প্রেমোদ্দীপক (বিশেষ পর্ব)

0
1898

#প্রেমোদ্দীপক। (বিশেষ পর্ব)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

আকাশের বুকে উঁকি দিয়েছে শুভ্র সরু চাঁদ। যা জানান দিচ্ছে কাল ইদ। দূর থেকে বাচ্চাদের চেঁচিয়ে বলা কথা কানে আসছে, ‘চাঁদ উঠেছে। ইদ মোবারক, ইদ মোবারক।’
চাঁদ উঠতেই চারদিকে যেন এক আনন্দঘন মহল তৈরি হয়েছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তাহিয়া। দৃষ্টি আকাশ পানে, এখান থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তাও সে আবছায়া সন্ধ্যা আকাশের দিকে চেয়ে আছে অনিমেষ। বিষন্ন তার চোয়ালখানা। শূন্য দৃষ্টি, বিষন্ন চাহনি, ভারি হয়ে আসা বুক। চোখের সামনে ভাসছে পুরনো স্মৃতি, মা আর ভাইটার চেহারা।
সংসার জীবনের প্রথম ইদ। সেই সাথে মা ভাইয়ের সাথে না করার ইদ ও । ইদ উপলক্ষে গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে এসেছে গতকাল। এখানে নেটওয়ার্ক নেই, আসার পর থেকে কথা হয়নি মায়ের সাথে, ঝগড়া করা হয়নি ভাইয়ের সাথে। ভীষণ মনে পড়ছে তাদের। প্রতিবছর চাঁদ রাতে কত আনন্দ করে তারা। সন্ধ্যা হলেই মা ভাইকে নিয়ে ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখে, রাত গড়ালেই দু’হাত ভরে মেহেদী পরে, সকালে নিজে ইদের নতুন জামা পরে, মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা মাকে নিজে পরিয়ে দেয়। মায়ের হাতের ফিরনি খায়, খেতে বসে তুহিনের ঝগড়াটা মিস হয় না। কতশত সুন্দর মুহুর্ত কাটে তাদের। এই মুহুর্তগুলো এখন স্মৃতি পাতায় আটকানো। আর বোধহয় হবে না, বিয়ের পর মেয়েদের বাবার বাড়িতে ইদ করার সুযোগ হয় না। তারও হবে না, যাত্রাটা বোধহয় এখানেই শুরু।

স্বামীর সাথে একসাথে প্রথম ইদ। অনুভূতি প্রবল হওয়ার কথা, কিন্তু তাহিয়ার অনুভূতিরা যেন ফিকে পড়েছে। মা ভাই যখন ভাবনায় আসছে, কান্না পাচ্ছে, উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মেয়েদের কেন পর হতে হয়? মায়ের সাথে সারাজীবন ইদ করার সুযোগ হয়না কেন? বিক্ষিপ্ত মনে কত প্রশ্নরা উঁকি দিচ্ছে। উত্তর কি আর মিলছে? না, এসব অমীমাংসিত বিষয়।

অভীক নেই, ইফতার করে নামাজ পড়তে গেছে মসজিদে। এখনো ফিরেনি। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি,ননাশরা পাশের ঘরে। এ ঘরে সে একাই। মানব শূন্যতায় একাকিত্ব এসে হানা দিয়েছে, বিষন্নতার সাথে মিলেমিশে একাকার। অভীক থাকলেও এই একাকীত্ব কিছুটা দূর হতো, কিন্তু মা ভাইয়ের শূন্যতা রয়েই যেত। তাহিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে আবার কল করল মায়ের নাম্বারে, কল গেল না। নেটওয়ার্ক নেই বলতে গেলে। তাও ক্ষীণ আশা নিয়ে ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করল, নাম্বার হোমে তুহিনের ছবি এড করা। পর্দায় তুহিনের ছবিটা ভেসে উঠল, এতকাল ঝগড়া করা ভাইটার ছবি দেখেই আজ বুক কাঁপল, সে কী আপন মনে হলো! কল গেল না। ফোন রেখে দিল। কয়েক ফোঁটা নোনাজল ঝাপসা চোখের বারান্দা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ফোনের পর্দায়।

তাহিয়ার মনে যখন বিষন্নতার অবাধ বিচরণ, ঠিক তখন রুমে উপস্থিত হলো অভীক। মাথার টুপি খুলে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে স্ত্রীকে পরখ করল,
‘ এই ভরসন্ধ্যায় জানালার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছো কেন? মশা কামড়াবে তো! ‘

প্রিয়তমের স্বর কানে যেতেই ধ্যান ভাঙলো তাহিয়ার। তড়িৎ চোখ মুছে, নিজেকে স্বাভাবিক করার অপ্রাণ চেষ্টা করল। ওর চেষ্টার মাঝে অভীক এসে দাঁড়াল ওর পিছনে। কাঠের জানালায় উঁকি দিয়ে আকাশ দেখল। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘চাঁদ তো দেখা যাচ্ছে না। কী দেখছো তুমি?’

তাহিয়া উত্তর দিল না। আর না পাশ ফিরল, ঠায় দাঁড়িয়ে কান্না গিলার চেষ্টা করে গেল। অভীক ওকে পরখ করে বলল,
‘চাঁদ রাতে চাঁদ না দেখলে হয়? চলো চাঁদ দেখে আসি!’

তাহিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘ ইফতার করেই চলে এসেছি, প্লেট বাটি গুলো সব ওভাবেই পড়ে আছে। চাচী একা হাতে কত করবেন? আমি গিয়ে হাত লাগাই। চাঁদ দেখতে যাওয়ার সময় নেই।’ তাহিয়া জানে চাঁদ দেখলেই মাকে ভেবে অভীকের সামনে কেঁদে দিবে সে। তাই এড়ানোর অপ্রাণ চেষ্টা।

অভীক শুনল না সে কথা। বুঝল কি না কে জানে? হাত ধরে বলল,
‘আরে চলো তো! যাব আর আসব। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। এসে কাজ কোরো।’

তাহিয়া হাঁটা থামিয়ে হাত ছাড়াতে চাইল,
‘বুঝার চেষ্টা করো অভী! আমরা এতগুলো মানুষের জন্য ইফতার বানানো, রাতের খাবার রান্না করাটা চাচীর জন্য বেশি চাপ হয়ে যায়। সেই দুপুর থেকে রান্নাঘরে ছিলেন, ইফতার করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া উচিত উনার। এখন আমি না গেলে এঁটো বাসন নিয়ে যাবেন পুকুরে। অন্যায় হয়ে যাবে উনার প্রতি। মেহমান হলেও একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি! বুঝার চেষ্টা করো অভী, ইদ তো উনার ও আছে।’

অভীক ওর কথাকে প্রাধান্য না দিয়ে হাত শক্ত করে ধরে ওকে উঠোনে নিয়ে গেল। মায়ের ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে কী যেন বলল মাকে। তারপর ফিরে এসে বলল,
‘তুমি ফিরে আসা অবধি চাচীর কাজ স্থগিত করার জন্য মা যাচ্ছেন। তুমি চলো আমার সাথে।’

তাহিয়া আবার কিছু বলতে গেল, তারমাঝে নীলিমা বের হলেন ঘর থেকে। ওর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ আমরা সবাই মাত্র চাঁদ দেখে এসেছি। তোরা দেখে আয়। আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি।’

আর কিছু বলার রইল না তাহিয়ার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অভীকের পিছু নিতে হলো। ওদের ঘরের পিছনে পুকুর, পুকুর পাড়ের পাশেই বিশাল আবাদি মাঠ। অভীক স্ত্রীর হাত ধরে মাঠে নিয়ে গেল। এখান থেকে স্পষ্ট চাঁদ দেখা যাচ্ছে। শুভ্র সরু চাঁদটায় চোখ যেতেই বুক ভেঙে এলো তাহিয়ার। এই বুঝি কেঁদে দিবে। তড়িৎ চোখ সরাল। পালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বলল,
‘দেখেছি চাঁদ, এবার চলো।’

অভীক ওর পিছনে দাঁড়ানো ছিল। হাতে ফোন। ফোনে কিছু দেখছে। নড়ল না। তাহিয়া ওকে রেখে একাই হাটা ধরল। দু’কদম আগাতেই অভীক দ্রুত পায়ে এসে ওর কাছে দাঁড়াল। আবছা আলোয় প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকাতেই কানে ফোন চেপে ধরল। তাহিয়া বিরক্তমাখা স্বরে বলতে গেল,
‘কী হচ্ছে কী অভী?’

বলতে গিয়ে থামতে হলো, কানে চাপা ফোনে কাঙ্খিত একটা নারী কন্ঠ ভেসে এলো। তাহিয়ার ভেতর চাপা কান্নাটা আর বাধা মানল না। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
‘মা..!’

ওপাশ থেকে মাহমুদার মলিন স্বর ভেসে এলো,
‘কেমন আছিস?’
‘ভালো। তুমি ভালো আছো? তুহিন কেমন আছে?’ চোখের পানি ফেলার মাঝে জিজ্ঞেস করল তাহিয়া। মাহমুদা বললেন,
‘আছে ভালোই। কাঁদছিস কেন? ‘
‘তোমাদের ছাড়া ইদ করার অভ্যাস নেই মা। মনে পড়ছে শুধু । ‘

মাহমুদা নিঃশব্দে কেঁদে ফেললেন। বললেন,
‘আমার ও মনে পড়েছে। কতবার কল দিয়েছি, নেটওয়ার্কের কারণে যায় নি। কবে ফিরবি তোরা?’

‘মা বলল, সপ্তাহখানেক পর। আমার চাচাতো ননদের বিয়ে দু’দিন পর। বিয়ে খেয়ে তারপর যাবে না কি। ‘ মলিন স্বরে বলল তাহিয়া। পরপরই বলল,
‘ আমি তো যেতে পারব না, তোমরা আসো। আমায় দেখে যাও। আসবে মা? ‘ কিভাবে আবদার করে উঠল মেয়েটা।

মাহমুদার বুক কেঁপে উঠল। আফসোস হলো, মেয়েটাকে কেন বিয়ে দিলেন এত তাড়াতাড়ি। আরও বছর দশেক রেখে দিতেন। মেয়ে সাথেই থাকতো। মাহমুদা করুণ স্বরে বললেন,
‘কাল তুহিন বাসায় থাকবে না বলল। বন্ধুদের সাথে কোথায় জানি ঘুরতে যাবে। আমি একা তো আসতে পারব না। পরসু আসব। হবে?’

মুখের বিষন্নতা সরে গেল তড়িৎ। চোখে পানি, ভেজা গালে হাসি ফুটল ঠোঁটে। তাহিয়াকে ভীষণ উৎফুল্ল দেখাল। প্রাণবন্ত হেসে বলল,
‘ আসো। দু’দিন থাকবে কিন্তু!’

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখল তাহিয়া। তুহিন নেই, বাইরে। তাহিয়া কথা বলতে চেয়ে ও পারল না। পরসু তো আসবেই দেখা হবে। এতক্ষণে ইদের খুশি লাগল ওর মনে। ফোন ফেরত দিতে গিয়ে, নেটওয়ার্ক চেক করল। এখানে ফুল নেটওয়ার্ক! তার মানে অভীক ওকে চাঁদ দেখার বাহানায় মায়ের সাথে কথা বলাতে নিয়ে এসেছে! লোকটা সব টের পায় কিভাবে! চট করেই মন ভালো করে দেয়। অভীক ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তাহিয়া কৃতজ্ঞ চোখে তাকালে অভীক আলতো স্বরে বলল,
‘ইদ মোবারক। চাঁদ রাতে আকাশের চাঁদের সাথে ঘরের চাঁদের হাসি ও দেখতে হয়। আমি দুটো একসাথে দেখতে চাই।

তাহিয়া চমৎকার হাসল। ধন্যবাদ দেয়ার পরিবর্তে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ইদ মোবারক। ‘ সন্ধ্যার শেষ আলোয় অভীক ওর ঘরের চাঁদের হাসি দেখে আকাশের চাঁদের হাসি দেখল। বুকের কাছেপাশে থেকেই প্রসন্ন মনে আকাশের চাঁদ দেখল তাহিয়াও।

বিষন্ন মনে গিয়েছিল মাঠে, ফিরল প্রাণবন্ত হয়ে। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে খাবার ঘরে গেল। ইফতারের রেখে দেয়া এঁটোবাসন ধুয়ে ফিরল ঘরে। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসছিল। রুমে গিয়ে বিছানায় বসল। অভীক ঘরেই ছিল। সোফায় বসে ফোন দেখছিল। ওকে দেখে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ টেবিলের উপর মেহেদি রাখা আছে। ‘

তাহিয়া বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ মেহেদি লাগানোর মতো এনার্জি নেই। ‘

থেমে দুষ্টু সুরে বলল, ‘ চারদিকে দেখি, চাঁদ রাতে হাসবেন্ডরা মেহেদি লাগিয়ে দেয়। তুমি ও তো আমাকে মেহেদি লাগিয়ে দিতে পারো। তা তো করো না। দিন যাবার সাথে সাথে তুমি ফানসে হয়ে যাচ্ছো অভী।’

অভীক ফোনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। পরপরই চোখ তুলে চাইল স্ত্রীর পানে। অবাক হয়ে বলল,
‘আমি ফানসে হয়ে যাচ্ছি!’

তাহিয়া মুখ টিপে হেসে বলল,
“তা নয়তো কী! মেহেদি এনে আমার হাত টেনে বলতে পারতে, ‘এতকাল তো নিজে মেহেদি লাগিয়েছো, আসো আজ আমি তোমাকে মেহেদি লাগিয়ে দিই।’ বলেছো? বলোনি। কেমন দূরসম্পর্কের বরের মতো বললে, টেবিলের উপর মেহেদি রাখা আছে। এসব ফানসে হওয়ার লক্ষণ। ‘

অভীক প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকাল স্ত্রীর পানে। পরপরই উঠে দাঁড়াল। মোবাইল রেখে মেহেদি হাতে নিল। তাহিয়ার পাশে বসে বাঁকা চোখে তাকাল। এক ভ্রু উঁচানো, এক ভ্রু নামানো। কেমন খলনায়কের মতো দেখাল ওকে। তেমন করেই বলল,
‘ আসো আজ আমি তোমার হাতে মেহেদি দিই। ‘

থেমে বলল, ‘তবে হ্যাঁ, আগেই বলে দিচ্ছে কাল সকালে হাত লুকানো লাগলে আমায় দোষ দিবে না।’

তাহিয়ার হাত টেনে কোলের উপর রাখল অভীক। তাহিয়া ওকে পরখ করে তড়িৎ উঠে বসল। আতঙ্কিত হয়ে বলল,
‘ তোমাকে সুবিধার লাগছে না অভী। কী না কী আঁকবে আমার হাতে। পরে লজ্জার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে আমাকে। থাক , লাগবে না মেহেদি লাগানো। আমি নিজেই লাগিয়ে দিব।’

হাত টেনে নিতে চাইল তাহিয়া। অভীক খপ করে হাতের কবজি ধরে ফেলল। বাঁকা হেসে বলল,
‘ সেটা আমাকে ফানসে বলার আগে ভাবা উচিত ছিল। এখন সময় তোমার নাগালের বাইরে। এই সময়টা আমার। চুপচাপ বসে থাকো। আমি তোমার হাতে ড্রয়িং করি।’

প্রথম ইদ। কত মানুষের সাথে দেখা হবে কাল। সবাই মেহেদি দেখতে চাইবে। উল্টোপাল্টা কিছু আঁকলে মুখ দেখাবার জো থাকবে না। শ্বাশুড়ি মহলের সামনে কী লজ্জায় না পড়তে হবে! তাহিয়ার স্বর নরম হলো।
এক গাল হেসে কোমল স্বরে বলল,
‘ আমি তো মজা করছিলাম। তুমি দেখি সত্যি ভেবে নিলে। মজা ও বুঝো না ! লাগাতে হবে না। আমি নিজেই লাগাব। ‘

অভীক ও হেসে বলল,
‘দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। তার কথাকে তো সবভাবে ভেবে নেয়া আমার গুরুদায়িত্ব। ‘

তাহিয়া কিছু বলতে চাইল। পারল না। অভীক স্লিপিং মাস্ক নিয়ে ওর চোখে পরিয়ে দিয়ে শুইয়ে দিল। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ আমাকে নিজের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ দাও, একদম বিরক্ত করবে না। চুপচাপ ঘুমাও।’

মেহেদির কোণ নিয়ে বসে গেল। তাহিয়ার হাতে ঠেকাল কোণে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কোণ ঘুরাচ্ছে। তাহিয়া উঁকি দিয়ে দেখতে চাইল ভয়ংকর কার্যনামা। অভীক চোখ রাঙাল। অগত্যা আবার শুয়ে পড়তে হলো। ক্লান্তি ভর করেছিল সেই ক্ষণে শুতেই ঘুম নামল চোখে। ঘুম ভাঙল অবনীর ডাকে,

‘তাহিয়া, কই তুই? মেহেদি দিবি না?’

চোখ খুলে অভীককে দেখতে পেল না তাহিয়া। ঘরে সে একা। অবনী দরজায় দাঁড়ানো। হাতে মেহেদির কোণ, সাথে অয়ন ও এসেছে। মেহেদির কোণ দেখে নিজের হাতের কথা মনে পড়ল। অভীক কী করেছে দেখা দরকার। হাত দুটো সামনে আনল। অভীকের প্রতিভা দেখে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল। অভীক উদ্ভট কিছু আঁকেনি। ওটা বোধহয় ওকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ছিল। অভীক ওর দুই হাতে কিছু কথা লিখে দিয়েছে, যাতে চোখ বুলার পর মনটা নেঁচে উঠল । ডান হাতের তালুতে লিখেছে,
‘Everything will be fine. Don’t’ be upset. ‘

বাঁ হাতের তালুতে লিখেছে,
‘ You should remember that you are the special person in my life, living in the depths of my heart. I’m always with you. Before you cry, you should remember that, your smile is your soulmate’s favorite. ‘
ছোটো ছোটো করে লিখেছে। তাও যেন জ্বলজ্বল করছে। পড়েই চোখটা কেমন শীতল হয়ে এলো। তখনকার কান্না থেকে যে এই লেখার উৎপত্তি, বেশ বুঝতে পারল তাহিয়া। আনমেই হেসে ফেলল।

অবনী ভেতরে এসে বলল,
‘হাসছিস কেন? মেহেদি দিবি না? আয়, আমি লাগিয়ে দিই।’

তড়িৎ হাসি থামাল তাহিয়া। আতঙ্কিত হলো ওর মুখ। অভীক যা লিখেছে তা এখনই প্রকাশ পেয়ে যাবে। লজ্জায় পড়ে যাবে ও। স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার, বাইরের মানুষের সামনে আসা মানেই লজ্জার। তাহিয়া তড়িৎ হাত পেছনে নিয়ে গেল। হাত লুকিয়ে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘ মেহেদী দিতে ইচ্ছে করছে না, আপু।’

অবনী ওর পাশে বসল। ভ্রু কুঁচকাল,
‘তোকে লাগাতে কে বলেছে? আমি লাগিয়ে দিব।’

তাহিয়া তাও আপত্তি করল। অবনী জোর করল, ‘ মাকে লাগিয়ে এসেছি। আমি ও লাগাব। আমরা সবাই মেহেদি লাগাব, তোর হাত খালি থাকবে? তা তো হবে না। দু’হাত রাঙাবি মেহেদিতে, সেজেগুজে শাড়ি পরে ইদের দিন সবাইকে সালাম করে টইটই করে ঘুরে বেড়াবি। তবেই না লাগবে নতুন বউয়ের মতো। দে, হাত দে!’

তাহিয়া মিনমিনে বলল, ‘আপু থাক না!’
অবনি হেসে বলল, ‘বিয়ের পর একসাথে প্রথম ইদ, ভালোভাবে ইনজয় কর। হেলাফেলা করিস না একদম। পরে আফসোস হবে।’

বলে নিজেই তাহিয়ার হাত টেনে সামনে আনল। তাহিয়া চোখ মুখ খিঁচে মনে মনে বলল, ‘এরা দুই ভাইবোন মিলে, আমার হাতের মানসম্মান চিনিয়ে নিয়েই ছাড়বে। ‘

হাত সামনে আনতেই লেখাগুলো চোখে পড়ল অবনীর। ডান হাতের লেখা পড়েই হেসে উঠল। বাঁ হাতের লেখা পড়ল না। কিছু ব্যাপার থাকুক স্বামী স্ত্রীর। ননাশ বলে, সব কথা নাক গলাতে হবে? উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ তোর হাত তো রাঙানো। আমি যাই, নিজের মেহেদি লাগাই। অয়ন চল। ‘

অয়ন ছেলেটা ভারি দুষ্টু। মামীর বাঁ হাতের লেখা সে দেখেছে। সবে ইংরেজি বাক্য পড়তে শিখেছে, অর্থ বুঝতে শিখেছে। যা দেখে তাই অর্থ মিলিয়ে পড়তে শুরু করাটাই এখন ওর প্রধান কাজ । মামীর হাতে লেখা দেখে কৌতুহলী হলো। গেল না ও। মামীর লুকানো হাতে উঁকি দিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগল,
‘You should remember that you are the special person in my life, living in the depths of my heart… থেমে থেমে এ টুকু পড়ে ফেলল। অবনী মিটিমিটি হাসল কেবল। ছেলেকে ধমকিয়ে বলল,
‘ বড়োদের ব্যাপারে নাক গলানো বাজে অভ্যাস, জানিস না? পড়তে হবে না। চল।’

তাহিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অয়ন ছেলেটা সবসময় ওকে লজ্জায় ফেলার ধান্দায় থাকে কেন?

তখন ঘরে এসে দাঁড়াল অভীক। ভাইকে দেখে অবনী ছেলেকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অভীক ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ ওকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

অয়নের চেঁচামেচি শুনে নীলিমা ও এদিকে এলেন। অবনীর আগে অয়নই অভিযোগের সুরে বলল,
‘দেখো না, মামীর হাতে কী সুন্দর লেখা ছিল মেহেদিতে। আমি পড়ছিলাম, মা দিলোই না। অল্প একটুক পড়েছি, You should remember that you are the special person in my life…. ‘ মনে করে করে বলল অয়ন।

অভীক আকস্মিক কেশে উঠল। মা পাশে দাঁড়িয়ে, বোনটাও তার দিকে তাকানো। কী লজ্জাজনক ব্যাপার হয়ে গেল! নীলিমা হেসে বেরিয়ে গেলেন। অয়ন থেমে গিয়ে এবার অর্থ করা শুরু করল, ‘you should – তোমার উচিত, remember that- মনে রাখা যে
you are the special person – তুমি বিশেষ মানুষ
in my life- আমার জীবনের।

অভীক বিব্রতবোধ করল। অবনী ছেলেকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাহিয়া বিছানায় চোখমুখ খিচে বসে রইল। অভীক গিয়ে পাশে বসতেই রেগে তাকাল। অভীক শূন্য চোখে তাকাল এক পলক। পরক্ষনেই হেসে উঠল শব্দ করে। হাসতে হাসতে বলল,
‘আমি কিন্তু আগেই সাবধান করেছিলাম। তুমিই আমাকে ফানসে প্রমাণ করতে গিয়ে ধরা খেলে। ‘

সকাল তখন সাড়ে সাতটা। ব্যস্ত হাতে চুলোয় রান্না করছে তাহিয়া। পায়েশ, ফালুদা, সেমাই করছে বাড়ির সবার জন্য। সাড়ে আটটায় ইদের জামাত। পুরুষরা ইদের নামাজে যাবার আগে টেবিলে নাস্তা হাজির করার তাড়া বেশ। নুডুলস সিদ্ধ করার জন্য পানি বসিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল তাহিয়া। অভীক ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। চুলোর আঁচ কমিয়ে এগিয়ে গেল খাটের দিকে। স্বামীকে জাগিয়ে দিল। বলল,
‘ পাঞ্জাবি, নামিয়ে রেখেছি। গোসল সেরে এসে পরে নাও। ‘

অভীক গোসল সেরে বেরুতে বেরুতে তাহিয়ার রান্না মোটামুটি শেষ। সেমাই, পায়েস বড়ো বাটিতে করে খাবার ঘরে রেখে এসেছে। এখন ফালুদার জেলি কেটে সাজানো বাকি শুধু। অভীককে দেখে বাটিতে জেলি সাজাতে সাজাতে বলল,
‘নাস্তা এখানে খাবে না কি খাবার ঘরে খাবে?’

স্ত্রীকে পরখ করে হাসল অভীক। সংসারে পা রেখেই পাক্কা গিন্নি হয়ে গেছে। আগের সেই শিশুসুলভ তাহিয়াটাকে আজকাল খুঁজে পাওয়া যায় না। অভীক স্ত্রীর কাজে হাত লাগাল। দ্রুত কাজ শেষ করতে সাহায্য করল। বাকি সবার জন্য বরাদ্দ ফালুদা রেখে এলো খাবার ঘরে। ফিরে এসে একটা বাটি হাতে নিল। আলতো স্বরে ডাকল,
‘হিয়া?’

তাহিয়া চমকাল। পাশ ফিরে চাইল, ‘হু!’
অভীক হাত টেনে পাশে বসাল। বাটি থেকে এক চামচ ফালুদা তুলে স্ত্রীর মুখের সামনে ধরে বলল,
‘ চুপচাপ শেষ করো।’

তাহিয়া চাপা হাসল। নিঃশব্দে নিয়ে নিল। অভীক এবার এক চামচ নিজের মুখে নিল। তাহিয়া বলল,
‘উনারা সবাই খেতে বসে তোমাকে খুঁজবে, তুমি ওখানে গিয়ে খেতে বসো।’

অভীক আরেক চামচ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ফালুদা শেষ করি এখানে। ওখানে সবার সাথে সেমাই খাব।’

তাহিয়া আবার হাসল। লোকটা ব্যালেন্স করে চলতে জানে। দুজনে ফালুদা শেষ করল। নামাজের উদ্দেশ্যে বেরুনোর জন্য পা বাড়াতেই তাহিয়া বলল,
‘সালামি দিবে না?’

অভীক হেসে বলল,
‘ ইদের সাজে নিজেকে সাজাও। তারপর পাবে সালামি। আমি নামাজ পড়ে এসে দিব।’

চলে গেল সে। ফিরে অনেক ঘন্টা দুয়েক বাদে। নীলিমার আদেশে তাহিয়া কাজ ছেড়ে তৈরি হতে বসেছে। গোসল সেরে ইদ উপলক্ষে অভীকের দেয়া শাড়ি পরল, খুব সাজল। অভীক এসে স্ত্রীকে দেখেই হাসল প্রাণবন্ত। বলল,
‘সুন্দর লাগছে আমার হিয়ারানীকে। ‘
তাহিয়া হেসে বলল,
‘সালামি দাও।’
অভীক কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘সবার সাথে দেখা করা শেষ? ‘

ইতিবাচক উত্তর দিল তাহিয়া। অভীক সন্তুষ্টচিত্তে বলল,
‘পারফেক্ট। চলো। ‘
‘কোথায়?’
‘ আমার সালামি নিতে।’ তাহিয়ার হাত ধরে ঘর থেকে বেরুলো অভীক। বাড়ির সামনে পার্ক করা গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে দিল। তাহিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কোথায় যাব আমরা?’

অভীক উত্তর দিল না। গাড়ি স্টার্ট দিল। ফয়সালকে ইদ উপলক্ষে দেশের বাড়ি পাঠিয়েছে। ড্রাইভিংটা সে রপ্ত করে নিয়েছে ইতিমধ্যে।

গাড়ি চলতে থাকল, সেই সাথে বাড়তে থাকলে তাহিয়ার প্রশ্ন, কৌতুহল। কিন্তু প্রশ্নরা কোন উত্তর পেল না। গাড়ি যখন গ্রাম পেরিয়ে চেনা এক রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাহিয়া তখন অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল অভীকের পানে। অস্ফুটস্বরে বলল,
‘এটা তো আমার বাসার রাস্তা…

অভীক ওর পানে চেয়ে হাসল কেবল। বলল,
‘ সবসময় ইদের দিন বাবা মাকে কেন মেয়ের শ্বশুরবাসায় গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতে হবে? মেয়েরাও তো পারে মায়েদের দেখে আসতে।’

খুশিতে তাহিয়া কথা বলতে পারল না। চমৎকার হাসি নিয়ে বসে রইল। চোখ মুখ খুশিতে মেতেছে। গাড়ি বাসার কাছে থামতেই তাহিয়া নেমে দৌড় দিল। অভীক পিছু নিতে নিতে বলল,
‘আরে, সাবধানে পড়ে যাবে তো।’

তাহিয়া থামল না। দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠল। অভীক হাসল, সেই শিশুসুলভ তাহিয়াটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। চারতলায় এসে থামল। কাঁপা হাতে কলিংবেল বাজাল তাহিয়া। খুশিতে হাত পা কাঁপছে।

দরজা খুললেন মাহমুদা। মেয়েকে দেখে চমকে গেলেন। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, চোখে অবিশ্বাস। তাহিয়া মাকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে দিল।

অভীক ওর পাশ দাঁড়িয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘সালামি পেলে কেউ কাঁদে? সালামি আগলে নিতে হয়। যাও। ‘

তাহিয়া আকস্মিক হেসে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সালামি হবে এটা।’
কাল বিলম্ব না করে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঝাপটে ধরল মাকে। বুকে মেয়ের অস্তিত্ব টের পেয়ে অবিশ্বাসের পাল্লা সরে আসল। মেয়েকে আগলে নিয়ে খুশিতে কেঁদে ফেললেন মাহমুদা।

তুহিন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিস্মিত চোখে তাকাল বোনের দিকে। তাহিয়া মাকে ছেড়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে বলল,
‘কেমন আছিস ভাই?’ আজ ভাইটার জন্য রাগ আসছে না, ঝগড়া আসছে না। ভালোবাসা আসছে। তুহিন উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘আছি, ভালো। আসবি বললি না। মা সকাল থেকে কাঁদছিল। ‘

তাহিয়া হেসে বলল,
‘আমি নিজেও জানতাম না। অভী কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের করে এনেছে। ‘

তুহিন হাসল। মনটা শীতল হয়ে এসেছে ওর। বোনটা সুখে আছে। যার জীবনে এমন একজন জীবনসঙ্গী থাকে, তার দুঃখ থাকে না। আকস্মিক সে অভীককে জড়িয়ে ধরল,
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া। ‘

সমাপ্ত….

ইদ মোবারক। সবাইকে ইদের শুভেচ্ছা। পাঠকের জন্য আমার পক্ষ থেকে ইদ সালামি ছিল এটা। এবার পাঠকের সালামি দেবার পালা। ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here