অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
পর্ব____৩৪
#কায়ানাত_আফরিন
পিটপিট করে চোখজোড়া খুললো রৌশিন। দেখলো কেউ ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে গহীন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে ওকে। ওর শরীর কিছুটা দুর্বল। তাই চোখ খোলা মাত্রই অবয়বটিকে স্পষ্ট না দেখে খানিকটা অস্পষ্ট দেখতে পেলো। রৌশিন নিঃশ্বাস ফেললো বারকয়েক। শক্তি জুগালো নিজের দুর্বল শরীরে। কয়েক সেকেন্ড পরই ওর ঘোলাটে দৃষ্টি হয়ে আসতে লাগলো স্পষ্ট। কিছু অবয়বটিকে নিজের সদ্য ঘুমফোটা চোখে দেখা মাত্রই যেন চরম রকমের অবাক। রৌশিন প্রথমে আনমনে চিমটি কাটলো নিজেকে। মনে হলো এসব বুঝি স্বপ্ন, সেদিন নাটকে স্বপ্না নামের যেই চরিত্রটি অভিনয় করেছিলো সেই স্বপ্নার মতোই স্বপ্ন। রৌশিন হতাশা গ্লানিতে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,
-রৌশিন রে ! জ্বর তোকে ভালোই কাবু করে ফেলসে। নাহলে এসব আজগুবি জিনিস দেখতি না।
পরক্ষণেই ও ভালোমতোই টের পেলো এ কোনো স্বপ্ন নয়। সত্যিই ফাহিম এসেছে এখানে। খাটের পাশে উদ্বিগ্ন হয়ে বসা ওর মা। পায়ের কাছে তেরছাভাবে মারুফ আর ইলার উপস্থিতিও টের পাচ্ছে। ফাহিম রৌশিনের প্রেশার মেপে দেখলো যে প্রশার ফল করেছে। জ্বরটা আগের মতো নেই। শরীরে ঘাম লক্ষ্য করাতে বুঝতে পারলো হয়তো জ্বর সারা শুরু করেছে। রৌশিনের কপালে আলতো ভাবে হাত রাখলো ফাহিম। কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-শরীরটা কেমন লাগছে তোমার রৌশিন?
রৌশিন প্রতিবারই অনুভব করে ফাহিমের মুখে ওর নাম শুনার মধ্যে অন্যরকম এক মাদকতা আছে। ওর কন্ঠটা জানি কেমন। নরম , ভরাট তবে প্রানবন্ত ধরনের। শুনলেই একটা দার্শনিক টাইপ ফিলিং আসলেও দর্শনের উচ্ছিষ্ট টুকুও ফাহিমের মধ্যে নেই। কথা আছে না, মানুষের পাঁচটা আঙুল সমান হয়না। ফাহিমও ঠিক তেমন। ও প্রকৃতিপ্রেমী না, ফিলোসফি , সাহিত্য , কবিতা ,বইনেশা এগুলো ফাহিমের মধ্যে অনুপস্থিত। এককথায় রৌশিনের বিপরীত মুখী মানুষ বললেই চলে। তবুও রৌশিনকে ওর ভালোলাগে , কারন ফাহিম সামাজিক। খুবই মিশুক আর উচ্ছ্বাসিত মানুষ সে।রৌশিনের প্রতিউত্তর না পেয়ে ফাহিম পরন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস করলোনা ওকে। হয়তো শরীরটা এখন সেরে ওঠেনি। রৌশিনের মা আহাজারি কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-কি হলো আমার মেয়েটার? সারাদিন গুমশুম হয়ে থাকে। হুটহাট জ্বর বাধিয়ে ফেলে। এতদিন পর কাল জ্বর সেরে রাতে আবার জ্বর এলো। কেনো, ডাকতে পারলি না আমাকে? তোর মা কি মরে গিয়েছিলো?
-আহা খালা বকেন না তো ওকে। ও তো এমনিতেও চাপা স্বাভাবের মেয়ে।
-তুমিই বুঝাও ওরে বাবা। পাগলিয়ে গেসে মেয়েটা।সারাদিন একলা একলা কিসব ভাবে আল্লাহ মালুম!
রৌশিন উঠে বসলো এবার। ফাহিম ব্যাগ্র হয়ে বলে ওঠলো,
-তোমার ওষুধ কিন্ত সব ঠিকমতো লিখে দিয়েছি। এখন বেড রেস্ট নাও। সাদ্দাফ ওষুধ নিয়ে আসবেদুপুরে তোমার জন্য। ঠিকাছে?
ফাহিম ইলা মারুফ আরও কিছুক্ষণ সময় কাটালো রৌশিনের সাথে। রৌশিন ওপর দিয়ে একটু ভাবহীন থাকলেও ভেতরে ছুটে যাচ্ছে আনন্দের ঝড়। রৌশিনের মা আগেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওদের রেখে চলে গিয়েছিলো। হঠাৎ ফাহিম ইলা আর মারুফকে বললো বাহিরে আফরা আর ফারহানের কাছে যেতে। ও কিছু জরুরি কথা বলবে। ইলা আর মারুফ বাধ্য হয়ে তা-ই করলো। রৌশিন ফাহিমের এরূপ কান্ডে কিছুই বুঝতে পারছে না।ফাহিম এবার এবার বসে পড়লো আফরার মুখোমুখি হয়।চোখে অল্পবিস্তর সন্দিহান রেশ। রৌশিন ভড়কে গেলেও নিজেকে শান্ত রাখলো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফাহিম জিজ্ঞেস করলো,
-এবার বলোতো? কাকে ভালোবেসে এমন জ্বর বাঁধিয়েছো?
রৌশিন নিষ্পলক হয়ে রইলো। কি বলবে এটা সে ভেবে পাচ্ছে না। ফাহিমের চোখে মুখে সীমাহীন কৌতুহলতা।তাই সে আবার বললো,
-আরে বলে ফেলো মেয়ে। ভালোবাসা কোনো পাপ না। এইযে, আমিও তো পছন্দ করি আফরাকে।
প্রথম কথাটা শুনে রৌশিন যেমন প্রতিকিয়া করেছিলো শেষ কথাটি শুনে সে যেন আরও স্তব্ধ হয়ে গেলো। অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-আপনি আফরা আপুকে পছন্দ করেন ভাইয়া?
-হুম করি। শুরুতে এমন কোনো ফিলিং ছিলো না। তবে দু’দিন আগে হুট করে মা বললো যে আফরার বাবার কাছে আমার আর আফরার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তখন থেকেই আমি একটু নজর দিলাম আমার ফিলিংসের প্রতি। আমার মনে হয়না আফরার এতে আপত্তি থাকতে পারে। ‘কজ ও আমার সাথে প্রচুর ফ্রেন্ডলি। তবুও , দেখা যাক।
কথাগুলো রৌশিনের বুকে তীরের মতো বিধছিলো। শুরতে আফরাকে ওর হিংসে হলেও এখন নিজের ভাগ্যের পরিহাসে খারাপ লাগছে। ও মেকি হাসি দিয়ে বলে ওঠলো,
-ভালোবাসা চাইলেই পাওয়া যায় না ফাহিম ভাই। তাই আমি কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। তাই কারও ভালোবাসায় বুদ হয়ে জ্বর আসার তো প্রশ্নই ওঠে না।
________________________
ফারহান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে। ফাহিম অনেক জোরাজোরি করেছিলো ওদের সাথে রৌশিনদের বাড়ির ভেতরে যেতে। কিন্ত ও শুনলো না। বাহিরে পিচঢালাই পথে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো নির্বিকার ভাবে। অদূরেই ছিলো আফরা। এতক্ষণ রৌশিনের মায়ের সাথে কথা বলার প্রচেষ্টায় ছিলো, কিন্ত পারলোনা। রৌশিনের মায়ের কথাবার্তায় একধরনের সিলেটি টান আছে, যেটা আফরার বুঝতে একটু না, মোটামুটি অনেক সমস্যাই হয়েছে। তাই কোনোমতে কথা বলে সে রৌশিনের সাথে কথা বলে শেষমেষ চলে গেলো ফারহানের কাছে। ফারহান নীরব, নিশ্চল। আজ ছেলেটা একটা সাদা রঙের শার্ট পড়েছে। সাথে অফ হোয়াইট জিন্স। শ্যামবর্ণের গায়ে এমন উজ্জ্বল রঙের সৌন্দর্য আসলেই বর্ণণাতীত। চুলগুলোও শ্রীমঙ্গলের শেষ সীমানার উত্তর গাঁয়ের হাওয়ার দাপটে উড়ে যেতে ব্যস্ত সমানতালে। আফরা কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। তারপর এগিয়ে যেতেই ফারহান মিনমনিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-দেখা করা হয়েছে?
-হুম, আপনি যাবেন না?
-আমি কেনো যাবো দেখা করতে?
-তাহলে এসেছেনই বা কেনো?
আফরা কাট কাট গলায় এ প্রশ্ন করতেই ফারহান ভ্রু কুচকালো৷ কেনো যেনো মনে হচ্ছে মেয়েটা রেগে আছে। রেগে আছে বললে ভুল হবে,,হয়তো মনে অভিমান জমেছে। সকালের আফরার সাথে ওর কথোপকথন গুলো মনে পড়তেই ফারহান বুঝে নিলো কেন এই অভিমান৷ ভালো লাগে ওর এই বিদেশীনি কে রাগাতে। তাই তো আবার ছুটে এলো এখানে। ফারহান ঠোঁট চেপে বলে ওঠলো,
-আপনি কি ভেবেছেন যে আমি আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য এসেছি এখানে?
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো আফরা। আড়নজরে ফারহানকে বারকয়েক দেখে অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে বলে ওঠলো,
-না তো! আমি……….আমি এমন কেনো মনে করবো?
-তাহলে তো ভালোই। এমন কিছুই মনে করবেন না। কারন ফারহান জুবায়ের কারও রাগ ভাঙাতে অভ্যস্ত নন।
ফারহান কথাটি বলো দাম্ভিক কন্ঠে। আফরার মনে চাপা ক্ষোভ জমলো। এই মানুষটা সবসময়ই থাকে কিভাবে ওকে হেয় করা যায়। ফাহিম আর ইলা আসলে ঠিকই বলে, এই লোকটার সাথে যেচে যেচে কথা বলা উচিত। তন্মধ্যে এসে পড়লো ইলা আর মারুফ। ফারহান মৌন ভাবে ইলাকে জিজ্ঞেস করলো,
-ফাহিম কোথায়?
-একটু পরে আসছে।
এদিকে মারুফ তো বারবার আফরাকে দেখে যাচ্ছে। কি সুন্দর একটি মেয়ে। হাসলে যেন মুক্তা ঝরে পড়ে। মারুফের হিসেবে এই মেয়ে যদি মুভি করতো নিঃসন্দেহে হিট হয়ে যেতো। ইলা দেখছে মারুফের এই আহাম্মকি দৃষ্টিটা। তাই দাঁত দাঁত চেপে ওকে বললো,
-আফরা আপুরে বড় বইনের নজরে দেখ আহাম্মক ! তোর সাথে কখনোই তার যাবেনা।
-আরে আমি কি কইসি যে আমার সাথে আপু যাইবো। দেখতে ক্ষতি কি? নিঃসন্দেহে উনার মতো সুন্দরী এই জনমে আর দেখতে পারুম না।অ্যামেরিকান তো না-ই।
সকালের বাতাসটা কিছুটা শীতল। উত্তুরে হাওয়ার সমাগমে আশপাশের বিশাল বিশাল কাঠ গাছগুলোর পাতা নড়ে অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি করছে। চায়ের রাজ্যের এই তো একটা সৌন্দর্য। দেখলেই মাথা কেমন যেন ঝিম ধরে যায়। আফরার ভালো লাগলেও গায়ের লোম কেনো যেন খাড়া হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে ঐই শীতল আবহাওয়াটা ওর পরনে পাতলা শার্টটির সঙ্গে মানানসই একেবারেই না। আজ দিনটাই খারাপ ভাবে শুরু হয়েছে। যার জন্য সুন্দর পোশাল পড়লো তার কোনো ধ্যান নেই বরং ঠান্ডায় কাপাকাপি করছে সে। হঠাৎই নিজের গায়ে একটা উষ্ণ আবরণ দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। মাথাটা চট করে ঘুরাতেই মুখোমুখি হলো একেবারে ফারহানের কাছে। ফারহান ওর ঠিক বরাবর দাঁড়িয়ে আছে, অনেকটাই কাছাকাছি। আফরা বুঝতে পারেনি যে ফারহান গায়ে ওর নিজের শার্ট জড়াতে গিয়ে এতটা কাছাকাছি এসে পড়বে তাহলে আফরা কখনোই মাথা চট করে ঘুরাতো না। ফারহানের দৃষ্টি নিচে থাকলেও আফরা ওর মুখোমুখি হওয়াতে গহীন দৃষ্টিতে দেখে নিলো আফরার মুখ। জড়ানো গলায় বললো,
-পড়ে নিন এটা। আমার জন্য এটা পড়ে এসেছেন আর তা পড়ে আপনার ঠান্ডা লাগছে এটা কি আর মেনে নেওয়া যায়?
ধক করে ওঠলো আফরার হৃদয়। ফারহানের কন্ঠে জড়ানো কেমন এক আড়ষ্ট অনুভূতি। এর মানে ফারহান কি জানতো এই জামাটি পড়ার উদ্দেশ্য? আফরার এখন নিজেকে নিতান্ত বোকা মনে হচ্ছে। ওর এমন পাগলামির জন্য কি ভাবছে ফারহান কে জানে?
.
.
.
~চলবে……ইনশাআল্লাহ
[রিচেক করা হয়নি। টাইপিং মিস্টেক বুঝে নেওয়ার অনুরোধ রইল।]