লাভ রেইন পর্ব-৩৯

0
1889

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৩৯

৯৭.
ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পাসপোর্ট চ্যাকিং এর কার্যক্রম শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তেহভীন আর সিলিভিয়া বিশাল লাউঞ্জে গিয়ে ফ্লাইটের অপেক্ষা করতে লাগলো। তেহভীনের বুকটা ধড়ফড় করছে। একটু আগেই তার ড্যাডকে দেখতে পেয়েছিলো সে। হঠাৎ এখানে আসার কারণটা তার জানা থাকলেও,মনে মনে বলছে; আজই কেন ড্যাডকে এখানে আসতে হলো? কাজের সূত্রে এই এয়ারপোর্ট দিয়ে প্রায় সময় আসা-যাওয়া করেন মি.মেথেউ এ্যাসফোর্ড। আজও সেজন্যে আসা। তেহভীন কোন মতে সিলিভিয়া কে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়েছে। এখন আপাততে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো তেহভীন।সিলিভিয়া পানির বোতলের মুখ খুলে দিয়ে তেহভীনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক পানি গিলে শেষ করে ফেললো। তারপর বোতলটা হাতেই রেখেই সিলিভিয়ার দিকে ফিরে তাকালো। সিলিভিয়া তখন ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে রেখেছিলো।তেহভীন তাকাতেই ফিক করে হেসে দিলো। তেহভীন অপ্রস্তুত হলো একটু। তারপর নিজেকে সামলে বলল,

— হাসছো কেন সিলভার?

—- কখন হাসলাম?

— এখন,

—- তুমি যে এতোটা অস্থির হয়ে পড়েছিলে হঠাৎ,
আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু তুমি আঙ্কেল কে দেখে ভয় পেয়ে এমনটা করছিলে সেটা পড়ে বুঝলাম।

তেহভীন বোতলটা ব্যাগে রেখে দিলো। এরপর সিলিভিয়ার কাছে ঘেঁষে বসে তার হাতটা আঁকড়ে ধরলো। এরপর বুকের উপর রেখে বলল,

—- ফীল মাই হার্ট পো’ন্ডিং! ইট’স টু ফাস্ট!

সিলিভিয়া একবার তেহভীনের মুখে চোখ বুলিয়ে পরমুহূর্তে দৃষ্টি তেহভীনের বুকের উপর রাখা হাতটার দিকে রাখলো। আশেপাশে এতো মানুষের ভিড়ে,প্রিয়-র বুকে হাত রেখে হৃদয়ের কম্পন অনুভব করতে লাগলো সিলিভিয়া। হাতের তালুতে মৃদুমন্দ ধাক্কা বুঝিয়ে দিচ্ছে মানুষটা কতোটা ভয় পেয়েছিলো একটু আগে।

— তুমি সেপারেশনে ভয় পাও?

—- অবশ্যই পাই,এটা মানুষের জীবনের একটা দুর্বল পয়েন্ট সিলভার। ভয় পাওয়াটা অবশ্যক।যেমন; আমি পেয়েছিলাম একটু আগে। ড্যাড যদি আমাকে অর্ডার করতেন এখনি উনার সাথে চলে যেতে, তখন আমার কষ্টটা কেমন হতো সেটা হয়তো আমি তোমাকে অনুভব করাতে পারবো না। কারণ আমি ড্যাডের অর্ডার অমান্য করতে পারতাম না,আর না তোমাকে এখানে রেখে চলে যেতে। সামনের দিনগুলো আমাদের কেমন হবে জানিনা।তবে এখনকার সময়টা ভালো করে রাখতে চাই সিলভার।

সিলিভিয়া তেহভীনের কথাগুলো নীরবে শ্রবণ করে গেলো। প্রত্যুত্তর করতো পারলো না। বাস্তবতা খুব কঠিন মনে হলো তার এই মুহূর্তে। সিলিভিয়ার মাঝেমধ্যে মনে হয় তার জীবন থেকে হুট তেহভীনের মতো ভালোবাসার মানুষটা হারিয়ে যাবে। হুট করে যেমন তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিলো,ঠিক তেমন করেই তেহভীন নিজের দায়বদ্ধতা থেকে তার জীবন থেকে মিলিয়ে যাবে। মাঝখানের মধুুর স্মৃতিটুকু ডায়রির পাতার ভাঁজে ভাঁজে থেকে যাবে। দিঘল চুলে টান পড়তেই ভাবনার সূতোতেও টান পড়লো। তেহভীনের হাতের নিজের চুলের গুচ্ছ দেখে বুঝলো,তেহভীন তার চুল টেনে ধরেছে।

— কি ভাবছো সিলভার?

— ভাবছি কখন নিজের দেশে ফিরবো।
সময় কাটছে না মনে হচ্ছে।

তেহভীন ফোনের স্ক্রিনে সময়টা দেখে নিয়ে বলল,

—- আর কিছুক্ষণ পর ফ্লাইটের
এনাউন্সমেন্ট করার হবে। শান্ত থাকো।

সিলিভিয়া চুপ মেরে নিজ দেশে ফেরার প্রহর গুনতে লাগলো। সময়টা যেনো চোখের পলকেই কেটো যায়।

৯৮.

প্রায় আড়াই বছর পর নিজের দেশের মাটিতে পা রেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললো সিলিভিয়া। সুখ,উত্তেজনা সব একত্রে মিলে অন্যরকম অমোদে মন ছেয়ে যাচ্ছে।কতদিন নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ভিনদেশে গিয়ে পড়ছিলো। পাশ থেকে তেহভীন সিলিভিয়ার আনন্দটা নিভৃতে উপভোগ করছে। এই কান্ট্রিতে এসেই তো প্রিটিলেডির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো।কতো হাস্যকর একটা মুহূর্ত দিয়ে সাক্ষাৎ-সূচনা হয়। সেই দিনটার কথা মনে হলে তেহভীনের চোয়ালে অদ্ভুত তৃপ্তিদায়ক হাসির ঝলকানি দৃশ্যমান হয়।তার তো বার বার সেদিনের সেই সকালের সময়টাতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।

কিছুটা দূরে গাড়ির পাশে রাদিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিলিভিয়া বিস্মিত হলো। দৃষ্টি সরিয়ে তেহভীনের দিকে তাকালে তেহভীন মাথা নাড়িয়ে বুঝালো,রাদিফকে সে আসতে বলেছে।
রাদিফ তাদের দেখে অনেকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে আসলো।সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

— আল্লাহ! কতোদিন পর সিলি আপুর সাথে দেখা।কেমন আছো আপু।

— অনেক ভালো,তুমি কেমন আছো?
আর আন্টি, রাইসা?

— আমি ভালো আছি,আম্মু, রাইসাও ভালো আছে।
তেহভীন ব্রো তুমি কেমন আছো?

— আমি খুব ভালো আছি রাডিফ,
তোমার কি অবস্থা?

সিলিভিয়া, তেহভীন, রাদিফ তখন কথা বলছিলো। তাদের মাঝে সায়মন এসে দাঁড়ালো। সিলিভিয়ার পাশে রাদিফকে দেখে না চমকালেও তেহভীনকে দেখে অনেক বেশি অবাক হলো।কারণ,সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে সে আগেও একবার দেখেছিলো। মাঝখানে বছর গড়িয়ে যাওয়ার পর মানুষটাকে দেখে বিমূঢ় হলো।
বহুদিন পর সায়মনক নামক ভাইটিকে দেখে সিলিভিয়া তৎক্ষনাৎ ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সায়মনের দৃষ্টি তখনো তেহভীনের উপর নিবদ্ধ। আরেকটা বিষয় খেয়াল করলো সায়মন,তার সম্মুখে দাঁড়ানো ছেলেটা কেমন জড়তাহীন,নিঃসংকোচ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার চোখের দিকে।যেনো,তারা পূর্বপরিচিত। সায়মন স্নেহশীল স্পর্শ সিলিভিয়ার মাথা বুলাতে লাগলো। অতঃপর সিলিভিয়া মাথা তুলে সর্বপ্রথম তেহভীনের আঙুল তাক করে বলল,

—- ভাইয়া ও আমার বন্ধু হয়।

সায়মন পূনরায় তেহভীনের দিকে তাকালো।সত্যি বলতে অত্যাধিক সুন্দর,শ্বেতবর্ণ চেহারার পুরুষটির সৌন্দর্য তার দৃষ্টিকে বারেবারে কেঁড়ে নিচ্ছে। মহা ঝামেলা,এই ছেলেটা শুধুই কি সিলিভিয়ার বন্ধু,অন্যকিছু না।মনে মনে নিজের কাছে প্রশ্ন রাখলো সায়মন। তেহভীন, স্পষ্ট ভাষায় সায়মন কে সালাম দিলো।ঘোরের মধ্যে থেকে সালামের জবাব দিলো সায়মন। এরপর মৃদু হাসলো।

—- শুধু বন্ধু?

সায়মনের প্রশ্নে সিলিভিয়ার অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। পাশে রাদিফ থাকার কারণে। রাদিফও উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে সিলিভিয়ার মুখ থেকে শুনার জন্য। সিলিভিয়া তেহভীনের দিকে তাকালো। তেহভীন তখন ঠোঁট চেপে হাসছিলো। তাই সিলিভিয়া দ্রুত সায়মনের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ালো।সায়মন ছোট করে হাসলো,এরপর বলল,

— চল তাড়াতাড়ি বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।

সায়মনকে দেখে রাদিফও বলে উঠলো,

—- ব্রো চলো,মা কে সারপ্রাইজ দেওয়া বাকি আছে।

তেহভীন ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলো,’স্টুপিডকে সে আগেবাগে জানিয়ে রেখেছিলো, বাসায় না জানানোর। তারপরও সে নিজ থেকে ধরে নিলো সারপ্রাইজের বিষয়টা।’

তেহভীন না’বোধক মাথা নেড়ে বলল,

— নো রাডিফ,আমি হোটেলে উঠবো।

— কিহ! হোটেলে? কেন ব্রো?

সিলিভিয়াও প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।সায়মন আর রাদিফের সামনে তেহভীনকে জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি লাগছে। তাই চেয়ে রইলো শুধু। সায়মন সিলিভিয়াকে বলল,

— সিলি,তোর বন্ধুকে আমাদের বাড়িতে আসতে বল হোটেলে উঠবে কেন?

তেহভীন বোধহয় সায়মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলো, তাই সে তৎক্ষনাৎ ফটাফট বলে উঠলো,

— নো থ্যাংক’স ব্রাদার।
আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে।যেটা
আমাকে হোটেলে থেকে করতে হবে। অন্যসময় যাবো।

সায়মন কিছু বললো না আর। রাদিফ বলল,

— ভাইয়া কোন হোটেলে উঠছো তুমি? আর
বুকিং করেছো কিভাবে?

তেহভীন রাদিফের বোকা কথা শুনে দু’আঙুলের সাহায্যে রাদিফের গাল টেনে ধরে বলল,

— রেডিসন ব্লু-তে। ‘বুকিং ডট কম’ থেকে বুক করছি। আর কিছু?

রাদিফ গালে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল,

— অহ, না না আর কিছু না।ব্রো আমিও যাবো তোমার সাথে।আমাকে নিয়ে চলো,প্লিজ?

তেহভীন রাদিফের সাথে আসা গাড়িটিতে উঠে বসলো। সিলিভিয়া বসলো সায়মনের ভাড়া করে আনা গাড়িতে। বসার আগ’পর্যন্ত দু’জনে দুজনের দিকে চেয়ে থাকলো। গাড়িতে বসে সিলিভিয়া শান্ত হতে পারছিলো না।একটা অপূর্ণ ইচ্ছে বাকি রয়ে গিয়েছে।সেটা পূর্ণ না হওয়া অবধি শান্ত হতে পারবে না সে। তুমুল চিন্তার বেগে ফট করে সায়মনকে বলে ফেললো,
— ভাইয়া আমার ফোনটা তেহভীনের কাছে রয়ে গিয়েছে।আমি একটু গিয়ে নিয়ে আসি?

সায়মন ভ্রুঁ কুঁচকালো,এরপর বলল,

— তোর ফোন তো তোর হাতেই আছে।

সিলিভিয়া পিলে চমকে উঠলো। হাতের দিকে চেয়ে দেখলো ফোনটা তার হাতেই আছে।অথচ এতক্ষণ তার হাত হালকা হয়েছিলো।দেখার পর অনুভব করলো ফোনটা হাতেই। একেবারে অস্থির হয়ে পড়লো সে। এরপর বলল,

— আসলে,ভাইয়া আমাকে টয়লেট ব্যবহার করতে হবে।সেজন্যেই উল্টা-পাল্টা বলে ফেলছি।

বলেই সিলিভিয়া ম্লান হাসলো। সায়মন বুঝলো অবস্থা হয়তো বেগতিক। তাই যেতে দিলো। গাড়ির দরজা খুলে সিলিভিয়াকে নামতে দেখেই,তেহভীন রাদিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— রাডিফ,আ’ম হাংগ্রি,প্লিজ আ্যরেঞ্জ
সাম ফুড ফর মি।

রাদিফকে বলার সাথে সাথে বেড়িয়ে গেলো খাবার আনতে।গাড়ির ড্রাইবার অলরেডি গাড়িতে ছিলোনা।তেহভীন তড়িৎ গতিতে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সিলিভিয়া সেদিকটাই চলে এলো। তেহভীন তখন দু’হাত ভাঁজ করে সিলিভিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো।সিলিভিয়া এগিয়ে এসে তেহভীনের বুক থেকে হাত জোড়া সরিয়ে,নিজেই তেহভীনের বুকের সাথে ল্যাপ্টে গেলো। তেহভীন ছোট করে হাসলো। সিলিভিয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— সিলভার,তুমি খুব দুষ্টু হয়েছো।
তোমার ভাইকে গাড়িতে রেখে এভাবে ছুটে এসেছো।আমি সিউর তোমার ভাইয়া সবটা দেখছেন।

সিলিভিয়া প্রত্যুত্তর করলো না চুপ থাকলো অনেকটা সময়। তেহভীনের শরীর থেকে ভেসে আসা সুভাষ নাসারন্ধ্র দিয়ে আবেশে প্রবেশ করতে লাগলো তার। তেহভীন মৃদু আওয়াজে বলে উঠলো,

— নেক্সট প্ল্যান কি সিলভার?

— ম্যাসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দিবো।

সিলিভিয়া তেহভীনকে ছাড়লো আরো কিছু সময় পর। মাথা তুলতেই দেখলো তেহভীনের শার্টটা বুকের দিকে কুঁচকে গেছে। সিলিভিয়া হেসে উঠলো। তেহভীন নিজের দিকে চেয়ে কিছু বললো না। শুধু সিলিভিয়ার হাসিটুকু উপভোগ করলো। না-জানি হাসিটা কতদিন দেখা হবে না আবার। সিলিভিয়া তেহভীনের বুকে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল,

— তুমি তো কুঁচকানো কাপড় পড়তে পছন্দ করো না। দেখো আমি কি করেছি। চেঞ্জ করে ফেলতে পারো?

বলেই সিলিভিয়া চলে আসতে লাগলো,তেহভীন কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,

— শার্টটা তোমার জন্য রেখে দেবো সিলভার। যদি কখনো তোমার প্রয়োজন হয়?

সিলিভিয়া জবাব দিলো না। তার টয়লেট করা শেষ। যদিও এতোটা সময় লাগার কথা না।তারপরও মুখর ভাবভঙ্গি এমন করলো যেনো সে মাত্র টয়লেট থেকে ফিরেছে।কিন্তু বোকা সিলভার জানেই-না সায়মন তাদের একসাথে আগেই দেখে ফেলেছে। তেহভীনের কাছ থেকে একটু শীতল স্পর্শ পেতে বোকামি করে পাগলের মতো ছুটে এসেছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here