অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
পর্ব___৩২
#কায়ানাত_আফরিন
লাউয়াছড়া বন থেকে ঘুরে এসেছে আজ দু’দিন হতে চললো। কিন্ত আফরার কাছে মনে হচ্ছে এ যেন দু’দুটো বছর। বৃষ্টিসিক্ত সেই মুহূর্তে ফারহানের সেই নেশা মিশ্রিত কথা ওর হিহাহিতজ্ঞান এতটাই শূণ্য করে ফেলেছিলো যে আফরা হয়ে ছিলো বিমূঢ়।পুরোটা পথেই ওর চোখে মুখে ছিলো ফারহানের কথার মারাত্নক ঘোর। বৃষ্টির ছন্দের তুলনায় তখন ফারহান এর কথাগুলো ওর হৃদয়ে তোলপাড় করে তুলেছিলো। বাসায় এসেই আফরা নিজেকে ঘরে বদ্ধ করে নিলো। রাতে ইলা এলো , মিসেস নাবিলা-মিঃ ইফাজ এমনকি শেষে ফাহিমও ডাকতে এলো। আফরা সবার সাথে স্বাভাবিক থাকলেও এড়িয়ে চললো ফারহানকে। হ্যাঁ, ফারহান এখন আগের মতো নিজেকে বাহিরের ওই ছোট ঘরটিতে আলাদা করে রাখে না। এখন নিয়মিতই আসা-যাওয়া হচ্ছে। কখনও ফাহিমের সাথে কথা বলতে তো কখনও ইলার সাথে অবসরে একটু আলাপচারিতা চালাতে। মিঃ ইফাজও খুশি ছেলেটার এমন পরিবর্তন দেখে। কেননা রাজনীতি নামক বেড়াজালে আবিষ্ট হয়ে ফারহান এতটাই শক্ত পাথর হয়ে গিয়েছিলো যে নিজের জীবন, ভবিষ্যত নিয়ে ওর কোনো মায়া ছিলোনা। তাই বলা চলে মিসেস নাবিলা ছাড়া মোটামোটি ফারহানের বাংলোতে নিয়মিত আসা-যাওয়ার ব্যাপারটায় সবাই খুশি। তবে আফরা কেনো যেন দেখা পাচ্ছেনা ফারহানের। প্রতিবারই সে বারান্দায় দাঁড়ালে শুনতে পায় পাশে ফাহিমের ঘর থেকে উচ্চস্বরে কথাবার্তার শব্দ। ছেলেরা স্বভাবতই একটু উচ্চস্বরে কথা বলে।আবার ড্রইংরুমেও ফারহানের ধপধপ শব্দ কাপিয়ে তুলে কাঠের সিড়িটিকে। রাতে ওর ঘরের সামনে খালি জায়গাটিতে কত্তো কিছু করে এর মাঝে আফরার ঘরের দিকে উকি দিতেও ভুলেও না। ফারহান আসলে বুঝতে পারছে না এই উড়নচন্ডী মেয়েটার আবার হলোটা কি। মেয়েটাতো এমনিতেও অদ্ভুত, কাজ কর্ম তার থেকেও বেশি অদ্ভুত। এভাবে দু’দিন কেটে গেলো তবুও দুজনের অন্তরে কোনো ধরনের সংলাপ তো দূরের কথা, চোখাচোখিও হলোনা।
এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন রাত। বাহিরে বাতাসের দাপটে সমানতালে উড়ে চলছে রঙহীন পর্দা। আফরার কানে মোবাইল , কথা বলছে পৃথিবীর ঠিক বিপরীত গোলার্ধে অবস্থানরত বাবার সাথে। যুগ কতটা অদ্ভুত তাইনা? এখন মুঠোফোনের সাহায্যেই দূর দূর যোগাযোগ করা যায় সবার সাথে। আফরার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিলো। এখানে যদিও হোটেলে সে থাকেনি তবুও অন্যান্য যাবতীয় খরচের দরুন মোটামোটি শূণ্যের কোঠায় ওর ব্যাংক ব্যালেন্স। হাতে ইনকামের আলাদা কোনো সোর্সও নেই। মিঃ ইফাজের কাছ থেকে চাওয়া তো অসম্ভব তবে বাবার কাছে টাকা চেতেও ওর মধ্যে কেমন যেন সংকোচ কাজ করছে। কারনটিও খুব স্বাভাবিক। অ্যামেরিকা বা ইউরোপের মতো অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে ১৮ বছরের পরই প্রত্যেক সন্তান আলাদা হয়ে যায়। নিজেদের টাকা দিয়ে নিজেরাই আনন্দ করে, জীবনযাপন করে। আফরাও এর ব্যাতিক্রম কিছু নয়। এখন তাই বাবার কাছে টাকাটা যাওয়া মোটেও ওর কাছে স্বাভাবিক কিছু নয়। তবুও নিজের সংকোচকে একপাশে সন্তর্পণে রেখে মিঃ আসিফকে বললো বিষয়টা। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর হঠাৎই প্রসঙ্গ উঠলো আফরার মায়ের। আফরার গলা ধরে আসছে। কেননা অ্যামেরিকা থেকে আসার আগে আফরার সাথে তুমুল তর্কাতর্কি হয়েছিলো উনার। তবে আফরা এখন বুঝতে পারছে, ওর মায়ের ওকে হুট করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো যৌক্তিক। ওর নিজের মধ্যে তুমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে এখানকার মানুষদের সাথে ঘুরাফিরা করে। যদিও এটা একটা লং ভ্যাকেশন কিন্তু এই স্মৃতিগুলো আজীবন স্মৃতির পাতায় সন্তর্পণে রেখে দিতে পারবে।
কথার এক পর্যায়ে মিঃ আসিফ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন যে ফাহিমকে ওর কেমন লাগে। আফরা প্রথমত কিছুটা হকচকিয়ে যায়। তবুও স্বাভাবিকতাই উত্তর দিলো এ কথার। আফরার জানে না যে বাবা হঠাৎ এসব প্রশ্ন ওকে কেন করলো। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ বাবা ও মেয়ের আলাপণ চললো সময় নিয়ে।
কথা শেষ করে মোবাইলটা আফরা রাখতেই খেয়াল করলো দরজার একপাশে ইলা দাঁড়িয়ে আছে। আফরা এতক্ষণ খেয়াল করেনি যে ইলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওখানে। তাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে ইলাকে বলে ওঠলো,
-‘আরে ইলা! তুমি কখন আসলে? খাটে এসে বসে পড়ো।’
ইলা খাটে এসে বসলো এবার। মুখে খুশির চরম রেশ। মেয়েটা কেমন যেন, সবসময়ই অস্থির থাকে। কথার মতো সর্দা বাচ্চামো ভাব বিদ্যমান। কেউ দেখলে বলতেই পারবে না যে এই মেয়ে অতলে এত সুন্দর একটি সম্পর্কে জড়িয়ে আছে৷ ইলার হঠাৎ এত দুরন্তপনা দেখে ভ্রু উচিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আফরা। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘হোয়াট হ্যাপেন্ড ইলা? তোমায় তো একটু বেশিই খুশি খুশি লাগছে যে?’
-‘আমি যে নিউজটা দেবো এটা শুনে তুমি আরও বেশি খুশি হয়ে যাবে।’
আফরা মাথা দুলিয়ে শুনলো ওর কথা। মুখে বরাবরের মতো মিহি হাসি ঝুলিয়ে ইলার নাক টিপে বলে ওঠলো,
-‘তাহলে তো নিউজটা শুনতেই হবে।’
-‘আগামীকাল আমার খুব কাছের একজন বন্ধুর জন্মদিন। আর সারপ্রাইজ হিসেবে আমরা চাচ্ছি ওকে টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে যেতে। আর সম্ভবত সেখানে তোমারও যাওয়া হচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের নাম শুনেছো?’
-‘উহু।’
অপ্রতিভ হয়ে বলে ওঠলো আফরা। ইলা এবার বললো,
-‘না শুনে ভালোই হয়েছে। আমি চাই তুমি হাওর এর জীবন্ত দৃশ্য টা প্রথম দেখো। আমরা যেহেতু মাত্র কলেজে পড়ি মা তাই মরে গেলেও আমারে একা যেতে দিবে না৷ তাই ফারহান ভাই, ফাহিম ভাই, সাব্বির, শামসু আমি, তুমি-আমরা সবাই যাবো ওখানে।’
-‘তা তো বুঝতে পারলাম, তবে জন্মদিনটা কার? রৌশিনের?’
-‘না আপু! আমাদের বার্থডে বয় এর নাম মারুফ।আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবচেয়ে গাধা ছেলে হলেও আমার আর রৌশিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওইযে সেদিন রৌশিন আসলোনা আমাদের বাসায়, ও এসেছিলো আমার সাথে মারুফের গিফ্ট কিনতে মার্কেটে যাবে বলে।’
-‘রৌশিনকে তো আমি চিনিই, তবে এবার মারুফের সাথেও পরিচিত হয়ে নেবো।’
ইলা হাসতে হাসতে বললো,
-‘ অবশ্যই, তুমি যেই সুইট কিউট একটা মেয়ে! সবাই তোমার সাথে অল্প সময়ের মধ্যেই মিশে যাবে।’
-‘শুধুমাত্র ফারহান ছাড়া।’
কথাটি আফরা বললো বিড়িবিড়িয়ে। ইলা প্রশ্নসূচক ভাবে ওর মুখপানে তাকিয়ে থাকলেও আফরা নানা কৌশলে তা এড়িয়ে নিতে সক্ষম হলো। আফরা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিলো এবার। মোটামোটি বেশ রাত হয়েছে৷ ইলা তাই দ্রুত ওর ঘরে চলে গেলো রৌশিনের সাথে কথা বলার জন্য। সেদিন মার্কেটে যাওয়ার পর থেকে কে জানে কি হয়েছে রৌশিনের? কারও সাথেই কোনো যোগাযোগ করছে না৷ ঘরে বসে আছে নানা চিন্তায় বুদ হয়ে। এতটাই বুদ হয়ে আছে যে মারুফ বা ইলা কারও কলই রসিভ করলো না।
.
.
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। রৌশিনদের জীর্ণশীর্ণ বারান্দাটিতে বাতাসের তীব্র ঝাপটাতে ঝপ ঝপ শব্দ তৈরি হচ্ছে। এসময় স্বভাবতই মানুষরা ঘোর সীমানার বাহিরে পা এগোনোর চেষ্টা করে না। আশপাশে যদি বাঁশঝাড় থাকে তবে তো আর কথাই নেই। রৌশিন জানালার কাছ ঘেঁষে আনমনে লিখে যাচ্ছে ডায়েরিতে ওর আত্নকথা। দুদিন জ্বরে থাকার কারনে তেমন কিছুই লিখতে পারিনি, এমনকি ওর জ্বর হয়েছে একথাটি পরিবার ছাড়া আর কাউকেই বলেনি।
জ্বরটি কোনো স্বাভাবিক কারনে হয়নি, হয়েছে একটা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে। স্বপ্নটা নিতান্তই তুচ্ছ মনে হলো ওর কাছে৷ বলা বাহুল্য, নাটকের সেদিন অভিনয় করা ওর ছোট্ট চরিত্রটি ছিলো পরিচালকের জন্য আর ওয়েব সিরিজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন সেই পুরো চিঠি আনা নেওয়ার প্রক্রিয়াটি ও এমনভাবে অভিনয় করেছে যে কেউ বলতে বাধ্য, এ বুঝি কোনো ক্যামেরা পর্দা নয়। মেয়েটি আসলেই এক নিতান্ত কোমলমতী কিশোরী যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কোমলীয়তার চরম উপস্থিতি। ডিরেক্টর সাহেব অল্প মুহুর্তে এমন একটা শট পেয়ে একটু না, বেজায়ই খুশি হয়েছিলেন। তাই অফারও দিয়েছিলেন রৌশিনকে এভাবে কো আর্টিস্ট হিসেবে বেশ কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। এমন সুযোগ যে কারো জন্যই একটা বিশেষ সুযোগ হলেও রৌশিন হ্যা বলতে পারলো না৷ কারনটাও খুব যৌক্তিক। রৌশিন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। এভাবে অভিনয় কোনো রক্ষণশীল পরিবারের জন্য সহজ কাম্য নয়। তাই ওর না করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। বাসায় এসে সে যখন লম্বা এক ঘুম দিলো তখনই সে স্বপ্নে দেখতে পেলো ফাহিমকে৷ কোনোভাবে ফাহিম জেনে গিয়েছিল যে রৌশিন আড়ালে আবডালে পাগলের মতো ভালোবাসে ছেলেটাকে। যা শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে সজোরে চড় মেরে দেয় রৌশিনের গালে৷ এটা নিতান্তই ছিলো এক দুঃস্বপ্ন। তবুও ওর মনে বিকট ভয় ঢুকে গেলো৷ চিন্তায় এতটাই নিমজ্জিত হয়ে পড়লো যে জ্বর বাধানোর ব্যাপারটাও বাদ পড়লো না৷ এখন জ্বর কিছুটা কমেছে৷ তাই ভাবলো একটু লিখালিখি করলে মন্দ কি! ব্যাস! তারপর শুরু হয়ে গেলো ডায়েরীর পাতায় কিছু বাক্য ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা। লেখার মধ্যে হঠাৎ ওর ঘোর কাটলো মোবাইলের রিংটোন এ। স্ক্রিনে বড় বড় অক্ষর এ ভেসে উঠেছে,
”ফাহিম ভাই! ”
এই দুটো শব্দের লিখা ওর বুকে তোলপাড় সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। রুমে নেটওয়ার্ক কম পাওয়া যায় বলে হুড়মুড়িয়ে মোবাইল নিয়ে চলে গেলো বারান্দায়। মোবাইল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফাহিম আড়ষ্ট কন্ঠে বলে ওঠলো,
-‘তোমার নাম রৌশিন না হয়ে বুকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া রৌদ্রময়ী রাখলে ভালো হতো৷ এই মেয়ে! তোমায় দুদিন ধরে কল দিচ্ছি, আর তুমি কিভাবে পারো পাষাণের মতো আমার, এই ফাহিম এর আড়ালে থাকার চেষ্টা করতে?’
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি মার্জনীয়।