অনুভূতিতে তুমি পর্ব-১০

0
3137

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১০

মেহেরিন খাবার টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে দ্রুত উঠে আসে নির্ঝরদের বাসার পিছনের দিকে। খানিকক্ষণ’র জন্য মনে হচ্ছিল তার দম যেন আটকে যাচ্ছিল। বাইরে এসে বুকভরে শ্বাস নিল সে। মাথা তুলে উপরের আকাশের দিলো। রাতের আকাশ টা ভারী সুন্দর লাগছে আজ। এখনো মনে পড়ে তার দুই বোন রাতে চুরি করে ছাদে উঠে আসতো শুধু আকাশ দেখবার জন্য। আজকের আকাশ টাও সেদিনের মতো সুন্দর। অতীতের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠলো মেহেরিন চোখের সামনে।

ছোট বেলায় রাতের আঁধারে ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আইসক্রিম খেতে ভালোবাসতো দুই বোন। বাবা ঘুমিয়ে পড়লে দু’জনে মিলে লুকিয়ে চলে আসতো ছাদে। রাত যত গভীর হতো ততোক্ষণ’ই দুই বোন বসে থাকতো। ঘুম না আসা অবদি উঠতে চাইতো না তারা। রাতের আকাশের তারা গুনতো বসে বসে। মাঝে মাঝেই এলোমেলো হয়ে যেত। আবারো নতুন করে গুনতে থাকতো। একদিন মেহেরিন ছাদে এসে দেখে নিরু দি নেই। মেহেরিন’র বড় বোনের নাম ছিল নিরুপমা! মেহেরিন ছোট করে ডাকতো নিরু দি। নিরু মেহেরিন কে আইসক্রিম আনতে পাঠিয়ে একা একা ছাদে চলে আসে। মেহেরিন’র বয়স তখন ১০ বছর আর নিরুর ১৫।

মেহেরিন আইসক্রিম নিয়ে ছাদে এসে দেখে নিরু নেই। এই অন্ধকারে একা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে ছোট মেহেরিন’র বেশ ভয় লাগছিল। মেহেরিন ভয়ে ভয়ে সামনে আগাল আর বলল,

“নিরু দি! নিরু দি!

কিন্তু আশপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলো না। বাতাস তখনই জোরে বয়ে গেল। বাতাসের জোরে গাছগুলো পাতায় শো শো আওয়াজ হতে লাগল।এই আওয়াজে ছোট মেহেরিন বেশ ভয় পেল। সে ঢোক গিলে বলল,

“কে কে?

কিন্তু কেউই কথা বলল না। মেহেরিন আবারো বলল,

“নিরু দি তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ নাহ। আমি জানি। আমি কিন্তু ভয় পাবো না বলে দিলাম।

বলেই উওরের আশা করল কিন্তু উওর পেলো না। আবারো শো শো আওয়াজে কেঁপে উঠলো মেহেরিন। তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সে এক পা এক পা করে পিছনে যেতে লাগল। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেল। মেহেরিন ভাবল নিরু। পিছনে ফিরে তাকাতেই মেহেরিন ভয়ে আঁতকে উঠল। সে জোরে চিৎকার দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তার সামনে একটা মেয়ে দাঁড়ানো। তার পুরো সামনে চুল দিয়ে মুখ ঢাকা। তার হাতে একটা মোমবাতি! কি ভয়ানক দেখাচ্ছে তাকে। সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে মেহেরিন’র দিকে। তার হাঁটাও যেন আরো ভয়ানক। কেমন করে হেলে দুলে আসছিল সে। মেহেরিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে,

“নিরু দি, নিরু দি এটা তুমি নাহ! আমি জানি এটা তুমি!

সে কিছু না বলে তার দিকেই হেঁটে আসছিল। মেহেরিন এবার জোরে জোরে কেঁদে দিল। তার কান্না দেখে নিরু সামনের চুল গুলো সরিয়ে বলে উঠে,

“মেহের! মেহের এটা আমি!

মেহেরিন কাঁদতে কাঁদতে,
“অ্যা অ্যা তুমি আমাকে আবার ভয় দেখাইছো নিরু দি অ্যা অ্যা।

“মেহের বোন আমার শান্ত হ।

মেহেরিন শান্ত হবার বদলে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। তার কান্নার আওয়াজে শুভ্র খান মানে মেহেরিন’র বাবা আর বাকি সব কাজের লোক দৌড়ে চলে এসে। মেহেরিন’র কান্না তবুও থামে না। সে কাঁদতেই থাকে। নিরু দু হাত দিয়ে জরিয়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। খুব মনে পড়ছে আজ সেসব কথা। ইচ্ছে করছে খুব একটু যদি জরিয়ে ধরে বসে থাকতো নিরু দি। নিরু দি যখন ছিল তার জীবনটাও খুব সহজ ছিল। সবকিছু ছিল, কোনোকিছুর অভাব ছিল না। নিরু দি চলে যেতেই এক এক করে তার প্রিয় মানুষ গুলো তাকে ছেড়ে চলে গেল। খুব মনে পড়ছে আজ নিরু দি তোমায়। কেন চলে গেলে তুমি আমায় ছেড়ে।

“মেহু! মেহু!

মেহেরিন‌ অতীত থেকে বেরিয়ে এলো। তার পিছনেই নির্ঝর দাঁড়ানো। মেহেরিন চোখের অশ্রু মুছে সামনে ঘুরে বলে,

“হুম!

নির্ঝর একটু এগিয়ে,
“ঠিক আছো তুমি!

“আমার আবার কি হবে?

“না এভাবে উঠে এলে যে,‌শরীর ঠিক আছে তোমার।

“হুম ঠিক আছি, শুধু একটু দম বন্ধ হয়ে আসছিল তাই…

“এখন কি তবে ঠিক আছো?

“বেশ আছি!
বলেই মেহেরিন হেসে দিলো। অন্ধকারের মাঝে ক্ষুদ্র আলোর রশ্মি দিয়ে মেহেরিন’র হাসি মাথা মুখটা দেখতে পেল নির্ঝর! মেহেরিন এবার নির্ঝরের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিল। নির্ঝর তখনই বলে উঠে,

“অর্ণব তাহলে তোমার ছেলে না!

মেহেরিন দাঁড়িয়ে গেল। উষ্ণ গলায় বলে উঠে,

“অর্ণব আমার ছেলে নির্ঝর!

“তোমার বোনের ছেলে হলেও আমার কোন সমস্যা নেই কিন্তু তুমি মিথ্যে কেন বলছো?

মেহেরিন নির্ঝরের দিকে ফিরে বলে উঠে,

“অর্ণব মেহেরিন বর্ষা খান’র ছেলে। এটাই তার একমাত্র পরিচয়।

“সেই পরিচয় তুমি টাকার জোরে বানাতেই পারো।

মেহেরিন কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,

“তুমি এতো উত্তেজিত কেন হচ্ছো মেহেরিন! কেউ তো তোমার থেকে অর্ণব কে কেড়ে নিচ্ছে না।

“অর্ণবকে কেড়ে নিবে, কে নিবে? কেন নিবে?

নির্ঝর বুঝতে পারছে মেহেরিন এখন একদম’ই সেই অবস্থায় নেই যাতে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা যায়। নির্ঝর আর জোর করল না। বলে উঠে,

“কেউ না এভাবেই বলছি। চলো খেতে যাবে চলো।

নির্ঝরের কথায় মেহেরিন শান্ত হলো। সে শীতল গলায় বলে উঠে,
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমি এখন চলে যাবো।

“কিন্তু মেহু…

মেহেরিন এবারও পুরো কথা শুনল না। হন হন করে হেঁটে চল গেল। অর্ণব কে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেল। নীলিমা আর রিদুয়ান চৌধুরী মেহেরিন’র অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে দুইজনেই দাঁড়িয়ে গেল। মেহেরিন তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“রাতের খাবারের জন্য ধন্যবাদ! আমরা আজ আসছি। অনেক রাত হয়ে গেছে।

বলেই বের হয়ে গেল সেখান থেকে। নীলিমা কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করল না। কিছুটা হতাশা কাজ করল তার মাঝে!
.
নির্ঝর হন হন করে হেঁটে তার ড্যাডি’র ঘরে বসল। রিদুয়ান চৌধুরী একবার নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। নির্ঝর খানিকক্ষণ বসে থাকার পরেও ড্যাডির মনোযোগ না পাওয়ায় হালকা কাশল। কিন্ত তাও কিছু হলো না। সে উঠে এবার পায়চারি করতে লাগলো। তার মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে। সবটা জানা চাই তার। কি হয়েছিল মেহেরিন’র বোনের সাথে, কেন’ই বা সে আ/ত্ম/হ/ত্যা হলো।

রুমে তখন প্রবেশ ঘটল নীলিমা’র। নির্ঝর কে এভাবে পায়চারি করতে দেখে নীলিমা বলে উঠে,

“কি হয়েছে তোর?

“আমার কি হবে? হয়েছে তো তোমাদের। নিজের ছেলে থেকে এতো বড় সত্যিটা কিভাবে লুকিয়ে রাখলে তোমরা দুজন?

“কি সত্যি?

“আবার জিজ্ঞেস করছো? অর্ণব যে মেহেরিন’র ছেলে না এই কথাটা কি একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করো নি আমায়?

“অর্ণব কে তো তুই ভালোবাসিস আদরও করিস এরপর আবার কি? এই কথা না জানলে কি হতো?

“ড্যাড তুমি কি এবার কিছু বলবে?

রিদুয়ান ফাইলের থেকে চোখ সরিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বল,
“কি বলবো?

নির্ঝর এসে রিদুয়ানের কাছে বসে বলে,
“সবটা বলো। আমার সবটা জানা চাই।

“কি জানতে চাস তুই?

“এটাই যে মেহেরিন বড় বোন কে? অর্ণব কার ছেলে? কেন’ই বা তার বোন আ/ত্ন/হ/ত্যা করল।

“আমি সবটা জানি না?

“যতটুকু জানো ততোটুকুই বলো!

রিদুয়ান চৌধুরী ফাইল বন্ধ করে ছেলের দিকে ঘুরলেন। নীলিমা সোফায় বসে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে রিদুয়ান চৌধুরী’র দিকে। এখানে নির্ঝরের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। রিদুয়ান চৌধুরী বলে উঠেন,

“মেহেরিন’র জন্মের সময় তার মা মারা যায়। শুভ্র খান’র তখন বড় মেয়ে নিরুপমা’র তখন বয়স ৫ বছর। শুভ্র খান এই দুই মেয়ের দায়িত্ব নিজেই নিলেন। দ্বিতীয় বিয়ে করলেন না দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে। খুব আদরে মানুষ করলেন তাদের। নিরুপমা ছিল একদম শান্তশিষ্ট মেয়ে। অনেকটা সহজ সরল ছিল সে। একদম শুভ্র খান’র মতো। আর মেহেরিন ছিল বেশ চঞ্চল। তার বাবার ধারনা ছিল মেহেরিন পুরোপুরি অধরার মতো হয়েছে। অধরা হলো মেহেরিন’র মা। মা’র সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম এই মেয়ের!

দুই মেয়েকে খুব ভালো করেই বড় করেছিলেন শুভ্র খান। নিরুপমা পরিণত বয়সেই বিয়ে করল। ছেলে তার নিজ পছন্দ ছিল। শুভ্র খান বরাবরই মেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। তাই আর না করেন নি। যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল তার সাথেই বিয়ে দেন। বিয়ের কয়েকবছর বছর বেশ ভালো ভাবেই পার হলেও তার কয়েকদিন পরেই ঘটল আরেক ঘটনা। সেই ছেলের সাথে অন্য মেয়ের সম্পর্ক আছে জানা গেল। নিরুপমা তখন ৫ মাসের প্রেগন্যান্ট! নিরুপমা এই অবস্থায় পুরো ভেঙ্গে যায়। মেহেরিন আর শুভ্র খান দুজনেই মানসিক ভাবে সুস্থ রাখার চেষ্টা করে।

নিরুপমা ঠিক করে নেয় সে তার স্বামী কে ডিভোর্স দেবে।‌এর মাঝেই তার স্বামী এসে ক্ষমা চায় তার কাছে। নিরুপমা শারীরিক আর মানসিক ভাবে বেশ দুর্বল থাকে। তাই এতো চিন্তা ভাবনা না করে মেনে নেয় স্বামী কে। অতঃপর চলে আসে স্বামীর সাথে স্বামীর বাসায়। সবাই ভেবে নেয় সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।

কয়েক মাস পরেই জন্ম হয় অর্ণবের। অর্ণব মানসিক ভাবে যে দুর্বল হবে ডাক্তার তখন’ই জানিয়ে দেয়। তবুও নিরুপমা আর তার স্বামী মিলে অর্ণব কে সুস্থ করার প্রস্তুতি নেয়। নিরুপমা’র মনে হয় তার স্বামী হয়তো ভালো হয়ে গেছে। একজন আদর্শ বাবা আর স্বামী হবার দায়িত্ব পালন করছে সে। অতঃপর…

নির্ঝর বলে উঠে,
“তারপর..

রিদুয়ান বলে উঠে,
“তারপর হঠাৎ একদিন মেহেরিন নিরুপমা’র বাসায় গিয়ে দেখল নিরুপমা ফ্যানের সাথে ঝুলছে আর নিচে বসে অর্ণব হামাগুড়ি খাচ্ছে।

“নিরুপমা আ/ত্ন/হ/ত্যা কেন করেছিল?

“তা জানি না তবে মনে হয় এমন কিছুই হয়েছিল যার কারনে সে এমন কিছু করার চেষ্টা করেছিল। পুলিশ তদন্ত করেছিল এই নিয়ে। মেহেরিন নিরুপমার স্বামীকে এসবের জন্য দায়ী করলেও যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় স্বামী ছাড়া পেয়ে যায়। এর কিছুমাস পরেই শুভ্র খান হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। এরপর মেহেরিন’র জন্য অর্ণব’ই রয়ে যায়। বোনের শেষ চিহ্ন হিসেবে আগলে রাখে তাকে। নিজের ছেলে হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় তাকে।

এতটুকু বলেই থামে রিদুয়ান। নির্ঝর উঠে দাঁড়ায়। চলে আসে সেখান থেকে। নিজের রুমে এসে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়। হুট করেই কানে বেজে উঠে মেহেরিন’র বলা কথাগুলো। মেহেরিন বলেছিল,

“”আমি সেই দলের লোক যাদের শুধু একটি মাত্র আকাঙ্ক্ষা থাকে। থাকে একটাই অবলম্বন! একজন কে নিয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখে সে। আমার সেই একজন হলো অর্ণব। আমার বেঁচে থাকার একটিমাত্র আশা।”

চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নির্ঝর। পকেটে হাত দিতেই একটা কাগজ পেল। বের করে দেখে এটাতে সেই ঝগড়ার পয়েন্ট গুলোই লেখা। কথাগুলো মোটেও মেহেরিন’র জন্য না। নির্ঝরের নিজের উপরই রাগ হতে লাগালো। যদি এসব কথা সে মেহেরিন কে বলতো তাহলে কি হতো! হয়তো অনেকটা কষ্ট পেয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকতো। নির্ঝর কাগজ টা ছিঁড়ে ফেলো দিলো যাতে তার রাগ টা একটু হলেও কমে।
.
অর্ণব কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার কপালে চুমু খেলো মেহেরিন। ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। স্টোররুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দু হাত দ্বারা দরজাটা খুলল। পুরো রুম অন্ধকার! মেহেরিন আলো জ্বালাল। সবার প্রথমেই একটা ছবিতে চোখ পড়ল তার। ছবিতে তার বাবা সোফায় বসে আছে। পিছনে মেহেরিন তার গলা জরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর নিচে নিরু দি বসা আছে। ছবিটার দিকে আগাতে লাগলো মেহেরিন। যত’ই সামনে আসছে ততোই দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। একবার মনে হলো তার পা যেন জমে যাচ্ছে।

মেহেরিন কাঁপা কাঁপা হাতে ছবিটায় হাত রাখল। ছুঁয়ে দেখল নিরু কে! চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু কণা। মেহেরিন’র গলা ভারী হয়ে যাচ্ছিল। তবুও সে বলে উঠলো,

“আমি পারি নি দি! আমি পারি নি। তোকে বাঁচাতে আমি পারি নি। সেদিনের ফোনটা আমার ধরা উচিত ছিল। সেদিন তোর ফোন ধরলে আজ হয়তো তুই বেঁচে থাকতি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতি। বাবা থাকতো আমাদের সাথে। আমরা সবাই থাকতাম একসাথে। কেন রেখে গেলি আমাকে এখানে, একা রেখে গেলি তো। নিয়ে যেতে তো পারতি। তুই আবারো আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। আর এবার একা না বাপি কেও নিয়ে গেলি। কেন দি কেন? কেন তোরা সবাই আমাকে একা ফেলে রেখে চলে যাস। জানিস তো আমি থাকতে পারি না তোদের ছাড়া। একাকিত্ব সহ্য হয় না আমার। আমি পারবো না দি একা থাকতে পারবো না। তোর মেহের এখনো একা থাকতে ভয় পায়। এখনো মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে তোর মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তোকে জ্বালাতে। খুব ইচ্ছে করে দি খুব। তুই যাবার পর সবাই ছেড়ে চলে গেছে আমাকে সবাই।

কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে মেহেরিন। খুব কাঁদছে সে। এখনো মনে পড়ে তার সেদিনের রাতের কথা। বৈশাখ মাস! রাতে বেশ জোরেই বৃষ্টি হচ্ছিল। তার সাথে দমকা বাতাস। নেটওয়ার্ক পাওয়াও বেশ মুসকিল। মেহেরিন গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল কিন্তু বাসায় আসার সময়’ই বিপত্তি ঘটল। মাঝরাস্তায় গাড়িটা হুট করেই বন্ধ হয়ে গেল। মেহেরিন ফোন গাড়িতে রেখে ছাতা নিয়ে বের হলো। গাড়িটা তেমন কিছু হয় নি। কিছু খুঁটিনাটি করার পর’ই মেহেরিন আবারো গাড়িতে এসে বসল। গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি চলতে শুরু করল। পাশে তাকিয়ে দেখে ফোনের আলো জ্বালানো। মেহেরিন তাকিয়ে দেখে নিরুর অনেক মিসকল। ফোনটা উঠিয়ে সে কল দিতে লাগল। প্রথম প্রথম নেটওয়ার্ক প্রবলেম এর কারনে কল যেত না। অতঃপর কল গেলেও ফোন কেউ ধরল না। মেহেরিন’র চিন্তা হতে লাগালো। ইদানিং নিরু কে অনেকটা অস্বাভাবিক লাগে তার কাছে। জিজু নিয়ে যাবার পর পরই অনেকটা বদল এসেছে। মেহেরিন নিয়মিত ফোন করে কিন্তু নিরু কিছুই বলে না। অনেকটা অচেনা লাগে এই নিরু কে। আর এখন যে কল করল মেহেরিন ধরতেই পারল না। মেহেরিন ঠিক করল নিরুর বাড়িতে যাবে। একটু দেখে আসবে তাকে।‌

নিরুর বাড়িতে এসে কলিং বাজালো অনেকক্ষণ ধরে কিন্তু কেউই দরজা খুলছে না। মেহেরিন নিরু কে রীতিমতো ফোন করেই যাচ্ছে। ফোন ও কেউ ধরছে না।‌রেগে দরজা ধাক্কানোর কথা ভেবে দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল।‌ মেহেরিন অনেকটা অবাক হলো। আর বেশি অবাক হলো এটা ভেবে যে ঘরটা বেশ অন্ধকার। মেহেরিন ফোনের আলো জ্বালিয়ে প্রবেশ করল ঘরে। নিরুর রুমের দিকে যেতেই দেখল সেখানে আলো জ্বলছে। মেহেরিন ফোনের আলো বন্ধ করে নিরুর ঘরের দিকে আগাল। বাইরে বৃষ্টি এখনো পড়ছে। কিছু কিছু সময় পড় বাজও পড়ছে। কি ভয়ানক সেই বাজ পরার আওয়াজ। বিদ্যুৎ চমকানি তে পুরো অন্ধকার ঘর কেমন আলোকিত হয়। মেহেরিন’র মনে হয় কোন ভুতের বাড়িতে আছে সে।

মেহেরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরুর ঘরের দিকে আগায়। দরজার সামনে তাকিয়ে দেখে অর্ণব হামাগুড়ি দিয়ে তার পায়ের কাছেই আসছে। মেহেরিন অর্ণব কে দেখে হেসে তাকে কোলে তুলে। অর্ণবের বয়সের বাচ্চারা এখন টুকটাক হলেও কথা বলার চেষ্টা করে অর্ণব তাও করে না। মেহেরিন অর্ণব কে কোলে তুলে সামনে তাকিয়ে বলল,

“আমার অর্ণ সোনা! দেখলি দি অর্ণব আমাকে চিনে…..

আর কথা বের হলো না তার মুখ দিয়ে। নিরু ঝুলে আছে ফ্যানের সাথে। তার চোখ দুটি বড় বড় করে চেয়ে আছে তার দিকে। নিরুর মুখে একটা বিশেষ মায়া ছিল। মেহেরিন সবসময় দেখতে পেতো সেই মায়া। মনে হতো এটা কোন মায়ের চাহনি। কিন্তু এই প্রথমবার নিরু কে দেখে ভয়ে পিছিয়ে গেল মেহেরিন। হুট করেই মেঝেতে পড়ে গেল সে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না তার। অনেক চেষ্টা করে জোরে চিৎকার করে বলল,

“নিরু দি!

সাথে সাথেই বিদ্যুৎ চমকালো।
.
হুট করেই চোখ মেলল মেহেরিন। কেউ তাকে নরম স্বরে ডাকছে। মেহেরিন সামনে তাকাল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব ঝাপসা। চোখ ঢলে সামনে তাকাল সে। কানে এসে বাজল একটা শব্দ!

“মেহের!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here