স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। পর্ব-১২

0
1820

স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-১২)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

‘ মাস্ক পরে নিন। তাহলে আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে কেউ চিনবে না।’ হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলানোর ফাঁকে জাওয়াদের দিকে মাস্ক বাড়িয়ে দিয়ে বলল মুশরাফা।

জাওয়াদ কপালের বিরক্তির ভাজ এঁটে শার্টের হাতা গুটাচ্ছিল। মেয়েটার গায়ে এই আলখাল্লা দেখলেই তার ঘা রি রি করে উঠে। সকাল অবধি মেজাজ ভালোই ছিল। বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়ে আবারও বিরক্তি মুখ, মন দুটোই তেতো হয়ে গেছে। বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে, শাড়ি গহনায় রানী সেজে যাবে। সবাই দেখেই বলবে, জাওয়াদ তোর পছন্দ আছে। খুশিতে আটখানা হবে জাওয়াদ। তা না, কীসব আলখাল্লা পরে জঙ্গলি সেজে যাচ্ছে তার সাথে। ওর বিরক্তিঘন মুহুর্তে মুশরাফা মাস্ক বাড়িয়ে দিল। সাথে বলা কথাটা শুনে জাওয়াদ থেমে গেল। বিস্ময় নিয়ে তাকাল স্ত্রীর পানে। মুশরাফার ধ্যান এদিকে নেই, সে এক হাতে মাস্ক বাড়িয়ে, অন্য হাতে নিকাব ঠিক করতে ব্যস্ত। চোখ জোড়া দেখা যাচ্ছে শুধু। জাওয়াদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মুখভঙ্গি যাচাই করার চেষ্টা করল। ফলাফল এলো, স্বাভাবিক। অথচ মেয়েটার মুখ থমথমে থাকার কথা। তার স্বামী তাকে পরিচয় দিতে চাইছে না বলে মাস্ক পরে নিজেকে আড়াল করছে, এটা তার জন্য অপমান। অন্য মেয়ে হলে কেঁদে কেটে একাকার করতো, অথচ এই মেয়ে স্বাভাবিক। যেন এটা হওয়ারই ছিল। মেয়েটা এমন কেন?

মুশরাফা হঠাৎ জাওয়াদের পানে তাকাল। চোখ হাসল ওর। হাসি হাসি স্বরে বলল,
‘ নির্দ্বিধায় পরে নিন। আমি কিছু মনে করব না। ‘

কাঙ্খিত মুখভঙ্গি না পেয়ে জাওয়াদের বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। মাস্ক নিল না সে। মুশরাফার হাসিটাতে যেন তিরস্কারের আভা পেল সে। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ মাস্ক পরার কারণ জেনে ও হাসছো কিভাবে? ‘

মুশরাফা ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ আমি কখনো ক্ষতির হিসেব কষি না, রাগের হিসেব ও কষি না। আমি কষি লাভের হিসেব। আপনার মাস্ক পরাটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলাম এখানে আমার লাভ আছে। সেই লাভটা আমাকে আনন্দ দিচ্ছে বলেই হাসছি।’

জাওয়াদ কিছুটা রেগে বলল,
‘মজা করছো আমার সাথে? এখানে লাভের কী আছে?’

দুজনার মাঝে এক হাতের দূরত্ব। মুশরাফা দূরত্ব গুজাল। নিজ হাতে জাওয়াদকে মাস্ক পরিয়ে দিল। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,
‘মাস্ক পরলে আপনার মুখ আবৃত থাকবে। সুন্দর মুখশ্রীটা কোন মেয়ের দেখার সুযোগ হবে না। কেউ আপনাকে চোখ দিয়ে গ্রাস করতে পারবে না। আমি সাথে থাকাকালীন সময়ে কেউ আপনার দিকে বাঁকা উদ্দেশ্যে তাকিয়ে থাকলে আমার সহ্য হবে না, হিংসে হবে। রাগ ও হবে হয়তো। রাগ, হিংসে শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আমি হয়তো শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে রাগ, কিংবা হিংসে বশত গুনাহের কাজে লিপ্ত হতে পারি। আপনি মাস্ক পরলে এই গুনাহ থেকে বাঁচতে পারব। লাভ না?’

জাওয়াদের চোখে আবার বিস্ময়ের রেখা। একটা মানুষ এত ইতিবাচক চিন্তা কিভাবে করতে পারে! আর তার এত অবহেলার পরও মনে প্রেম আসছে কিভাবে! সে আনমনে প্রশ্ন করলে,
‘আমার দিকে কেউ তাকালে তোমার সহ্য হবে না কেন?’

মুশরাফা হেসে বলল,
‘এই প্রশ্নের উত্তরটা না হয় আপনি খুঁজে বের করুন! যেদিন আপনি কারণটা বের করতে পারবেন, সেদিন আমার পোশাক দেখে আপনার কপালে বিরক্তির ভাজ আসবে না। সেদিন আপনি আপনার বিরক্তির উপর বিরক্তি হবেন। আমি সেইদিনের অপেক্ষায় রইলাম।’

কথাগুলোর ভাবার্থ গভীর। এত গভীরতায় পৌঁছাতে পারল না জাওয়াদ। ফলে কথার মানে বুঝতে পারল না সে। মুশরাফা থেকে সরে গিয়ে বলল,
‘ থাকো অপেক্ষায়। আমি চললাম। ‘

নিজের ট্রলি হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলো জাওয়াদ। মুশরাফা ও নিজের ট্রলি তুলে নিয়ে অনুসরণ করল তাকে। বসার ঘরে সবাই তাদের অপেক্ষা করছেন। জাওয়াদ বসার ঘরের কাছে গিয়ে মাস্ক খুলে ফেলল। ঘরের ভেতরে মাস্ক পরে থাকা বেমানান। বাইরে গিয়ে আবার পরবে। তাদের দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল। মুশরাফার বাবা আর মামা যাবে ওদের সাথে। বর কনেকে একা পাঠানো যায় না কি!

মুশরাফা ফরিদার কাছে যখন বিদায় নিতে গেল। তখন ফরিদা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আল্লাহ, তোকে দুঃখহীন সুখেভরা একটা জীবন দিক। প্রতিদিন ফোন দিবি, দু’দিন পরপর এসে হাজির হবি। ভাববি না, বিয়ে হয়ে গেছে বলে পর করে দিয়েছি।’

মুশরাফা কাঁদল না। সে সহজে কাঁদে না। তবে বুকের কাঁপুনি ঠিকই ধরতে পারল। স্মিত হেসে বলল,
‘ দোয়া করো। নিজের খেয়াল রেখো, নিয়মিত ওষুধ নিবে। ফাইজার সাথে অযথা রাগারাগি করো না, সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে বুঝবে ও। ‘

ফরিদা হাসলেন। যাবার বেলায় ও অন্যের চিন্তায় মত্ত সে। জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মেয়েটার জীবনে কষ্টের পাল্লা ভারি, তুমি একটু সুখ দিও। সবসময় ওর পাশে থেকো।’

ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে এই কান্নার দৃশ্য দেখতে একবারেই ভালো লাগছিল না জাওয়াদের। বিরক্ত লাগছিল ওর। নাটক মনে হচ্ছিল। কবে রেহাই পাবে সে চিন্তায় অস্থির। মামী শ্বাশুড়ির কথার উত্তরে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘আপনি চিন্তা করবেন না।’

মামীকে ছেড়ে মায়ের কাছে গেল মুশরাফা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘নতুন জীবনে পা রাখছি। মাথায় হাত বুলিয়ে একটু দোয়া করে দিবে, মা?’

মুশরাফার স্বরটা কাতরতায় ভরা। এই একটা মানুষের ভালোবাসার জন্য সারাজীবন চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় ছিল সে। অথচ পায়নি। একটা বার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি।

লায়লার চোয়ালে নিত্যকার গম্ভীর্য ছিল। আকস্মিক মেয়ের কথায় মেয়ের দিকে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই ভেতরটা কেঁপে উঠল উনার। দৃষ্টি নরম হলো। মনে পড়ল, এভাবে তাকানো হয়নি কতকাল!

মায়েরা যতই নিষ্ঠুর হোক, গর্ভে ধারণের সময় জন্ম নেয়া টানটা কখনো না কখনো বেরিয়েই আসে। সেই ক্ষণে তারা হাজার চেষ্টার পরও কঠোর হতে পারেন না। লায়লা আঞ্জুমান এই ক্ষণে এসে সেই টানটা অনুভব করলেন। মেয়ের প্রতি জন্মে থাকা রাগের পাহাড় মেয়েকে নিয়ে ভাবতে দেয়নি। মেয়ের বিয়ে কোথায় হচ্ছে, কার সাথে হচ্ছে সেটা যাচাই করার ও ইচ্ছে ছিল না। আসার ইচ্ছা ও ছিল না। লোকলজ্জার ভয়ে এসেছেন মাত্র। এসেই যেন আটকা পড়লেন। মেয়েটাকে বধূর সাজে দেখে তার চক্ষ যেন শীতল হয়ে এসেছিল। ইচ্ছে করেছিল মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, কিন্তু এতকালের দূরত্বে তাদের মাঝে গড়ে উঠে দেয়ালের জন্য পারেন নি। দূর থেকেই তাকিয়ে দেখেছেন। বরকে দেখেও তার ভালো লেগেছে। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালোই। তার উৎফুল্লতা দেখে ভালো লেগেছিল। ছেলেটা বিয়েতে খুশি। যাক, মেয়েটা সুখী হবে। কিন্তু বিয়ের পরদিন যখন তারা একসাথে ঘুরতে বেরুচ্ছিল তখন মেয়ে জামাইয়ের চেহারার বদলটা কেন যেন তার চোখে লেগেছিল। এই দৃষ্টির সাথে নিজের দৃষ্টির সাদৃশ্য পেলেন। ছেলেটা মেয়েটাকে মেনে নিতে পারছে না! মনের ভাবনা মিথ্যা হওয়ার দোয়াও করেছিলেন মনে মনে।
খানিক আগে যখন জাওয়াদরা রুম থেকে বেরুচ্ছিল, তখন তার মাস্ক খুলা, মুশরাফার দিকে ছুঁড়ে দেয়া বিরক্তিমাখা দৃষ্টি যেন তার ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করল। মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। চিন্তার পসরা বসল মনে। মেয়েটার সব ঠিকঠাক, যত গন্ডগোল সব পোশাক আশাকে। পোশাক আশাকটা বদলালেই হয়। এটাই মেয়ের কাল হবে, মেয়েটা বুঝে না কেন?

মেয়ের কথায় শিকলে বাধা মনটা আকস্মিক নড়ে উঠল। মাতৃত্বের মমতা উঁকি দিল মনে। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। অনেক গুলো বছরে তিলে তিলে গড়ে উঠা মনের দূরত্ব সেটা হতে দিল না। পারলেন না। তার ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝড় কেউ টের পেল না। সবাই দোয়া করল, যাতে কোন বিশৃঙ্খলা না করে। ফরিদা পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘জামাই আছে, মন থেকে না হোক, মুখ থেকে হলেও বিদায় দিন। একটু অভিনয় করুন, বিশৃঙ্খলা করবেন না আপা। আপনার কাছে হাতজোড় করছি।’

লায়লার ভেতরকার এক সত্তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তিনি তড়িৎ চোখ মুখ থেকে কোমলতা সরালেন। গম্ভীর করলেন মুখ। ডান হাতটা মেয়ের মাথায় রাখলেন। তিনি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলেন, তার হাত কাঁপছে। শুধু হাত নয়, হাতের সাথে কাঁপছে মন , কাঁপছে মাতৃত্ব। মনে মনে অনেক দোয়া করলেন। মুখে বললেন,
‘সুখী হ।’

মুশরাফা কী যে খুশি হলো! এই পর্যায়ে তার চোখে অশ্রু দেখা গেল। আবেগী হয়ে গেল সে। মাকে জড়িয়ে ধরল আকস্মিক। কান্না হাসিতে মেতে বলল,
‘আল্লাহ তোমাকে সবসময় সুখী রাখুক। আসি।’

মুশরাফা মাকে ছেড়ে সরে গেল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। বাবা, মামা যাচ্ছে তার সাথে। ফরিদা, ফাইজা, ফাবিহা, জায়ফা দরজা অবধি এগিয়ে দিল মুশরাফাকে। লায়লা দিলেন না। শান বাধানো মনটায় ঝঙ্কার তুলছে তার। বাকি সবার মতো মেয়ে বিদায়ের কষ্ট ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। সবার পিছনে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে মেয়ের যাওয়া দেখলেন। কেউ দেখল না, মাশকারার প্রলেপ লাগানো পাপড়ি জোড়া হঠাৎ ভিজে উঠার দৃশ্য। এই ঘরে থাকা যাবে আর এক মুহুর্ত। মনটা খা খা করছে। বসার ঘর ছাড়লেন তিনি। বাসায় যাওয়ার জন্য আগে থেকেই তৈরি হয়েছিলেন। রুমে গিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরলেন। জায়ফার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘চল, আমাদের দেরি হচ্ছে।’

ফরিদা অশ্রুভেজা চোখে তাকালেন। ক্ষিপ্ত হয়ে বলেই ফেললেন,
‘ আপনার মনে একটু ও মমতা নেই! আপনি সত্যি রাফাকে জন্ম দিয়েছেন? আমার সন্দেহ হয় আপা। মায়েরা এত নিষ্ঠুর হয়! আপনার মতো মা কোন শত্রুর ও না হোক আপা। আপনি রাফার মা হওয়ার যোগ্য না।’

লায়লা গম্ভীরমুখে কেমন করে হাসলেন। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
‘আপনি তো যোগ্য, তবে আপনি রাখবেন ওর খেয়াল। ওর সুখ দুঃখের খবর রাখবেন। ছেলেটা তো ওর মতো জংলি না, মেনে টেনে নিয়েছে? হাবভাব তো সুবিধার না ছেলের। ওই জংলি পোশাকের জন্য জামাইর মার খাচ্ছে কি না খোঁজ নিয়েন। অসামাজিকের জন্য শ্বাশুড়ির নির্যাতনের শিকার হয় কিনা জেনে নিয়েন। যা স্বভাব ওর, হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওই মেয়ের ব্যাপারে কোন কিছু শোনার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি শুনেন। এই চল জায়ফা।’

মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন লায়লা। ফরিদা ক্ষিপ্ত হয়ে কত কী বলে গেলেন। অথচ তিনি টের পেলেন না, লায়লা তাচ্ছিল্যের আড়ালে তাকে সতর্ক করে গেছেন। তিনি যাবার আগে স্বরের সাথে যুদ্ধ করেছেন, বলতে যে, ভাবি আমার মেয়েটার খেয়াল রাখবেন। আমার মন বলছে, ও সুখে নেই। ওর সুখ যাচাই করবেন।
কিন্তু পারলেন কই? মনে জমানো রাগ, ক্ষোভ মানুষের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। আর দূরত্ব গড়ে তুলে জড়তা। এই জড়তার জন্য চাইলেই অনেক বছর বাদে কাছে আসা যায় না, স্বাভাবিক হওয়া যায় না। মনের কথা বলা যায় না।

মায়মুনা ছেলে বউয়ের আগমন উপলক্ষ আত্মীয় স্বজন দাওয়াত করেছেন। বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হয়েছে। সেভাবে কাউকে বলা হয়নি। সবার অভিযোগ, বউ না দেখার আক্ষেপ। ভাই বোনগুলো তো ক্ষেপে আছেন, মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোক ও বেজায় নারাজ। সবার দিকে চেয়ে ছোটো খাটো গেট টুগেদারের আয়োজন করলেন। বোন, জা নিয়ে বসার ঘরে বউ আসার অপেক্ষায় বসলেন তিনি। বউ আসল, বউয়ের পোশাক থেকে বিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। এভাবে শ্বশুর বাড়ি আসে কেউ? একদিনের জন্য পর্দা না করলে কী হতো!
মানুষ কাজের আগে কত শর্তে সায় দেন, কিন্তু কাজের বেলায় সব ভুলে যান। মায়মুনা মুশরাফাকে পর্দার পরিবেশ গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিয়ের আগে। বিয়ে হতেই তিনি শক্ত মাটির নাগাল পেয়ে গেলেন। ওসব হেলাতেই ফেলে রেখেছেন তিনি। বিয়ে তে তো কত কথাই বলয়া হয়, বলতে হয় বলেই বলা। সব মানতে হবে না কি!

বিয়েতে আবার পর্দা কিসের? একদিনেরই তো ব্যাপার। কাল থেকে আবার পর্দা করবে। সমস্যা কী?
মুশরাফাকে বোরকায় দেখে তার মুখের রঙ বদলাল। ছেলের দিকে তাকালেন রাগি চোখে। যার অর্থ, এভাবে এনেছিস কেন? জাওয়াদ হতাশ চোখে তাকাল কেবল। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

মায়মুনা মুশরাফাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করে গমগমে গলায় বললেন,
‘একদিনের জন্য পর্দা না করলে কী এমন হতো? যাক গে, এসব আলখাল্লা ছেড়ে বসার ঘরে আসো। ‘

বসার ঘরে নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ দেখে এসেছে মুশরাফা। যাদের কাউকেই চিনে না ও। ছেলে বয়সী, বয়স্ক অনেকজন আছে। এরা সবাই গায়রে মাহরম। কীভাবে যাবে ও?

স্তব্ধ চোখে তাকাল। স্বর অবরুদ্ধ হলো ওর, হতভম্ব হলো মুখ। মায়মুনার পরিবর্তিত মুখটা কিছুতেই হজম হচ্ছে না ওর। বিয়ের দিন অবধি উনার স্বরে কী কোমলতাই না ছিল! সবার সামনে বলছিলেন, তুমি একবারে চিন্তা করো না। আমার বাসায় যেভাবে ইচ্ছে থাকতে পারবে, তোমার পর্দার খেলাপ হবে না। অথচ নিজের বাসায় আসতেই সেই কোমলতা দূর হয়ে গেল! মুশরাফা কিছু বলতে চাইল, মায়মুনা সুযোগ না দিয়ে কাকনকে ডেকে ওকে তৈরি করিয়ে বসার ঘরে নেয়ার নির্দেশ দিলেন। তারপর চলে গেলেন।

মুশরাফা শ্বাশুড়ির মাঝে মায়ের রূপ দেখতে পেল। সব মেয়েরা শ্বাশুড়িতে মাকে চায়। সে পেল, অথচ খুশিতে হতে পারছে না। কী ভাগ্য ওর! মুশরাফা বুঝে গেল, স্বামীর কাতারে শ্বাশুড়ি ও পড়ে গেছে। সে বাবার বাড়ি থেকে বেঁচে আবার বাবার বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। আবার শুরু হবে পর্দা রক্ষার সংগ্রাম। মামা তাকে এই সংগ্রামী জীবন থেকে বাঁচানোর জন্য বিয়ে দিলেন, সেই একই জাতে। ততক্ষণে কাকন চলে এসেছে। এ যেন কাকন নয় সাফা, সেই দিনের সাফা। জোরাজোরি করে বোরকা খুলে ফেলল ওর। এরপর বসার ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি শুরু করল। মুশরাফা ঠায় বসে রইল।

জাওয়াদের রুমটা মায়মুনার রুমের পাশে। মায়ের রুমের পাশ কাটিয়ে বসার ঘরে যেতে হয়। ফ্রেশ হয়ে জাওয়াদ বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হলো। মায়ের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাকনের আওয়াজ পেল। মুশরাফার চাপা স্বর ও কান এড়াল না। কৌতুহলবশত দরজা গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখেই কাকন অভিযোগের সুরে বলল,
‘দেখো, তোমার বউ বসার ঘরে যেতে চাচ্ছে না।’

জাওয়াদ তাকাল মুশরাফার পানে। গোলাপী কাতান শাড়িতে মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে। চোখ ধাঁধিয়ে আসছে তার সৌন্দর্যে। এই রূপেই একদিন আটকে গিয়েছিল জাওয়াদ। মোহে পড়ে জীবনে ও এনেছে, অথচ বাস্তবতার সম্মুখীন হতেই মোহ কেটে গেল। এত আকর্ষণীয় রূপ ও ওকে আকর্ষণ করতে পারছে না। আজ কোন ঘোর লাগছে না, মুগ্ধতা ভীড় জমাচ্ছে না চোখে।
সিনেমার মতো নায়িকার রূপে মজে নায়িকার সব দোষ ক্ষমা করা হয়না বাস্তবে। দোষের কাছে রূপকে হারতে দেখা যায়। এখনো দেখা গেল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। যেন কিছু জানেই না এমন ভান করে বলল,
‘ এসব মেয়ালি প্রথায় আমি নেই। তোমরা জানো।’

জাওয়াদ চলে গেল। মানুষ কারো প্রতি বেশি আশা করলে, সে পূরণ না করলে হতাশ হয়। মুশরাফা জাওয়াদের প্রতি কোন আশা করেনি। যে তার পর্দার জন্য তাকে স্ত্রী পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে, সে তার পর্দার ব্যাপারে সাপোর্ট করবে! স্বপ্ন বৈকি। আশা না করায় হতাশ হয়নি। তবুও কেন যেন এক পলক তাকিয়েছিল স্বামীর পানে। জাওয়াদ দৃষ্টির আড়াল হতেই মনে মনে বলল,
‘আল্লাহ, আমাকে ধৈর্যধারণ করার শক্তি দাও। আমি যেন ধৈয্যশীল হই, দুর্বল না হই।’

চাপা শ্বাস ফেলে কাকনের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমাকে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার সুযোগ দিবেন, ভাবি?’
মুশরাফার দৃঢ় বিশ্বাস, সবাই নিরাশ করলেও আল্লাহ ওকে নিরাশ করবে না। আল্লাহর বিধান পালনের জন্যই তো এত সংগ্রাম তার। সফলতা আনার দায়ভার ও তার।

সময় বাড়ল, বাড়ল বিপদ। এ যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। শেষ অবধি কী হলো? এলো কোন প্রতিকার? না কি হার মানতে হলো?

চলবে…

এখন অবধি জাওয়াদের চরিত্রটা নেতিবাচক। নায়ক চরিত্র সে। শুরু থেকে সবার অনুরোধ ছিল, অনিককে নায়ক বানানোর। অনিকের চরিত্রটা ইতিবাচক। জাওয়াদকে কারো পছন্দ নয়। কারো অনুরোধ গ্রহণ করতে পারিনি আমি। কারণ, এটা পূর্ব পরিকল্পিত। অনিক দায়িত্ববান। স্বামী হলে দায়িত্ববান হবে। আমি ইতিমধ্যে ‘প্রেমোদ্দীপক’ গল্পে অভীককে দায়িত্ববান স্বামীরূপে উপস্থাপন করেছি। এই গল্পেও অনিককে নায়ক করলে, দুটোর ধরণ একই হয়ে যেত। আমার কিংবা পাঠকের ঘেয়ামী লাগল। তাই আমি এই গল্পে নতুনত্ব এনেছি। দায়িত্বহীন স্বামী স্বরূপ প্রকাশ করেছি। তা ছাড়া, বাস্তবতার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, অভীকের চেয়ে জাওয়াদদের সংখ্যা বেশি। আমি এই গল্পটা বাস্তবতা থেকে তুলে ধরেছি।

এতকাল দায়িত্ববান স্বামীর স্বরূপ দেখেছেন, এবার দায়িত্বহীন স্বামীর কান্ড দেখুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here