিল জাওয়াদ।
মুশরাফা চওড়া হাসল,
‘তার মানে ঘটনা সত্যি! ‘ আবার স্থির দৃষ্টি ফেলল মুশরাফা।

জাওয়াদ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘দেখো, শরবত শেষ করেছি। এবার অন্তত চোখ সরাও মুশরাফা। ‘

মুশরাফা ঠোঁট উল্টালো,
”সকালে ও ‘রাফা’ ডাকছিলেন। এখন ‘মুশরাফা?’ কয়েক ঘন্টায় ভালোবাসা শেষ? এটা ভালোবাসা না হাওয়াই মিঠাই? ছুঁয়ে দিলেই গায়েব।’

মুশরাফাকে ভীষণ চঞ্চল দেখাচ্ছে। শান্ত, কোমল কিংবা কঠোর সেই মেয়েটি এখন আর নেই। এখনকার মেয়েটা চঞ্চল, চতুর। যে মেপে মেপে কাট কাট কথা বলে না, গম্ভীর চোখে তাকায় না। এ যেন অন্য রূপ। এই মেয়ের কত রূপ? খনিকেই রঙ বদলায়। জাওয়াদ আড়চোখে ওর বদলে যাওয়া রূপটা পরখ করল। এখন বিরক্তি আসছে না। বিরক্তিটা কি শরবতের সাথে গিলে ফেলেছে? না কি চঞ্চলতার চাঞ্চল্যে উড়ে গেছে কে জানে?

চারদিক আঁধার মাড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে প্রকৃতিকে। নিস্তব্ধতা কাটাতে মুয়াজ্জিনের মধুর সুরে রবের বাণী গেয়ে উঠলেন। আযান কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল মুশরাফার। আযান শেষ হওয়া অবধি শুয়ে রইল। তারপর উঠে ওয়াশরুমে গেল। বেরিয়ে জায়নামাজটা বিছালো খাটের পাশ ঘেঁষে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত জাওয়াদকে ডাকতে লাগল,
‘এ্যাই, উঠুন নামাজের সময় হয়ে গেছে।’

জাওয়াদের সাড়াশব্দ নেই। গভীর ঘুমে আছন্ন সে। মুশরাফা ওর কানে ফুঁ দিল। শিউরে উঠল জাওয়াদ। ঘুম ছুটে গেল। ঘুমঘুম স্বরে বলল,
‘কী হয়েছে?’
‘উঠুন।’
‘কেন?’
‘নামাজের সময় হয়েছে।’
‘আমি নামাজ পড়িনা। বিরক্ত করো না। ঘুমাতে দাও।’ বলে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল জাওয়াদ। মুশরাফা ঝাকি দিল। ঘুম ছাটালো চোখ থেকে। জাওয়াদ রেগে বলল,
‘সমস্যাটা কী তোমার? বললাম তো নামাজ পড়ব না।’
‘আমি নামাজ পড়তে বলছি না। জাস্ট অযু করে আসুন। ‘

জাওয়াদ যেতে চাইল না। মুশরাফা নাছোড়বান্দা, ঠেলে পাঠালো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে অযু করে বের হলো জাওয়াদ। মুখে তীব্র বিরক্তি, চোখে রাগ। বের হয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল মুশরাফার দিকে। জায়নামাজের পাশ কাটিয়ে খাটে উঠতে গিয়ে থেমে গেল। চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে। অযু করে এসেছে। একজন মুসলিম অযু করলে নামাজ না পড়ে থাকতে পারে না। চতুর মেয়েটা এটা জেনেই শুধু অযু করতে বলেছে। সে জানে অযু করলে নামাজ না পড়ে থাকতে পারবে না জাওয়াদ। হলো ও তাই। পা থামিয়ে নিল জায়নামাজের গোড়ায়। রাগত চোখে তাকাল মুশরাফার পানে।

মুশরাফার নামাজ শেষ। সে উঠে দাঁড়াল। চেয়ার থেকে টাওয়াল তুলে নিয়ে জাওয়াদের মুখ মুছে দিল। তারপর বলল,
‘এখন আপনাকে স্বামী স্বামী ধরনের সুন্দর লাগছে। ‘

জাওয়াদ তীক্ষ্ম চোখে ওর কাজ পরখ করছিল। কপালে ছিল বিরক্তির ভাজ। মুশরাফার কথায় আকস্মিক সব বিরক্তি উবে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। হেসে ফেলল সে। মুশরাফা ও হাসল, সার্থকতার হাসি।

সকালে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখল মুশরাফা। হলো আরেক বিপত্তি।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here