#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ১৩
৩২.
দুইদিন পর নিজস্ব ফ্ল্যাটে ফিরলো তানজিদ। নতুন মুভির কাজ এখন শেষের পথে। আর কয়েকটা সিন শুট করার পর মুভির কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটবে। এই মুভিটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত সে। ফ্ল্যাটের কাছে এসে দেখলো দরজা হাঁট করে খোলা। তানজিদ হকচকিয়ে গেলো। লাইসেন্সকৃত রিভলভার ব্যাকসাইডে শার্টের নিচে থেকে বের করলো।তানজিদের অযাচিত মন তৎক্ষনাৎ কারো আগমন প্রত্যাশা করে। রিভলবার পূর্বের স্থানে রেখে দিয়ে তানজিদ নিজের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। চতুর দৃষ্টি চারপাশে রাখতে রাখতে লিভিংরুমের সোফায় ধপ করে বসলো তানজিদ।
কু’ল লেমনেডের একটা গ্লাস চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই তানজিদ মাথা তুলে তাঁকালো। প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইটির মুখ দেখে সব ক্লান্তি অকস্মাৎ দূর হয়ে গেলো। তানজিদ উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে সেন্ট্রাল টেবিলে রাখলো। অতঃপর ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো তেহভীনকে। বলল,
— আফটার এল দিজ টাইম?
— আফটার সেভেন মান্থ। মিস ইউ সো মাচ।
— ড্যাড কিছু বলবে না? বলে এসেছো?
— বলিনি। আমি তোমার কাছে এসেছি। মম
কে জানাতে বলেছি। আর ড্যাড অনেক ব্যস্ত।
— পরে তোমার সাথে যদি রাগারাগি করেন?
— ম্যানেজ করে নিবো।
তেহভীন ছেড়ে সোফায় বসলো তানজদিন। তেহভীন ও বসলো।জিজ্ঞেস করলো,
— মুভির কাজ কেমন চলছে? কয়টা চলছে?
কয়টা পেন্ডিং এ আছে?
তানজিদ চাপা শ্বাস ফেলে বলল,
— আপাততে একটা চলছে। পেন্ডিং আছে দুইটা।
এটা কি আমার লাইফ বলো তো তুমি? ড্যাডের সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ। ব্রেক-আপ,মম-তামান্না ওদেরকে মিস করছি।অদ্ভুত লাইফ স্পেন্ড করছি। সবটা কি স্বাভাবিক ভাবে হতে পারতো না?
তেহভীন ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
— কয় নাম্বার ব্রেক-আপ?
তানজিদ গম্ভীরমুখে বলল,
— যার জন্য ক্যাথরিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি।
সেই একজন-ই। আর ছিলো না।
এবার তেহভীন মুখ কালো করে বলল,
— আর ড্যাড ক্যাথরিনকে আমার সাথে জড়িয়ে দিয়েছে। আই ডোন্ট লাইক হার। সি ইজ
ডিজগাস্টিং লেডি।
তানজিদ তেহভীনের কথা শুনে মন খারাপ করে ফেললো। সে যদি একবছর আগে এনগেজমেন্টটা করে ফেলতো।তাহলে তেহভীনকে আর ক্যাথরিন নামক ডিজগাস্টিং লেডিটার সাথে এনগেজড হতে হতো না। তানজিদ তেহভীনকে আশ্বাস দিতে বলল,
— ডোন্ট ওয়ারি।ক্যাথরিনকে আমিই নাহয় বিয়ে
করে নিবো। এলসার সাথে আমার ব্রেক-আপ হয়ে গেছে।
তেহভীন সুমিষ্ট কন্ঠনালিতে সুর তুলে হেসে ফেললো।
—- তাহলে আমিও করতে রাজি।আমাদের হাপ-ওয়াইফ থাকবে সে।
কথাটা বলতেই হঠাৎ তেহভীনের হার্টবিট বেড়ে যায়। কি বলতে কি বলে ফেলেছে ভাবতে লাগলো।কয়েক মাস আগেও ক্যাথরিনকে বিয়ে করতে হবে কথাটা মনের মধ্যে এসে উঁকিঝুঁকি দিতো। আজ আচমকা নিজের উচ্চারিত কথায় নিজের-ই রাগ লাগছে।
— হুয়াট হ্যাপেন্ড তেহভীন?
ঘোর কেটে যায় তেহভীনের।নিষ্পল চাহনি ছুঁড়লো তানজিদের দিকে।তেহভীনের স্থির দৃষ্টি দেখে ভরকালো তানজিদ। পেশিবহুল বাহুতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
— আর ইউ ওকে?
তেহভীন শান্ত স্বরে বলল,
— আই আম ফাইন ব্রাদার।
— তুমি সদূর লন্ডন থেকে আমেরিকা এসেছো,আমার সাথে দেখা করতে। নিশ্চয় অনেক টায়ার্ড যাও ফ্রেস হয়ে নাও।
— ফর ইউ কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি গতকাল এসেছি।আজ সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরেছি। এখন তোমার সাথে বসে আছি।
— আচ্ছা নিশ্চয় একাকী ঘুরাফেরা, তুমি এনজয় করো নি। কাল থেকে আমার সাথে স্টার্ট করবে।
৩৩.
ল্যাপটপ সামনে রেখে অনবরত টাইপিং করছে সিলিভিয়া। আসার আগে সিলিভিয়ার অনেক টেনশান ছিলো।মাস্টার্সের ৩-৪ সেমিস্টার,থিসিস এসবের জন্য এক্সট্রা যে খরচ লাগে সেটা ঋণের সাহায্যে করার চিন্তাভাবনা করেছিলো সে। কিন্তু হঠাৎ করে জমির কথা মনে পড়লো সিলিভিয়ার। জমিটা বিক্রি করেই ছাড়িয়েছে সিলিভিয়া। যা পেয়েছে তাতে সব সেমিস্টার,থিসিস কম্পলিট হয়ে যাবে তার।
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্যে উচ্চ সুদে যেই লোনটা নেওয়ার সুযোগ আছে সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে হবে না সিলিভিয়াকে। ডিগ্রী শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে জব খুঁজে নিতে হবে।নাহলে নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে। এতোটা স্ট্রাগল করার পর একটা চাকরির জন্য পিছিয়ে যাওয়াটা বোকামি।তাই আগেবাগে অনলাইনে রিচার্শ সম্পর্কে কিছু সুস্পষ্ট ধারণা সংরক্ষণ করতে লাগলো সিলিভিয়া। রুমমেট বাকি তিনজন মেয়েগুলো যতেষ্ট অমায়িক ব্যাবহার।
— সিলিইইভিয়া,উই আর গুয়িং আউট,উইল
ইউ গো উইথ আচ?
ক্যাডির কথায় মাথা ঘুরিয়ে তাঁকালো সিলিভিয়া। মেয়েটি আমেরিকান। ব্যবহারে ভীষণ মিষ্টান্ন ভাব।
সিলিভিয়া না করার পথ খুঁজে পেলো না। তাই পরিহিত পোশাক সমেত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ওকে,আই এম রেডি।
অন্যজন আমেরিকান মেয়ে যার নাম আমারা, সে বলল,
— বাইরে খুব ঠান্ডা,গরম কাপড় পড়ো।
তৎক্ষনাৎ সিলিভিয়ার মনে পড়লো বাইরের শৈত্য প্রবাহের কথা। তার মা রুজিনাও অনেকবার জানিয়ে দিয়েছেন এই পরিবেশে এসে যেনো নিজের শরীরটির যত্ন নিতে অবহেলা না করে। কালো একটা সুয়েটার গায়ে জড়িয়ে ডরমেটরি থেকে বের হলো তিন জনে। তাদের সাথে আরো দুইজন ছেলে যুক্ত হলো। তারা ক্যাডি আর আমারার বন্ধু।সিলিভিয়ার এ দেশে আসার বয়স আজ ছয়দিন, তাদের সাথে আরো চারদিন আগে পরিচিত হয়।তাদের নাম ড্যাবিয়ান আর গ্যাটলি।গ্যাটলির গায়ের রং ভীষণ কালো।শুধু দাঁতকপাটি চকচকে সাদা।
ক্যালিফোর্নিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য।সিলিভিয়ার ইউনিভার্সিটি ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে অবস্থির। ক্যালিফোর্নিয়ায় বৃষ্টিপাত মূলত শরৎকাল এবং শীতকালে হয়।তাই বর্তমান আবহাওয়ার ঠাণ্ডা। ড্যাবিয়ান আর সিলিভিয়া পাশাপাশি টুকটাক কথা বলতে বলতে আগাচ্ছে,আর বাকিরা সামনে হাঁটছে। আজ যেহেতু অফ’ডে পাঁচজনে মিলে ঠিক করলো সৈকতে যাবে।শহরের শহর লস আ্যঙ্গেলেস থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করে সৈকতে পৌছালো। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে বুব্বা গাম্প রেঁস্তোরাটি দর্শনের জন্য যাবে।যেটা মূলত দর্শকদর জন্য উন্মুক্ত থাকে।আশেপাশে একই নামে কৃত্রিম ক্যান্ডিস এবং বড় ফরেস্ট গ্যাম্প স্পোর্টস জুতা সহ একটি জুতার দোকান রয়েছে।
ফ্যাশনেবল শফ এবং ক্যাপের পরে দুই কিলোমিটার দূরত্বে একটি বিশাল লোহার গেইট দেখা যায়।এটি হ্রদ শাইন বাগানের প্রবশ পথ।মাঝখানে একটি ছোট হ্রদ সহ আরামদায়ক পার্ক।আরো অন্যান্য নিদর্শন ও রয়েছে,যা বর্ণনার বাইরে।
ড্যাবিয়েন একটা ক্যাপে তে বসার প্রস্তাব রাখলো। অগত্যা সকলে রাজি হয়।
৩৪.
মেঘাচ্ছন্ন সুদৃশ্যমান এবং আকর্ষণীয় এই ওয়েদারে সময় কাটাতে ঘুরতে আসলো দুই ভাই। আশেপাশে অনেকটাই ঘুরাফেরা শেষ। কফিতে চুমুক বসিয়ে
তানজিদ বলল,
— কেমন লেগেছে তোমার?
— ভালো!
— শুধু ভালো?
— না অনেক।
তানজিদ দেখলো তেহভীনের মুখ কেমন যেনো চুপসানো। মনে মনে হয়তো কিছু চিন্তা করছে।
— তেহভীন?
ভাইয়ের ডাকে চোখ তুলে তাকালো তেহভীন। তানজিদ তেহভীনের চোখজোড়া দেখে আঁতকে উঠে। রক্তিম চোখে, অস্থিরতা,বিচলতা,রাগ সব দেখতে পাচ্ছে সে। তারপর কেমন নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে।
— আর ইউ ওকে?
তেহভীন নিজের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি কয়েক হাত দূরে টেবিলের দিকে ছুঁড়লো। কারো ঠোঁটের প্রশস্ত হাসি বুকে জ্বালা-যন্ত্রণা তুলে দিয়েছে তার। তেহভীন সন্তপর্ণে দৃষ্টি লুকিয়ে তানজিদের দিকে চেয়ে বলল,
— ইয়েস ব্রাদার। আই ওয়ান্ট টু গো হোম ব্রো।
— ওয়েল, ফিনিশ দ্যা কফি।
তেহভীন কন্ঠে জোর দিয়ে বলল,
— নো,রাইট নাও!
তানজিদ অবাক হয়ে যায় তেহভীনের আচরণে। পরনের হুডিটা মাথার দিকে টেনে মুখশ্রী আরো গভীরভাবে আঁড়াল করার চেষ্টা করে বলল,
— ঠিক আছে চলো।
গরম গরম কফির মগে চুমু বসিয়ে আড্ডার আসর বসিয়ে দিয়েছে ক্যাডি,আমারা,ড্যাবিয়া,আর গ্যাটলি।মাঝখানে তাদের মধ্যে তাদের কথোপকথনে কখনো সায় জানায়,তো কখনো হাসে সিলিভিয়া।
গ্যাটলি বেশ রসিকতাপূর্ণ একজন ছেলে। সে বলে,
— আমাদের ক্লাসে আমিই একদম সবচেয়ে
বেশি কালো ছিলাম।বাকিরা একদম ফর্সা। তো একদিন ক্লাসে সবার এইম কি জানতে চাইলেন।সকলে উত্তর ও দিলো। আর যখন আমার টার্ন আসে তখন আমি কি বলেছি জানো?
সিলিভিয়া উৎসুখ কন্ঠে জানতে চাইলো,
— কি?
— স্যার,আই ওয়েন্ট টু বি ফেয়ার হোয়েন আই গ্রু আপ। [স্যার,আমি বড় হয়ে ফর্সা হতে চাই]
গ্যাটলির কথায় সবাই হেসে উঠলো। সিলিভিয়াও হাসার তালে মেতে উঠেছিল তখন। তখনি যেনো বাতাসের সাথে ভেসে আসা একটা সুমিষ্টঘ্রাণ সিলিভিয়ার নাকে এসে ঠেকলো।এই ঘ্রাণটা একদম আলাদা।হাজার জন মানুষের মধ্যে থেকে ঘ্রাণটা আলাদা করা যাবে।মানুষটাকেও চিনে ফেলতে পারবে সিলিভিয়া। স্নায়ু টানটান হয়ে উঠলো সিলিভিয়ার। এই ঘ্রাণ,অনুমান কখনো ভুল হতে পারেনা।সিলিভিয়া হঠাৎ বিচলিত হয়ে আশেপাশে তাঁকালো। কাঙ্খিত মানুষটিকে খুঁজার অভিপ্রায়ে। দরজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই সিলিভিয়া সেই প্রিয়পুরুষটিকে দেখতে পেলো।যার দেহের গঠন পেছন থেকেও চিনতে পারবে সিলিভিয়া। আর একটা মুহূর্ত ও নষ্ট করলো না সিলিভিয়া।সবার মাঝখান থেকে উঠে হঠাৎ একটা দৌড় দিলো দরজার দিকে।
(চলবে)