#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ০৩
৬.
গগনে আজ না আছে তীক্ষ্ণ হরিদ্রাভ রশ্মি,আর না নীলিমার ছোঁয়া। আছে ম্লান ও পাংশুটেবর্ণের আবির্ভাব। উৎকন্ঠিত, উদাসিন মায়াময় শৈত্যপ্রভাহ।
প্রকৃতি শীতলতার আমেজে ভরপুর হলেও সিলিভিয়ার মন মেজাজ ভারী তীক্ষ্ণ, ক্রুদ্ধ হয়ে আছে আজ। সায়মনের ক্রিকেট খেলার বেট হাতে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছে সে। তার বেরিয়ে যাওয়াটা নেহাৎ-ই কারো চক্ষুগোচর হয়নি,না হলে রুজিনা মেয়েকে আঁটকে ফেলতেন।পাড়া-মহল্লায় মেয়ের ভারী দুর্নাম। সিলিভিয়া হাতে বেটটা ডানহাতের মুঠোয় শক্তভাবে মুঠোবন্দি করলো। পদযুগলের স্থানান্তরিত অভিসন্ধি আপাততে ব্রিজের ধারে চায়ের ছোট্ট দোকানটি।
রোজকার নিয়মানুসারে দ্বিতীয় বার চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছিলো রামিশ হায়দার। সিলিভিয়াকে আসতে দেখে মুখ থেকে সব চা থুবড়ে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে দিয়ে পকেট থেকে ঝটপট ট্যিসু বের পুরো মুখশ্রী মুছে ফেললো। কৃষ্ণবর্ণ উদ্দেশ্যহীন চুলে হাত গলিয়ে কৃত্রিমভাবে খাঁড়া রাখার প্রচেষ্টা চালালো। সিলিভিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
— ওয়াও! দোস্ত,ক্রিকেট খেলতে এসেছিস?
সিলিভিয়া কোন টু শব্দ করলো না। নিঃশব্দে রামিশের কাছাকাছি এসে প্রচণ্ড তেতে যাওয়া মস্তিষ্কের তাণ্ডবলীলা শুরু করে দিলো। ধনুকের তীর ছুঁড়ার ন্যায় লক্ষভেদ করলো রামিশের পাশ্চাদ্দেশ। বেট দিয়ে ধুম-ধারাক্কা আঘাত করতে লাগলো।আর রামিশের বরাবরের মতো নিজের দূর্বল পয়েন্টটাকে বাঁচাতে নড়েচড়ে লাফাতে লাগলো। বলল,
— আরে আরে,দোস্ত মারছিস কেন? আল্লাহ!
ব্যাথা পাচ্ছি। ওই আর মারিস না, আমি না তোর পিচ্চিকালের বন্ধু? এতে নির্দয় কেন তুই।
সিলিভিয়া মাটিতে বেট ঠেকিয়ে বলল,
— হা’লারপুত! রামিশা সাইজা আমার আব্বুর ফোনে কল দেওয়ার মতো সাহস কই পেয়েছিস তুই? বল?
তোর রামিশা নামের বইন আসছে কোথায় থেকে।তোর বইন শুধু আমি। আমাকে আপু ডাকবি।
এ পর্যায়ে রামিশ কিঞ্চিৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— তুই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছিস কেন?
তাই তো আঙ্কেল রে ফোন দিছি। আর আমি না বলছি আমি তোরে ভালোবাসি? তুই ইগনোর করছিস কেন? তুই ভালোবাসিস না?
— তোরে ভালোবাসবে আমার জুতা।ফের যদি আমার আব্বুর ফোনে কল দিয়ে দেখিস। কুত্তা!
সিলিভিয়া আর দাঁড়ালো না।পেছন ফিরে চলে যেতে লাগলো। রামিশ পেছন থেকে বলতে লাগলো,
— ব্লকটা খুলে দে দোস্ত। তাইলে আর তোর আব্বুকে ফোন দিবো না।
সিলিভিয়া সামনে যেতে যেতে বলল,
— জুতার ভারি খাইতে চাইস না।
সিলিভিয়ার শরীর কাঁপছে ভীষণ।রাগ,উত্তেজনা,লজ্জা এসবের প্রতিসরণ তার মধ্যে ঘটে, তখন তার শরীর বেশ কম্পিত হয়ে উঠে। আর রামিশ সে তো সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে কাল।দুইদিন ধরে বারবার তার বাবার ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছিলো সে।কোন মেয়েকে দিয়ে কথা বলিয়েছে সেটা সিলিভিয়া জানেনা।কারণ রামিশের নিজের কোন বোন নেই। ফোন দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিলো সিলিভিয়ার সাথে কথা বলা। একমাসে রামিশ তাকে প্রপোজ করেছে।সিলিভিয়ার সবসময় নিজের একজন ভালো বন্ধু হিসেবে দেখে এসেছে আজ অবধি।এখন রামিশের মনে যদি অন্য অভিসন্ধি থাকে,তাহলে সেটার দায়বদ্ধতা একান্ত তার-ই। রাগান্বিত মেজাজটা রামিশকে আঘাত করতে পেরে বড্ড প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে।
৭.
সিলিভিয়ার ঘুমটা পূর্বাহ্নের ভেঙেছিলো রুভাইয়াতের ফোনে। কড়াভাবে জানিয়েছেন আজ রাইসার জন্মদিন সিলিভিয়া যেনো বিকেলে পড়ানোর টাইমে এখানে এসে স্বশরীর উপস্থিত হয়। সিলিভিয়া বেশ আপত্তি করছিলো। ওদের বাড়িতে আগমন অতিথিদের মাঝে থাকতে এমনিতেই সে বেশ আড়ষ্টবোধ করে।এখানে আরো লোকালয়ের মাঝে উপস্থিত থাকতে মন সায় দিচ্ছেনা তার।এদিকে উনার কড়া আদেশটা অমান্য করার সাহস ও তার নেই।অগত্যা এখন ছাইরঙা অপরাহ্নে নিজেকে পরিপাটিরূপে সাজিয়ে বাড়ি প্রস্থান করলো সিলিভিয়া।
অটো থেকে নেমে পদযুগল বাড়ালো রাদিফদের অভিজাত্য এলাকার উদ্দেশ্যে।পায়ে হেঁটে যেতে দশমিনিট লাগে। মিরপুরের এই এলাকায় গাড়ি প্রবেশ নিষেধ। জমির মালিক পিচঢালা রোডের পাশে বিশাল সবুজ সমারোহ বিস্তৃত ঘাসের মাঠটা ফাঁকা রেখেছে। মাঠে এ্যাপার্টমেন্টের চিল্ড্রেনরা এখানে খেলাধুলা,বড়রা আড্ডা,বৃদ্ধরা হাঁটাহাঁটি করে।
প্রবেশ পথ সিলিভিয়া সবে ঢুকতে যাচ্ছিলো,আকস্মিক ভাবে বলিষ্ঠ দেহের একটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো সে। তেহভিন ঝটপট সিলিভিয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরে। ব্যাপারটা একদম অনাকাঙ্খিত ছিলো।তেহভীন নিজেও জানতো না এমনটা হবে।সিলিভিয়ার সর্বশরীর টেনে সোজাভাবে দাঁড়া করালো সে। অনেকটা ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
— আম এক্সট্রেমলি স্যরি সিলভার।প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড প্রিটি লেডি।ইট’স এ আনওয়ান্টেড সিচুয়েশন।
সিলিভিয়ার মাথায় অন্য চিন্তার আবির্ভাব ঘটলো।আমার নামটা যেনো কি ‘তানজিলা ফারাশ সিলিভিয়া’। সিলিভিয়া নামটা কি খুবই ডিফিকাল্ট ছিলো।যারজন্য আমার নামটাকে এভাবে ‘সিলভার’ বলে অখ্যায়িত করলো। সিলিভিয়া মনে মনে ঝাঁঝালো স্বরে কয়েকটা শব্দ আওড়ালেও,ঠোঁট দিয়ে একটা শব্দ ও ছুঁড়তে পারলো না।তেহভীন অনেকটা ব্যস্তভঙ্গিতে সিলিভিয়ার পাশ কেটে লিফটের ভেতরে ঢুকে বাটন প্রেস করে লিপ্টের দরজা বন্ধ করে দিলো।
— সিলি আপু তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
রাদিফের কন্ঠস্বর শুনে চমকে গেলো সিলিভিয়া।রাদিফের দিকে ফিরে নিজের বিব্রতবোধ চেহারা লুকিয়ে স্মিত হাসলো,
— এমনি দাঁড়িয়েছি।
— তেহভীন ভাইয়াকে দেখেছো যেতে?
— হ্যাঁ দেখেছি।মাত্র বেরিয়েছে।কেন?
রাদিফ অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলল,
— আমার ফোন নিয়ে নিয়েছে। কোথায় যে রেখেছে?
— ফোন কেন?
— আজকের ডেকোরেশনটা ফুফি ভাইয়াকে করতে বলেছে। আর কাম-চোর ভাইয়া আমাদের ডেয়ার দিয়েছে, আমাদের ফোন কেড়ে নিয়ে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।এখন ফোন যদি আমরা খুঁজে পাই।তাহলে ডেকোরেশনটা ভাইয়া করবে।আর না পেলে আমরা। এখন ভাইয়া আমার আর তামান্না আপুর ফোন নিয়ে পগারপার। আর তামান্না আপু জীবনেও এসব করবেনা।
সিলিভিয়া রাদিফের কথা শুনে হেসে দিলো। এমন অদ্ভুদ মানুষ সে আজ প্রথম দেখেছে সে।সিলিভিয়া বলল,
— ঠিক আছে,আমি হেল্ফ করছি তোমাকে।
— ভেতরে এসো আপু।
সিলিভিয়া রাদিফের সাথে ভেতরে গেলো। লিভিংরুমের সোফাসেট গুলো মাঝখান থেকে সরিয়ে মাঝের স্থানটাকে ফাঁকা করা হলো।ছোট টেবিলে কয়েক প্যাকেট বেলুন,স্টিকার,সিজর’স,
স্কচটেপ আরো অনেক সরঞ্জাম। রুভাইয়াত সিলিভিয়াকে দেখে ভীষণ খুশী হয়। তায়্যিবা রুভাইয়াতে সাথে রান্নাঘরে ব্যস্ত। তামান্না নামের মেয়েটি রুভাইয়াতের রুমে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে।রাইসা এসে সিলিভিয়াকে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো।রুভাইয়াত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রুমে নিয়ে যায়।
রাদিফ সাদা ওয়ালের কোন এড়িয়ায় কি কি লাগাতে হবে সিলিভিয়াকে জানালো। সে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ডেকোরেশন করছে আর সিলিভিয়া একটা একটা করে রাদিফকে এগিয়ে দিতে লাগলো। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় অতিক্রম করে সম্পূর্ণ ডেকোরেশন কম্পলিট হয়। কয়েক কদম পিছিয়ে রাদিফকে টেবিল থেকে নামার জায়গা করে দিলো। সিলিভিয়া পেছন ফিরে চলে যেতে উদ্দ্যত হয়। তখনি দরজায় খাম্বার মতো পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা তেহভীনকে দেখতে পেলো।রাদিফের দিকে চেয়ে কেমন বিদ্রুপসূচক হাসছে। রাদিফকে দিয়ে ডেকোরেশনটা করাতে গিয়ে সে যেনো রাজ্য জয় করিয়ে ফেলেছে।রাদিফের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সে ক্ষেপে আছে।সিলিভিয়া রাদিফের সাপোর্টার হয়ে বলল,
— রাদিফ এক মাঘে শীত যায় না।মনে রেখো।
রাদিফ সিলিভিয়ার কথায় ছোট করে হাসলো। তেহভিন নিজের হাসি বজায় রেখে, অপরিপক্ক বাংলা ভাষায় বললো,
— শীট কোনু মাগে জাই না,সব মাগে শীট টাকে।
তেহভীনের মুখে এহেন বাংলা শুনে সিলিভিয়া চমকে গেলো। সে ভেবেছিলো তেহভিন বাংলা বলতে পারেনা।ইয়াক! কি বিশ্রীভাবে বলেছে।আমাদের বাঙালিদের কতো সুন্দর মাতৃভাষাটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিলো এই ছেলেটা। রাদিফের তীক্ষ্ণ হাসির সুরে সিলিভিয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটলো। তেহভীনের ভাবভঙ্গির কোন পরিবর্তন হলো না।ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে সিলিভিয়ার দিকে একচোট চেয়ে রাদিফের রুমে চলে গেলো।
(চলবে)
কেমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আপনারা আজ একটু গল্পের নেগেটিভ সাইটগুলো কমেন্টে বলুন।আমি সামনের পর্ব গুলো ঠিকভাবে লেখার চেষ্টা করবো।